হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪২

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪২
তোয়া নিধী দোয়েল

শ্রীমঙ্গলের সবুজ অরণ্যে ঘেরা পরিবেশ-কে বিদায়
জানিয়ে— গাড়ি ছুটছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। সকাল আটটায় বেড়িয়েছে আদনান-তুর্কি। গাড়ি যতক্ষণ শ্রীমঙ্গল শরের ভেতরে ছিলো— তুর্কি ততক্ষণ জানালার বাইরে মুখ বের করে; তার সৌন্দর্য অবলকন করে গেছে। ওদের জীবনের সব চেয়ে সেরা মূহুর্ত কেটেছে এই শহরে!
গাড়ি এখন ঢাকার মধ্য দিয়ে ছুটছে। তুর্কি আদনানের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে রয়েছে। আদনানের বুকের শার্টের বোতামে আনমনে আঙুল চালাচ্ছে। আদনান ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলে—

-খারাপ লাগছে, বেগম সাহেবা? ফ্রেশ হওয়ার জন্য কোথাও নামবো?
তুর্কি ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে—
– না।
-তাহলে, এই ভাবে মন মরা হয়ে রয়েছো কেনো?
-এমনি। পানি পান করবো একটু। পানি দিন।
আদনান পাশ থেকে পানির বোতল বের করে তুর্কিকে দেয়। তুর্কি বোতল নিয়ে পানি পান করে। তখন আদনানের ফোন বেজে ওঠে। আদনান— স্কিনে ভেসে ওঠা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকায়। আননোন নাম্বার! কল-টি কেটে যাওয়ার আগ মূহুর্তে আদনান রিসিভ করে। ও পাশ থেকে একটা মেয়েলি অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
– আসসালামু-আলাইকুম, ভাইয়া। আমি সোফিয়া। তুর্কি কই?
তুর্কির ফ্রেণ্ড সোফিয়া কল করেছে৷ আদনান সালামের উত্তর নিয়ে— তুর্কির দিকে ফোন এগিয়ে দেয়। তুর্কি ফোন নিয়ে জিজ্ঞাসা করে— কে কল করেছে। আদনান বলে সোফিয়া। তুর্কি ফোন কানে তুলে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-কিরে, তুই আমার জামাইয়ের নাম্বার কই পেলি?
ও পাশ থেকে সোফিয়ার ভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—
– দোস্ত, দোস্ত! আমাকে বাঁচা, প্লিজ।
সোফিয়ার কণ্ঠস্বর শুনে তুর্কির কপালে ভাঁজ পড়ে। ও জিজ্ঞাসা করে—
-কী হয়েছে তোর? এই ভাবে কাঁদছিস কেনো?
– দোস্ত, দোস্ত! সাইমম বিয়ে করছে।
তুর্কি একটু ব্যথিত কণ্ঠে বলে—
-সবাই দেখছি বিয়ে করে ফেলছে। অথচ, আমাকে কেউ দাওয়াত দিচ্ছে না। এই রকম বেইমানি মানা যায় না। সেই কবে থেকে শুধু বিয়ের গল্পই শুনছি।
সোফিয়া তুর্কির কথায় পাত্তা না দিয়ে পূর্বের স্বর বজায় রেখে বলে—

-দোস্ত! আমি…আমি…
-কী?
ও পাশ থেকে উত্তর আসার আগেই— শোনা যায় সোফিয়ার কান্নায় ভেঙে পড়া শব্দ! সোফিয়া খুব জোরে-জোরে কান্না করছে। তুর্কি, সোফিয়ার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সোফিয়া কে শান্ত হতে বলে; জিজ্ঞাসা করে
– দোস্ত, কী হয়েছে? এই ভাবে কাঁদছিস কেনো? আমাকে বল৷ তোর শরীর ঠিক আছে? আংকেল-আন্টি?
সোফিয়া একই ভাবে কেঁদে যাচ্ছে। তুর্কি আবারও জিজ্ঞাসা করতে— এক অকল্পনীয় কথা বলে সোফিয়া! কাঁদতে-কাঁদতে বলে—
-দোস্ত, দোস্ত আমি প্রেগন্যান্ট!
সোফিয়ার কথা শুনে— তুর্কি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। চরম বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে—
– এই সব কী বলছিস তুই!
– হ্যাঁ, দোস্ত! সাইমম এখন এই বাচ্চাকে অস্বীকার করছে। আর ওর আগামীকাল বিয়ে, দোস্ত। আমি এখন কী করবো? আমার মরণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই!

-এই, এক দম বাজে কথা বলবি না। শান্ত হো তুই। খবরদার মাথায় উল্টা-পাল্টা কোনো চিন্তা আনবি না। ধর্মে কিন্তু এর চরম নিষেধাজ্ঞা আছে।
-তাহলে আমি কী করবো, দোস্ত। আমাকে বাঁচা প্লিজ!
– শান্ত হো তুই। আমি আছি তোর সাথে। আর ওই বাই* কাকে বিয়ে করছে?
বউয়ের মুখে গালি শুনে— চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় আদনান। রাশভারী কণ্ঠে বলে—
-বেগম সাহেবা!
তুর্কি আদনানের কথা কানে নেয় না। ও এক মনে সোফিয়া কে বোঝাতে থাকে। ও-ওকে আশ্বাস দেয়, ও কিছু করবে। তবু ও যেনো মাথায় আত্মহত্যার কথা না আনে। এক মনে গালি দিতে থাকে সাইমম কে।
বেশ অনেকক্ষণ কথা বলে ফোন রাখে তুর্কি। আগে বাসায় পৌঁছাতে হবে। আদনানের কাছে ফোন দিয়ে গভীর ভাবনায় ডুব দেয়। ওদিকে আদনান একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না। ওর মাথায় শুধু একটাই চিন্তা— বান্ধবী কে বাঁচতে হবে।

বেলা দুইটা বাজে— মানিকগঞ্জ এসে পৌঁছে ওরা। তুর্কি সব কিছু ফেলে— আগে ফ্রেশ হয়ে সোফিয়াকে কল করতে বসেছে। পুরো রাস্তায় ওকে একটু পর-পর কল করেছে। সোফিয়া যাতে কোনো কিছু না ঘটায় সেই জন্য। কয়েকবার রিং হতেই কল ধরে সোফিয়া। মেয়েটা তখন ও কেঁদে যাচ্ছে। তবে, গলার স্বর ক্ষিণ হয়ে এসেছে। ভেঙে গেছে। তুর্কি ওকে শান্ত হতে বলে জিজ্ঞাসা করে—
– দোস্ত, শান্ত হো তুই। এত বড় ভুল কীভাবে করলি? যতই রিলেশন করিস— সব কিছু বিলিয়ে দিতে গেলি কেনো? এই সব কোন ধরণের ভালোবাসা?
ও পাশ থেকে ভাঙা কণ্ঠে সোফিয়া বলে—
-দোস্ত, আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি! তাই, ওর আহ্বানে নিজেকে সঁপে দিতে দ্বিতীয় বার ভাবি নি। আমি বুঝতে পারি-নি এত বড় কিছু হয়ে যাবে।
সোফিয়ার কথা শুনে গা জ্বলে ওঠে তুর্কির। তেজি কণ্ঠে বলে—

– এতই যখন পিরিত— তাইলে এখন বাচ্চা মানতে নারাজ কেন?
ওপাশ থেকে ভেজা কণ্ঠে ভেসে আসে—
– জানিনা, দোস্ত। আমি কিচ্ছু জানিনা।
-বালের রিলেশন আমার। বিয়ের আগে কীসের প্রেম? বিয়ে করবি। তারপর জামাইয়ের সাথে ইচ্ছে মত প্রেম করবি। আর এতই যখন প্রেম ওঠে তাহলে— সব কিছু বিলিয়ে কেন দ্যাস? এই সব কোন ধরণের প্রেম— যে প্রেমে সব কিছু দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হয়? বোঝা আমাকে।
– দোস্ত একটা কাজ করি— আমি বরং ফাঁস নিয়ে মরে যাই। আমার আম্মু-আব্বু যদি শুনে— তাহলে তাঁরা মরে যাবে, দোস্ত। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে তাঁরা। আমি কী জবাব দিবো?
– এক দম ফালতু কথা বলবি না। রিলেশনে যাওয়ার আগে মা-বাবার কথা মনে ছিলো না? এখন কেনো ফালতু কথা মনে হচ্ছে? তুই আগে বল ওই বে*জন্মার বিয়ে কার সাথে? স্যার, বাসায় আছে। আমি তাঁর সাথে আলোচনা করে কোনো সমাধান বের করছি। দোহাই লাগি দোস্ত, তুই কোনো বাজে চিন্তা মাথায় আনিস না।
সোফিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলে—

-মেয়েটার নাম বোধহয়, মিহি উপমা। আমাদের কলেজে পড়ে হয়তো। কিন্তু, আমাদের অনেক সিনিয়র।
‘মিহি উপমা’ নামটি শুনে বুক কেঁপে ওঠে তুর্কির। ওর বোন নয় তো? ও অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে—
– মিহি উপমা মানে? তাঁর বাবা কি কলেজের প্রিন্সিপাল?
-এত কিছু জানিনা, দোস্ত। শুধু এই টুকুই শুনেছি।
তুর্কি অস্থির চিত্তে উপমার কথা ভাবতে থাকে। উপমার ও তো বিয়ে। কিন্তু, কার সাথে বিয়ে এইটা তো ও জানে না। আগে জানতে হবে উপমার বিয়ে কার সাথে। যদি ওই বে*জন্মার সাথে হয়— তাহলে উপমার সাথে মিলে কিছু করতে হবে। আদনানকে আগে জানাতে হবে। তিল পরিমাণ কথা থাকলে ও— তুর্কি আগে আদনানকে জানায়। তা না হলে ওর পেট গুঁড়-গুড় করে! কল কেটে দেয় তুর্কি। আর বার বার বলে দেয়— কোনো টেনশন না করতে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

তুর্কি বিছানায় ফোন ফেলে— সোফিয়ার ঘটনা ভাবতে থাকে৷ একটা মানুষ, একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভরসা করলে, বিশ্বাস করলে বিয়ের আগে সব দিয়ে দেয়। আর পরে ওই বে*জন্মারা গুলো— সব কিছু গ্রহণ করে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই ভালোবাসা!
চোখ বন্ধ করে ফেলে তুর্কি। ভালোবাসা এক নোংরা গল্প শুনে গা ঘিন ঘিন করে ওঠে ওর। ভালোবাসার এত নোংরা রূপ, শোনার পর তুর্কির চোখের সামনে ভেসে ওঠে আদনানের মুখ। যে ওকে শিখিয়েছে ভালোবাসা কতটা পবিত্র! কতটা শুদ্ধ! তাহলে এ কী রূপ!
ও চোখ মেলে তাকালে— স্মৃতির পাতায় হানা দেয় আদনানের বলা কথা। যেখানে আদনান আগে ওর প্রেমে পড়েছিলো। তবুও হারাম রিলেশনে না জড়িয়ে—সরাসরি বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। হোক সেটা ওর অজান্তে— তবুও সে যে ওকে সত্যি ভালোবাসে তার প্রমাণ দিয়েছে!

স্বামী হওয়া সত্ত্বেও, ওদের মধ্যে সঙ্গম না হওয়া পর্যন্ত— কখনো আদনান ওর সাথে কোনো জোর-জবরদস্তি করেনি। তুর্কির কোনো সমস্যা হলে— সে দ্রুত এগিয়ে এসেছে। ওর অসুখের বিভীষিকাময় রাত গুলোতে— একাকী ওর শিয়রে বসে জেগেছে। ওর কাজ করতে সমস্যা হতে পারে বলে— আগে থেকেই মা, ভাই অথবা চাচা কে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও কখনো অভিমান করলে, রাগ করলে— শত চেষ্টা করে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেছে। একজন স্ত্রী হিসেবে যতটুকু স্বাধীনতা দেওয়ার; দরকার তার থেকে বেশি দিয়েছে। নিসন্দেহে একজন মেয়ে বা বউ একজন পুরুষের কাছ থেকে— টাকার থেকে যত্ন আর ভালোবাসা টাই বেশি চেয়ে থাকে। মেয়েরা তো ফুলের মত। তাঁদের যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে হয়! যা আদনান, প্রতিটা মূহুর্তে ওকে এই সব উপলব্ধি করিয়েছে।

অথচ এখন মানুষ দুই দিনে রিলেশনে যেতে পারে না— আগে শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে। তাহলে ভালোবাসা কোথায়? এ খুব বিরল বস্তু! খুব সহজ মানুষ এর সন্ধান পায় না। অথচ আদনান প্রতিটা মূহুর্তে ওকে গভীর ভাবে ভালোবেসে গেছে।
তুর্কি চোখ বন্ধ করে ভাবে— মানুষ কতটা ভাগ্যবতী হলে এই রকম একটা স্বামী পায়! অথচ ভালোবাসার কত ভয়ংকর রূপ রয়েছে! ও সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফুঁপিয়ে ওঠে। দুই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে নামে।
আদনান গোসল সেরে বাইরে আসে। তুর্কিকে বিছানায় বসে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়ে যায়৷ মেয়েটার কোনো সমস্যা হলো না তো! ও দ্রুত হাতের তোয়ালে ফেলে তুর্কির কাছে যায়। তুর্কিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে—

– বেগম সাহেবা! কী হয়েছে? এই ভাবে কাঁদছো কেনো?
তুর্কি কিছু বলে না। ও সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে আদনানের বুকে। ফুঁপিয়ে, কেঁপে-কেঁপে ওঠে । আদনান বিচলিত কণ্ঠে বলে—
– কী হয়েছে, বেগম সাহেবা? আমি কি তোমাকে কোনো কিছু নিয়ে হার্ড করেছি?
তুর্কি, আদনানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ভেজা কণ্ঠে
বলে—
– স্যার, ভালোবাসার এত নোংরা রূপ কীভাবে হয়?
তুর্কির কথা শুনে, ঘাবড়ে যায় আদনান। ওর নামে কেউ কি তুর্কি কে কিছু বলেছে? ও তুর্কির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

– কী হয়েছে, ম্যাডাম? আমি কি কোনো ভাবে তোমাকে হার্ড করেছি?
তুর্কি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে ওঠে সব বলে আদনানকে। আদনান সব শুনে ওকে শক্ত করে চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে। শান্ত হতে বলে। তুর্কি এ ও বলে সোফিয়া নাকি আত্মহত্যা করবে। এই ভেবে আরও কান্না করে তুর্কি। আদনান অনেকক্ষণ বোঝানোর পর তুর্কিকে নিজের আয়ত্তে আনে। শান্ত করে বলে— ও দেখছে সব কিছু। সব ঠিক করে দেবে। তুর্কি আদনানকে বাধা দিয়ে বলে— ঝামেলা আরেকটা আছে। আগে শিউর হতে হবে উপমার সাথে ঘটনা টা কোনো ভাবে জড়িত নাকি। আর এর জন্য ওকে বিয়ে বাড়ি যেতে হবে। আদনান ওর কথা সমর্থন করে। রেডি হতে বলে।
আদনান বিছানা থেকে ওঠতে গেলে— তুর্কি হাত টেনে ধরে। শান্ত কণ্ঠে বলে—

– আপনাকে অনেক ভালোবাসি, স্যার! ভীষণ ভালোবাসি!
আদনান ওর দিকে ঘুরে ওর দুই গালে হাত রেখে কপালে চুম্বন করে। মৃদু হেসে বলে— ও- ও কতটা ভালোবাসে তুর্কি কে। তুর্কি আবারও আদনানের বুকে মাথা রেখে বলে—
– স্যার, আমাকে কথা দিন— আপনি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কোথাও না।
আদনান তুর্কির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—
– মৃত্যু চিরন্তন সত্য, বেগম সাহেবা। এর কাছে সবাইকে নতি স্বীকার কর‍তে হবে। তবে, এই টুকু আশ্বাস দিতে পারি—আমার দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত; তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। নিশ্চিন্তে আমার বুকে থাকো তুমি। যতক্ষণ নিশ্বাস চলছে— আমি তোমাই রবো। ভয় পেও না।
আদনানের কথা শুনে, ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তুর্কি। সৃষ্টি কর্তার কাছে আদনানের দীর্ঘায়ু কামনা করে।

ব্যালকনিতে হলুদ শাড়ি পরে বসে রয়েছে উপমা। কোলে একটা ডায়েরি— আর এক মুঠো নীল চুড়ি। ওই বাড়ি থেকে কিছু মানুষ এসে হলুদের অনুষ্ঠান সেরে গেছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। হলুদের ঘ্রাণ, এই আনন্দ-আয়োজন সব চরম দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে ওর কাছে। ওর মন কাউকে খুঁজছে৷
ও ডায়েরি খুলে। সেখান শুকিয়ে যাওয়া কিছু কাঠগোলাপ! যে গুলো রেজুয়ান দিয়ে ছিলো৷ ও খুব যত্নে এখানে রেখে দিয়েছিলো। সেই গুলোই আজ খুলে দেখছে৷ নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে। সেই সুন্দর মনোরম ঘ্রাণ টা আর নেই! ওর জীবনের মত কেমন যেনো ভ্যাপসা গন্ধ হয়ে গেছে। ও এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ফুল গুলোর দিকে।
ব্যালকনিতে ধীর পায়ে হেঁটে আসে সূচি। ওর ও মন ভালো নেই। বন্ধুর কী হয়েছে; তা জানা না পর্যন্ত মনে শান্তি মিলবে না। ও ধীরে হেঁটে ওর পাশে বসে। ওর কোলে শুকিয়ে যাওয়া ফুল দেখে অবাক হয়। সন্দিহান মনে জিজ্ঞাসা
করে—

-দোস্ত, এই গুলো কে দিয়েছে?
সূচির কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উপমা। উত্তর দেওয়ার আগেই সূচির বুকে— সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়ে উপমা। ফুঁপিয়ে ওঠে কেঁদে বলে—
– দোস্ত, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না৷ অসহ্য লাগছে। আমি কী করবো।
সূচি ওকে সামলে নিয়ে বলে—
-বলবি তো তুই। কী হয়েছে তোর।
– আমার হৃদয় আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে। ও কাউকে চাইছে!
উপমা আর ও কিছু বলতে যাবে— সেই মূহুর্তে সেখানে উপস্থিতি হয় তুর্কি। দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় উপমা। তুর্কির পরনে সবুজ রঙের কুর্তি। তুর্কি এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে—
– তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি আপু।
উপমা চোখের জল মুছে; মিথ্যে হাসি দিয়ে বলে—

-এই তো ছিলাম এখানে। কখন এসেছিস তোরা? ফুপু বললো তোরা নাকি ঘুরতে গিয়েছিস? ভাইয়া এসেছে?
-এই তো আসলাম আজ। আজ এসে নি এখানে। আগামীকাল আসবে। তুমি আগে তোমার বরের ছবি দেখাও। আমার এত সুন্দর বোনের বর টা কে আগে দেখে নেই।
সাইমমের কথা মনে হতে বিষে ছেঁয়ে যায় উপমার মন। ও হাসি লুকিয়ে বলে—
-আমার কাছে তো নেই।
সূচি বলে—
-আমার কাছে আছে৷ দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
সূচি ফোন আনতে-আনতে টুকটাক কথা বলে দুই বোন। সূচি এসে ছেলের ছবি দেখাতেই রাগে জ্বলে ওঠে তুর্কি। উপমার দুই হাত ধরে বলে—
-আপুউউউ, তোমার সাথে অনেক কথা আছে!

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁধে পিন লাগানোর চেষ্টা করছে তুর্কি। ওর পরনে লাল শাড়ি। উপমার বিয়েতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আদনান শার্টের বোতাম লাগাতে-লাগাতে ওর পিছনে এসে দাঁড়ায়। তুর্কির হাত থেকে পিন নিয়ে কাঁধে লাগিয়ে দেয়। তুর্কি টেবিলের ওপর থেকে চুড়ি নিয়ে পড়তে গেলে— আদনান পিছন থেকে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে ঘাড়ে নাক ঘষে বলে—
-বেগম সাহেবা! মন তো কিছু একটা চাইছে! দিবে নাকি?!
আদনানের বেহায়া আবদার শুনে—দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করে তুর্কি। ওর হাতের উপর হাত দিয়ে ছোটার চেষ্টা করতে করতে বলে—

– এক দম না। আমাদের আজ অনেক কাজ আছে।
আদনান আগের স্বর বজায় রেখে বলে—
– হ্যাঁ, তাই তো সেই পারিশ্রমিক আগেই চেয়ে নিচ্ছি। পরে যদি তুমি মত বদলাও! তাই আগে এই দিকে আসো…!
আদনান, তুর্কিকে নিজের দিকে ঘোরায়। দুই গালে আলতো স্পর্শে করে— অধরে-অধর ছুঁইয়ে দেয়। কপালে ও একটা গাঢ় চুমু খেয়ে বলে—
-বাকিটা পরে৷
তুর্কি, আদনানকে ধাক্কা মেরে বলে—
-হয়েছে? এবার সরুন। আমাকে তৈরি হতে দিন। কত কাজ বাকি মনে আছে?
আদনান তুর্কিকে ছেড়ে শার্টের কফ ভাঁজ করতে কর‍তে বলে—
-হুম। কিন্তু, আগে যাবে কোথায়?

-সোফিয়ার কাছে। আচ্ছা, আপনি আগে সোফিয়া কে একটা কল করে আমার কাছে দিন। দেখি ওর কত দূর।
এই বলে তুর্কি চোখে কাজল পড়তে থাকে। আদনান সোফিয়ার নাম্বারে কল দিয়ে— তুর্কির দিকে ফোন এগিয়ে দেয়। আয়নাতে দু’জনের দৃষ্টি সংযোগ হলে— আদনান বাঁ চোখ মারে। তুর্কি থতমত খেয়ে— ওর হাত থেকে কাজল পড়ে যায়। আদনান, তুর্কি ভ্যাবাচেকা খাওয়া দেখে হো-হো করে হেসে ওঠে। তুর্কি চোখ গরম করে আদনানের হাত থেকে ফোন নিয়ে বিড়বিড় করে—
– অসভ্য লোক!
আদনান ওর দিকে ফিসফিসিয়ে বলে—
-আমাকে তো সারা দিন মারো। তাহলে ভাবো আমার অবস্থা কী হয়।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
-ফাজিল লোক!

উপমা গোসল সেরে এসে চুল মুছতে-মুছতে সূচিকে বলে— কিরে সব গুছিয়ে দিয়েছিস? উনি কিন্তু এখনি এসে পড়বে।
সূচি, উপমার শাড়ি-ব্লাউজ, ওড়না গুছিয়ে দিয়ে বলে—
– হ্যাঁ। কিন্তু, তুই আমাকে একটা কথা বল— এই তো কাল রাতে কত কান্না করলি। আর সকাল হতে না হতেই পার্লারে যাওয়ার জন্য এত ব্যাকুল হচ্ছিস?
উপমা তোয়ালে রেখে এসে বলে—
-বিয়ে তো মানুষ একবারই করে৷ তো একটু সাজবো না?
-কিন্তু…
-কোনো কিন্তু না। তুই রেডি হো। আমি উনাকে কল করে দেখছি— এসে পড়েছে নাকি।
মূলত, উপমা সাইমমের সাথে পার্লারে যাচ্ছে। বিয়েটা সাধারণ ভাবে হোক— কিন্তু, একবারই তো হবে। তাই আজ ও হবু স্বামীর মনের মত সাজবে৷ তাই, সাইমম কে নিয়েই বের হবে।

আজ সারাদিন একটা কথা ও বলেনি রেজুয়ান। ভীষণ নিস্তব্ধতায় কেটেছে বেলা। মুজাহিদ স্কুল থেকে এসে খুঁচিয়ে দুই-একটা হাঁ-হুঁ ছাড়া কিছুই বের করতে পারে নি।
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে মুজাহিদের ঘরে আসে আদনান। মুজাহিদ শুয়ে বই পড়ছিলো। আদনান এসে জিজ্ঞাসা
করে—
-বাপের ভাই, মীম কই?
মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে—
– ও তোর রুমে না?
-কই না তো।
-না মানে?

মুজাহিদ শোয়া থেকে ওঠে বসে। সে জানে ভালোবাসা বিচ্ছেদ কতটা কঠিন! কোনো উল্টা-পাল্টা কিছু যেনো করে না বসে তাই। মুজাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—
-তুই বল, আমি কী করবো। মেয়ে রাজি থাকলে তুলে আনতাম। কিন্তু,
আর কিছু বলার আগেই মুজাহিদের ফোন বেজে ওঠে। একটা আননোন নাম্বার!

নিমতুলির বিশাল শিরিষ (কড়ই) গাছের নিচে বসে রয়েছে রেজুয়ান। বিধস্ত চেহারা বিদ্যমান। শিরিষ গাছের সামনে চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে৷ রাত্রি গভীর হওয়ার দরুন রাস্তায় মানুষের চলাচল ও কমে এসেছে৷ মাঝে মাঝে দুই একটা অটো, রিকশা ছুটছে।
রেজুয়ান ফোনের স্কিনে কিছু দেখায় ব্যস্ত! একটা মেয়ের ছবি! যে লাল শাড়ি পরে আয়নার সামনে বসে রয়েছে। গায়ে খুব সীমিত অলংকার।

ছবিটা উপমার! কিছুক্ষণ আগে সূচি পাঠিয়েছে। তাই গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে রেজুয়ান। কী এমন ক্ষতি হতো— এই বউটা ওর হলে! এতক্ষণে বোধহয় পরের হয়েও গেছে! রেজুয়ান ফোন ওফ করে পাশে রেখে দেয়। দুই হাত দিয়ে মুখ ছাপিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ তারপর গভীর অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া আকাশ পানে তাকায়।
আকাশে হাজার নক্ষত্রের খেলা। তবে কোনো চাঁদ নেই৷ দূর থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হাঁক-ডাক। মাঝে মাঝে জোনাকিরা ও উড়ে চলেছে মৃদু আলো দিয়ে।
রেজুয়ান আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুরু রাস্তার বাঁ দিকে তাকায়। একটা খালি রিকশা ধীর গতিতে আসছে। পাগল-পাগল লাগছে নিজেকে৷ সব কিছু অসহ্য মনে হচ্ছে। বড় ভাই আর চাচার জন্য জীবনে অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই। অথচ আজ?

ও ভীষণ বিরক্তিতে ওঠে দাঁড়ায়৷ পায়ের কাছে একটা খালি বোতল পড়া ছিলো। সেটা কে এক লাথি মেরে দূরে ছুঁড়ে দেয়। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে অস্থির নয়ন জোড়া সহসা ছুটে যায়— সুরু রাস্তায় ডান দিকে মোড়।
মোড়ে দৃষ্টি পড়তে-ই ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায় রেজুয়ানের! নিমতুলির ডান দিকের মোড় ঘুরে কেউ ছুটে আসছে। মোড়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে— এক নারী মূর্তি ছুটে আসছে! যাঁর পরনে লাল শাড়ি! মাথায় লাল ওড়না বাতাসের দরুন উড়ছে! দুই হাত দিয়ে পরনের শাড়ি পায়ের গোড়ালি থেকে একটু উপরে তুলেছে— যাতে দৌড়াতে সুবিধা হয়।
সময়ে সাথে সাথে নারী মূর্তিটি দৃশ্যমান হতে থাকে! নারী মুর্তিটির মুখশ্রী দৃশ্যমান হতে— রেজুয়ানের অস্তিত্ব কেঁপে ওঠে! হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় দ্বিগুণ! এ কী দেখছে ও!

নারী-টি রেজুয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়! একটু ঝুঁকে, দুই হাঁটুতে হাত দিয়ে চোখ মুখ খিঁচে— জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে! মুখ হাঁ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর দাঁড়িয়ে রেজুয়ানের দিকে এক কদম এগিয়ে এসে— ওর ডান হাত চেপে ধরে! বিদিত কণ্ঠস্বর থেকে ভেসে আসে কিছু কথা—
-তুমি কই ছিলে বলো তো! তোমাকে খুঁজতে-খুঁজতে হাঁপিয়ে গেছি! তাড়াতাড়ি কাজী অফিসে চলো!
কথাটি শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে রেজুয়ানের। এ কী স্বপ্ন! এ কী করে সম্ভব! রেজুয়ান যেনো ভ্রমের মধ্যে পড়ে গেছে! ওর মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে আসে— ‘কাঠগোলাপ!’

প্রজাপতির মত উড়তে-উড়তে ঘরে প্রবেশ করে তুর্কি। ঘরে চোখ পড়তেই দেখে— আদনান ভীষণ ব্যস্ত হয়ে আলমারির সামনে কিছু একটা করছে। ও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ডাকে—
-জানেমান! কী করো?
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। এমনকি পিছনে ও তাকায় না। ‘জানেমান’ ডাকটি দিয়ে পরপরই তুর্কি নিজের কপাল চাপড়ে! এই লোক ‘জানেমান’ শোনার লোক? তুর্কি আবার বলে—
– স্যার, কিছু খুঁজছেন?
আদনান পকেটে কিছু টাকা ভরে খুব হন্তদন্ত হয়ে তুর্কির দিকে এগিয়ে আসে৷ তুর্কি এক গালে ডান হাত রেখে বলে—
-জানেমান, বরণ ডালা সাজাও! নতুন বউ নিয়ে আসছি!
কথাটি বলে আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায় না আদনান। দ্রুত পায়ে হেঁটে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আদনানের মুখে ‘জানেমান’ শুনে তুর্কির বুকে কিঞ্চিৎ কাঁপুনি ধরে। পরপরই আদনানের বলা শেষ কথাটি মনে পড়ে— নতুন বউ নিয়ে আসছি!
‘নতুন বউ’ মানে!

তুর্কি দ্রুত ছুটে আদনানের সামনে গিয়ে ওর পথ আটকায়! আদনানের টি-শার্টের কলার ধরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে—
-কী বললেন? নতুন বউ আনতে যাচ্ছি মানে!
আদনান তুর্কির হাতের ওপর হাত রেখে দ্রুত কণ্ঠে বলে—
– ম্যাডাম, ম্যাডাম রিল্যাক্স!
– রিল্যাক্স মানে কী? আমি আপনাকে খুন করে ফেলবো!
আদনান তুর্কির দুই গালে হাত দিয়ে বলে—
-আরে বোকা মেয়ে, আমার নয়। তোমার জা আনতে যাচ্ছি! এখন যেতে দেও। তা না হলে দেরি হয়ে যাবে। এসে সব কথা বলবো তোমাকে।
এই কথা বলে আদনান তুর্কির হাত কলার থেকে সরিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে— আদনানের যাওয়ার পানে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে! নতুন জা মানে?

রেজুয়ানকে পলকহীন নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে— উপমা মাছি তাড়ানোর মত হাত নাড়ায় ওর মুখের সামনে। তবুও যেনো বিস্ময় কাটে না রেজুয়ানের! মূহুর্তে হওয়া ঘটনা ওর কাছে মীরাক্কেল মনে হচ্ছে! কোনো যাদু বলে কেউ উপমাকে এনে দিয়েছে ওর কাছে! রেজুয়ানের কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য না হওয়াতে; উপমা বিরক্ত কণ্ঠে বলে—
– কী হলো? এই ভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি কাজী অফিসে চলো!
উপমার কথায় ধ্যান ভাঙে রেজুয়ানের। ও ক্ষিণ কণ্ঠে বলে—
-কাজী অফিসে কেনো যাবো?
রেজুয়ানের কথায় এবার চটে যায় উপমা। কাজী অভিসে কী করতে যায় মানুষ? ও কণ্ঠে কিঞ্চিৎ তেজ মিশিয়ে বলে—
-বোকার মত প্রশ্ন করো না। কাজী অফিসে কী করতে যায় মানুষ? বিয়ে করবো আমরা! বিয়ে করবো! তাড়াতাড়ি চলো!

রেজুয়ান অবাক কণ্ঠে বলে—
-বিয়ে করবো মানে!
উপমা রেজুয়ানের ধরা হাত— ধরে রেখেই ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে আসে৷ ওর মুখের বরাবর হয়ে ওর চোখে-চোখ রেখে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে—
-ভালোবাসো না আমায়? আর কাউকে ভালোবাসলে যে তাকে বিয়ে করতে হয়— এইটা নিশ্চয়ই জানো! তাহলে অযথা কেনো এত ‘মানে মানে’ করছো?
উপমার বলা কথা— রেজুয়ানের পুরো অস্তিত্ব কাঁপিয়ে তোলে! এই মেয়ে বলে কী! ও ঢোক গিলে বলে—
-কাঠগোলাপ, কী বলছো তুমি? যা বলছো ভেবে বলছো তো? আমার কিন্তু, কোনো ক্যারিয়ার নেই। এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি৷ শুধু ভালবাসলেই হয় না; এক সাথে চলতে গেলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া লাগে!
উপমা পূর্বের স্বর বজায় রেখে বলে—

-কে বলেছে আগে প্রতিষ্ঠিত হয়ে হয়? আগে ক্যারিয়ার ঠিক করতে হয়? কই লেখা আছে এইটা?
সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করে। আমরা না হয় বিয়ে করে এক সাথে প্রতিষ্ঠিত হবো! আর তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। তাহলে, আমাকে ঘরে তুলতে ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি যদি বিয়ের আসর থেকে তোমার জন্য পালিয়ে আসিতে পারি; তাহলে তুমি কেনো আমাকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ঘরে তুলতে পারবে না?
রেজুয়ান কী বলবে ভেবে পায় না। কী বলা উচিত তাও জানে না। ও ড্যাপ-ড্যাপ করে তাকিয়ে থাকে উপমার দিকে। উপমা আবার বলে—
-আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমার ফিরে যাওয়ার পথ বন্ধ! বিয়ের ভরা আসর থেকে পালিয়ে এসেছি; বাবা আমাকে আর মেনে নিবে না। আর তুমি আমাকে ফেরাতে ও পারবে না। কারণ তোমার পালিত বাপ, আর তোমার ভাই আসছে বিয়ের সাক্ষী দিতে!
রেজুয়ান অবাক কণ্ঠে বলে—

-মানে?
-আমি বাড়ি থেকে আসার আগে— আদনান স্যার কে বলে এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি আসছে তাঁরা। এতক্ষণে…
উপমার কথা শেষ হওয়ার আগেই; একটা রিকশা এসে থামে ওদের সামনে। রেজুয়ান বিস্মিত নয়নে তাকায়। রিকশা থেকে আদনান-মুজাহিদ নেমে আসে। আদনান ভাড়া মেটাতে-মেটাতে, মুজাহিদ রেজুয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়৷ উতফুল্ল চিত্তে বলে—
– তাড়াতাড়ি কাজী অফিসে চল, বাচ্চা। কখন আবার মেয়ের বাড়ির লোক হানা দেয় বলা যায় না। একবার বিয়ে হয়ে গেলে কেউ আর কিছু করতে পারবে না।
এই বলে মুজাহিদ উপমার কাছে যায়। উপমার উদ্দেশ্যে বলে—
-মামুনি তাড়াতাড়ি চলো।

কী হচ্ছে! কিছুই রেজুয়ানের মাথায় ঢুকছে না। উপমা রেজুয়ানের হাত ছেড়ে মুজাহিদের সাথে হাঁটতে আরম্ভ করে। রেজুয়ান মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়াগায়। আদনান ওকে ঐ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলে—
-কিরে, এই রকম পাথর হলি কেন? তাড়াতাড়ি চল।
রেজুয়ান, আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে—
-ভাই, কী হচ্ছে এইসব। বাড়িতে…
আদনান, রেজুয়ান কে থামিয়ে দিয়ে বলে—
-আমি তোর ভাই, বেঁচে আছি না? বাড়িতে, বাইরে এবং মেয়ের বাড়ির সব ঝামেলা দেখে নেবো৷ তুই শুধু এখন বিয়ে করতে চল!
অতঃপর কাজী অফিসের দিকে হাঁটতে থাকে ওরা।

কাজী অনেক আগে রেজুয়ানকে কবুল বলতে বলছে। কিন্তু, রেজুয়ান থ মেরে বসে রয়েছে। মূলত ওর মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রেজুয়ান কবুল বলছে না দেখে কাজী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সে বোধহয় এই প্রথম কোনো ছেলেকে দেখছে— যে কবুল বলতে এত দেরি করছে। ছেলে মানুষ কখনো এত দেরি করে— কবুল বলতে? কাজী ফের বিরক্ত কণ্ঠে বলে—
-তোমার সমস্যা কী বাবা, কবুল বলছেন না কেনো?
রেজুয়ানের কাণ্ড দেখে উপমা ও বিরক্ত হয়ে যায়। ও রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে—
– সমস্যা কী তোমার? কবুল বলছো না কেনো? মেয়েদের মত এত সময় নিচ্ছো কেনো?
তারপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে—
-ভাইয়া ওকে কবুল বলতে বলেন।
আদনান রেজুয়ানের পিঠে এক কিল দিয়ে বলে—
– এই তোর সমস্যা কী? কবুল বল।

উপমা, আদনানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে— ফের রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে কটমট করতে করতে বলে—
-ভালোবাসার সময় মনে ছিলো না— ভালবাসলে তাকে ঘরে তুলতে হবে? আমি যদি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসতে পারি; তুমি কেনো ‘ভালোবাসির’ জায়গায় ‘কবুল’ বলতে পারো না? ‘ভালোবাসি’ তো খুব সহজে গলা দিয়ে বের হত— তাহলে ‘কবুল’ কেনো গলা দিয়ে বের হয় না? তাড়াতাড়ি বলো বলছি!
উপমার ঝারা খাওয়ার পর— রেজুয়ান ওর দিকে তাকায়। স্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করে— ‘কবুল! কবুল! কবুল!’
উপমা মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে৷ মুজাহিদ উপরে তাকিয়ে বুকে হাত দিয়ে হাঁফ ছেড়ে শব্দ করে বলে— ‘আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!’
আদনান ও শুকরিয়া আদায় করে৷ যাবতীয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে— বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়না দেয় সবাই। আদনান-মুজাহিদ আগে বের হয়। আজ বাড়িতে বড়সড় কিছু একটা ঘটবে। তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা৷ উপমা আগে এক পা দিলে— পিছন থেকে হাত টেনে ধরে রেজুয়ান। হাতে টান লাগলে দাঁড়িয়ে যায় উপমা। রেজুয়ান ওর সামনে এসে ধীরেসুস্থে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে—

-তোমাকে কী বলবো আমার জানা নেই, কাঠগোলাপ! তবে এই টুকু বলতেই পারি— আজ যত টাকা দেনমোহর হিসেবে দেওয়া হলো তোমাকে; একদিন এর টাকার দিগুণ করে ফের ঘরে তুলবো তোমাকে! তুমি শুধু এই ভাবে হাত ধরে থেকো।
উপমা ও রেজুয়ানের চোখে চোখ রেখে বলে—
-আমি কোনো টাকা-পয়সা জন্য পালিয়ে আসি নি। বাবার একমাত্র মেয়েছিলাম। টাকার কোনো অভাব ছিলো না। নেহাত ভালোবাসো, তাই এসেছি৷ সারাজীবন এইটা পেলেই হবে। ছোট বেলা থেকেই আমার জীবনে ভালবাসার ভীষণ অভাব!
-তুমি তো বাসো না!
উপমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—
-আই ট্রাস্ট ইউ, মোর দ্যান অ্যানিওয়ান! এর থেকে বেশি কী চাও?
রেজুয়ান আর কিছু বলে না। ওর হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

কনে যে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে গেছে; এই নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায় বিয়ে বাড়ি। কেউ কোথাও খুঁজে পায় না। ওদিকে— সাইমম ও নাকি কাকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে৷ এই নিয়ে ফারুকের মাথায় বাড়ি। কিন্তু, সব চেয়ে ভাবার বিষয় তার মেয়ে কার সাথে চলে গেছে! ফারুক শতবার সূচির কাছে জিজ্ঞাসা করে ও কোনো উত্তর পায় না। জুবাইরা— তুর্কি কে কল করে সব জানায়। তুর্কি বৈঠক খানায় বসে মায়ের সাথে কথা বলছিলো৷ সব শুনে তুর্কি বলে

-দেখছো মা, তুমি আমাকে আগে আগে বিয়ে দিয়ে ভালো করেছো না? বিয়ে তো দিতেই চাইছিলে না। যদি আমি ও এই রকম একটা কাজ করতাম তখন?
-চুপ কর। ভালো লাগছে বা কিছু। মেয়েটা কই গেছে কে জানে।
-হুম।
-সারফারাজ ভালো ছেলে বলে বিয়েটা দিয়েছি। তা না হলে জীবনে ও দিতাম না।
মায়ের মুখের মেয়ে ব্যতীত মেয়ের জামাইয়ের প্রশংসা শুনে চেতে যায় তুর্কি। তেজি কণ্ঠে বলে—
– বাহ্! আম্মু জামাইয়ের প্রশংসায় তো পঞ্চমুখ! তোমার মেয়ে যে কত ভালো তাও একটু বলো।
– হ্যাঁ, তুই যে কত ভালো তা আমার জানা আছে। নেহাত জামাই টা ভালো— তাই তোকে সহ করতে পারে। অন্য কেউ হলে…

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪১

-আম্মু! তুমি কী বলতে চাইছো? আমি পাজি?
– না না তা বলবো কেনো। তোমার মত লক্ষী মেয়ে হই না
তুর্কি আরও কিছু বলার জন্য উদ্যত হয়। সেই মূহুর্তে দরজায় উপস্থিত হয় আদনান, মুজাহিদ রেজুয়ান আর উপমা। উপমা কে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায় তুর্কি। ও অবাক কণ্ঠে বলে—
-আপু, এখানে কী করছে!

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৩