হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ২২

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ২২
নন্দিনী চৌধুরী

শুভ্রতার মা শুভ্রতা বসে আছে মুখামুখি রুমে।শুভ্রতার মায়ের চোখের পানি।আর শুভ্রতা মাথা নিচু করে বসে আছে।প্রায় অনেকক্ষন হয়েছে তারা এভাবে বসে আছে।শুভ্রতার মা মেয়ের সাথে লজ্জায় অপরাধবোধে কথা বলতে পারছেনা।তবুও শারমিন শুভ্রতার সাথে প্রথম কথা বলা শুরু করলেন।
শারমিন:শুভ্রতা!

মায়ের মুখে এতোটা বছর পর নিজের নাম শুনে বুকটা ধুক করে উঠলো।এতোদিন পর নিজ মাকে এতো কাছাকাছি সে।শুভ্রতা মা আমার বলতে লাগলেন,
শারমীন:কেমন আছিস মা।জানি ভালো আছিস।এতো ভালো স্বামী পরিবার পেয়েছিস ভালোই থাকবি।আমিও চাইরে মা তুই অনেক ভালো থাক।ছোট থেকে শুধু কষ্ট পেয়েছিস।আমার বাবা ভাই তার বউদের থেকে।আর আমার থেকেও।আমি তোর জন্মদাত্রী হয়ে তোকে কষ্ট দিয়েছি।জানি আমার উপর অনেক রেগে আছিস।কিন্তু বিশ্বাস কর মা।তোকে কষ্ট দিতে একদম চাইনি আমি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তোর বাবা আর আমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম।সেই ভার্সিটি থেকে আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।আমার বাবা আমাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিলো কিন্তু আমি বলেছিলাম আমি বিয়ে করলে তোর বাবাকেই করবো।তোর বাবা ছিলো গরিব ঘরের।মা বাবা কেউ ছিলোনা ওর।তাই আমার বাবা আমাকে ওর কাছে বিয়ে দিতে রাজী ছিলোনা।তারপর একদিন পালিয়ে গেলাম আমরা।বিয়ে করে নিলাম দুজোনে।আমি আসার সময় মায়ের কিছু গহনা ছিলো সেগুলো সাথে নিয়ে এসেছিলাম।

সেগুলো বিক্রি করে আর তোর বাবা কিছু টাকা জমিয়েছিলো সেটা দিয়ে একটা টিনের ঘর ভাড়া নিলাম।হাতে থাকা টাকা দিয়ে তোর বাবা আমাকে চালাতে লাগলো।আর চেষ্টা করতে লাগলো চাকরির জন্য।অবশেষে পেয়েও গেলো চাকরি।আমরা একটা বাসা ভাড়া নিলাম।দেখতে দেখতে দুই বছরের মাথায় তুই আমার পেটে আসলি।খুব খুশি হয়েছিলো তোর বাবা।তারপর জন্মনিলি তুই।তোর বাবা তোকে কোলে নিয়ে সেদিন খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলো।এর মাঝেও আমার সাথে তোর নানারা কেউ যোগাযোগ করেনি।আসতে আসতে তুই বড় হলি।কিন্তু একদিন এক ঝরে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।

তোর বাবা তোর আট বছরের সময় মারা গেলো।তোর বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালানো আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো।তখন বাবা আর ভাইয়েরা আমাকে আর তোকে নিজেদের কাছে নিতে চায়।আমিও রাজী হয়ে যাই ভেবেছিলাম একা দুইটা মেয়ে মানুষ আমরা কিভাবে থাকবো।তাই চলে আসি তাদের কাছে।এখানে আসার দুই বছরের মাথায় বাবা আমাকে আবার বিয়ের জন্য চাপ দেয়।আমি এই জীবনে আর কাউকে নিজের জীবনে আনবোনা বলে ঠিক করেছিলাম।কারন তোর বাবাকে আমি খুব ভালোবাসি।

কিন্তু বাবা আমাকে চাপ দিতে থাকে বলতে থাকে আমি যদি বিয়ে না করি তবে তোকে এতিম খানায় দিয়ে আসবে।আমি চাইলেও সেই মূহূর্তে তোকে নিয়ে চলে আসতে পারতাম না।কারন আমি তোকে কি করে খাওয়াতাম বড় করতাম।বাধ্য হয়ে আমি বিয়েতে রাজী হই।কিন্তু আমি বলেছিলাম বিয়ে করে আমি তোকেও নিয়ে যাবো আমার সাথে।বাবা তাতে রাজীও হয়েছিলো।কিন্তু বিয়ের পর তোকে আমার কাছে দিলোনা।

বাহানা দিলো প্রথমে আমি যাই পরে যেনো তোকে নেই।তাদের কথা মেনে চলে আসলাম।জাহিদ লোকটা একটুও খারাপ নারে সব জেনে আমাকে বিয়ে করেছে।সেও একটা মেয়ে পাবে বলে আমাকে বিয়ে করেছিলো।জাহিদের সাথে আমি মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।তোর বাবার কথা খুব মনে পরতো।বিয়ের পর তোকে আনতে গেলে বাবা তোকে আমাকে আনতে দেয়না আর দেখাও করতে দেয়না।আমি জোর করলেও দিতোনা।আমি বাসায় এসে জাহিদের কাছে কাঁদতাম।তারপর একদিন জাহিদ তোকে নিতে গেলো কিন্তু তুই সাফ জানিয়ে দিলি।

তুই আমার কাছে আসবিনা।আমি জানতাম না বাবারা তোকে আমার নামে কান পুড়িয়েছে। আমি নাকি তোকে আমার সুখের জন্য ছেড়ে গেছি।সেদিন আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনবো ভাবিনি।আমার অবস্থা ভালো করতে জাহিদ একটা বাচ্চা নিলো।বাচ্চা হবার পর ও আমি তোকে ভুলতে পারিনি।আমার ভুল ছিলো এখানেই আমার জোর করে হলেও আইন আদালত করে হোলেও তোকে নিজের কাছে আনা উচিত ছিলো যা আমি করিনি।

কিন্তু মা রে জাহিদ তোকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে।তুই যেদিন আসবিনা বললি বাসায় এসে সেও সেদিন কেঁদেছিলো।বিশ্বাস কর মা আমি আজো তোকে অনেক ভালোবাসি।নিজের মেয়ে থেকেও তার মুখ থেকে আমি মা ডাক শুনতে পাইনা।আমাকে মাফ করে দিস পারলে।আর একটা বার আমাকে ডাকিস।মরার আগে একবার তোর মুখ থেকে মা ডাকটা শুনে যেতে চাই।আর হ্যা এই নে এইগুলো তোর বাবার রেখে যাওয়া কিছুজিনিশ।তোর বাবা তোর জন্য এগুলা রেখেছিলো।

শারমীন কথাগুলো বলে আচঁল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে একটা ডাক শুনে থমকে যায়।
“মা!”
মা ডাকটা শুনে শারমীন পিছনে ফিরে দেখে শুভ্রতা চোখে পানি টলমল করছে।শারমীন অবাক কন্ঠে বলে,
শারমীন:কি বললি শুভ্রতা আরেকবার বল।
শুভ্রতা:মা

শারমীন আনন্দে মেয়েকে জরিয়ে ধরে।এতো গুলো বছর পর নিজের মেয়ের মুখ থেকে আবার সেই মধুর ডাকটা শুনতে পেলো।যার জন্য তিনি এতো হাসফাস অস্থির থাকতেন।আজ সেই ডাকটা তার মেয়ে তাকে ডাকলো।শুভ্রতা মায়ের কোলে আচড়ে পরে কাঁদতে লাগলো।এতোগুলো বছর পর সেই মমতা ভোরা ভালোবাসার স্থানটায় সে মাথা রাখলো।ছোট বেলায় ব্যাথা পেলেই মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতো।মা মলম লাগিয়ে দিতো।আর আদর করে দিতো।

শুভ্রতা কেঁদে যাচ্ছে।সেতো জানতোনা তার মা কতটা কষ্ট সয্য করেছে।না জেনে সেও তো মাকে কষ্ট দিয়েছে।শুভ্রতা মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদে কেঁদে বলছে,
শুভ্রতা:আমাকে ক্ষমা করে দিওমা।আমি না জেনে তোমাকে ভুল বুজেছি।তুমি চলে যাওয়ার পর কেউ আমাকে ওবাড়িতে ভালোবাসতোনা।সবাই আমাকে মারতো বকা দিতো।আমার অনেক কষ্ট হতোমা।আমি কালো বলে আমাকে সবাই দূরে দূরে রাখতো।জানো মা আমার খুব ইচ্ছা করতো তোমার কোলে এভাবে মাথা রেখে কাঁদতে।কিন্তু তুমিতো তখন ছিলেনা।

জানো মা আমাকে যখন মামি মারতো তখন মা মা বলে কাঁদতাম।কিন্তু কেউ আসতো আমাকে আদর করতে।মা তুমিই বলো আমি কালো বলে কি মানুষ না।জানো মা যখন বাড়িতে অনেক ভালো কিছু রান্না হতো আমার ও ইচ্ছা করতো খেতে কিন্তু খেলে মামি মারতো।এই সব কিছুর জন্য মনে হতো তুমি তোমার সুখের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেছো।কিন্তু বিশ্বাস করো মা।আমিও তোমাকে প্রতিটা মূহূর্তে মনে করেছি।
শুভ্রতার কান্না শুনে শারমীন ও কেঁদে যাচ্ছেন।মেয়েটা তার কত কষ্টই না পেয়েছে।শারমীন মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে।

বসার রুমে সোফায় বসে আছে শিশির, জাহিদ,সাবিনা,ইকবাল,মিসেস ইকবাল,মহুয়া,চাঁপা।সবার মাঝেই একটা চিন্তা কাজ করছে আর সেটা হলো শুভ্রতা আর তার মায়ের মাঝে কি হচ্ছে।তখন যখন শুভ্রতা ওর মাকে দেখেছিলো তখন ওর চোখে একটা রাগ কষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।শুভ্রতাতো প্রথমে কথা বলতেই চাইছিলোনা।শারমীনের অনেক অনুরোধে কথা বলতে রাজী হয়েছে।প্রায় ১ঘন্টার মতো তারা দুইজন উপরে।
জাহিদ:তোমার কি মনে হয় ওদের মাঝে সব আগের মতো হবে?

শিশির:কোনো সন্তানই তার মা বাবার প্রতি রেগে থাকতে পারেনা।সন্তান অন্যায় করলে যেমন মা বাবা মাফ করে।তেমন মা বাবা অন্যায় করলে সন্তান মাফ করে।আর এখানেতো আন্টির কোনো দোষ নেই।শুভ্রতা সব জানলে আমি সিওর ওদের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে।
জাহিদ:তাই যেনো হয়।শারমীন শুভ্রতার এই দুরুত্ব আর মানতে পারছিনা আমি।এভার সব ভালো হয়ে যাক তাই চাই।

কথা বলার মাঝেই শিশিররা দেখলো শুভ্রতা আর শারমীন নিচে আসছে।তাদের এক সাথে দেখে বুজা যাচ্ছে তাদের মাঝে সব ঠিক।তাদের এক সাথে দেখে সবার মুখেই হাসি ফুটলো।শুভ্রতা শারমীন নিচে আসার পর শুভ্রতা জাহীদের কাছে গেলো।জাহীদকে গিয়ে জরিয়ে ধরে বলে,
শুভ্রতা:আমাকে মাফ করে দিও বাবা।আমি তোমাকেও অনেক কষ্ট দিয়েছি।
শুভ্রতার মুখে বাবা ডাকটা শুনে জাহিদের চোখে পানি চলে আসে।জাহিদ শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

জাহিদ:তুমি আমাকে কষ্ট দেওনি মামনি।আমি সব সময় চেয়েছি তুমি আমাদের কাছে থাকো।একটা সুখি ফ্যামিলি হোক আমাদের।সেই আশাটা আজ আমার পূরন হয়েছে।
সাবিনা:যাক অবশেষে সব মান অভিমানের পালা তাহলে শেষ।
মহুয়া:হ্যা এবার সব হ্যাপি হ্যাপি।

সাবিনা:বেয়াই বেয়ান আপনারা কিন্তু আজকে যেতে পারবেন না।এই প্রথম আমাদের বাসায় আসছেন।আজ থাকতেই হবে।আর কাল আমার মেয়েকে দেখতে আসবে সেখানে আপনারা থাকলে আমার ভালো লাগবে।
শারমীন:আজ আমি এমনিও যাবোনা।আজ আমার মেয়েকে নিয়েই আমি থাকবো।
শারমীনের এমন কথা শুনে শুভ্রতার ছোট ভাই বলে উঠে,
ইসসস আপুকে পেয়ে মা আমাকে ভুলে গেছে।
শুভ্রতা ভাইয়ের এই কথা শুনে ওর গাল টেনে দিয়ে বলে,
শুভ্রতা:ভুলেনি পিচ্চি তোকে আর আমাকে নিয়েই আজকে মা সময় কাটাবে।তাইনা বলো মা।

শারমীন:হ্যা।
সাবিনা:তাহলে আমি যাই রান্না ঘরে।
চাঁপা:আমিও আইতাছি আম্মা।
সাবিনা আর মিসেস ইকবাল রান্না ঘরে চলে যায়।জাহিদ কে একটা রুমে দিয়ে আসে আর শুভ্রতার ভাইকে।শারমীন মেয়েকে নিয়ে রুমে এসে গল্প জুরে দেয়।আর শিশির আর ইকবাল যায় বাহিরে।
রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে আজকে ঘুমিয়েছে শুভ্রতা।যদিও শেষ রাতের দিকে গিয়ে শিশির ওকে নিয়ে আসছে রুমে।আসলে বউকে ছাড়া কি আর ঘুম আসে।শিশিরের ও সেই দোষা হয়েছে।
সকালে,,

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ২১

সকাল থেকে তোরজোর চলছে।আজকে মেহেদিরা আসবে মহুয়াকে দেখতে।সবাই যার যার কাজে বিজি।দুপুরের আগেই আসবে মেহেদিরা।মহুয়াকে সাজাচ্ছে শুভ্রতা।শিশির সব দিক খেয়াল রাখছে।১২টা নাগাদ মেহেদিরা আসলো।দুই পক্ষের মাঝে কথা বার্তা হলো।মেহেদি মহুয়াকে আলাদা ভাবে কথা বলতে দেওয়া হলো।সব ঠিক ঠাক করে।আগামি শুক্রুবার বিয়ে ধার্য করা হয়েছে ওদের।সব কথা মাঝে জাহিদ একটা কথা বলে উঠলো।
জাহিদ:আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
সাবিনা:হ্যা বলুন।

জাহিদ:বলছিলাম যে এই বিয়েতেই আমরা শিশির শুভ্রতার আবার বিয়ে দিলে কেমন হয়।আসলে হুট করে বিয়ে হওয়ায় আমরা কেউ ছিলামনা।একটা মাত্র মেয়ে তার বিয়ে নিয়ে অনেক ইচ্ছা আছে।
সাবিনা:আইডিয়া খারাপ না।তাহলে ফাইনাল এই শুক্রুবার এক সাথে দুই বিয়ে হবে একটা শিশির শুভ্রতা একটা মেহেদি মহুয়া।
সবাই সাবিনার কথায় সহমত জানায়।অতয়েব আগামী শুক্রুবার হতে যাচ্ছে দুটো বিয়ে।

হৃদয়ের স্পন্দন শেষ পর্ব