ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২২+২৩

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২২+২৩
তাজরীন ফাতিহা

কিছু মানুষের শিরা, উপশিরা, ধমনী পর্যন্ত ঘাড়ত্যাড়ামি প্রবাহিত হয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ মারওয়ান আজাদ। বউ, বাচ্চার অনুপস্থিতি তাকে বিন্দুমাত্র হতাশ করলো না, দুঃখ ছুঁতে পারলো না। স্বাভাবিক নিয়মে খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে আর বাইরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। যেন সে পিউর সিঙ্গেল পুরুষ। সে যে দুবছর বয়সী একটা পুত্রসন্তানের বাবা সেটাও বোধকরি দুইদিনে ভুলে বসে আছে। মাহাবুব আলম বড় পুত্রের সাথে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। নিশাত চলে যাওয়ার পরদিন মারওয়ানের বউ বাচ্চার প্রতি অনিহা, নির্লিপ্ততা দেখে চিল্লাচিল্লি করে প্রেশার বাড়িয়ে বিছানামুখী হয়েছেন তিনি। অথচ তার গুণধর বড় পুত্র ছিল একেবারে নির্লিপ্ত। যেন এসব কথা কানেই ঢোকেনি তার। সেই থেকে একটা শব্দও মাহাবুব আলম খরচ করেননি আর।

অন্যদিকে মারওয়ানের এইদিকে বিশেষ নজর নেই। সে সকাল সকাল বের হয়ে যায় ফেরে একেবারে রাতে। কোথায় থাকে, কোথায় খায়, কি করে তা জিজ্ঞেস করলেও তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়না। ঘরে এসেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ফোন দিয়ে একমাত্র বাবা ন্যাওটা ছেলের খোঁজ পর্যন্ত নেয়না। অতটুকু ছেলে তাকে ছাড়া কেমন আছে, কি করছে, আপাত দৃষ্টিতে নিজের স্ত্রীকে নাহয় বাদই দিলো কিন্তু সন্তানের প্রতি এরকম বিমুখ, দায়িত্বজ্ঞানহীন বাবা আর একটাও আছে কিনা সেটা আসলেই ভাবনার বিষয়।
মারওয়ান ঘরে ঢুকেই বিছানায় ঘামে ভেজা শার্ট খুলে রাখলো। তারপর হাত, পা ছড়িয়ে চোখ বুঝলো। ক্লান্তিতে চোখ বুঝে আসার সময় বুকটা ভার ভার লাগলো। মনে হচ্ছে বুকের উপর কেউ শুয়ে আছে। আচমকা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। তার বুকটা খালি। আশেপাশে তাকিয়ে কি যেন খুঁজলো। এরকম বুক বেয়ে ওঠার স্বভাব তো নাহওয়ানের। কিন্তু ও আসবে কোথা থেকে? স্বপ্ন দেখেছে সম্ভবত। মারওয়ান মাথা থেকে এসব ঝেড়ে চোখ বুঝে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাঝরাতে ঘুম ছুটে গেলে মারওয়ান উঠে বসলো। খিদে পেয়েছে তার। নিশাত চলে যাওয়ার তিনদিন হলো। দুইদিন ধরে ঘরের মানুষদের সাথে অঘোষিত যুদ্ধ চলছে তার। ঘরে খায়না সে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি কিন্তু আজ এই মাঝ রাতে খিদে লেগেছে তার। সে খাট থেকে নেমে দরজা খুলে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে বেরুলো। ঘরের সামনের লাইটের আলো উঠোনকে আলোকিত করে রেখেছে। সে ধীর পায়ে হেঁটে রান্নাঘরের দরজা খুললো। লাইট জ্বালিয়ে পাতিলের ঢাকনা উঠিয়ে দেখলো কোনো খাবার আছে কিনা? পাতিলে সামান্য ভাত ও তরকারি ছিল। মারওয়ান হাত ধুয়ে প্লেটে ভাত, তরকারি বেড়ে নিলো। রান্নাঘরের মেঝেতে বসে ভাত খেতে লাগলো।
ভাত খেয়ে প্লেট ধুয়ে রেখে দিলো। তারপর রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে দরজা আটকে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। পথিমধ্যে কারো ডাকে থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মাহদী দাঁড়ানো। মাহদী হেঁটে এসে বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

“ভাইয়া নাহওয়ান, ভাবীকে আনবে না?”
মারওয়ান লুঙ্গি ধরে বললো,
“তোর ভাবী আমাকে বলে গিয়েছিল নাকি? আমি আনবো কোন দুঃখে?”
“তোমার এতো উদাসীনতা কিন্তু ভালো নয় ভাইয়া। এতদিনের সংসারে স্ত্রী, সন্তানের প্রতি কি একটুও মায়া জন্মে নি তোমার? ভাবিকে বাদ দিলাম, নাহওয়ানকেও কি তোমার মনে পড়ে না? বাবা, মা তোমার এরকম উদ্ভট কার্যক্রমে ক্ষেপে গেছেন।”
মারওয়ান হামি দিয়ে বললো,
“আমার ঘুম পাচ্ছে। এসব বিষয়ে প্যাঁচাল পারতে ইচ্ছে করছে না। ঘুমিয়ে পড়।”
বলেই হেঁটে ঘরে চলে গেলো। মাহদী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় ভাইয়ের চলে যাওয়া দেখলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কতকিছু ভেবে গেলো। বড় ভাইয়ের মতিগতি বোঝা বড় দায়। বড় ভাই কি কোনোদিন স্বাভাবিক হবে না? এরকম রোবটের মতো স্বভাব কতদিন থাকবে? আদৌ কোনোদিন পরিবর্তন হবে? কি হবে ভবিষ্যৎ? মহান রব ফয়সালা করে দিক। আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘরে চলে গেলো।

নিশুতি রাত। গুনগুন করে কান্নার আওয়াজে ইহাবের ঘুম ভেঙে গেলো। মানহা ঘুমের ঘোরে গুনগুন করে কাঁদছে। বিষয়টা ইহাব গত রাতেও খেয়াল করেছে। আগে কাঁদতো কিনা সে জানে না। ইহাব ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো। ড্রিম লাইটের আলোতে ঘুমন্ত মানহার দিকে চাইলো। ইহাব গায়ে হাত রাখতে চেয়েও রাখলো না। মানহার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ডাকতে লাগলো,
“মানহা, এই মানহা।”
মানহা ঘুমের মধ্যেই কেঁপে উঠলো। ইহাব মানহাকে কাঁপতে দেখে কিছুটা ভয় পেলো। মানহার শরীরে হাত দিলো যেন কাঁপুনি কমে। মানহা কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে গেলো। ঘাম ছেড়ে দিয়েছে তার শরীরে। ইহাব মানহার শরীর মৃদু নাড়িয়ে আবারও ডাকলো,
“মানহা, মানহা।”
মানহা এপাশ ফিরে ইহাবের হাত জড়িয়ে ধরে বললো,

“আম্মু, আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আমার ভীষণ ভয় করছে। ওরা আবারও এসেছে।”
বলেই ইহাবের হাত শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো। ইহাব ভ্রু ভাঁজ করে চাইলো। কারা আবার এসেছে? মানহাকে ডেকেও কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। অনেকক্ষণ ধরে হাত শক্ত করে ধরায় ঝিরঝির করে উঠলো হাতখানা। হাত ছাড়াতেও পারছে না। এমনিতেই ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। অগত্যা চুপচাপ বসে রইলো।
ভোর চারটা। মানহা নড়েচড়ে উঠলো। চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুলে গেলো, দৃষ্টিতে ধরা দিলো আলো আঁধারের মিশেলে একটি ছায়ামূর্তি। যে তার সামনে ঝুঁকে রয়েছে। মানহা হকচকিয়ে গেলো। ভয়ে হাত, পা অবশ হয়ে আসলো তার। ছায়মূর্তিটি এগিয়ে আসতে নিলে মানহা ভূত ভেবে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিলো। অপরদিকে চড় খেয়ে ঘুমন্ত ইহাব বোকা বনে গেলো। মাথার নিচে একহাত রেখে কখন ঘুমে ঢুলে পড়ছিল খেয়াল নেই তার। তার ঘুমন্ত মাথা ঝুঁকে মানহার দিকে আসলে মানহা ভয় পেয়ে অপ্রত্যাশিত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। কি থেকে কি ঘটে গেলো মস্তিষ্কে সিগন্যাল দিতেই রাগে ফেটে পরলো ইহাব। মানহা কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত শোয়া থেকে উঠে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালো। পাশে তাকিয়ে দেখলো ইহাব গালে হাত দিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মানহা ঢোঁক গিলে বললো,

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
ইহাব গম্ভীর বদনে বললো,
“তুমি আমাকে থাপ্পড় দিলে কেন?”
“দুঃখিত আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম খারাপ জাতীয় কিছু। সরি।”
“সরি?? জুতা মেরে গরু দান?”
মানহা মুখ নামিয়ে বললো,
“আপনি আমার দিকে ঝুঁকে ছিলেন কেন?”
“সুখে, আমার তো সুখের কমতি নাই। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ শরীরে পুলক দিয়ে উঠছিল তো তাই ভাবলাম একটু ঝুঁকে কমাই।”
মানহা মুখ কঠিন করে বললো,
“বাজে কথা বলছেন কেন?”

“বাজে কথা? আমাকে টাচ করবেন না, এসবে আমি কমফোর্টেবল নই, কথায় কথায় গায়ে পড়েন কেন? আমার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলবেন যতদিন না আমি কমফোর্ট ফিল করি, ব্লা ব্লা।”
মানহা চোখ কুঁচকে বললো,
“কি বলতে চাইছেন সরাসরি বলুন। আমার কথা আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?”
ইহাব ঠান্ডা গলায় বললো,
“এতো ডায়ালগ দিয়ে সেই আমার গায়ে পড়ার লজিক কি ভাই?”
মানহা বিভ্রান্ত হলো। সদ্য ঘুম থেকে উঠে নিউরনে কথাগুলো সংযোগ করতে পারলো না। ঘুমের কারণে মাথা ভার ভার লাগছে। চোখ কচলে বললো,

“কিছু খেয়েছেন নাকি? কে আপনার গায়ে পড়েছে? আপনার মতো লুজ ক্যারেক্টার আমার না ওকে? চোখ সরান।”
ইহাবের রাগ আকাশ ছুঁলো। ইহাব শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
“কার ক্যারেক্টার লুজ সেটা তো দেখলামই। মুখে খালি বড় বড় কথা। সারা রাত আমার হাতের সাথে ঝাপটাঝাপটি করে এখন আমার উপর উল্টো দোষ দেয়া হচ্ছে? উফ চিপকে হাতের রস বের করে ফেলেছে মনে হয়। এই ব্যথা কতদিন থাকে কে জানে? আমার হাত, গাল কি তোমার সম্পত্তি নাকি যে যখন ইচ্ছে তখন চেপে ধরবে, থাপ্পড় মারবে? শালার অকৃতজ্ঞ মেয়ে মানুষ।”
মানহা কিছুই বুঝতে পারলো না। লোকটার হাত তার মাথার নিচে গেলো কি করে? মানহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হাতের সাথে ঝাপটাঝাপটি?”
ইহাব দুহাত এগিয়ে দিয়ে বললো,

“হ্যাঁ। না বুঝতে পারলে আসো তোমাকে ঝাপটে বুঝাই।”
মানহা দূরে সরে বললো,
“দূরে থাকুন। আপনি আপনার জায়গা ছেড়ে আমার জায়গায় এসেছেন কেন?”
“তোমার যে রাত্রের বাতিক আছে তার জন্য।”
“রাত্রের বাতিক মানে?”
“রাত্রের বাতিক মানে ঘুমের মধ্যে হাঁটা, কথা বলা, ভেউ ভেউ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।”
“ভেউ ভেউ কি?”
“গুনগুন করে কাঁদা।”
মানহা মুখ শক্ত করে রাখলো। ইহাব আবারও বললো,
“তোমার জীন টিনের আছর আছে নাকি? তাই তো বলি তোমার বাপ, ভাই বেশি রিয়েক্ট না করে আমার ঘাড়ে গোছিয়ে দিয়েছে কেন? উপ্রে উপ্রে আমাকে দেখতেই পারে না এখন মেয়ের দোষ ত্রুটি লুকিয়ে পরের ছেলের হাতে তুলে দিয়েছে। ভূত, টুতে ধরলে যেন পরের ছেলের ঘাড় আগে মটকায়। এতো সেয়ানা তোমার পরিবার!”
মানহা এবার মুখ টানটান করে আওয়াজ উঁচু করে বললো,
“আপনি কিন্তু বেশি বেশি বলছেন? না জেনে পটর পটর করছেন কেন? আমার কোনো কিছুর আছর টাছর নেই। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আমি।”

ইহাব হামি দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ তার নমুনা তো দুই রাতেই দেখিয়ে দিয়েছো।”
মানহা আর কিছু বললো না। কথায় কথা বাড়ে। তাই চুপচাপ ওযু করার জন্য বাথরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। ইহাব মানহাকে চলে যেতে দেখে পিছন থেকে বললো,
“এখন পালাচ্ছো কেন? ভাই, বোন দুটোই ধুরন্ধর। কোনো উত্তর দিতে না পারলে হয় ছ্যাঁত করে উঠবে নাহয় পালিয়ে যাবে।”
মানহা হাঁটা থামিয়ে বললো,
“পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া কিভাবে করতে হয় সেটা আপনার কাছ থেকে শেখা উচিত। দেখছেন বিষয়টা এড়িয়ে যাচ্ছি তবুও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঝগড়া করতে চাচ্ছেন। ঘুমের ঘোরে মানুষ কতকিছুই তো করে সেটা কি মনে রেখেছি? কি এক্সপ্লেইন করবো?”
বলেই মানহা গটগট করে হেঁটে বাথরুমে চলে গেলো। ইহাব গাল হাতাতে হাতাতে বললো,
“বেয়াদব মেয়ে। ছোট্ট মরিচ কিন্তু ঝাল মাগোমা!”

নাসির উদ্দিন বাজারে গিয়েছেন। নিশাত ফাঁকা উঠোনের মাঝখানে মোড়ায় বসা। চুলগুলো খুলে দেয়া। নিশাতের চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে তার মা রাবেয়া খাতুন। একটু আগে নিশাত তার ছোট বোন নাজিয়ার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো তখন রাবেয়া খাতুন জোর করে বড় মেয়ের মাথায় তেল লাগাতে বসে গেলেন। নিশাত খাটো দেখে তার চুল বড় বড় লাগে। যদিও অনেকদিন ধরে চুলের যত্ন নেয়া হয় না। বিয়ের পর থেকেই চুলের যত্ন তেমন একটা নেয়া হতো না। তারপর নাহওয়ান হওয়ার পর থেকে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আগের কথা ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে দম ছাড়লো নিশাত। নাজিয়া নাহওয়ানকে নিয়ে খেলছে। নাজিয়া এবার ক্লাস টেনে পড়ে। রাবেয়া খাতুন মেয়ের মাথায় তেল লাগাতে লাগাতে বললেন,
“নিশাত তুই আর ঢাকা যাবি না?”
নিশাত চোখ বন্ধ করে বললো,
“জানি না মা।”

রাবেয়া খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এরকম ছেলের কাছে কেন যে তোকে দিয়েছিলাম। একটা খোঁজও নিলো না। নাতিটার জন্য খারাপ লাগে। সারাদিন বাবা বাবা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানহীন বাবার কোনো খোঁজ নাই। কি যে হবে ভবিষ্যতে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।”
নিশাত কিছু না বলে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। এবাড়ি আসার পর থেকে রাতে ঘুম হয়না তার। সেদিন রাতে লোকটাকে চিঠির কথা জিজ্ঞেস করলে কোনো জবাব দেয়নি। চিঠিটা কি সত্যিই কোনো মেয়ে দিয়েছে? বিয়ের এতো বছরে কোনোদিন মারওয়ানকে চরিত্রহীন মনে হয়নি। তবে সেই চিঠি তার বিশ্বাস নাড়িয়ে দিয়েছে। বিয়ের অনেক বছর পরও কত সাধু পুরুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়। সেখানে সংসারের প্রতি উদাসীন ওই পুরুষের যে নারীঘটিত কোনো ব্যাপার নেই তার বা গ্যারান্টি কি? সে তো ঠিকই জিজ্ঞেস করেছিল চিঠিটা কার? কে দিয়েছে? কিন্তু কোনো জবাব ওই ধোঁকাবাজ পুরুষ তাকে দেয়নি। নিশাত আর যাবে না। এতোই যখন বউ, বাচ্চার প্রতি অনিহা ওই লোকের সেহেতু ওই সংসারে পড়ে থাকার কোনো মানে হয়না। চার বছর তো সে একাই সামলেছে সংসার আর না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারবে না।

নিশাত চোখ খুলে দেখলো সে কারো উরুর উপর মাথা ফেলে শুয়ে আছে। এখনো উঠোনেই বসা। মাথা ফেলে রেখেই ঘুম ঘুম চোখে বলতে লাগলো,
“মা, নাহওয়ান কই?”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো না। নিশাত বললো,
“কি হলো, আমার ছেলে কই মা?”
“মা, আমি ইকানে।”

নিশাত নিজের মাথার উপরে ছেলের কণ্ঠ শুনে ত্বরিত মাথা তুলে চাইলো। তাকিয়ে দেখলো মারওয়ানের গুরুগম্ভীর চোখমুখ। ছেলেকে কোলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশাত ভুল দেখছে ভেবে চোখ কচলালো। কিসব দেখছে সে। এই লোক এখানে আসবে কিভাবে? স্বপ্ন দেখছে না তো? নাহওয়ান বাবার গলা জড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিচফিচ করে হেঁসে দিলো। নিশাতের হাত দুটো এখনো মারওয়ানের ঠ্যাংয়ের উপর ভর দেয়া। মারওয়ান এতক্ষণে মুখ খুললো,
“নাটক শেষ হলে হাত দুটো সরাও। দেখতে ছোটখাটো হলে কি হবে ওজন তো মনে হয় একশো কেজির উপরে। হাতের ওজনই সহ্য করা যাচ্ছে না। পুরো শরীরের ভর দিলে তো আমাকে খুঁজেই পাওয়া যেতো না। ভাগ্যিস ঘুমন্ত অবস্থায় আবেগে পড়ে কোলে টোলে নেইনি। এই আলুর বস্তা তুলতে গেলে নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতো। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।”
নিশাত মুখ কঠিন করে হাত দুটো সরিয়ে নিলো। মোড়া থেকে উঠে দাড়িয়ে চুলে খোঁপা করলো। পড়নে গোল কামিজ। যা ফ্রকের মতো দেখাচ্ছে। মারওয়ান ভ্রু কুঁচকে রেখেই বললো,
“বাপের বাড়ি এসে কি নিজেকে অবিবাহিত ল্যাদা বাচ্চা মনে করছো নাকি? বাচ্চাদের মতো ফ্রক ট্রক পড়ে ঘুরছো।”
নিশাত মুখ কঠিন রেখেই বললো,

“এটা কোনো ফ্রক নয়। এটাকে গোল কামিজ বলে। আপনি এখানে কি করছেন?”
মারওয়ান পা দোলাতে দোলাতে বললো,
“জামাই আদর খেতে এসেছি।”
“মানে?”
“মানে সিম্পল। অনেকদিন জামাই আদর খাইনা। তোমার বাপ, মা তো আর আমাকে দাওয়াত দেবে না তাই নিজেই লাজ লজ্জা ভেঙে আদর খেতে এলাম।”
নিশাত ওড়না মাথায় দিয়ে কঠিন কণ্ঠে বললো,
“সেদিনের ওই ঘটনার পর আপনি জামাই আদর খেতে এসেছেন কোন মুখে? আপনাদের পুরুষদের তো একটা নারীতে হয় না। তাই সাধু সেজে ভিতরে একটা বাইরে আরেকটা নারী ঝুলিয়ে রাখেন। যেন একটা চলে গেলে আরেকটা অপশন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।”
মারওয়ান চোখ রাঙিয়ে বললো,

“মুখে লাগাম টান। ছেলের সামনে আরেকটা ফালতু কথা বললে…”
নিশাত রেগে চিল্লিয়ে বললো,
“ফালতু কথা কোনটা? সেদিনের সেই চিঠি মিথ্যা? নাকি চিঠির লেখা মিথ্যা? নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কিভাবে? কার সাথে সিনেমা দেখতে যান আপনি? কার হাতের রান্না খেতে চান আপনি? কে সেই একান্তজন আপনার? এসবের জবাব কই? আপনি দোষী নাহলে চুপ কেন? ছেলের চিন্তা আপনার করার আর কি দরকার? একদিন তো ঠিকই বাবার এই রূপ জানবে তখন আর তার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, পাগলামি থাকবে না।”

মারওয়ান রাগান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। নাহওয়ান বাবা, মাকে রাগারাগি করতে ভয়ে দেখে বাবার কোলে আরও গুটিয়ে গেলো। মারওয়ান রাগ কন্ট্রোল করে নাহওয়ানকে নিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো। শাশুড়ির কোলে ছেলেকে দিয়ে নিশাতের দিকে এগিয়ে গেলো। রাবেয়া খাতুন জামাইকে রাগতে দেখে কিছুটা ভয় পেলেন। এমনিতেই মারওয়ান শ্বশুরবাড়ি আসে না। বিয়ের পর এইবার মিলিয়ে মোটে দুবার এসেছে। তাই কন্যা জামাইয়ের সাথে তার সখ্যতা নেই। মেয়েকে চিল্লাতে শুনেছে সে। আবার মারবে টারবে নাতো মেয়েটাকে?
নিশাত ঘরে গিয়ে ফুঁসতে লাগলো। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। তার কোনো কথার দাম নেই। প্রত্যেকটা কথাকে হেলা করে এই লোক। যেন নিশাত তার কেনা পুতুল। যেমনে নাচাবে তেমনি নাচবে সে। নিশাত সচারাচর রাগে না কিন্ত রাগলে মুখ কন্ট্রোল করতে পারেনা। যা আসে তাই উগরে দেয়। কে আছে কে নেই তার ধার ধারে না। লোকটা তাকে রাগিয়ে দিয়েছে আজ। হেঁয়ালি করে সব কথাকে। যেন জোকস বলছে সে। ফালতু লোক।

দরাম করে দরজা লাগানোর শব্দে কেঁপে উঠলো নিশাত। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো মারওয়ান রাগান্বিত ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিশাত নড়লো না আগের ভঙ্গিতেই বসে থাকলো। এই লোক কি করে সেও দেখবে। দোষ করেছে সে অথচ চোখ রাঙিয়ে রাগ দেখাচ্ছে তাকে। আজকে তেড়িবেড়ি কিছু করলে কামড় বসিয়ে দেবে। রাগ অত্যধিক উঠলে মানুষকে কামড়ানোর বাতিক আছে তার।

মারওয়ান এসে নিশাতের গাল চেপে ধরলে নিশাত হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। মারওয়ান ব্যথা পেলেও শব্দ করলো না কোনো। নিশাত দুই মিনিট পর দাঁত উঠিয়ে দেখলো রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। নিশাত তবুও ফুঁসতে লাগলো। রাগ তার মোটেও কমছে না আজ। এই লোককে দেখলেই ওই চিঠির কথা মনে পড়ে যায় অমনি মাথার তালু রাগে ফেটে যায় যেন। লোকটা এখন তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তাতে তার কি? আরও কামড় দিতে হবে নাহলে রাগ পড়বে না তার। নিশাত দাঁড়ালো। মারওয়ানের বুক বরাবর তার মাথা। নিশাত কোথায় কামড়াবে ভেবে ভেবে বোতাম খোলা শার্টের ভিতরে নজর গেলো। আজ যেন তার গায়ে ডাইনি ভর করেছে। শার্টের দুইপাশের কলার ধরে বুকে কামড় বসিয়ে দিলো আবার। মারওয়ান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কামড় খাচ্ছে। নিশাতকে সরাতে গেলে কামড়ের তীব্রতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাই নিরীহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর নিশাত মুখ উঠিয়ে দেখলো বুকে লাল দাগ হয়ে গেছে। এবার একটু ঠাণ্ডা হলো সে।
বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বার এতো রেগেছে নিশাত। মারওয়ানকে প্রথম যেবার কামড় দিয়েছিল তখন মারওয়ানও তাকে পাল্টা চড় দিয়েছিল। এমনিতেই রাগের মাথা তার উপরে চড় দেয়ায় ক্ষেপে গিয়ে আরও কামড় দিয়েছিল সে। মারওয়ান সেই কামড় খেয়ে একদিন বিছানাগামী হয়েছিল। তখন থেকে মারওয়ান নিশাতের কামড়যুক্ত রাগকে ভয় পায়।

কামড় দেয়া শেষ হলে নিশাত নিজেকে শান্ত করতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মারওয়ান বললো,
“যত্তসব পাগল ছাগল। কামড়িয়ে আবার বিছানায় পাঠনোর ধান্দা। কুকুরে কামড়ালে চৌদ্দটা ইনজেকশন লাগে কিন্তু মানুষরূপী ডাইনি কামড়ালে কটা লাগে?”
নিশাত আবারও কটমট ভঙ্গিতে চাইলে মারওয়ান বললো,
“আরেকবার চোখ রাঙালে এবার আমি কামড়াবো।”
নিশাতের মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। তার ঘরের মধ্যেই বাথরুম। তাই উঠে দৌঁড়ে বাথরুমে গেলো। মারওয়ান নিশাতকে বাথরুমে যেতে দেখে নিজেও পিছুপিছু গেলো। নিশাত মাথায় হাত চেপে ধরে পানি ঢালছে। মারওয়ান পিছন থেকে নিশাতকে ধরলো। নিশাতের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। নিশাত মাত্রাতিরিক্ত রেগে গেলে মাথা যন্ত্রণায় ছটফটায়। আজও ব্যতিক্রম হয়নি। মারওয়ান পানি ঢালা শেষে মাথা মুছিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মুভ ক্রিম কপালে ডলে দিতে দিতে বললো,
“আরও জামাইকে কামড়াও। দেখেছো আল্লাহ কিভাবে শাস্তি দিলো।”
নিশাত কিছুই শুনলো না। ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলো। মারওয়ান নিশাতের ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে রইলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

মারওয়ান উঠোনের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে ছেলের জন্য আনা চিপস খাচ্ছে। নাহওয়ান নানির কাছ থেকে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ছুটে এসে বাবার পা জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমাল চিপ কাও?”
“তোর চিপস আবার কি? তুই বাকিগুলো খা।”
“ইননা। ইটা কাবো। ডাও।”
বলে বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। মারওয়ান বললো,
“আমারটার দিকে তোর নজর কেন? তোকে দিবো না।”
নাহওয়ান মায়া মায়া চেহারায় বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ডিবে না।”
“না।”
“ইট্টু কাবো।”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২১

মারওয়ান আরেকটা চিপস ছিঁড়ে ছেলেকে দিয়ে বললো,
“ইট্টু না তুই বরং বেশিই খা।”
নাহওয়ান সেটা ফেলে দিয়ে মারওয়ানের পা বেয়ে উপরে উঠে তার উরুতে বসে মারওয়ানের দিকে ফোকলা হেঁসে চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো। মারওয়ান বললো,
“কতবড় সেয়ানা ভাবা যায়!”

ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ২৪