হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৫

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৫
রাউফুন

তুলিকা নীতির দেওয়া সুন্দর একটা চুরিদার পরেছে এই মুহুর্তে। যদিও সেটা অনেক লুস তার শরীরে ফীট করেনি। কিন্তু জামার সঙ্গে ফিতা থাকায় কোমড়ে বেঁধে রেখেছে এতে জামাটা তার শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। রাতে তো আর শাড়ী পরে ঘুমানো সম্ভব ছিলো না তার। সে ভোর বেলায় রান্না ঘরে নীতির সাথে কাজে সাহায্য করছে।

এতো জনের সকালের নাস্তা করা তো চারটি খানি কথা না। নীতি একা পারতোও না। তার কষ্ট হবে ভেবেই হাত লাগাই তুলিকা। আশফিও ভোর ছয়টাই রুম থেকে বেরোলো। মিষ্টি রঙের শাড়ি পরেছে আশফি। তাকে যেনো একেবারে সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো দেখাচ্ছে। তুলিকা আশফিকে দেখে এগিয়ে এলো। তার ভেজা চুল কানে গুজে দিয়ে মুচকি হেসে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘কোনো এক উপন্যাসে পড়েছিলাম,স্বামীর স্পর্শে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। আজ দেখেও নিলাম।’
‘তুলি তুই কিন্তু বড্ড পেকেছিস! সব সময় বেশি বেশি বলিস!’ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো আশফি।
‘ইশ লজ্জা দিও না তো আমার ছোট জাকে। তুলিকা, বিয়ে তো তোমারও হবে তখন কিন্তু আশফি ছাড়বে না তোমাকে! সময় হলে সব ফিরিয়ে দেবে।’

‘আমি বিয়েই করবো না।’ মেকি হেসে বললো তুলিকা।
‘সেকি! এটা কেমন কথা গো! বিয়ে করবে না মানে আবার কি?’
‘আমি বিয়ে করলে মিষ্টির কি হবে? আমার তো আর বাবা-মা নেই ভাবি! আমার ছোট্ট মিষ্টির কি হবে? আমার যিনি স্বামী হবেন সে যদি মিষ্টির দায়িত্ব না নিতে চাই?’

নীতির মন খারাপ হয়ে গেলো এটা শুনে। সে কিছু বলবে তখনই মাইজিন এলো। তুলিকাও দেখলো মাইজিনের দিকে। তার এলোমেলো চুলে তাকে আরও সুদর্শন লাগছে। তুলিকা এক ঝলক দেখতেই তার হ্রদস্পন্দনে ধুকপুকানির তাল পেলো। তার হৃদয়ে যেনো কেউ দামামা বাজাচ্ছে। সে তার শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো মাইজিনের থেকে। কি অদ্ভুত এই মানুষ টাকে দেখলেই তার এমন লাগে কেন? আর সে কেমন খাপছাড়া গোছের হয়ে যায়।

‘মাইজিন তোমার ভাই কই? চা দিবো না কফি দিবো তোমাকে?’
‘আর চা -কফি। বড় ভাবি সত্যি করে একটা কথা বলুন তো?’
‘কি কথা? তোমাকে এমন লাগছে কেন?’
‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে ভাবি! আগে বলুন তো আপনাদের বিয়ের পর কখনোই সাইমুম ভাই আর আপনি আলাদা ঘুমিয়েছেন?’

‘নাহ! কিন্তু আমাদের বাড়ি গিয়ে একদিন থেকেছিলাম আলাদা!’লজ্জা পেয়ে বললো নীতি।
‘ভাবি আপনি লজ্জা পাচ্ছেন আর আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
‘আরে কি হয়েছে বলবেন তো মাইজিন ভাই?’ শুধাই আশফি!
‘ছোট ভাবি জানেন এখন আমার হাত পা ছড়িয়ে কাঁন্না করতে মন চাইছে!’
‘ভনিতা না করে বলো কি হইছে!’
‘বড় ভাবি গো আপনার সোয়ামি যে আমার ইজ্জত লুটলো! আমার বিয়ের আগেই আমার বউয়ের হক মে’রে দিলো!’
বেকুবের মতো তুলিকা আর আশফি চোখ বড় বড় করে , বড় ভাবি এরপর মাইজিনের দিকে তাকালো। নীতি মাথায় হাত দিয়ে বললো,

‘কি বলছো এসব! ইজ্জত লুটলো মানে?’
‘লজ্জার কথা কি আর বলবো। সক্কাল সক্কাল ঘুম টাই হারাম করে দিসে।’
‘আহা ভাই এবার বলে ফেলো। এখানে লজ্জার কথা আসছে কেন?’
‘আপনার আদরের স্বামী আমারে আপনাকে ভেবে, জড়াই ধরছে, চুম্মা চাট্টি দিছে ইয়াক!’
আশফি আর তুলিকা বড় ভাবিকে লজ্জা দিতে ঠোঁট চেপে হেসে আলতো গুতা দিলো কনুই দিয়ে। তখনই সাইমুম কোথা থেকে যেনো ছুটে এলো। মাইজিন তাকে দেখেই ছুটলো।
‘দাঁড়া মাইজিন। তোকে কত করে বললাম কাউকে কিছু বলিস না। যা চাস তাই দিবো শুনলি না। দিলি তো আমার সম্মানের ফালুদা বানিয়ে।’

‘আর তুমি? তুমি কি করেছো ভাইয়া? ছিঃ ছিঃ!’ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বললো মাইজিন। মাইজিনকে ধরতে চেষ্টা করছে সাইমুম। তিন অবলা নারী তাদের এই অবস্থা দেখে পেট ফাঁটা হাসি হাসছে। এতো সব শব্দের উৎস পেয়ে নীরব আসলো। হাই তুলতে তুলতে বললো,
‘কি হয়েছে এখানে? আরে মাইজিন, বড় ভাইয়া তোমরা এভাবে ছুটাছুটি করছো কেন? সকাল সকাল হলো টা কি!’
‘নীরব ভাইয়া আর বলো না। যা হওয়ার তা তো আমার সঙ্গেই হইছে।’

‘এই মাইজিন তুই এমন মেয়েদের মতো ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদিস কেন?’
‘আমার সঙ্গে যা হইছে তা যদি তোমার সঙ্গে হতো তুমিও কাঁন্না করতে ভাইয়া!’
‘বড় ভাবি, ছোট ভাবি আমাকে বাঁচান। সাইমুম ভাইয়া আমাকে মে’রে’ই দিবে।’
সাইমুমের তাড়া খেয়ে মাইজিন রান্না ঘরে গিয়ে প্রথমে বড় ভাবির আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। সাইমুম সেখানে যেতেই মাইজিন বড় ভাবিকে ছেড়ে দিয়ে তুলিকার দুই কাধ ধরে তার আড়ালে লুকিয়ে পরে৷ আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠে তুলিকা। কিন্তু যিনি স্পর্শ করেছেন তার সেদিকে খেয়াল নেই। কিন্তু সে তো এমন স্পর্শে পরিচিত নয়। তার পেট থেকে শুরু করে সারা শরীরের কম্পন তুলেছে এই হঠাৎ স্পর্শ!

‘আরে সাইমুম থামো। তোমার কি আক্কেল জ্ঞান নাই? এখানে ছোট ভাইয়ের বউ আছে চোখে দেখো না? চার বছর বিয়ে হয়েছে বউ আর ভাইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারো না।’ হাসি থামাতে থামাতে বলে নীতি।
সব পাড়াপাড়ি হুরোহুরি থেমে গেলো। মাইজিন রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সোফায় বসলো। নীরব এতক্ষণ সবটা বুঝতে পেরে বললো,

‘এটা কিন্তু ঠিক না ভাইয়া। তুমি ভাবিকে চিনতে ভুল করো কিভাবে? আমি তো এমন ভুল জীবনেও করবো না।’
‘হ্যাঁ করেন নাই তো! শুধু আমার জায়গায় আমার বেস্টু বসেছিলো তাই তো আমার আর বেস্টুর মধ্যে পার্থক্য টা বুঝতে পারেননি। এই নাকি প্রথম দেখাই প্রেমে পরেছিলেন। এখন সব দোষ ভাইয়ার তাই না?’ কপট অভিমানী গলায় বলে আশফি। নীরব চুপসে গেলো আশফির অভিযোগ শুনে।
মাইজিন আর সাইমুম হেসে ফেলে এতে।
‘হ্যাঁ খুব আমাকে ফাসাতে আসছিলি। নে এখন সামলা ঠ্যালা।’
‘এহ বললেই হলো আমি তো বুঝতে পারছিলাম। আর তুমি তো আমার চেয়েও বড় আকাম করছো তার বেলাই কিছু না তাই না?’

এর মধ্যে তুলিকা হলো নিরব দর্শক। কারণ সে মাইজিনের হঠাৎ স্পর্শ ভুলতে পারছে না। হুট করেই সেখানে মিষ্টির আগমন হলো। সে গলা খাকারি দিয়ে প্রতিটি মানুষকে অবলোকন করলো।এরপরে বললো,
‘তোমরা সক্কলে কি নিয়া হাসতাছো? আমারেও কও দেহি!’
সবাই মিষ্টির কথা শুনে তার দিকে তাকাই৷ বারো কি তেরো বছরের মেয়েটির কথা শুনে সমস্বরে হেসে বলে, ‘কওন যাইবো না আফামনি। ইহা বড়দের মামলা।’

আবারও সমস্বরে হেসে উঠলো! আর মিষ্টি গাল ফুলালো। মাইজিন হাসতে হাসতে তুলিকার দিকে চোখ পরলো। মেয়েটা গুটিয়ে আছে কেমন যেনো। মুখটা মলিন কেন? সে কি হাসেনি? মাইজিনের তখনকার কথা মনে পরলো। সে কি হুট করেই তুলিকাকে স্পর্শ করে ফেলেছিলো? এতো সবকিছুর মধ্যে সে ভুলেই গেছিলো বিষয়টা। তার স্পর্শটা কি মেয়েটার খারাপ লেগেছিলো? না হলে মুখ ওমন মলিন কেন হবে? শিট! নিজের উপরেই নিজে ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো সে! এমনটা সে কি করে করতে পারলো?

ভাগ্যিস অনেক রাতে ঘুমিয়েছে সব মেহমান। কড়া ঘুম হয়েছে এতে সবার। ঘুম ভাঙবেও দেরিতে। তা না হলে তাদের এতো সব হই হুল্লোড়ে ভরা বাড়ির মানুষ সব জেগে যেতো।
রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আশফির বাবা-মা আত্মীয় স্বজনরা সবাই এসেছেন। রিসেপশনের অনুষ্ঠান শেষ হতেই আশফি, নীরব, মাইজিন, সবাই আশফিদের বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দিলো। তুলিকা, মিষ্টি তো আছেই। নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পর দিনই নতুন দম্পতিদের পদচারণ হয় মেয়ের বাবার বাড়িতে।

রাস্তায় অনেক মজা করলো তারা সকলে। মাইজিনের খালা, মাইজিনের মা, শারমিন তারা সবাই তাদের বাড়ি চলে গেছেন। মাইজিনকে আশফি যেতে দেইনি তার সঙ্গে আনবে বলে। বড় ভাইয়া, ভাবিকে আসতে বলেছিলো কিন্তু তারা আসবেন না আশফির শশুর মশাই একলা হয়ে যাবেন বলে। তারা যখন বাসায় পৌঁছায় তখন সন্ধ্যা! সূর্য ডুবু ডুবু হয়ে রক্তিমাভা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে এবং ধরণীতে।সূর্যের লালচে-ধূসর আলো তুলিকার মুখে পরাই ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছিলো তাকে। তার মাথায় থাকা ওড়না মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে। মাইজিনের নজর পরেছে তার এমন রূপে।সে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। গাড়ি থামতেই সকলে নেমে আসে। মাইজিন তুলিকার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় বলে,

‘নারীদের উপর পুরুষের একটা প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয় কোনো কারণ ছাড়াই! পৃথিবীর পঞ্চাশ পার্সেন্ট পুরুষের বিপর্যয়ের কারণ নাকি নারী। কিন্তু তারপরও কি আমরা এই নারী ছাড়া থাকতে পারি? নাহ! আমিও বোধহয় ব্যতিক্রম নয় তুলিকা!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৪

তুলিকা হা করে তাকিয়ে রইলো মাইজিনের যাওয়ার পানে।লোকটা কি বোঝালো এই কথার দ্বারা?

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৬