চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪২

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪২
Writer Asfiya Islam Jannat

অন্তরিক্ষ তখন স্তব্ধ,শান্ত। অজস্র তারার ভিড়ে চন্দ্রপ্রভা। কনকনে বাতাস, পাতা নড়ছে মৃদু মৃদু। রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ কুকুরটি ডেকে চলেছে বহুক্ষণ হলো। এখনো শব্দ আসছে বাহির থেকে। তবে তাতে মনোযোগ ভঙ্গ হলো না নির্বাণের। সে আপন মনে ল্যাপটপে কাজ করেছে, দ্রুতগামী হাত দু’টি কি-বোর্ডের পাতায় চলতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ঠিক তখনই নাহিদ এলো নির্বাণের রুমে৷ না বলে, না কয়ে ধপ করে বসে পড়লো নির্বাণের পাশে। বত্রিশটা দাঁত প্রদর্শিত করে বিস্তৃত হাসে সে, “কি করোস?”

নির্বাণ এক ঝলক তাকায়। গম্ভীরমুখে বলে, “চোখে কম দেখা শুরু করেছিস নাকি? কাজ করছি চোখে পড়ছে না?”
নাহিদ মুখ অন্ধকার করে প্রতিবাদীর কন্ঠে বলে, “তো সেটা কি সুন্দর করে বলা যায় না? ভাবীর বেলায় কত মিষ্টি করে কথা বলোস, আমার বেলায় মুখে বিষ আসে কেন? নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য এবং সহিংসতা সৃষ্টি করছিস তুই। এটা কিন্তু ঠিক না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নির্বাণ বিরক্তি নিয়ে বলে, “এই তুই আসছিস কেন? হোস্টেলে যতদিন থাকোস ততদিন শান্তিতে যায় আমার, বাসায় আসলেই ক্যাঁচাল করোস।”
“কই তোর ভাই ঘামের পানি, নাকের পানি এক করে খেটেখুটে বাসায় ফিরেছে দুইমাস পর। আদরযত্ন করবি,ভালো-মন্দ খাওয়াবি তা না কথা শুনাচ্ছিস আমায়? কেমন ভাই তুই?”
“তুই যে কি কি করে বেরাস তা আমাকে শুনাতে আসিস না। কোন কিছু আমার অজানা না।”
নাহিদ ঘাবড়ায়, “মানে? কি জানিস তুই?”

“তোর হোস্টেল থেকে ফোন এসেছিল এটা জানাতে যে, তুই আসিফ নামের একটি ছেলের সাথে মারামারি করে পালাতক হয়েছিস।”
নাহিদ অস্ফুটস্বরে বলে, “ভাই, মাকে বলিস না কিছু প্লিজ। এবার মা জানলে, মেরেই ফেলবে আমায়।”
“দেখি!”
“দেখি মানে কি? তুই বলবি না মাকে।”
নির্বাণ চোখ ছোট ছোট করে বলে, “তুই ভালো করেই জানিস মা মারপিট পছন্দ করে না, তাও তুই এসবে যাস কেন? মেরেছিস কেন ওকে?”

“ওই শা*, আমার ফ্রেন্ড স্নেহাকে অনেকদিন ধরে উত্ত্যক্ত করছিল। রাস্তা-ঘাটে,বাসার নিচে সব জায়গায়। এমনকি সেদিন নাকি বাজারের রাস্তায় ওর হাত ধরে অসভ্যতামি করেছিল৷ সাথে আরও কাহিনী করে, যা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। স্নেহা তখন কোনমতে নিজের জান বাঁচিয়ে ফিরে আসে। আর পরে আমাদের কথাটা জানায়, খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আসিফ আমার হোস্টেলেই থাকে। তো ওকে শিক্ষা দিতে আরকি আমরা বন্ধুরা মিলে একটু….”

শেষ কথা আমতা আমতা করে বলে নাহিদ মাথা চুলকায়। নির্বাণ বলে, “গাধার বাচ্চা, এভাবে কাজ করিস কেন যে ধরা পড়ে যাস? বাঁশ দিবি ঠান্ডা মাথায়, এভাবে সাপ মরবে ঠিকই কিন্তু সেই খবর তোর বা হাত পর্যন্ত জানবে না।”
নাহিদ চোখ বড় বড় করে বলে, “এম আই ড্রিমিং ওর হোয়াট? তুই আমাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস? তুই আদৌ আমার ভাই তো?”
“নিয়ত তোর যতদিন ভালো আছে ততদিন আমার সাপোর্ট পাবি তুই। এখন সেটা যে বিষয় নিয়ে হোক না কেন। কিন্তু যেই অসৎ পথে যাবি পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতেও দ্বিধা হবে না আমার। মনে রাখিস, সবার খোঁজ-খবর কিন্তু কাছে আসে। তাই যা করবি ভেবেচিন্তে।”

নাহিদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আচ্ছা, তবে এবার হ্যাল্প কর। মা যাতে কিছু জানতে না পারে, তুই সব মিটমাট করে দে।”
নির্বাণ পুনরায় কাজে মন দিয়ে বলে, “হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবি যদি কেউ আসলেই দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দিতে সবসময় নিজের হাত ময়লা করতে হয় না। দূরে থেকে কারো অবস্থা করুণ কেন, মরণান্তিকও করা যায়।”
নাহিদ খুশি হয়ে নির্বাণকে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চুমু খায়, “ইউ আর দ্যা বেস্ট ব্রাদার ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।”
নির্বাণ মুহূর্তে নাহিদকে দূরে ঠেলে দিয়ে ছিঁটকে সরে আসে। হাত দিয়ে নিজের গাল ঘেঁষে বলে, “ইয়াক ছিহ! এসব শিখেছিস কোথা থেকে? হোস্টেলে কি এসব করে বেরাস নাকি?”

নাহিদ ভ্রু উঁচু করে তাকায়, “তোর কি আমাকে হাফ-লেডিস মনে হয়?”
নির্বাণ নিজের গাল ঘেঁষতে ঘেঁষতে বলে, “না মনে হওয়ার কারণ দেখছি না।”
“এই ভাবিস তুই আমাকে? ছিহ! আমি মেয়ে মানুষের মধ্যে ইন্টেরেস্টেড, ছেলেদের মধ্যে না।”
নির্বাণ বলল না কিছু। নাহিদ এগিয়ে এসে নির্বাণের পাশ ঘেঁষে বসেমাত্র নির্বাণ চেঁচিয়ে উঠে, “দূরে থেকে কথা বল। কাছে আসার কোন প্রয়োজন নেই।”

নাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে, “ভাবীর বেলায় তো দূর দূর করোস না, উল্টা তখন যেন তোর মনে ক্লোজাপ কাছের আসার গল্পের লিরিক্স চলে। আর আমি কাছে আসলেই যত দোষ হয়।”
নির্বাণ দাঁতে দাঁত চাপে, “বেশি কথা বলিস তুই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার থাকলে বল নাইলে ভাগ এখান থেকে।”
নাহিদ ক্যাবলাকান্তের মত প্রশস্ত হাসি হাসে। বলে,”তোর ল্যাপটপ দিবি একটু?”
“কোন খুশিতে?”

“প্রজেক্টের একটু কাজ আছে। আমারটা হোস্টেলে ফেলে আসছি, তোরটা দে না।”
নির্বাণ তপ্তশ্বাস ফেলে নিজের ফাইলগুলো আলাদা ফোল্ডারে সরিয়ে ফেললো৷ অতঃপর সাটার অফ করে ল্যাপটপটা নাহিদের নিকট দিয়ে বলে, “আধাঘন্টার মাঝে ফেরত দিয়ে যাবি।”
নাহিদ খুশি হয়ে বলে, “আচ্ছা। আয় এই খুশিতে আরেকটা চুমু দেই তোকে।”
নির্বাণ চেঁচিয়ে উঠতেই নাহিদ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে দৌড়ে পালায়। আপাতত তার যা দরকার ছিল তা সে পেয়ে গিয়েছে। নির্বাণ অপ্রসন্নতার সাথে সেদিক একবার তাকায়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনরায় মাথা চাড়া দিতেই গা ঘিন ঘিন করে উঠে তার। বিছানা ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে, একবার জায়গায়টা না ধুঁয়ে তার শান্তি হবে না। ভাগ্যিস, স্পর্শীর বেলায় তার খুঁতখুঁতে ভাবটা কম নাহলে দিনে কতবার যে তাকে ওয়াশরুমে দৌড়াতে হতো কে জানে।

মাঝে দুই দিন কাটে। সায়াহ্নের প্রহর শেষে তিমিরাচ্ছন্ন আকাশের দেখা মিলে। চাঁদ মুখ লুকায় মেঘের আঁচলে, ধ্রুবতারার রাজত্ব তখন। বাতাসের অস্তিত্ব এই আছে তো এই নেই। অর্ধ-নিদ্রামগ্রতায় ডুবন্ত নগরীর কোথাও বাতি জ্বলে, কোথাও জ্বলে না। হরিদ্রাভ আলোয় রাঙ্গা রাস্তায় গাড়ি চলছে বিরতিহীন, শা শা শব্দ করে। ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। দশের ঘর পেরিয়েছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। গাবতলীর মাজার রোডে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে উবার আসে থামে। উবার থেকে নেমে পড়ার পরমুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীকে নিয়ে বাসে উঠে পড়ে। পিছে পিছে উঠে নাহিদ,স্পৃহাও। গন্তব্য তাদের কক্সবাজার। যদিও প্ল্যান হয়েছিল নির্বাণ আর স্পর্শী একাই যাবে কিন্তু শেষ মুহূর্তে নাহিদও যাবে জানায় আর নির্বাণের সাথে টিকেট কেটে ফেলে। তবে সে ভুলবশত দুইটা টিকেট কেটে ফেলে। টিকেটের টাকা রিফান্ড হবে না বলে নির্বাণ স্পৃহাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। বলা বাহুল্য, স্পৃহার কথা নাহিদই খুব সুক্ষ্ণভাবে নির্বাণের মাথায় ডুকিয়েছিল। পরবর্তীতে নির্বাণ নিজ হতেই মিজানের সাথে কথা বলে স্পৃহাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে নেয়। স্পৃহার যেহেতু এডমিশন টেস্ট শেষ হয়ে গিয়েছিল সেহেতু সেও আর নাকচ করেনি যাওয়ার জন্য।

নিজ সিট খুঁজে পেতেই স্পর্শী জানালার ধারে গিয়ে বসে। বদ্ধ জানালার ভিতর দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে সে। তার আসার একদম ছিল না কিন্তু বাবার উপর কথা বলতে না পারায় অগত্যা আসতে হলো তাকে। কিন্তু সে তখনও রুষ্ট নির্বাণের সাথে। খামাখা এত টাকা খরচ কেন করতে গেল সে? পড়ে করলে কি হতো না? নির্বাণ ব্যাগপত্র উপরে তুলে রেখে স্পর্শীর পাশে এসে বসতেই আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো স্পর্শী৷ সে ঘাড় ঘুরে একবার তাকালো অতঃপর মাথা উঁচু করে স্পৃহার অবস্থান একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল। তাদের থেকে বেশ কয়েক সিট পড়ে স্পৃহা বসেছে বলে তেমন দেখা যাচ্ছে না তাকে। নির্বাণ বিষয়টা বুঝে বলে, “স্পৃহা, নাহিদ একসাথেই বসেছে চিন্তা নেই। নাহিদকে বলেছি স্পৃহার খেয়াল রাখতে।”
স্পর্শী শান্ত চোখে তাকায়, মৌনাবলম্বন করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় ব্যবধানে। নীরবতাই যেন প্রকাশ করে দিচ্ছে স্পর্শীর অভিমানের পাল্লা ভারী কতটুকু। নির্বাণও কথা বাড়ায় না, অপেক্ষা করে গাড়ি ছাড়ার।

হাইওয়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি চলছে নিজ গন্তব্যে। পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে রাশি রাশি কৃষ্ণমেঘ। বাসের ভিতরে আলো জ্বলছে টিমটিম করে। শান্ত,কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। অনেকে ঘুমিয়ে পড়ছে, অনেকে তখনও জাগ্রত। নাহিদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে স্পৃহার দিকে তাকায়। স্পৃহা আঁখিপল্লব এক করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে শুয়ে আছে। অভিব্যক্তি শূণ্য প্রায়। নাহিদ ঠোঁট কামড়ালো। আনমনে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “মেয়েটাকে কি আমি গান শোনার নিজের পাশে বসিয়েছি নাকি? কই ভাবলাম একটু কথা হবে, হাসি-মজা হবে, সুযোগ হবে তা না ম্যাডাম কানে ইয়ারফোন গুঁজে আপন দুনিয়ায় মগ্ন। বলি কি আমার কোন দাম নেই তার কাছে? এত অবজ্ঞা কেন আমার প্রতি তার? একটু আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দুটো কথা বললে কি হয়?”

মনে মনে তীব্র আক্ষেপ প্রকাশ করে নাহিদ হাত ডান দিকে উঠায় আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্য। ঘটনা এক ঘটে তখনই। নাহিদের হাতের ডগায় ইয়ারফোনের বাড়তি অংশ আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে যায়। সে দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে আসতে নিলে খুব জোড়ে টান খায় আর স্পৃহার কান থেকে ইয়ারফোনটি ছিঁটকে সামনের সিটে বারি খায়। স্পৃহা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চশমার মধ্য দিয়েই চোখ বড় বড় করে তাকায় নাহিদের পানে। ঘটনাক্রমে নাহিদ তখন হতবুদ্ধি, হতবিহ্বল এবং অস্ফুট কন্ঠস্বর, “আ’ম সরি! আমি এটা ইচ্ছে করে করিনি, হুট করে হয়ে গেল এমন।”

স্পৃহার চোখ ছোট হলো, “আচ্ছা সমস্যা নেই।”
কথাটা বলে কোলে নিষ্প্রাণ অবস্থায় পড়ে থাকা ইয়ারফোন কুড়িয়ে পুনরায় কানে গুঁজে নেয়। কিন্তু এবার আর তার ভিতর থেকে কোন ধ্বনি তরঙ্গিত হয় না। বন্ধ হয়ে থাকে। ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়, নেত্রপল্লব খুলে ইয়ারফোনের দিকে তাকায় সে৷ মোবাইল ঘেটে কতক্ষণ ইয়ারফোনে বারি দেয় চালু হওয়ার আশায়। কিন্তু অবস্থায় পরিবর্তন আসে না। নাহিদ স্পৃহার কর্মকান্ড দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোন সমস্যা?”
“ইয়ারফোন চলছে না, নষ্ট হয়ে গিয়েছে বোধহয়।”

কথাটা শুনে নাহিদের মন হৃষ্টচিত্তে নেচে উঠে। কাজটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও লাভ তারই হয়েছে। নাহিদ মনে মনে বলে, “একদম ঠিক হয়েছে। এতক্ষণ থার্ড পার্সন হয়ে ছিল শা*, ইন্তেকাল করে পুণ্যের কাজই করেছে।”
তবে মুখে দুঃখী ভাব এনে নাহিদ বলে অন্য কথা, “অহ আচ্ছা, সরি! আমার জন্য হলো এটা।”
স্পৃহা বলে, “প্যারা নেই। তা আপনার কাছে ইয়ারফোন হবে? আমার আবার যাত্রার সময় গান না হলে চলে না।”

নাহিদ তার পরিহিত জ্যাকেটের ডান পকেটে হাত দেয়, এক জোড়া ব্লুটুথ ইয়ারপোডস পড়ে আছে ভিতরে। তবে সে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে অস্বীকৃতি জানায়, “না নেই। তাড়াহুড়ায় আনতে ভুলে গিয়েছি।”
স্পৃহার মুখ ছোট হয়ে এলো। নাহিদ তা দেখে কথা অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করে, সাথে স্পৃহাকে কম্ফোর্ট ফিল করানোর। নাহিদ মজার মানুষ হওয়ায় এক দুই কথায় আড্ডা জমাতেও সক্ষম হয় সে। জড়তা কাটে স্পৃহার, রাজ্যের কথা জুড়ে যায় দুইজনের মাঝে। বাকি যাত্রা স্পৃহার কেমন গেল জানা নেই তবে নাহিদের বেশ ভালোই কাটলো।

“তোমার রাগ করার কারণটা কোথায়? আসতে চাওনি কেন?”
নির্বাণের প্রশ্ন শুনে স্পর্শী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলে, “সেটা বলে লাভ কি এখন? হচ্ছে তো সব আপনার কথা অনুযায়ী, আমার কথা দাম আছে নাকি কোন?”
“তুমি বলেছ আমায় কিছু? না বললে বুঝব কিভাবে? অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিলে?”
স্পর্শী রাগান্বিত কন্ঠে বলে, “না!”
নির্বাণ প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, “তাহলে? সমস্যা কোথায়?”
স্পর্শী কথা পেটে দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে, “আপনি খামাখা এত খরচ এখন কেন করতে গেলেন বলুন তো? পরে গেলে হতো না?”

নির্বাণ ভ্রু কুঞ্চিত করে, “হঠাৎ এই কথা উঠল কেন? কেউ কি কিছু বলেছে তোমায়?”
“কে কি বলবে? আমি নিজ থেকে বলছি। মাত্র জব ছেড়েছেন আপনি আর এখনই…”
বাকিটুকু আর না বলে চুপ করে যায়। বাক্য শেষ করতে জড়তা কাজ করে মনে। নির্বাণ স্পর্শীর কথার অর্থ বুঝতে পেরে রসিকতার সুরে বলে, “আদর্শ স্ত্রী হওয়ার ট্রেনিং নিচ্ছ নাকি? এখন থেকেই জামাইয়ের খরচের হিসাব রাখছো? নট বেড! আমার কাছে আসার এত তাড়া তোমার? আগে জানতাম না তো।”

স্পর্শী ফুঁসে ওঠে বলে, “মজা নিচ্ছেন? বেশ! সংসারই করবো না আপনার সাথে আর, যান গিয়ে নতুন বউ খুঁজে নিন। সাক্ষী আমি হবো নে।”
নির্বাণ স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “আমি অন্যের হলে তুমি সহ্য করতে পারবে সে-টা? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে এখনই বাসের মধ্যে কাউকে তুলে নিয়ে ঝটপট রেজিস্ট্রার করে ফেলব আর হানিমুনটা একবারে কক্সবাজারেই সেরে আসব। কি বল?”

স্পর্শী এবার কাবু হয়। আঘাতপ্রাপ্ত বক্ষঃস্থলে,চিত্তে দগ্ধের কালসিটে দাগ পড়ে। কণ্ঠনালী ধরে আসতে শুরু করে, নয়ন হয় নম। কম্পিত কণ্ঠ কিন্তু প্রচন্ড শাণিত শোনায়, “করে দেখেন না এমন একবার, হাওয়ায় মিইয়ে যেতে সময় লাগবে না আমার।”
নির্বাণ দৃষ্টি শান্ত হয়। উপলব্ধি হয় মজা করতে গিয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে। নির্বাণ এক হাত দিয়ে স্পর্শীকে নিজের বুকে টেনে নেয়। মাথায় টানা কাপড়ের উপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “যেখানে কৃষ্ণকণ্যার মোহ কাটিয়ে উঠার সাধ্য দুর্ধর্ষ রাজার পর্যন্ত নেই সেখানে আমি অনাড়ম্বর একজন। কিভাবে এই দুঃসাহসিকতা দেখাই বল?”

স্পর্শী চোখ বুজে নেয়, কার্নিশ ঘেঁষে পড়ে এক ফোঁটা নোনাজল। শ্যামবর্ণের অধিকারী হওয়ায় শৈশব যার কেটেছিল সকলের তুচ্ছতাচ্ছিল্যে, শেষে কি-না সেই জায়গা পেয়েছে অন্যের রাজ্যের রানির আসনে৷ এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি আর হতে পারে? নির্বাণকে আঁকড়ে ধরে স্পর্শী। নির্বাণ তা দেখে হাসে, “আর অভিমান কর না। নাহলে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে। আর তোমার বরের চাকরি গিয়েছে তো কি হয়েছে? তার যে দুইটা রেস্টুরেন্ট আছে ভুলে গিয়েছ? সে সারাজীবন বসে থাকলেও ভালোই চলতে পারবে। কোন সমস্যা হবে না, তাই এসব নিয়ে আর ভেবো না। ইঞ্জয় দ্যা জার্নি,ফিল দ্যা মোমেন্ট। এই সময় কিন্তু আর ফিরে আসবে না।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪১

স্পর্শী ছোট করে ‘হুম’ বলে। সে আপাতত মগ্ন প্রিয় মানুষটির উষ্ণ আলিঙ্গনে। নির্বাণ স্পর্শীকে আগলে নিয়ে বলে, “ঘুমোও! আমি লাইট অফ করে দিতে বলছি।”

চৈতালি পূর্ণিমা পর্ব ৪৩