সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪০

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪০
লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

প্রকৃতি যখন দ্যুতির ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল তখনই হসপিটালের করিডোরে এসে পৌঁছায় তূর্য, শ্রেয়া,প্রিয়ু। মেহরিমা চৌধুরী থ মে’রে বসে আছেন। পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ত্রিহা। শ্রেয়া জড়তা,শঙ্কা নিয়ে ওনার কাছে এগিয়ে আসল। তূর্য গিয়েছে ডাক্তারের কাছে।

অসহায় চোখে শাশুড়ির অশ্রু বিসর্জন দেওয়া দেখছে শ্রেয়া। খারাপ লাগছে ওর। ও কেন আরেকটু হালকা করতে পারলো না নুরুল চৌধুরীর বুকে চেপে থাকা কষ্টের ভার?এই ওজন সইতে না পেরেই যেন আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কখনও তিনি মুখ খুলে ছোট বাচ্চাদের মতোন আবদার করতে পারলেন না আমার ছেলেদের আগের ন্যায় ফেরত চাই। কিন্তু শ্রেয়া ঠিকই উপলব্ধি করেছে ওনার কথাগুলো কতটা আর্তনাদ মিশেছিল। ত্রিহা ওকে দেখে নিজের জায়গা ছেড়ে, ইশারা করলো বসার জন্য। মাথা নাড়িয়ে না জানালো সে। ত্রিহা শুনলো না। হাত ধরে বসিয়ে দিল। তাঁর মতে মানুষের বিপদ কালে পাশে দাঁড়ালে প্রিয় হয়ে উঠা যায়। প্রিয় না হলেও কমপক্ষে মনে কৃতজ্ঞতার একটা স্থান সৃষ্ট করা যায়। শ্রেয়া কিছু সময় পার করে মিনমিনে কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ আম্মা। কাঁদবেন না। বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন। ‘
মেহরিমা ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলেন। চোখ মুখে বিধস্ত ভাব। কোনো কথা বলতে মন চাইছে না ওনার। তবুও কাতরস্বরে বলে উঠলেন,

‘তূর্য কে বলো তোহাশ কে কল দিতে। দরকার হলে আমি সেই বাড়ি ছেড়ে দেবো। আমার স্বামীর প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন মুছে যাক তা আমি চাই না। যে ভালোবাসা হারায় সেই বুঝে,তার স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে রাখতে না পারার যন্ত্রণা টা ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। আমার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে উনি ছেলের সাথে এত বছর যোগাযোগ করলেন না। আসলেই সৎ সৎ-ই হয়। যতই একদম বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলো না কেন কখনও সৎ তকমা মুছে যাবে না।

আপন মা হাজার বার মা’রলেও তাতে সমাজের বা ছেলে মেয়ের কিছু আসে যায় না,সেক্ষেত্রে এটা শাসন। সৎ মা যদি একটু উচ্চ আওয়াজও করে তাহলে ধরেই নেয় মানুষ সতীনের সন্তান সহ্য করতে পারে না। সব সৎ মা আবার ভালো হয় না। কেউ কেউ হয়। আমি হয়ত সেই কেউ এর তালিকায় যুক্ত হতে পারি নি। আরিয়ানার যত কাছে যেতে চেয়েছি আমাকে সৎ শাশুড়ি ভেবে ততটাই অবহেলা, দোষ দিয়েছে। তোমার আপন শাশুড়ি হয়েও ভালো হতে পারলাম না। খারাপই চাইলাম তোমার। তার মানে আমি সত্যিই খারাপ। ভালো স্ত্রী, ভালো মা, ভালো শাশুড়ি কিছুই হতে পারি নি। এতটাই নিচু মনের হয়ে গিয়েছিলাম যে এতিম মেয়েটাকেও আঘা’ত করেছি। এটারই শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে আল্লাহ। ‘

শ্রেয়ার বাক শক্তি হারিয়ে ফেলল খানিক সময়ের জন্য। নিস্তব্ধ,অটল চাহনি মেহরিমার দিক। একটা মানুষ কি করে পারে দোষ না করেও নিজের উপর নিয়ে নিতে সবটা?মা হয়ত এমনই হয়। কোনো নিষ্ঠুরতা,স্বার্থপরতা নেই। আছে কেবল মায়া। আচ্ছা তোহাশ কি যোজন দূরে থেকে কখনও অনুভব করেছে সে কতটা জঘ’ন্য ব্যবহার করেছিল মা’য়ের সঙ্গে? কতটা ক্ষত বিক্ষত করেছে মা- বাবার মন?আরিয়ানা কি আঁচ করতে পেরেছে নিজের ভুল নাকি সবকিছুই তার ইচ্ছেকৃত ছিল?বুক ফেটে কান্না আসার উপক্রম শ্রেয়ার। কন্ঠনালি কাঁপছে। নিজেকে সামলে ধাতস্থ হলো।

‘ আপনি কোনো দো’ষ করেন নি। বরং তোহাশ ভাইয়া নিজের কারণেই মা’য়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি ছোট নাহলে আমার মা’কে আগলে রাখতাম,তাহলে বাবা মা’রতে পারতেন না। যে বাবা মা হারায় তারাই মূল্য বুঝে। এ পৃথিবীতে বাবা মা’র মতো নিঃস্বার্থ ভাবে কেউ ভালোবাসে না। অন্য কেউ ভালোবাসলেও সেটা মানুষ ভাগ্য ভালো বলে পায়। ‘
শ্রেয়ার নরম,আফসোসের স্বর কর্ণপাত হওয়া মাত্র মেহরিমা অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে পড়লেন। কিছু বলতে পারলেন না তিনি। তূর্য ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতেই ওঠে দাঁড়ালেন।

শ্রেয়ার দিকে এক নজর চেয়ে মেহরিমা চৌধুরীর দিকে তাকালো তূর্য। ক্লান্ত মেশানো গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ ভাই আসছে। গতকাল ফ্লাইটে ওঠার আগে আমাকে ফোন দিয়েছিল। পরিবার সমেতই আসছে। এখন তাকে চৌধুরী বাড়িতে কিভাবে আনবে সেটা তোমরা ভালো জানো। ‘
মেহরিমা চমকে উঠলেন। বললেন,’ হাসপাতালে আসবে?’
তূর্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,’ আমি না করেছি। বর্তমানে মিসেস আরিয়ানার চাচার বাড়িতে আছেন। আমি চাই না হাসপাতালে কোনো সিন ক্রিয়েট হোক। বাবার অবস্থা এখন কিছু টা ভালো। যা করার,বলার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ‘

একদিন পর কিছুটা সুস্থ হয় নুরুল চৌধুরী। ওইদিকে ছেলের অবস্থা দেখে ফাতেমা চৌধুরীও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তূর্যর উপর ভরসা রেখে মেহরিমা বাড়িতে চলে গিয়েছেন। শ্রেয়া,প্রিয়ু,আয়ুশ হসপিটালেই রয়ে গেল। করিডোরে পাতানো বেঞ্চিতে বসে ঘুমে আয়ুশের কাঁধে ঢলে পড়েছে প্রিয়ু। অপরদিকে শ্রেয়া বসে বসে ভাবছে কিভাবে এত এত মনোমালিন্যের দেয়াল ভেঙে এক হবে পুরো পরিবার। একই ছাদের নিচে কত মানুষ বাস করে অথচ সবার মনের মিলন থাকে না। বিচ্ছেদ সহজ, সন্ধি কঠিন। খুবই কঠিন।

একজন নার্স এসে জানালো তূর্যকে ডাকছেন নুরুল চৌধুরী, সাথে শ্রেয়াকেও। তূর্যর পিছন পিছন শ্রেয়া কেবিনে ঢুকে পড়ে। ওদের দেখে অচিরেই রোগা চেহারাটা হাসোজ্জল হয়ে ওঠে নুরুল চৌধুরীর। দুর্বল কন্ঠে হাঁক ছাড়লেন,’ কাছে আয় তোরা। ‘
তূর্য চেয়ার টেনে বাবার কাছাকাছি বসলো। শ্রেয়া একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। নুরুল চৌধুরী আবারও মুখ খুললেন। বললেন,’ বাবার কাছে এসে বস। ‘
তূর্যর দিকে এক পলক তাকিয়ে তার পাশের টুলে বসলো শ্রেয়া। ওদের দু’জনের দিকে চেয়ে দুই অধর প্রসারিত করলেন তিনি।

‘ জিতেই গেলেন। নিজের অভিমান ভেঙে ছেলেকে ডাকলেন না,কিন্তু সেই অভিমানের ভারে দুনিয়া ছাড়তে রাজি আছেন। ‘
তাচ্ছিল্যমাখা কন্ঠে একেকটা বাক্য উচ্চারণ করলো তূর্য। শ্রেয়া আঁতকে উঠলো। একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে বলা ঠিক? কিন্তু নুরুল চৌধুরীর হাসি দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল ও। তিনি খোশমেজাজে ওকে লক্ষ্য করে বললো,
‘ এই কথাগুলোতে কি আছে জানিস মা?কষ্ট, অভিমান, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়,ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান। তোর স্বামী আমাকে এত ভালোবাসে কিন্তু প্রকাশ করে না। ওর কি বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে লজ্জা লাগে?’
শ্রেয়া সাহসের কাজ করে বসলো। তৎক্ষনাৎ বলে ফেলল,’ হয়ত। ‘

নিমিষেই তূর্য রোষপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলো ওর উপর। দৃষ্টিতে দমে গেল ও। নুরুল চৌধুরী মৃদু ধ’মকে বললেন,
‘ ওকে চোখ রাঙালে কেন?আমার সহজ সরল মেয়েটাকে একদম ভয় দেখাবে না। যা সত্য তা-ই বলেছে ও। শুনলাম তোমার ভাই এসেছে? সম্পত্তির ভাগ নিতে?’
‘ না। অফিসের কাজে এসেছে। চলে যাবে আবার৷ ‘
‘ ওকে চৌধুরী বাড়িতে নিয়ে এসো। সম্পত্তির ভাগ করবো। ওর বউকেও আসতে বলো। তাকে দেখাতে চাই ওর মতো এতিম আরও একটা মেয়ে আমার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে। সারাক্ষণ ভাবে কিভাবে সবার মন জয় করবে,ওর মতো ভাঙ্গার চেষ্টা করে নি।’

সকাল থেকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চৌধুরী বাড়িতে। শ্রেয়া ও প্রিয়ু ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছে ত্রিহার সঙ্গে। মেহরিমা ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন নিজেকে। বসার ঘর থেকে রহিমা বড় বড় পা ফেলে রান্নাঘরের দুয়ারে উপস্থিত হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
‘ নতুন বধূ,ত্রিহা,প্রিয়ু আইয়া পড়ছে। তূর্য বাবা লইয়া আইছে ওরা রে। জলদি আইয়ো। ‘
রান্না প্রায় শেষের দিকে। ত্রিহা আদুরে ভঙ্গিতে প্রিয়ুর উদ্দেশ্যে বললো,’ তোমরা যাও। আমি আসছি। ‘

সকাল থেকে প্রিয়ু,শ্রেয়া উভয়েই খুব উত্তেজিত তোহাশ ও আরিয়ানাকে দেখার জন্য। দু’জনেই হাত ধুয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। এসেই পা জোড়া থমকে গেল। অত্যন্ত সুন্দর গড়নের একটা মেয়ে কোলে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে থ্রি পিস। বাচ্চা টার বয়স বড়জোর এক কি দেড় বছর হবে। মেয়েটার পাশেই একজন সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে। শ্রেয়া হতবাক। কে বলবে এরা একই মায়ের পেটের না। তূর্য ও তোহাশের চেহারায় অনেকটাই মিল। ছোট ছোট পায়ে আরেকটু এগিয়ে আসে ও। ওর পিছন থেকে লাঠি ভর দিয়ে ফাতেমা চৌধুরী সামনে আসেন। তোহাশের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে সোফায় বসে পড়লেন। বলে উঠলেন,

‘ আরে মেহমানেরা দাঁড়ায় আছেন ক্যান?কত বছর পর আসলেন, বসেন বসেন। তূর্য বাবু ওদের বসতে বলবা না তুমি?’
প্রিয়ু মুখ টিপে হাসছে। তূর্য ধপ করে ফাতেমার পাশে বসে পড়লো। ফিসফিস করে বললো,
‘ ফাতু বাবু কেন ডাকো?দু’দিন পর বাবুর বাপ হবো। ‘
চারিধারে দৃষ্টি বুলাচ্ছে তোহাশ। দাদির খোঁচা মা’রা ও ঠিকি বুঝতে পেরেছে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে সবার সামনে। কেউই এগিয়ে এসে কথা বলছে না। না বলাটাই স্বাভাবিক। শ্রেয়া সামনের মানুষ টার মনের হাল বুঝে নম্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ কেমন আছেন ভাইয়া?’

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৩৯

আরিয়ানা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তোহাশ মুখে হাসি টেনে উত্তর দেয়, ‘ ভালো। তুমি তূর্যর বউ,রাইট?’
‘ হুম আমার শান্তশিষ্ট, প্যাঁচ বিহীন ভালো মনের বউ। ‘— সোফায় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে বলে তূর্য।

সন্ধি হৃদয়ে হৃদয়ে পর্ব ৪১