চন্দ্রাস্ত পর্ব ৭

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৭
ফারহানা কবীর মানাল

সকাল হয়েছে অনেক আগে। ঘড়িতে বেলা এগারোটার মতো বাজে। চারদিকে রোদ চকচক করছে। মিলি নিজের বিছানায় এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। তার চোখে-মুখে আঁচড়ের দাগ। যেন কারোর সাথে ধস্তাধস্তি হয়েছে। দারোগা সাহেব বললেন, “বাড়িতে আপনারা কে কে থাকেন?”
মানিক মিয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধরা গলায় বললেন, “আমরা চারজন থাকি। রোহান, আমি, মিলি আর ওর মা।”

“এর বাইরে কেউ থাকে না? আপনার ছেলে বউ? তারা কোথায় থাকে?”
“ছেলে মা’রা গেছে। ওর বউই ওকে খু’ন করেছিল।”
“সকাল থেকে কোথায় ছিলেন? কোন ধরনের চিৎকারে আওয়াজ শুনতে পাননি?”
“বাড়িতে ছিলাম না আমি। কাজের জন্য ভোর ভোর বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ফিরে এসে দেখি এসব কিছু হয়েছে। তাই আপনাদের কল দিয়েছি।”
“আপনার মেয়ের সাথে কারো কোন শত্রুতা আছে?”
“আমার জানা মতে নেই, আর থাকলেও আমি জানি না।”
দারোগা সাহেব কনস্টেবল ছেলেটার দিকে তাকালেন। হাতের ইশারা দিয়ে বললেন, “ঘরের সবটা খুব ভালো করে পরীক্ষা করবে। যেন কিছু বাদ না থাকে। মানিক সাহেব, আপনার স্ত্রী কোথায়?”
মানিক মিয়া তার বউকে ডেকে পাঠালো। ভদ্রমহিলা একহাত ঘোমটা টেনে ঘরের ভেতর ঢুকল। দারোগা সাহেব বললেন, “সকাল থেকে কোথায় ছিলেন? মেয়ের এই অবস্থা, অথচ আপনি কিছু জানতেই পারলেন না। অদ্ভুত ব্যাপার!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে কান্নাভেজা গলায় বলল, “বাড়িতে ছিলাম না। রোহানকে স্কুলে দিতে গিয়েছিলাম। এমন কিছু হবে জানলে কখনো যেতাম না।”
“তা বেশ ভালো। সকালে কেউ আপনার মেয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিল?”
“ওর কোন এক বান্ধবী এসেছিল। বলল- নতুন পরিচয় হয়েছে। মিলি আসতে বলেছে। মিলি নিজেই ওকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেছিল।”
“আপনি তাকে চেনেন? বা তার নাম ঠিকানা কিছু জানেন?”
“আগে কখনও দেখিনি। তবে ভালো মেয়ে মনে হলো। হেসে হেসে আমার সাথে কথা বলল। একটু তাড়ায় ছিলাম তাই নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“আপনাদের মেয়ে মিলির ফোনের ওয়ালপেপারে একটা ছেলের ছবি দেয়া। ছেলেটা কে?”
সে এগিয়ে এসে ছবি দেখল। আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলল, “এটা তো হাবিবের ছবি!”
“হাবিব কে? আপনার মেয়ের প্রেমিক না স্বামী?”
ভদ্রমহিলা ডানে বামে মাথা দোলােতে লাগল। মানিক মিয়া বললেন, “হাবিব আমার ছেলের শালা। বিবাহিত ছেলে। তাকে আমার মেয়ে তাকে পছন্দ করত। বিয়ে করতে চাইত।”

“একতরফা?”
“যতদূর জানি, ঘটনা এক তরফা। ওর সাথে হাবিবের কোন সম্পর্ক নেই।”
“তা কিভাবে সম্ভব? ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে দু’জন একই টেবিলে বসে আছে।”
“এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।”
“ছেলে মেয়ের দিকে একটু নজর দিতে হয়, ছেড়ে রেখে দিলে এমনই হবে।”
মানিক মিয়া কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে রইলেন। ঠিক তখনই মহিউদ্দিন সাহেব, হাবিব আর নাইমা ঘরের ভেতর ঢুকল। হাবিব নাইমাকে সাথে আনতে চায়নি। সে জেদ ধরে এসেছে। দারোগা সাহেব বললেন, “আপনিই মিস্টার হাবিব?”
হাবিব বলল, “জ্বি আমি। কেন জানতে চাইছেন?”

“এই মেয়ের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক?”
“তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
“সম্পর্ক নেই বিধায় একই টেবিলে বসে আছেন। সম্পর্ক থাকলে কি করতেন?”
হাবিব জবাব দিলো না। বিরক্তি নিঃশ্বাস ফেলল। দারোগা সাহেব বললেন, “ধরে নিচ্ছি এটা খু’ন। লা’শ নিয়ে যাচ্ছি। তদন্ত চলতে থাকবে, পোস্ট’ম’র্টে’ম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কিছুদিন আপনারা শহরের বাইরে যাবেন না। হাবিব সাহেব আপনিও না।”
মানিক মিয়া বললেন, “এসব কে করল? কেন করল?” তার গলার স্বর মিইয়ে গেছে। যেন তিনি খুব ভেঙে পড়েছেন। পুলিশেরা লা’শ নিয়ে চলে গেল। তারা বেরিয়ে যাবার পরপরই নাইমা বলল, “মিলি আপুকে প্রথম কে দেখেছেন?”
মিলি মা বলল, “তোমাকে বলতে যাব কেন? কে তুমি?”
নাইমা খুব শান্ত গলায় বলল, “আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি কি চান না খু’নি ধরা পড়ুক? তার যথাযথ শা’স্তি হোক।”

“এসব কাজ পুলিশের। তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। বাচ্চা মেয়ে তার তেজ দেখ, কথার ধরন শোন, যেন পাকা গোয়েন্দা।”
সে আর কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের ভেতর দেখতে লাগল। মহিউদ্দিন সাহেব, হাবিব আর মানিক মিয়া কথা বলছে। কি বলছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তারা খুব নিচু গলায় কথা বলছে। মানিক মিয়া বললেন, “দারোগা সাহেব, তোমার সাথে মিলির একটা ছবি দেখাল। ওর সাথে তোমার কি সম্পর্ক বাবা?”
হাবিব তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সবটা শোনার পর তিনি একটু নড়ে উঠলেন। অস্পষ্ট গলায় বললেন, “আল্লাহ আমায় কোন পা’পের শা’স্তি দিচ্ছেন, আল্লাহই ভালো জানেন। এসব দেখার চেয়ে ম’রে যাওয়া অনেক ভালো।”
মহিউদ্দিন সাহেব তার কাঁধে হাত রাখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। নাইমা বলল, “অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। দেখা যাক পুলিশ কি করে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলে সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি কি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?”

মানিক মিয়া বিস্মিত ভঙ্গিতে বললেন, “কি জানতে চাও মা?”
“এ ক’দিন মিলি আপুর ব্যবহার কেমন ছিল? দুশ্চিন্তায় থাকত নাকি অন্য রকমের?”
“জানোই তো, আমি তেমন একটা বাড়িতে থাকি না। মিলিও নিজের মনমতো চলাফেরা করে। তবে একটা ব্যাপার নিয়ে ও খুব চিন্তায় ছিল।”
“কি ব্যাপার নিয়ে?”
“মিলি হাবিবকে পছন্দ করে- কথাটা আমি কয়েকদিন আগেই জেনেছি। জানার পর ওর বিয়ে ঠিক করি। আমার এক বন্ধু আগেই সম্মন্ধ এনেছিল। ঘটনা জানার পর তার সাথে কথা বললাম, তড়িঘড়ি করে ওরা মিলিকে দেখতে এলো। দেখতে আসার ব্যাপারটা মিলি ভালোভাবে নিতে পারেনি। ঝগড়া ঝামেলা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পাঁচদিন পর ফিরেছে। জিজ্ঞেস করলে বলেছে- বন্ধুর বাসায় ছিল। কিন্তু এখন সত্যিটা জানলাম।”
“বাড়ির ফেরার পর কি করত? কেমন আচরণ করত?”
“গম্ভীর হয়ে থাকত। দু একবার ওর মায়ের সাথে খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করেছে।”
“মিলি আপুর বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“কয়েকজনকে চিনি। এর বাইরে কি করে বলতে পারব না।”

নাইমা প্রশ্ন থামালো। মিলির ঘরে দেখল- ঘর খোলা। কনস্টেবল দরজা টেনে দিয়ে গেছে, তবে তালা লাগায়নি। সে দ্রুত ঘরে ঢুকল। সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। টেবিলের ওপর রাখা বইয়ের পাতা উল্টে দেখতে লাগল।
মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “যা হবার হয়ে গেছে। এখন আরর কিছু করার নেই। আল্লাহ চাইলে খু’নি ধরা পড়বে।”
মানিক মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ইতিমধ্যে খু’নের ঘটনা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানির মতো হুহু করে লোক ডুকছে বাড়িতে। নানান আলাপ সালাপ করছে। মহিউদ্দিন সাহেব বললেন, “আমরা এখন আসি। পরে৷ আবার আসব। হাবিব যা, গিয়ে নাইমাকে ডেকে নিয়ে আয়।”
হাবিব নাইমাকে খুঁজতে গেল। সারা বাড়ি খোঁজার পর মিলির ঘরের দরজায় হাত রাখল। দরজা সরিয়ে বলল, “ডাকছি, সারা দিচ্ছিস না কেন? চলে আয়, বাড়ি ফিরতে হবে।”
নাইমা বলল, “আসছি।” ঠিক তখনই তার চোখ পড়ল ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা একজোড়া কানের দুলের ওপর। সে এগিয়ে গিয়ে কানের দুল জোড়া হাতে নিলো। শুকনো ঢোক গিলে ওটা জামার আড়ালে লুকিয়ে রাখল। সারাপথ সে আর কোন কথা বলল না। গম্ভীর মুখে নিরব হয়ে রইল।

নববী সবেমাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে। ভেজা চুল খুলে পিঠের ওপর ছড়িয়ে রেখেছে। চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ। এমন চেহারায় তাকে খুুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সে নরম পায়ে হেঁটে বিছানায় বসল। মোবাইল হাতে নিয়ে হাবিবকে কল দিয়ে বলল, “কোথায় তুমি? আম্মা বললেন- সকালে না খেয়ে বেরিয়ে গেছ।”
হাবিব বলল, “অফিসে এসেছি। চিন্তা করো না। ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেব।
“ওই বাড়িতে কি হয়েছে?”
“পরে কথা বলব নববী, একটু ব্যস্ত আছি।”
নববী আচ্ছা বলে কল কেটে দিলো। মোবাইলটা বিছানায় রাখতেই নাইমার তার ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। সে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। নববী বলল, “কি হয়েছে নাইমা? তুমি এমন করছ কেন?”
নাইমা বিছানায় বসল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “আমার কথা বাদ দাও। দৌড়ে এসেছি। তাই হাঁপিয়ে গেছি।”

“কি হয়েছে? পানি দেব? পানি পান করবে?”
“আমার কথা বাদ দাও। তার আগে বলো তুমি কোথায় গিয়েছিলে? সকালে তোমাকে বাড়িতে দেখিনি।”
নববী চিকন গলায় বলল, “ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। চেক-আপ করাতে। কেন কি হয়েছে?”
সে গলার স্বর নিচু করে বলল, “মিথ্যে বলো না। তুমি মিলি আপুুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।”
“এসব কি বলছ? আমি কেন মিলির সাথে দেখা করতে যাব?”
“কারণ যা-ই হোক। মিথ্যে বলো না। নিজেই বিপদে পড়বে। মিলি আপু মা’রা গেছে। পুলিশ তার লা’শ নিয়ে গেছে। পোস্টমর্টেম হবে। তদন্ত চলবে। আমার কথা বুঝতে পারছ?” সে তাকে কানের দুল জোড়া বের করে দেখাল। বলল, “এই দুল তোমার। ভাইয়া তোমার জন্য নিয়ে এসেছিল। গতকাল রাতেও তোমার কানে দেখেছি। এখন দেখছি না কেন?”

নববী কানে হাত দিলো। আমতা আমতা করে বলল, “খুুলে রেখেছি। আমার কাছেই আছে। তাছাড়া এই ডিজাইনের কত কানের দুল হয়।”
“আমি জানি তোমার কাছে দুল জোড়া নেই। মিথ্যে বলো না।”
নববী বালিশের নিচ থেকে তার কানের দুল জোড়া বের করল। সেগুলো নাইমার হাতে দিয়ে বলল, “এই যে আমারটা। এই কানের দুল আমার না।”
নাইমা সরু চোখে তাকাল। শান্ত গলায় বলল, “কানের দুল তোমার না হলে তুমি এমন করছ কেন? তোমাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন?”
নববী নাইমার হাত চেপে ধরল। বলল, “সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো- আমি মিলিকে আমি মা’র’নি। ওর কি হয়েছিল তা আমি জানি না। আমি তো শুধু ওকে সর্তক করতে গিয়েছিলাম।”
সে আর কিছু বলবে তার আগে দরজায় টোকা পড়ল। শরিফা বেগম বললেন, “ঘরে দরজা আটকে কি করিস? নাইমা এদিকে আয়।”

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৬

“আসছি মা। ভাবীর সাথে কথা বলছিলাম।”
“তাড়াতাড়ি আয়। আমি একটু ওদের বাড়িতে যাব। ম’রা বাড়ি রোহান কি না কি করছে।”
নববী নাইমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দু’জনের চোখেই ভয়।

চন্দ্রাস্ত পর্ব ৮