আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৪ (২)
সাবিলা সাবি
জ্যাসপার কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ফিওনার কোমরে তার শক্ত হাত পেঁচিয়ে নিলো,আর তাকে নিজের শরীরে এমনভাবে মিশিয়ে নিলো আকাশের কোনো প্রলয় আসন্নের মতো। তার দৃঢ় বাহুর বন্ধনে ফিওনা এতটাই অবশ হয়ে গেল যে, শ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে উঠল।
জ্যাসপারের উচ্চতা এতটাই যে ফিওনার মুখ এসে ঠেকেছে তার শক্ত বক্ষের কাছে। ফিওনা চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হলো—তাকে অতিক্রম করে থাকা সেই গভীর, নিষ্ঠুর সবুজ চোখের গভীরে কী এক অজানা আকর্ষণের টান।
এক মুহূর্তে হারিয়ে গেল চারপাশের সবকিছু।
ফিওনার মনের ভেতর ধীরে ধীরে ঢেউ তুলল এক নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি, এক অভাবনীয় আকাঙ্ক্ষা। তার বুকের গতি ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠল, আর তার অনুভূতি ধোঁয়ার মতো জড়িয়ে ধরল তাকে। এই ড্রাগন মনস্টারটারটা আসলে চায় কী? তার স্পর্শে কেন এমন এক অচেনা উত্তাপে পুড়ে যাচ্ছে সে?
জ্যাসপার একদম কাছে এসে গভীর, আবেশী স্বরে বলে উঠল, “তোমাকে না বলেছিলাম আমার কাছে আসবে না? নিজেকে আমার থেকে দূরে রাখবে মনে নেই?”
ফিওনা অবাক হয়ে তাকিয়ে জবাব দিল, “কিন্তু আজকে তো আমি আপনার কাছে আসিনি; আপনি নিজেই এসেছেন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপারের চোখে এক অদ্ভুত কিছু ফুটে উঠল। “তুমি আসতে বাধ্য করেছ। কেনো করো বাধ্য? এমন এমন কাজ করো যে, আমি সামনে আসতে বাধ্য হই!”
ফিওনা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “আমি আবার কী করেছি?”
“এই যে, আমি যখন গ্লাস হাউজে ঢুকছিলাম, ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পানির ঝরনা ছড়াচ্ছে।
তখনই বুঝলাম, কিছু তো একটা ঘটেছে ছাদে। তাই ছুটে এসেছি।”
ফিওনার চোখে বিস্ময় “আপনার কেন মনে হলো এটা আমি করেছি ছাদে ?”
জ্যাসপার ঠোঁট বাঁকিয়ে এক রুক্ষ তিরস্কারে বলল, “এমন বেয়াক্কেল কাজ আর কে করবে এই মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ?”
এই কথায় ফিওনার রাগে গা জ্বলে উঠল। নিজেকে জ্যাসপারের শক্ত বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করল, কিন্তু সে আরো শক্ত করে তার সরু, কোমল দেহটিকে নিজের বুকে চেপে ধরে রাখল। এমন এক অদম্য বন্ধনে ফিওনার শরীর ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই বন্ধনের গভীরে এক প্রচণ্ড আকর্ষণের স্রোত বইছে— যা তাকে তার অজান্তেই এক গভীর তীব্র আবেশে আচ্ছন্ন করে তুলেছে।
জ্যাসপারের শক্তিশালী বাঁধনে বন্দী ফিওনা এক পলকে বলল, “ছাড়ুন আমাকে, ব্যথা পাচ্ছি।”
জ্যাসপার নিচু কণ্ঠে তির্যক ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, “ছাড়বো কেন? এটাই তো চেয়েছিলে—আমি তোমার প্রতি আকর্ষিত হয়ে তোমার কাছে আসি?”
ফিওনা বিষ্ময়ে বলল, “আপনাকে কে বলেছে যে আমি এটা চেয়েছি?”
জ্যাসপারের তীক্ষ্ণ চোখে বিদ্রুপ ফুটে উঠল “তাহলে ব্লেজার খুলে ফেলে দিয়েছ কেন? এখনও কি বুঝতে পারছো না, তুমি কী অবস্থায় আছো? একবার নিজের দিকে তাকাও।”
ফিওনার কোমড়ের পেঁচিয়ে রাখা জ্যাসপারের হাত কিছুটা শিথিল হলেও তার কর্ষিত বাঁধন পুরোপুরি মুক্ত হলো না। ফিওনা ধীরে ধীরে নিজের দেহের দিকে তাকাতেই তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠলো।জ্যাসপারের বলা কথাগুলো তখনই তার কাছে অর্থবহ হয়ে উঠলো।
পলকের মধ্যে নিজেকে জ্যাসপারের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে ফিওনা লজ্জায় পেছন ফিরে দাঁড়ালো।তাড়াতাড়ি হাত দুটো বুকের সামনে আড়াআড়িভাবে এনে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করার চেষ্টা করলো, তার নিঃশ্বাস তখনো দ্রুততায় ওঠানামা করছে, অথচ কথার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না।
জ্যাসপার লক্ষ্য করলো ফিওনার সারা শরীর ঠান্ডায় কাঁপছে। কোনো কথা না বলে, সে মাটিতে পড়ে থাকা ব্লেজারটি তুলে আবারো ফিওনার কাঁপনধরা শরীরের ওপর আলতো করে জড়িয়ে দিলো। তারপর নিঃশব্দে পেছন থেকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসে কণ্ঠে বলল, “চলো, কক্ষে যাই। সেখানেই তোমার সবকিছু দেখাবে।”
ফিওনার র*ক্ত মাথায় ছুটে এলো; তার কান দুটি লজ্জায় আগুনের মতো গরম হয়ে উঠলো। এমন নির্লজ্জ উক্তির জবাব খুঁজে না পেয়ে, সে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে নিজের দুই কান চেপে ধরে শব্দগুলোকে তাড়াতে চাইলো।
একই মুহূর্তে দূর থেকে অ্যাকুয়ারা সবকিছু লক্ষ্য করছিল। তার চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠলো— এ কেমন নতুন প্রিন্স, এমন আচরণ এক অনন্য বৈপরীত্য!
প্রিন্স জ্যাসপারের আচরণে অ্যাকুয়ারার মনে দ্বিধার স্রোত বইতে লাগলো। যে প্রিন্স কোনোদিন নারীর দিকে ভালো করে তাকায়নি, অ্যালিসার মতো অভিজাত ড্রাগন কন্যার সঙ্গেও যার বিবাহ ঠিক করা তার হাতটাও আজ পর্যন্ত ধরেনি জ্যাসপার। সেই তিনিই কী করে আজ এক মানব কন্যাকে এমন স্নেহময় তত্ত্বাবধানে জড়িয়ে নিচ্ছেন!
ফিওনার কাঁপন দেখে ব্লেজারটি নিজের হাতে তাকে জড়িয়ে দিতে দেখা যেনো অ্যাকুয়ারার চোখে নতুন এক জ্যাসপারকেই উপস্থাপন করলো। সন্দেহ আর বিস্ময়ে অবশিষ্ট না থাকতে পেরে, জ্যাসপারের পিছু ফিরে তাকানোর আগেই অ্যাকুয়ারা ছাদের দরজা থেকে সরে গেল।
এদিকে, ফিওনার দিকে তাকিয়ে জ্যাসপার এক শান্ত অথচ গভীর কণ্ঠে বললেন, “চলো,এবার নিচে যাই।”
কাঁপতে কাঁপতে ফিওনা তার পিছু নিলো। নিস্তব্ধ সিঁড়িতে তাদের পদক্ষেপের শব্দ আরও গভীর হয়ে উঠলো, ফিওনার শ্বাস আর জ্যাসপারের দীর্ঘ ছায়া—সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সেই বিকেলেই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
দুজন একসাথে ছাদ থেকে নামতেই জ্যাসপার নিরবে নিজের কক্ষে চলে গেলো। ফিওনা করিডোর ধরে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ অ্যাকুয়ারার সামনে এসে পড়ে। চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা আর উদ্বেগের ছাপ নিয়ে ফিওনা জিজ্ঞেস করলো, “অ্যাকুয়ারা, তুমি আমাকে ছাদে একা রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলে?”
অ্যাকুয়ারা খানিকটা বিব্রত হেসে বললো, “আসলে, একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, তাই নিচে নেমেছিলাম। আর অনেকক্ষন পরেই দেখি থারিনিয়াস আর আলবিরা হাউজে প্রবেশ করেছে। ওদের সামনে তো ছাদে আসা সম্ভব ছিল না, নইলে ওরা ঠিকই ধরে ফেলত যে তুমিও ছাদে আছো।ভেবেছিলাম,কিছু সময় পরে কৌশলে তোমাকে নামিয়ে আনবো। কিন্তু তখনই দেখি প্রিন্স হনহন করে ছাদের দিকে উঠে যাচ্ছেন, তাই আর সাহস পাইনি।”
ফিওনা একটু ভ্রূকুটি করে বললো,”সরি,অ্যাকু। আসলে আমি কৌতূহল সামলাতে না পেরে বাটনটি চাপ দিয়েছিলাম।”
অ্যাকুয়ারা চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “ফিওনা, এমন কোনো কাজ আর কোরো না,প্লিজ। এতে শুধু তুমি না, আমাদের সবার বিপদ হতে পারে। এখন বরং নিজের ঘরে যাও, জামা কাপড় পাল্টে বিশ্রাম নাও।”
ফিওনা একরকম মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অ্যাকুয়ারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলো। অ্যাকুয়ারা করিডোরের নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে থেকে এক অজানা আশঙ্কায় মগ্ন হয়ে হাঁটতে থাকে তার মনে প্রশ্ন, কী এমন ঘটছে প্রিন্সের মধ্যে, যার ফলে সে এমন আচরন করছে?
কক্ষে প্রবেশ করে ফিওনা ভেজা কাপড় পাল্টানোর সময় ব্লেজারটা গা থেকে খুলতেই এক অদম্য আকর্ষণ অনুভব করলো।এক অদৃশ্য শক্তি তাকে সেই ব্লেজারের দিকে টানছিলো। তার হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্লেজারের ওপর রেখে চোখদুটো বন্ধ করে, অল্প সময়ের জন্য তা উপরের দিকে টেনে নিয়ে ঘ্রান নিতে থাকলো। সেই ঘ্রাণ,এক স্নিগ্ধ,মাতাল করা সুবাস যা তার স্নায়ুতে অজান্তে প্রবাহিত হচ্ছিল।
জ্যাসপারের গায়ের পারফিউমের ঘ্রান—তাতে ছিলো কিছুটা মিষ্টি আর উষ্ণ আর আকর্ষণীয় ঘ্রাণ,যা হালকাভাবে এক ধরনের দারুচিনি আর সিগনেচার স্যিজলিং মসলার।ব্লেজারের প্রতিটি ভাঁজে সেই অদ্ভুত সুবাস মিশে আছে ফিওনার দৃষ্টি জড়িয়ে এলো সেই ঘ্রাণের প্রতি,এই অদৃশ্য আর্কিটেকচারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলো কিছু এক গভীরতা, যা তাকে আকর্ষণ করছিলো,তার হৃদয়ের গহীনে। সে ক্ষণিকের জন্য ঘ্রানটিকে নিজের মধ্যে পূর্ণভাবে ধারণ করতে চাইলো সেই মুহূর্তে জ্যাসপারের উপস্থিতি প্রতিটি শ্বাসে মিশে গিয়েছিলো।
সারাদিন কেটে গেল, ফিওনার আর জ্যাসপারের সঙ্গে দেখা হলো না। সূর্য ঢলে পড়তেই জ্যাসপার তার ল্যাবের নির্জনতা আঁকড়ে ধরে ড্রাকোনিসের সাথে সংযোগ স্থাপন করল।গভীর মনোযোগে সে তার ভাইকে উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, এক গভীর প্রত্যয় তার চোখেমুখে বিরাজ করছে।
রাত গড়িয়ে গেছে।কিন্তু জ্যাসপার সেই ল্যাবেই রয়ে গেছে,কাজ আর আলোচনা তাকে গ্রাস করে রেখেছে।অন্যদিকে, ফিওনা বিশ্রামের ঘোরে তলিয়ে গেছে।আজকের দিনের ক্লান্তি আর শরীরের মৃদু অসুস্থতায় ঘুম তার কাছে একমাত্র আরাম। গভীর নিদ্রায় ডুবে গেছে সে, দিনের ঘটনাগুলোর ভার ঘুমের চাদরে মুছে যাচ্ছে, এক অচেনা শান্তি তার জগতটাকে ঢেকে রেখেছে।
ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাকুয়ারা প্রতিদিনের মতো ফিওনাকে ডেকে তোলার জন্য তার কক্ষে প্রবেশ করে। কিন্তু আজ সবকিছুই ভিন্ন মনে হলো—ফিওনা সাদা কম্বলের নিচে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে নিশ্চল শুয়ে আছে। অ্যাকুয়ারা একবার, দুবার তার নাম ধরে ডাকল, কিন্তু ফিওনা সাড়া দিল না সে গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
মৃদু উদ্বেগে, অ্যাকুয়ারা ফিওনাকে হালকা ধাক্কা দিতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। ফিওনার শরীর স্পর্শ করতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে তার ত্বক অস্বাভাবিক উষ্ণতায় দহন করছে,আগুনের উত্তাপে ঝলসে উঠেছে।এই তাপমাত্রা তাদের ভেনাসের স্বাভাবিক উষ্ণতার সমান, অথচ পৃথিবীতে এমন তাপমাত্রা অস্বাভাবিক আর অস্বস্তিকর।
অ্যাকুয়ারা তৎক্ষণাৎ বুঝল,পৃথিবীর মানুষের জন্য এমন উত্তাপ কোনো সুস্থতার লক্ষণ নয়; এই তীব্র উষ্ণতা জ্বরের ইঙ্গিত দিচ্ছে, মানবদেহে অসুস্থতার প্রথম পদক্ষেপ। ফিওনার অসুস্থতা তার উদ্বেগকে আরও গাঢ় করে তুলল, সে ভাবতে লাগল কিভাবে দ্রুত সাহায্য আনা যায় এই অসুস্থ মানব-কন্যার জন্য।
অ্যকুয়ারা দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে থারিনিয়াস আর আলবিরাকে সবটা জানাল। ফিওনার অবস্থা শুনে তাদের চেহারাতেও গভীর উৎকণ্ঠা ভেসে উঠল। তারপর, তারা সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল, প্রিন্সের ল্যাব থেকে আসার প্রতীক্ষায়।
অবশেষে, গ্লাস হাউজের দরজা খুলে এক দুর্বার অথচ স্থির উপস্থিতিতে জ্যাসপার প্রবেশ করল। লিভিং রুমে সে সবার মুখে গাঢ় চিন্তার ছাপ খেয়াল করল, সে মুহূর্তে, পুরো স্থানটির বায়ু ভারী হয়ে উঠল তার আভিজাত্যের প্রভাবেই।
প্রতিটি পদক্ষেপে তার নির্ভীক চাহনি, কঠোর মুখাবয়ব, আর প্রখর নির্লিপ্ততার আভাস ফুটে উঠল।সবার কৌতূহল আর উৎকণ্ঠা ভেদ করে, জ্যাসপার ধীর কণ্ঠে বলল “কী হয়েছে? সবাই এমন ভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো একসাথে ?”
তার প্রশ্নের প্রতিধ্বনিত সুরে সবাই আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। থারিনিয়াস কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে বলল,
“প্রিন্স,ওই মানব মেয়েটির প্রবল জ্বর এসেছে। তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।”
জ্যাসপারের মুখে এক মুহূর্তের জন্য চিন্তার রেখা পড়লেও, সে নিজেকে অটল রেখে মুখের ভাব পাল্টালো না। নিজের সমস্ত উদ্বেগকে লুকিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে রইল সবার সামনে, নিরাসক্ততার অদৃশ্য আড়ালে গভীর চিন্তায় ডুবে।
জ্যাসপার থারিনিয়াসকে গভীর কণ্ঠে নির্দেশ দিলো, “ল্যাবে যাও,পৃথিবীর মানুষের জ্বর সাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা জেনে এসো।”
থারিনিয়াস আদেশ পেয়ে দ্রুত ল্যাবের দিকে এগিয়ে গেল।এরপর জ্যাসপার অ্যাকুয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, “থারিনিয়াস আসার পর যা যা করতে হবে, সেসব সবকিছু তুমি সম্পন্ন করবে।”
অ্যাকুয়ারা সাহস করে একটু এগিয়ে এসে বলল, “প্রিন্স, আপনি একবার ফিওনাকে দেখে এলে কেমন হয়? তার কী অবস্থা, তা নিজের চোখে দেখে আসতেন।”
জ্যাসপারের চোখে হালকা নির্লিপ্ততা ফুটে উঠল, “কোনো প্রয়োজন নেই,” বলেই সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে গেল।
নিজের কক্ষে পৌঁছে, দরজা বন্ধ করেই সে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, হৃদয়ের কোনো চাপা কষ্টকে বাইরে বের না হতে দেওয়ার জন্য নিজেকে সামলে নিলো।
অ্যাকুয়ারা দূর থেকে তাকিয়ে বুঝে গেল, প্রিন্সের অন্তরে আদতে কোনো পরিবর্তন আসেনি—সে এখনো আগের মতোই কঠোর আর নিজের আবেগের প্রতি সম্পূর্ণ নির্মোহ।
অবশেষে থারিনিয়াস শহর থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র একটি থার্মোমিটার নিয়ে গ্লাস হাউজে ফিরে এলো।অ্যকুয়ারা ধীর পায়ে ফিওনার পাশে এগিয়ে গেল।থার্মোমিটার তার মুখে রেখে জর পরিমাপ করল—১০৪ ডিগ্রি। কাল বিকেলে ছাদে প্রচণ্ড ভিজে থাকার কারণেই এমন তীব্র জ্বর আক্রমণ করেছে তাকে।ফিওনার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট; তার শরীর সমস্ত শক্তি হারিয়েছে।
অ্যকুয়ারা প্রথমে তাকে সামান্য হালকা খাবার খাইয়ে দেয়। ফিওনার চোখে এক ধরনের ধোঁয়াটে আচ্ছন্নতা, চোখ মেলতে চাইলেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটানা বুজে আসতে থাকে। শীতল হাত ধরে ধরে অ্যকুয়ারা তাকে ধীরে ধীরে বসিয়ে দেয়, যত্নের সঙ্গে ওষুধ মুখে তুলে দেয়।
সবকিছু সম্পন্ন করার পর, অ্যকুয়ারা ফিওনাকে আবার আলতো করে শুইয়ে দেয়। কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময়, অ্যকুয়ারা একবার নিঃশব্দে তার ক্লান্ত মুখপানে চেয়ে থাকে।
দিনের আলো অস্তমিত হয়েছে, রাতের নিস্তব্ধতায় ঘেরা গ্লাস হাউজে ধীর পায়ে ফিরলো জ্যাসপার। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ—সবাই নিজ নিজ কক্ষে গভীর বিশ্রামে নিমগ্ন। করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ ফিওনার কক্ষের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। কক্ষের ভেতর থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে ফিওনার কথা ভেসে আসছে, মনে হচ্ছে কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে।
জ্যাসপারের মনে হলো কেউ তাকে এক অদৃশ্য সুতায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে কক্ষের দরজা খোলে সে। ভেতরে প্রবেশ করতেই ফিওনার অবস্থায় চমকে ওঠে—বিছানায় শুয়ে, শরীর প্রচণ্ড কাঁপছে, অগ্নিশিখার মাঝে তপ্ত হয়ে জ্বলছে। তার বিবর্ণ মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, আর ঠোঁটের কোণে অস্থির বিড়বিড় ধ্বনি। অস্পষ্ট শব্দগুলো অজানা কোনো আর্তি বহন করছে।
জ্যাসপার নিরবে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তার মুখে বিষাদময় কৌতূহলের রেখা ফুটে ওঠে।
জ্যাসপার নিঃশব্দে ফিওনার কক্ষের কাছে এগিয়ে দাঁড়ায়, তার কান ফিওনার মৃদু বিড়বিড় শব্দের দিকে নিবদ্ধ করে। ফিওনার কন্ঠে ক্লান্তি আর একাকীত্বের গভীর ছাপ, সে অতীতের কারো উদ্দেশ্যে কিছু বলছে।
ফিওনা অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড়বিড় করে উঠে, “মিস ঝাং… কোথায় আপনি? গ্রান্ডপা কেনো আসছেন না? আমার এতো জ্বর, তিনি এখনো আমাকে দেখতে আসলেন না… মিস ঝাং, আপনি জানেন না… জ্বর এলে আমার ভয় করে, একা ঘরে এইভাবে থাকতে পারি না।”
জ্যাসপার স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তার হৃদয় ক্ষণিকের জন্য নীরব অনুভূতির ভারে আবদ্ধ হয়।সে অনুভব করতে পারে ফিওনার সেই নিঃসঙ্গতা, যা হয়তো এই মানব কন্যার কোমল জীবনে প্রাচীন স্মৃতির জ্বালা বহন করছে।
কিছুক্ষণ নীরবতা, হঠাৎ ফিওনার কণ্ঠ আবার প্রতিধ্বনিত হয়, ভেঙে পড়ে স্মৃতির ভারে, “বাবা-মা,কোথায় তোমরা? কেনো আমাকে রেখে চলে গেলে? ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে দিল কেনো? তোমাদের ছাড়া আমি অসহায়।”
ফিওনার কণ্ঠের এই যন্ত্রণার আকুতি অদৃশ্য শূন্যতার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। জ্যাসপার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার মনে এক চাপা কৌতূহল আর অজানা অনুভূতির স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে, নির্বিকার চিত্তে উল্টো ঘুরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয় সে যাতে করে এই মানব মেয়ের একাকীত্ব তার শক্তিময় সত্ত্বাকে ছুঁতে না পারে।
ফিওনা পুনরায় মৃদু গলায় বললো, “মিস ঝাং,আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে…পানি প্লিজ…আমি পানি খাবো।” তার কণ্ঠে দুর্বলতা, ক্লান্তি আচ্ছন্ন।
জ্যাসপার মুহূর্তেই থেমে যায়, তার চোখে কিছু চিন্তা চলে আসে। তারপর,এক আর্দ্র নিঃশ্বাসে ঘুরে দাঁড়ায়, তখনও ফিওনা বিড়বিড় করে পানি চাইছে। জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনার দিকে এগিয়ে আসে। ফিওনার পাশে বসে, তার পিঠ বেড হেডের সাপোর্টে ঠেকিয়ে, অতি সাবধানে পানির গ্লাস হাতে নিলো
ফিওনার মাথাটা একহাতে নরমভাবে উঁচু করে, জ্যাসপার তার ঠোঁটের কাছে গ্লাসটি নিয়ে আসলো।ফিওনার ঠোঁটগুলো অল্প একটু খুলে পানির স্পর্শে সাড়া দিল। কিছু পানি তার ঠোঁটের কোণ থেকে ঝরে পড়ে, যা ঠোঁটের কিনারা বেয়ে বুকের কাছের জামাটা খানিকটা ভিজে যায়।ৎজ্যাসপার চোখে চোখে অবলোকন করে, তার কোমলতায় কিছু অজানা অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
ফিওনার অজান্তেই হাতের সঙ্গে ঠোঁট বেয়ে পড়া পানি আবার শরীরের নরম ছোঁয়ার মতো অনুভব হয়।তখন, জ্যাসপারের মন ধীরে ধীরে কাঁপছিলো, না জানি কেমন এক অনুভূতির তরঙ্গে।
জ্যাসপার পানি খাইয়ে ফিওনাকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে উদ্যত হয়, কিন্তু হঠাৎ ফিওনার অবশ হাতটি তার কনুই ধরে ফেলে। মৃদু স্পর্শে থমকে যায় জ্যাসপার; ফিওনার স্পর্শে এমন এক নির্ভরতা তাকে গভীর কোনো টানেই টেনে রাখে।
ফিওনার কণ্ঠে অসহায় আকুতি, ফিওনা অনবরত কাঁপছে,তা র গরম হাতটি জ্যাসপারের কনুই আঁকড়ে ধরেছে। সে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, “প্লিজ,মিস ঝাং, আমাকে একা রেখে যাবেন না। আমি অসুস্থ হলে আপনি তো সবসময় আমার পাশে সারারাত ধরে থেকেছেন যেমনটা ছোটবেলায় মা থাকতো। প্লিজ, আমার ভয় লাগছে, আমার কাছেই থাকুন না।”
অসুস্থতায় দুর্বল ফিওনার সেই কথাগুলো তার হৃদয়ের এক নিভৃত কোণে আঘাত করে।
জ্যাসপার থমকে যায়। ফিওনার হাতের তপ্ত স্পর্শ তাকে থামিয়ে দেয়। কোনো কথা না বলে, সে ধীরে ধীরে ফিওনার হাতের ওপর নিজের হাত রাখে, অনুভব করে সেই মানবীয় তাপ আর অসহায়ত্ব।
ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাতটি নিজের গালের পাশে চেপে ধরে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,”আপনার হাতটা খুব শীতল, মিস ঝাং… মনে হচ্ছে আমার জ্বর এখনই সেরে যাবে।”
তার কণ্ঠে গভীর প্রশান্তির আভাস, সেই শীতলতার স্পর্শে যন্ত্রণা মুছে যাবে। জ্যাসপারের কঠিন দৃষ্টি কিছুটা নরম হয়ে আসে, তবে মুখের রেখায় কোনো ভাবান্তর ফুটে ওঠে না। তবুও,তার হাতের শীতলতা নিঃশব্দে ফিওনার অবসন্ন মনকে আশ্রয় দেয়, সেই মুহূর্তে তাদের চারপাশে এক নীরবতার আচ্ছাদন নেমে আসে।
জ্যাসপার ফিওনার গালের স্পর্শে এক গভীর তাপ অনুভব করল, তার শরীরের উত্তাপ অশান্ত আগুনের মতন জ্বলছে।মেয়েটির ক্ষীণ, অবিরাম কাঁপুনি কম্বলের নিচে ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে, আর তা দেখে এক মুহূর্ত চিন্তায় ডুবে যায় জ্যাসপার। এরপর, কিছু না ভেবে ফিওনাকে আলতো করে নিজের বুকে টেনে নেয়, দু’হাতে তাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে রাখে— তার নিজের উষ্ণতায় এই অসহায় দেহটির শীতল যন্ত্রণাকে প্রশমিত করার তাগিদে।
ফিওনা সেই উষ্ণতার আশ্রয়ে শিথিল হয়ে জ্যাসপারের কোমরে শার্টটা শক্ত করে ধরে রাখে,যাতে করে তাকে একা রেখে সে আর যেতে না পারে। তবে অসুস্থতায় ফিওনার চোখ ভারী হয়ে আসে, চোখ বেয়ে ধীরে ধীরে নীরব অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে। সেই মুহূর্তে,জ্যাসপার তার গালে হাত রেখে মৃদু স্পর্শে মুখটা একটু তুলে ধরে।ফিওনার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু তার বুড়ো আঙুলে এসে ঠেকে। এ স্পর্শের নিঃশব্দে কেবল এক অনাবিল প্রশান্তির ছায়া, যে নীরবভাবে তাদের দুজনকে এক নিবিড় আশ্রয়ে জড়িয়ে রেখেছে।
জ্যাসপার নিজে বুঝতে পারছিল না কেন সে ফিওনাকে এত কাছাকাছি টেনে নিয়ে আসছে, কেন তার অসুস্থতা তাকে এত গভীরভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে মেয়েটির দুর্বল, কাঁপতে থাকা শরীর আর সেই কষ্ট যা সে নিঃশব্দে সহ্য করছে—এগুলো সব কিছুই এক অদ্ভুতভাবে জ্যাসপারের হ্নদয়ের গহীনে কোথাও গভীর আঘাত করছে। তার ভেতরের ড্রাগন সত্তা, যে একসময় সর্বভুক শক্তি আর শীতল নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকতো, আজ এক অতিরিক্ত সূক্ষ্ম অনুভূতির কাছে পরাজিত হচ্ছিল। “এটা কি?কোন এক অপরিচিত টান তাকে বেঁধে ফেলেছে?”
জ্যাসপার জানতো, ডিভাইসের নির্দেশে তাকে ফিওনাকে দূরে রাখতে হবে, কিন্তু সে না চাইলেও এক অজানা আবেগ তাকে বাধ্য করছে তাকে আঁকড়ে ধরতে। কি তা? প্রেম কি সত্যিই তার হৃদয় এখন সেই মুহূর্তে কিছু চায় যা সে কখনও অনুভব করেনি?
ফিওনার কাঁপতে থাকা দেহ তার চঞ্চল হৃদয়ে কোনো গভীর কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছিল, ফিওনার নরম শ্বাসপ্রশ্বাস, তার ত্বকের উষ্ণতা—এগুলি জ্যাসপারের কাছে মুহূর্তের জন্য ভীষণ মধুর এক স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। তার মুখটা আরো কাছে এনে, সে ফিওনার নিঃশব্দ কান্না, তার অসুস্থতা—সবকিছুর গভীরে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে? কেন তার হৃদয়ে এত গভীর টান সৃষ্টি হচ্ছে? তার ড্রাগন সত্তা, যে জানতো কীভাবে নিজেকে শাসন করতে হয়,আজ এক নিঃস্ব ভীরু প্রেমিকের মতো একে অপরের অগোছালো হৃদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৪
জ্যাসপার বুঝতে পারলো, তার অস্তিত্বের কোনো জায়গায় এই অনুভূতি ছিলই। সম্ভবত সে কখনো অনুভব করতে পারেনি, কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে,যখন তার হাত ফিওনার মুখের কাছে ছিল, যখন তার চোখ ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল—তার হৃদয়ের গহীনে এক নীরব পরিবর্তন ঘটছিল। ফিওনা,যার প্রতি সে এতদিন কঠোর নিষ্ঠুর ছিল, আজ তার প্রতি এক গভীর আকর্ষণ অনুভব করছে।
জ্যাসপার মনে মনে আওড়ালো, তার চোখ ফিওনার মুখের দিকে স্থির ছিল,সে নিজেই কোনো অজানা চুম্বকতার কাছে বাধ্য হয়ে চলে আসছে।
“তবে কি আমি সত্যি সত্যি এই হিউম্যান গার্লটার প্রেমে পড়েছি?” তার মুখে অস্থিরতা ফুটে উঠলো অস্বাভাবিক প্রশ্নে।