হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৮

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৮
রাউফুন

আপাতত রুমে কোনো আসবাবপত্রই নেই। রাতটা কিভাবে কা’টা’বে সেটাই ভাবছে মাইজিন। এখন রাত এগারোটা বাজে। পে’টে কিছুই পরেনি কারোরই। মাইজিন তুলিকাকে অনেক্ষন থেকেই পরখ করে চলেছে। মেয়েটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে কেমন পাংশুটে হয়ে গেছে। মাইজিন তুলিকার একটু কাছে আসতেই চট করে সরে দাঁড়ালো।
‘উম এতোটা অশান্ত কেন হচ্ছেন আপনি? এতো বিচলিত হবেন না প্লিজ! আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আপনি মিষ্টির খেয়াল রাখবেন। তারাতাড়ি ফিরবো!’

তুলিকা আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই। মাইজিন যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। এই মুহুর্তে সে খুব করে চাইছিলো একা থাকতে। অস্বস্তি হচ্ছিলো মাইজিনের উপস্থিতিতে। তাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে কি এতো সহজেই সবটা ঠিক হবে? সব কিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। মাইজিন তো তখন বলেছে তার অনুমতি ব্যাতিত স্পর্শ করবে না। তবুও এখন সে তার বিবাহিত স্ত্রী৷ সম্পুর্ন অধিকার আছে মাইজিনের তার উপর! যদি বিয়ের আগের দেওয়া কথা ভুলে যায়। পুরুষ মানুষ তো, বলা যায় না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এর মধ্যে তুলিকা আর মিষ্টি মিলে পুরো রুম গুলো সুন্দর করে মুছে ফেলেছে। তিনটা রুম, দুটো বেড রুম, মাঝখানে ড্রয়িংরুম আর রান্না ঘর রয়েছে। দুটো রুমেই আলাদা আলাদা ওয়াশরুম আছে। রান্না ঘর সহ তিনটা রুম পরিষ্কার করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। একটু জিরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলো তারা দুই বোন। অন্যদিন হলে হইতো মিষ্টি জেগে থাকতো না। কিন্তু আজকের নির্মম ঘটনা মন সাপটে গেঁথে রয়েছে তার মনে।

আজকের ঘটনা কিছুতেই ভুলে উঠতে পারছে না দুজনের কেউ-ই। দু চোখের ঘুম কে’রে’ছে এই অগ্নি’কাণ্ড! রাত এক টা বেজে গেছে এখনো মাইজিন আসছে না ভেবে চিন্তা হচ্ছে তুলিকার। সে কি আর ফিরবে না? এখনো কেন আসছে না? বললো তো তারাতাড়ি ফিরবে? তাহলে এতো দেরি কেন হচ্ছে? দুই বোন ভয়ে গুটিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। ভয় করছে এই মুহুর্তে খুব। তার তো একটা ফোনও নেই যে কল করবে। যদি তাদের এখানে একা ফেলে মাইজিন চলে যায় কি হবে তাদের? মনের মধ্যে নানান আজেবাজে চিন্তা ভর করছে তার। দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে তার এসব ভেবেই। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে কেমন যেনো!

মাইজিন যখন ফিরলো তখন রাত দেরটা বেজে গেছে। এতো রাতে কোনো দোকানই তেমন খোলা ছিলো না। আপাতত সে রাতের খাবার কিনে এনেছে। দুটো জাজিম (তোশক), চারটে বালিশ, বিছানার চাদর! আর কিছু হাড়ি-পাতিল! মাইজিনের কাছে আলাদা চাবি ছিলো সেটা দিয়েই ভেতরে এসেছে। তম্বন্ধে মাইজিনকে দেখতে পেয়ে তুলিকার জানে পানি এলো। সে তার মস্তিষ্কের সকল আজেবাজে চিন্তা ফোস করে উড়িয়ে দিলো বাতাসের সঙ্গে! কি না কি ভাবছিলো সে এতক্ষণ!

মাইজিন একটু হাসলো তুলিকার স্বস্তির শ্বাস ফেলা দেখে। সে জিনিস পত্র সব ঘর আনতে আনতে বলল,
‘ভয় পেয়ে গেছিলেন আপনি, আমার আসতে দেরি হচ্ছে বলে? কি ভেবেছিলেন আর আসবো না?’
‘ন-না আসলে এতো রাত হয়ে গেছে আপনি আসছিলেন না তাই চিন্তা হচ্ছিলো একটু!’
‘আসলে বাইরে যাওয়ার পর আমার মনে হলো ঘুমাবো কোথায় আমরা? তারপর এসব টুকটাক জিনিস কিনে ফেললাম। রাতে যা কিছু দরকার হবে সেগুলোই আর কি!’

তুলিকা “ঘুমাবো কোথায় আমরা!’’এই কথাতে আটকে আছে। মাইজিন আমরা বলতে কি তাদের দুজনকে বোঝালো না-কি? সে চুপ থাকলো। মাইজিন কিছু বললো না শুধু মুচকি হাসলো! সব কিছু আনা শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
‘তুলিকা মিষ্টিকে নিয়ে আসুন খেয়ে নেবেন!’

মাইজিন, তুলিকা, মিষ্টি খেয়ে নিলো। আসার সময় গ্লাস, জগ, এক সেট মেলামাইন প্লেটও কিনে এনেছিলো। খেতে খেতে নিমজ্জিত হয়ে তুলিকা মাইজিনকে প্রশ্ন করে,’এএতো কিছু কিনলেন, নিশ্চয়ই অনেক গুলো টাকা লাগলো!’
‘এতো হেজিটেড কেন করছেন? আপনার বরের ধন-সম্পদের অভাব নেই, এটা একদমই সামান্য খরচ! তাছাড়া সংসার টা আপনার। আমার এবং এই সংসারের ব্যাপারে সবকিছু জানার অধিকার আপনার আছে। আজকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস তো কিনতে পারিনি। কালকে সবকিছু পেয়ে যাবেন। আপনি একটা কাজ করবেন তো, আমাকে লিষ্ট করে দেবেন। না মানে আমি এসব ব্যাপারে ভীষণ অপটু!’

‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার থেকেও ভালো জানেন এসব ব্যাপারে। কত কিছু কিনে এনেছেন। এসব তো আমার মাথাতেই আসেনি।’
‘আপনার মাইন্ড এখন ডিস্টার্বড হয়ে আছে তাই এসব মাথায় আসেনি। খাওয়া শেষ করে শুতে আসুন!’
”শুতে আসুন!” কথাটাই আবার আটকে যায় তুলিকা। অদ্ভুত ঠেকছে তার সবকিছু। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তুলিকা বিছানা করলো। দুটো রুমে দুটো জাজিম, চাদর বিছিয়ে বালিশ পেতে ঠিকঠাক করলো।

‘স্যরি তুলিকা। আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। কাল খাট কিনে দেবো। আমাকে ক্ষমা করবেন আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে পারলাম না। ক’ষ্ট পেতে দেবো না বলেও সে কথা রাখতে পারলাম না।’
‘না না কষ্ট কিসের। আপনি এভাবে বলবেন না! এর চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট করেছি আমি আমার জীবনে। আমার কাছে এসব কিছুই না। আপনি এতো ভাববেন না আমাকে নিয়ে।’

‘আচ্ছা আপনি মিষ্টির সঙ্গে শুয়ে পরুন পাশের রুমে। আমি ওই রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরছি!’
মাইজিন শুতে চলে গেলো৷ আর তুলিকা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। কি অকপটে সবকিছু বললো মাইজিন। অথচ সে কি সব যা-তা ভাবছিলো। মানুষটা কি সত্যিই এতোটাই ভালো? কতটা নিদারুণ চাহনি মাইজিনের। তার গভীর কালো চোখ, কি পবিত্র চাহনী, যেনো রাজ্যের স্বপ্ন বোনা সেই দু-চোখে! কালো শার্টে তার লাল ফর্সা শরীর যেনো আরও কিছুটা লাল লাগছিলো তার কাছে। তার কথা কতটা মাধুর্যযুক্ত!

তার আচার ব্যবহার, কথা-বার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির মানুষ! মাইজিনের মা তো তাকে পছন্দই করে না তিনি কি এই বিয়েটা মানবেন? যদি কোনো দিনও না মানেন তাদেরকে?সেদিনই তো তাকে কীভাবে চোর প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন মহিলা। এমন একজন ভালো মানুষের ওরকম মা হয় বুঝি? মাইজিনের বাবা আশফির বিয়েতে আসেন! মাইজিন কি তার বাবার মতো হয়েছে?

ভোর বেলায় তুলিকা উঠে বসে আছে। সকালে কি রান্না করবে? কিছুই তো নেই। এতক্ষণ দুটো মেয়ে গুটি শুটি মে’রে বসে আছে। খিদেতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো মিষ্টির।
‘এই বুবুজান খিদে লাগছে যে!’
‘চুপ করবি। নতুন বাসা কিভাবে কি করবো বুঝিস না? এরকম তো কতই অনাহারে থেকেছিস তবে আজকে কেন পারছিস না?’

মাইজিনের ঘুম ভাঙলো বারোটাই। ঝাপিয়ে উঠে মাইজিন। আল্লাহ! সে এতোটা কেয়ারলেস হলো কি করে? বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে এটা সে কিভাবে ভুলে গেলো? দেরিতে ঘুম থেকে উঠা যে তার রোজকার অভ্যাস সেটা কিন্তু একদমই নয়। এমনিতে সে খুবই পাংচুয়াল! কিন্তু কাল রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর চারটে বাজে ঘুমিয়েছিলো। এই জন্য এখন এতো বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। সে পাশের রুমে গিয়ে গলা পরিষ্কার করে তার উপস্তিতির জানান দিলো। তুলিকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মাইজিনকে! মুচকি হাসে তুলিকা। বিনিময়ে মাইজিন ও হাসে। সে লজ্জায় মাথা নত করে বলে,
‘আ’ম স্যরি এতো বেলা হয়ে গেছে। আপনাকে আবারও কষ্ট দিয়ে ফেললাম তুলিকা। আপনার বর একটা অপদার্থ ছেলে। কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই।’

‘আরে আপনি এতো ভাবছেন কেন?’
‘আমার খুব খিদে পেয়েছে মাইজিন ভাইয়া!’ বললো মিষ্টি।
তুলিকা মিষ্টির দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালে দমে গেলো মিষ্টি। মিষ্টির কথায় মাইজিনের খারাপ লাগা যেনো আকাশ ছুঁই ছুঁই। সে ম্লানমুখে বলে,

‘আসলে এতো বেলা অব্দি ঘুমোই না আমি। সকালে অফিস থাকে আমার। কিন্তু আজ কিভাবে যে**!’
‘সমস্যা নেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন! আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনার ঘুম হয়নি রাতে।’
‘আমি এতোটা নির্বোধের মতো কাজ করলাম কিভাবে? আপনি আমাকে একটু যদি ডেকে দিতেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম আপনি বেলা অব্দিই ঘুমান তাই ডাকিনি।’
‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি আপনি প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন।’

তুলিকা মাথা নাড়লো। মাইজিনের ভীষণ খারাপ লাগছে তুলিকা আর মিষ্টির শুকনো মুখ দেখে। নিশ্চয়ই অনেক খিদে পেয়েছে মেয়ে দুটোর। এখনো পর্যন্ত একদিন হয়েছে অথচ সে নিজের দায়িত্বে অপারগ! ছিঃ ছিঃ নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে সে । তুলিকার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলো না এই রকম একটা ভুলের জন্য।
‘তুই একটা দায়িত্বজ্ঞান হীন পুরুষ মাইজিন। দুটো মানুষের দায়িত্ব নিতে পারিস না আবার বড় বড় গল্প করিস! তুই একটা গা’ধা! ইররেস্পন্সিবল তুই মাইজিন সুলতান!’

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৭

যেতে যেতে নিজেকে হাজার টা বকা দিলো মাইজিন৷ সকালের খাবার খেয়ে মার্কেটে যেতে হবে। তুলিকা আর মিষ্টিকেও সঙ্গে নেবে। ওঁদের প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনে দিতে হবে!

হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৯