হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৩
তোয়া নিধী দোয়েল
উপমা কলেজ প্রাঙ্গণে এসে আজ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়! ওর পাশ দিয়ে ছোট-বড় বয়সী যে ছেলেই যাচ্ছে সবাই ও-কে সালাম দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ব্যাপার টা স্বাভাবিক মনে হলেও; ক্ষণে ক্ষণে যখন এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েচ্ছে তখন বিব্রতবোধ করছে। বাবার জন্য কলেজে আলাদা পরিচিতি থাকলেও ও কখনো তা জাহির করে না। পাশ থেকে সূচি সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
-দোস্ত, আজ সবার কী হলো? সবাই তোকে এত ভক্তির সাথে সম্মান করছে?
উপমা ঠোঁট উল্টে বলে,
-জানিনা রে। শোন তোকে একটা কথা বলার ছিলো।
-হুম বল।
-ওই যে…
-আসসালামু-আলাইকুম প্রতিমা আপু! কেমন আছেন?
ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটার সময় একটা ছেলে এসে উপমাকে সালাম দেয়। ছেলেটির পাশে উপস্থিত অন্য একটি ছেলে অস্ফুটস্বরে বলে,
-ধুর হালা, প্রতিমা না! গোলাপ নাকি গোলাপি এই রকম নাম!
ছেলে দু’জন নিজেদের মধ্যে উপমার সঠিক নাম নিয়ে তর্কাতর্কি আরম্ভ করে। উপমা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। দু’জনের মধ্যে একজন কে উপমার চেনে! ওদের কথা শুনে, সূচি বাজখাঁই কণ্ঠে বলে,
-এই কীসের প্রতিমা, গোলাপি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছেলে দু’জন নিজেদের মধ্যে বাক্-বিতণ্ডা থামিয়ে ওদের দিকে তাকায়। বোকা হেসে বলে,
-এই যে, এই আপু টার নাম প্রতিমা নাকি গোলাপি?
-ওর নাম দিয়ে আপনারা কী করবেন?
ছেলেটা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই উপমা ছেলেটাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-আপনি সেই না! ঐ যে ঝামেলার দিন রাতে…
বাকি টুকু বলার আগে অভ্র স্মিত হেসে বলে,
-জি আপু!
সূচি ভ্রু কুঞ্জন করে উপমার দিকে তাকায়। উপমা অভ্রর হাসির বিপরীতে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে বলে,
-প্রতিমা না ভাইয়া। উপমা। আমার নাম মিহি উপমা।
অভ্র হাসি আরও দীর্ঘ করে বলে,
-ওওও…সরি! ভুল নাম বললাম।
– সমস্যা নেই। আপনি তো একটা ধন্যবাদ পাওনাদার। ঐ রাতের পর আর দেখা হয়-নি।
সূচি উপমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-কিসের ধন্যবাদ!?
অভ্র সূচির দিকে তাকিয়ে বলে,
-উনি ও তো ছিলেন?
উপমা উপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-জি।
তারপর আবার বলে,
-চলুন কোনো কফি হাউজে বসি।
-সরি আপু! আজ সময় নেই। আসলে আমার এক ফ্রেণ্ড অসুস্থ। ও-কে দেখতে যেতে হবে।
-ও আচ্ছা।
-কিছু মনে নিবেন না আপু। ও বেশ কয়েক দিন ধরেই অসুস্থ৷ ব্যস্ততার কারণে যাওয়া ওঠে-নি। আজ একটু সময় হয়েছে। তাই যাচ্ছি। অন্য-কোনোদিন দেখা হলে অবশ্যই বসবো।
-ওকে ভাইয়া। তাহলে আজ আর জোর করবো না। তবে মন থেকে একটা থ্যাংকস….
-আপু, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি?
উপমাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে অভ্র বলে।
-জি বলুন।
-আপু, থ্যাংকস টা আমি পাওনাদার না। এটার আসল মালিক মীম। আপনি বরং ও-কে বলুন।
রেজুয়ানের কথা ওঠতে মনে মনে ফুঁসে ওঠে উপমা। বার বার কল করাতে ও ও-কে ব্লক করে দিয়েছে। এখন আবার ঐ ছেলের সাথে কথা বলতে হবে?!
রেজুয়ানের ঘরে বসে রয়েছে রেজুয়ান, মোহনা, সূচনা আর তুর্কি। বেশ অনেক্ষণ যাবৎ অনেক রকম পরিকল্পনা করে ও তাঁরা কোনো সিদ্বান্তে পৌঁছাতে পারি-নি। তার উপর মুজাহিদ ও স্কুলে চলে গেছে। কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না।
-আপনার মোটা মাথায় তো কুটিল বুদ্ধির অভাব নেই। অথচ এখন কোনো বুদ্ধি বের করতে পারছেন না?
কণ্ঠে বেশ তেজ নিয়ে শুধায় তুর্কি৷ রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-সে তো আপনার ও কম না। আমার সাদাসিধা ভোলা-ভালা ভাই টারে যে ভাবে পটাইছেন!
তুর্কি চোখ ছোট করে বলে,
-আমি পটাইছি?! নাকি আপনারা দুই-ভাই মিলে ষড়যন্ত্র করে আমাকে পটাইছেন?
-আমি….
-উফ্! ভাই তোরা দু’জন থামবি? আসা মাত্র থেকে তোরা দু’জন ঝগড়া করতাছস। দয়া করে থাম এখন।
রেজুয়ান মোহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমি শুরু করছি?
সূচনা কটমট করে বলে,
-চুপ ভাই চুপ। শুরু যেই করুক। থাম তোরা এখন।
তুর্কি আনমনে কিছু ভেবে বলে,
-আপু ফোনটা দেও তো। চাচ্চু কে কল করবো।
-জাহিদ মাস্টার এখন ক্লাসে।
-আপনাকে কি বলে ক্লাসে ঢুকেছে?
-এই থামো থামো। দয়া করে আবার শুরু করো না। ধরো ফোন।
তুর্কি মোহনার কাছ থেকে ফোন নিয়ে মুজাহিদ কে কল করে। ভাগ্যক্রমে মুজাহিদ ক্লাসে ছিল না। তুর্কি ওর মাথায় আসা পরিকল্পনার কথা মুজাহিদ কে জানায়৷ সাথে মোহনা, সূচনা আর রেজুয়ান শোনে। সবাই শোনে হইহই করে উঠে। দারুণ একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে! তবে ওপাশ থেকে মুজাহিদ ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
-আমি তো স্কুলের গেটাপে আছি।
রেজুয়ান তুর্কির কাছ থেকে ফোন নিয়ে বলে,
-আরে বাপের ভাই, আমি থাকতে তোমার চিন্তা কী? তোমার পাঞ্জাবি নিয়ে যাম-নি। এত প্যারা নেও কেন?
হুমাইরা, রচনা মিলে রান্নার আয়োজন করছে। তুর্কি ছুটে রান্নাঘরে এসে হুমাইরা কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আম্মু আম্মু আম্মু! ধন্যবাদ তোমাকে, আমাকে আমার পৃথিবী উপহার দেওয়ার জন্য!
হুমাইরা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-মানে?
-মানে হচ্ছে( হুমাইরার সামনে এসে) আমার আম্মু আমাকে এই পৃথিবী উপহার দিয়েছে। আর তুমি আমাকে আমার পৃথিবী উপহার দিয়েছো!
-কী যা-তা বলছিস? আর তুই ব্যথা নিয়ে এই রকম ছুটছিস কেনো? তাড়াতাড়ি রুমে যা।
-আজ আমি রান্না করবো। তোমরা রেস্ট করো যাও।
হুমাইরা রচনা বিস্মিত হয়। একে তো মেয়েটা অসুস্থ। তার উপর রান্না? রচনা এগিয়ে এসে বলে,
-পাগল হয়েছিস? সকালে দেখে আসলাম ব্যথায় নড়তে পারছিস না। আর এখন…
-এখন ব্যথা একদম ঠিক হয়ে গেছে। আর আজকে দুপুরে আমি রান্না করবো।
-সর। উল্টা-পাল্টা বকিস না।
মোহনা, সূচনা এসে বলে,
– ও মা। আজ তোমরা বিশ্রাম করো যাও। আজ আমরা রান্না করবো।
রেজুয়ান রান্নাঘরে এসে হুমাইরার কাঁধ চেপে বলে,
-আজ আমরা রান্নাকরছি তো মাতাশ্রী। তোমরা আজ যাও। খালা-চাচি…
– হুম। তারপর চারজনে মিলে বিষ বানাও! সর এখান থেকে।
আরেও কয়েক দফা যুদ্ধ চলার পর অবশেষে হুমাইরা আর রচনা কে রান্নাঘর থেকে বের করতে সক্ষম হয় ওরা। রেজুয়ান ফোন বের করে মুজাহিদ কে কল করে। বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-এই বালডায় যে কেন একটা স্মার্টফোন কিনে না। সব টাকা বউয়ের জন্য জমাইতেছে।
সূচনা রেজুয়ানের পিঠে দুম করে কিল মেরে বলে,
-ভদ্র ভাষায় কথা বল৷ ভাবি আছে না।
রেজুয়ান তুর্কির দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে বলে,
-ও থুক্কু! থুক্কু! সরি ভাবিজান।
মাত্র কলেজ থেকে বাড়িতে পৌঁছায় আদনান। রুমে ঢুকে তুর্কিকে দেখতে না পেয়ে মেজাজ চড়ে যায়। এই মেয়ে একটা কথা শোনে না। সব সময় হৈ-হুল্লোড় করতে পারলে বাঁচে! নিশ্চয়ই মোহনা সূচনার ঘরে আড্ডা গেছে। ব্যথা বাড়ুক শুধু!
ও পকেটে থেকে যাবতীয় দরকারি জিনিস টেবিলের উপর রাখে। তখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে তুর্কি। ওর পরনে আদনানের দেওয়া সেই প্রথম লাল শাড়ি। এক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরেছে। অন্য হাতে খাবারের প্লেট। অর্ধভেজা চুল গুলো মুক্ত বাতাসে উড়ছে। আদনানের দিকে তাকিয়ে লম্বা করে ডাকে,
– স্যার…!
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে তুর্কি। ওর পরিসাজ দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। হাতের কাজ ফেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে। এক হাত দিয়ে তুর্কির হাত থেকে প্লেট নিয়ে অন্য হাতের বাহুর মধ্যে ওকে আবদ্ধ করে। রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
-তোমাকে নড়া-চড়া করতে বারণ করেছিলাম।
হাঁটার তালে তালে তুর্কি বিরক্ত দৃষ্টি নিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। কই এত সুন্দর করে সেজেছে; তা নিয়ে একটু কম্পলিমেন্ট দিবে! তা না সব সময় শাসন। ও রাগ টুকু সংবরণ করে। আজ লোকটার বার্থডে। ঝগড়া না করাই শ্রেয়। ও মৃদু হেসে বলে
-আমাকে কেমন লাগছে স্যার?
আদনান হাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে তুর্কিকে বিছানায় বসায়। ও-কে ভালোভাবে পরখ করে ঠোঁট উল্টে বলে,
-নতুন বউ, নতুন বউ লাগছে। এই রকম সাজ দিয়েছো কেনো?
আদনানের মুখে ‘বউ’ কথাটি শুনে চমকে ওঠে তুর্কি। বসা থেকে দাঁড়িয়ে আদনানের মুখোমুখি হয়ে বলে,
-কী…কী বললেন? আবার বলেন?
-এই ভাবে সেজেছো কেনো?
তুর্কি কপাল চাপড়ে বলে,
-আরে এইটা না। আমাকে কেমন লাগছে বললেন?
-কেনো? বউ বউ লাগছে!
আদনানের মুখে ‘বউ’ ডাক শুনে তুর্কি ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ করে বলে,
– লাভ ইউ স্যার। সাথে থ্যাংকস ও! এত সুন্দর কম্পলিমেন্ট দেওয়ার জন্য!
আদনান উল্টো ঘুরে বলে,
-তোমাকে যে নড়াচড়া করতে মানা করে গিয়েছিলাম। কথাটা কানে তুলো নি কেনো?
-বাড়ির কেউ বাড়ি নেই। আপনাকে খাবার বেড়ে দিবে কে?
-আমি একাই বেড়ে খেতাম। তোমাকে ওঠতে বলেছে কে? ব্যথা যদি বাড়ে তখন কী করবে?মা কই?
-বললাম না কেউ বাড়ি নেই।
আদনান তুর্কির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-কেনো? কই গেছে?
তুর্কি এগিয়ে আসতে চাইলে আদনান ও-কে থামিয়ে বলে,
-বসে বলো।
তুর্কি বিছানায় বসে বলে,
-আম্মু, চাচিয়াম্মা, মোহনা আপু, সূচন আপু সবাই আপনার নানু বাড়ি গেছে। আম্মুর কোন চাচি নাকি অসুস্থ। চাচ্চু স্কুলে। ভাইয়া তাঁর বন্ধু দের সাথে বেরিয়েছে।
-ওর ঐ পা নিয়ে আবার বেরিয়েছে! বাড়িতে আসুক আজ।
তুর্কি বিছানা থেকে ওঠে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বলে,
– স্যার, বিরিয়ানি টা একটু খেয়ে দেখুন তো কেমন হয়েছে।
-তোমাকে ওঠতে মানা করছি না?
-বসছি। আগে আপনি ট্রাই করুন।
-খাচ্ছি তুমি বসো।
তুর্কি বিছানায় গিয়ে বসে। আদনান ফ্রেশ হয়ে এসে এক চামচ বিরিয়ানি মুখে দেয়। খুব বেশি ভালো না হলেও মন্দ হয়নি। আদনান আরেক চামচ মুখে নিয়ে বলে,
– নট ব্যাড।
-আমি বানিয়েছি।
আদনান খাবার চিবানো থামিয়ে বলে,
-এই শরীর নিয়ে?
– তো? বাড়ির কেউ নেই৷ কী…
-খাবার আনিয়ে নিতাম। তোমার এই শরীর নিয়ে রান্না করতে বলেছে কে?
-আমাকে একবার খাইয়ে দিন।
আদনান এক চামচ বিরিয়ানি ওর মুখে ও দেয়। বাকিটা শেষ করতে করতে বলে,
-রেডি হও। হাসপাতালে যেতে হবে।
-আমি তো রেডিই।
আদনান প্লেট টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে,
-এই ভাবে কেউ হাসপাতালে যায়!
– হ্যাঁ স্যার, আমি যাই। আর তার থেকে ও বড় কথা আপনি পাঞ্জাবি পরে যাবেন।
বিছানার কর্নার থেকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে। আদনান ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এত লাফালাফি করার জন্য, ব্যথা কি মাথায় ওঠেছে? কী যা- তা বলছো?
-আমরা হাসপাতালে যাওয়ার আগে একটা জায়গায় যাবো৷ সেই জন্য বলছি।
-কই?
-আগে আপনি রেডি হয়ে আসুন। তার পর বলছি। প্লিজ।
তুর্কি আদনানকে ঠেলেঠুলে তৈরি হতে পাঠায়৷ রেডি হয়ে আসলে দু’জন বের হয় তুর্কির গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
রিকশা এসে থামে বেউথা ব্রিজ এর কাছে। তুর্কি- আদনান রিকশা থেকে নামে। ভাড়া পরিশোধ হয়ে গেলে রিকশা চলে যায়। ওরা ব্রিজ ডান পাশ দিয়ে পাশা-পাশি হাঁটতে থাকে।
সময় টা অপরাহ্ন। সূর্য মামা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। পশ্চিম আকাশ টা কমলা বর্ণের ধারণ করেছে। ব্রিজ থেকে খুব সুন্দর লাগছে আকাশটা। পরিবেশ কিছুটা কোলাহলময়। বিকেল হলে প্রায় মানুষ এখানে ঘুরতে আসে। মৃদু বাতাস বইছে।
তুর্কি মুগ্ধ চোখে মনোহর দৃশ্য দেখে। আদনান সোজা তাকিয়ে হাঁটছে৷ তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– স্যার, আকাশটা কি সুন্দর লাগছে না!
আদনান পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-হুম।
হুম বলে পাশে তাকাতে দৃষ্টিগোচর হয় অর্ধাঙ্গিনীকে। যে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওইদিক। লাল শাড়ি পরিহিত মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে, বোধহয় ঐ কমলা রঙের আকশ কন্যা সে! কী দারুণ মানিয়েছে আকাশের রঙের সাথে!
আদনান পকেটে থেকে ফোন বের করে; তুর্কির অগোচরে পাশ থেকে আকাশ সহ তুর্কির একটা সাইড পিক ক্লিক করে। তুর্কি বুঝে ওঠার আগে ফোন লুকিয়ে ফেলে। মৃদু হেসে তুর্কি তালে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।
হঠাৎ, হাঁটতে হাঁটতে তুর্কি থেমে যায়। পাশ ফিরে তাকায় আদনানের দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলে,
-ইসস! ভুলে গেছি!
আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কী?
-আরে এত সুন্দর ভিউ! তার উপর আমি আমার প্রিয় মানুষটির সাথে হাঁটছি। অথচ হাত না ধরে! এত বড় ভুল আমি কী ভাবে করলাম?
তুর্কি কথা শুনে আদনান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। ও ভেবেছে কী না কী! তুর্কি আদনানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– স্যার, দ্রুত আমার হাত ধরুন।
আদনান হাত দেওয়ার আগেই তুর্কি নিজেই আদনানের হাত টেনে শক্ত করে ধরে হাঁটতে আরম্ভ এখন শান্তি লাগছে! আদনান মৃদু হেসে হাঁটতে থাকে।
দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর, ওরা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছায়। এখানে তেমন কোলাহল নেই। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীর পানি। আশে-পাশে থেকে মন জুড়ানো শীতল হাওয়া। হাওয়ার তালে তালে উড়ছে তুর্কি লম্বা আঁচল। বালুমাখা পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। আদনান মনে দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
-আমরা যাচ্ছি কোথায়?
এই কথা টা প্রায় হাজার বার জিজ্ঞাসা করেছে ও। তুর্কি কোনো উত্তর দেয় নি। তবে এইবার ওর মেজাজ চড়ে যায়। এক কথা এই লোক কত বার বলতে পারে। আদনানের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
– স্যার, আপনি এত অধৈর্য কেনো বলুন তো? বললাম না আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তবুও কেনো বারবার জিজ্ঞাসা করছেন?
আদনান ও ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-তো এই নির্জন জায়গায় কিসের সারপ্রাইজ? আমি তো এখানে সারপ্রাইজ এর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শুধু পানি আর বালি।
আদনানের কথা শুনে তুর্কির মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি হানা দেয়। ও ঠোঁটে শয়তানি হাসি নিয়ে আদনানের বাহু আরেকটু চেপে ধরে বলে,
-কেনো স্যার ভয় হচ্ছে? যদি এই নির্জন পরিবেশে আমি আপনার সাথে কিছু করি।
তুর্কির কথা শুনে আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-বাজে কথা না বলে, সত্যি কথা বলো আমরা যাচ্ছি কই?
-উফ্! বললাম না সারপ্রাইজ। চোখ বন্ধ করুন।
আদনান কিছু বলার আগেই তুর্কি ওর দুই হাত দিয়ে আদনানের চোখ চেপে ধরে। আদনান তুর্কির হাতের উপর হাত রেখে মুখ থেকে ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলে,
-কী করছো?
-আরে আসুন তো। ভয় পাইয়েন না। চুপ চাপ কথা না বলে হাঁটুন।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পোঁছিয়ে যায়। যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে কিছু মানুষ! আদনান তুর্কি পৌঁছালে সবাই এক সাথে দাঁড়ায়। তুর্কি ইশারা করেতেই; সবাই সবার পজিশনে দাঁড়িয়ে পরে। তুর্কি ‘ওয়ান, টু, থ্রি’ বলে আদনানের চোখ খুলে দেয়। আদনান চোখ মেলে বিষ্ময়ত হয়ে যায়!
বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত! সবাই এক সাথে বলে উঠে,
– হ্যাপি বার্থডে!
সবাই এক সাথে তালি দিয়ে উঠে। সবার মুখে চমৎকার হাসির রেখা। উপচে পড়া আনন্দ। হুমাইরা, রচনা, মোহনা, সূচনা, আলামিন, মুমিনুল সবাই। মুজাহিদ আর রেজুয়ান এর কথা আলাদা ভাবে বলতে হবে না। ওরা না থাকলে তো সব কিছু-ই অসম্পূর্ণ! একে একে সবাই ওকে আলিঙ্গন করে অভিনন্দন জানাতে থাকে।
মূলত, বাড়ির সবাই আদনানের বার্থডে সেলিব্রেট করতে এখানে এসেছে। সাথে একটা বন-ভজন ও হয়ে যাবে। আর এই সব প্ল্যান তুর্কি, রেজুয়ান আর মুজাহিদের। সেই বৃষ্টির রাতে আদনান ওকে জানিয়েছিল, ওর সব কিছু ভিন্ন রকমের ভালো লাগে। সবার থেকে আলাদা কিছু। সেই ভিন্নতার জন্যই ও এই রকম একটা প্ল্যান করেছে।
তুর্কি ছুটে গোলাপের গুচ্ছো নিয়ে আসে। আদনানের সামনে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে,
-আই লাভ ইউ, স্যার। আমার ভালোবাসার শুভেচ্ছা আপনাকে।
আদনান কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-কী?
তুর্কি ডানে-বামে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-সরি স্যার। আই হ্যাপি বার্থডে। না না। হ্যাপি বার্থডে, স্যার। হ্যাপি বার্থডে। আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আদনান মৃদু হেসে ওর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নেয়। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলে,
– থ্যাংকস, ম্যাডাম।
তুর্কি ঠোঁটের হাসি প্রশস্থ করে দুই হাত বাড়িয়ে বলে,
-সবার সাথে হাগ করলেন। আমার সাথে করবেন না।
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-এখানে বাড়ির সবাই৷ পাগলামি করো না।
তুর্কি ও ভ্রু কুঁচকে বলে,
-তো? সবার সাথে তো করতে পারেলন।
-সবাই আর তুমি এক?
তুর্কি চোখ ছোট ছোট করে মুখ বাঁকায়। আদনান আবার বলে,
-তোমার পায়ে, কোমড়ে না ব্যথা? এত লাফালাফি কী ভাবে করছো?
তুর্কি কোমড়ে হাত দিয়ে একটু কুঁজো হয়ে বলে,
-আপনার সাথে থাকলে আমার সব দুঃখ, ব্যথা দূর হয়ে যায়, স্যার।
আদনান এক ভ্রু উঁচু করে বলে,
-হুম। একটু তাড়াতাড়ি-ই বোধহয় দূর হয়ে গেলো?
তুর্কি আমতা আমতা করে বলে,
-সবাই অপেক্ষা করছে, স্যার। চলুন চলুন।
তুর্কি আদনানের হাত টেনে নিয়ে যায়।
নদীর তীরে বিছানো হয়েছে একটা মাদুর। তাতে বাহারি আয়োজন। বিভিন্ন খাবার-দাবার সহ সুন্দর একটা কেক। এক পাশে দাঁড় করানো রেজুয়ানের গিটার। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোত। বয়ে আসছে শীতল হাওয়া। পশ্চিম আকাশে সোনার রবি মেঘেদের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। এই অপরুপ দৃশ্য আরও মনোহর করে তোলার জন্য উপস্থিত হয়েছে সুন্দর একটা পরিবার!
সবাই ধীরে ধীরে মাদুরের উপর গোল হয়ে বসতে থাকে। অর্ধেক থেমেছে ছেলেদের চক্রে। এবং বাকি অর্ধেক ভরে উঠেছে মেয়েদের চক্রে। মাঝে রয়েছে বাহারি রকমের খাবার।
শীতল হাওয়ার সাথে ভাসছে কলকল হাসির শব্দ। রচনা, হুমাইরা প্লেটে খাবার সাজাতে থাকে। তুর্কি গ্লাসে গ্লাসে জুস ঢালতে থাকে। মুজাহিদ কেক এর উপর ডেকোরেশন করতে থাকে। পাশ থেকে খোঁচা মারার জন্য রেজুয়ান বলে,
-বাপের চাই, আর কত কাল বড় বাচ্চার কেক ডেকোরেশন করবা? ইচ্ছা করে না, ছোট বাচ্চার কেক ডেকোরেশন করতে? এখন বিয়েটা করো।
মুজাহিদ ওর কথায় পাত্তা দেয় না। ওর সাথে মুখ লাগানো মানে পঁচা পানিতে ডুব দেওয়া। কোনো উত্তর না পেয়ে আদনান ও মুজাহিদের কানের কাছে গিয়ে বলে,
-এবার অন্ততঃ বিয়েটা করো বাপের ভাই। আমাদের তো ইচ্ছে করে আমাদের ছোট ভাই-বোনদের জন্মদিন সেলিব্রেট করতে।
মুজাহিদ ডেকোরেশন শেষ করে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,
-তোদের দুইটাকে একটা লাত্থি মারবো, একদম নদীতে গিয়ে পড়বি। ফাজিলের দল তোরা সব কিছুতে আমার বিয়ে নিয়ে পড়ছ কেন?
আদনান রেজুয়ান এক সাথে বলে,
-কারণ, আমরা আমাদের পালিত মা-কে দেখতে চাই।
-তোদের কোনো পালিত মা নেই। আমি একাই বড় করেছি তোদের।
আদনান মুজাহিদের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
-আরে বলো। আমরা ধরে বেঁধে এনে তোমার সাথে বিবাহ দেই!
মুজাহিদ কটমট করে বলে,
-লাত্থি খাওয়ার আগে কেক কাট।
রেজুয়ান আদনানের কানের কাছে যেয়ে বলে,
-বাপের ভাই লজ্জা পাইছে।
তার পর দুইজনে হো হো করে হেসে উঠে। মুজাহিদ ওদের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। ভাগ্য করে দুইটা ভাতিজা পেয়েছিলো। বিয়ের খোঁটা দিতে দিতে জীবন শেষ করে ফেললো।
এত আয়োজন দেখে আলামিনের চোখ চড়ক গাছ! সে পাশ ফিরে হুমাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
-এত কিছু আয়োজন করার কী দরকার ছিলো? কত টাকা নষ্ট হয়েছে!
হুমাইরা রাগে ফুঁসে ওঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-এই..এই লোককে এখানে কে আনছে? আমি তাকে একটু দেখতে চাই।
আলামিন বউয়ের কথা কিঞ্চিৎ দমে যায়। তবুও মিনমিনিয়ে বলে,
-টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু না!
-শুধু যে টাকা টাকা করো; টাকা নিয়ে কি কবরে যাবা? কোন পাপের জন্য যে এই লোক কপালে জুটছিল আল্লাহ-তায়ালাই জানে। জীবনটা ভরা কিপ্টামি করে গেলো।
আলামিন কে মুখ ঝামটা দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় হুমাইরা। আলামিন আরও কিছু বলতে গেলে মুমিনুল থামিয়ে দেয়।
-ভাই, এমন করস কেন? এক দিন-ই তো। সবাই মিলে একটু আনন্দ করছি তাতে সমস্যা হচ্ছে কী?
-তাই বলে এত…
হুমাইরা চোখ গরম করে তাকাতেই থেমে যায় আলামিন। ওদের ঝগড়া দেখে ছোটরা ঠোঁট টিপে হাসে। তুর্কি হাত উঁচু করে বলে,
-হয়েছে.. হয়েছে। অনেক ঝগড়া হয়েছে। এখন কেক কাটিং হবে। (আদনানের দিকে তাকিয়ে) স্যার, শুরু করুন।
আদনান কেক কাটিং শুরু করে। সবাই আনন্দের সাথে ওকে শুভেচ্ছা জানাতে থাকে৷ কেক কাটা শেষ হলে; একে একে সবাইকে খাওয়াতে থাকে আদনান। তুর্কি কে খাওয়াতে আসলে তুর্কি অদ্ভুত ভাবে হেসে কেক মুখে নেয়। তার পর সামান্য একটু কেক নিয়ে আদনানের মুখে দিয়ে বলে,
-লাভ ইউ, স্যার!
আদনান স্বভাবতঃ ওর নাকে টোকা দিয়ে চলে যায়। তুর্কি ভ্রু কুঞ্জন করে তাকিয়ে থাকে।
বেশ দীর্ঘক্ষণ সময় সবাই মিলে গল্প করে। খাবার খায়। মুজাহিদ রেজুয়ানের কথায় হো হো করে হেসে উঠে। ভীষণ সুখ সুখ একটা মূহুর্ত উপভোগ করে সবাই!
এত কিছুর মাঝে ও তুর্কির দৃষ্টি তাঁর পতির দিকে স্থির। আদনান ও কথার মাঝে মাঝে তাঁর পত্নীর দিকে তাকায়। দু’জনের দৃষ্টি সংযোগ হলে আদনান দুই ভ্রু নাচায়। কী হয়েছে এইটা বোঝানোর জন্য। তুর্কি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে শুধু বাঁ চোখ টিপে। আদনান দৃষ্টি সরিয়ে নিলে তুর্কি ও দৃষ্টি সরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে।
রেজুয়ান পাশ থেকে গিটার নিয়ে বলে,
-এখন সবাই মিলে একটা গান শুরু করি চলো।
মুজাহিদ রেজুয়ানের তালে তাল দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ। সবাই শুরু করো।
রেজুয়ান মুজাহিদ এর দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
-বাপের ভাই, ঐ বড় বক্সটা উপর করে তবলা বাজাও।
মুজাহিদ বক্সটা হাতে নিয়ে বলে,
-এইটা দিয়ে হবে?
-ভাই, গান ধর।
আলামিন আদনানকে খোঁচা দিয়ে বলে,
-তোর মা-কে শুরু করতে বল। অনেক সুন্দর গান গাইতে পারে। আমাদের যখন নতুন বিয়ে হলো…
হুমাইরা হইহই করে ওঠে,
-আ্যই আ্যই ফাজিল লোক। ছোট দের সামনে এই সব কী কথাবার্তা? বয়স কি দিনে দিনে কমতেছে তোমার?
রচনা-ও আলামিন এর তালে তাল মিলিয়ে বলে,
-আপা তো স্কুলে থাকতে কত গান গাইতো। উপহার ও পেতো। আপার কণ্ঠ অনেক সুন্দর!
-মার খাবি। আমি কোনো গান গাইতে পারবো না। ছোটরা সবাই এখানে।
আদনান মা-কে অনুরোধ করে বলে,
-মা জননী.. মা জননী এমন করো না। একটা গাইবে। একটু খানি। একটু খানি…। তুমি শুরু করবে। ধীরে ধীরে আমরা সবাই গাইবো।
অতঃপর সবার অনেক জোরাজুরিতে গান গাইতে রাজি হয় হুমাইরা। তবে ভীষণ বিব্রত বোধ করছে। মনে মনে আলামিন কে সহস্র বার বকছেন। হুমাইরা গান শুরু করে,
‘প্রেমের ও জোয়ারে
ভাসাবো দোঁহারে— বাঁধন খুলে দাও,
দাও দাও দাও।
(মুজাহিদ বক্সে শব্দ করে সুর তুলে। আদনান ও গিটার এ টুংটাং শব্দ তুলে)
প্রেমের ও জোয়ারে
ভাসাবো দোঁহারে—(তুর্কি আদনানের দিকে দৃষ্টি স্থির করে গায়) বাঁধন খুলে দাও,
দাও দাও দাও। (তুর্কি, হুমাইরা, রচনা, মোহনা, সূচনা এক সাথে)
(মাঝে কিছু সুর তুলতে থাকে। তুর্কি আদনানের দিকে দৃষ্টি স্থির করে রাখে। হুমাইরা গেয়ে ওঠে)
প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল,
হৃদয় দুলিল, দুলিল, দুলিল–
প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল,
হৃদয় দুলিল, দুলিল, দুলিল– (তুর্কি)
পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগবিদিক
পাগল হে নাবিক, ভুলাও দিগবিদিক (আদনান, রেজুয়ান, মুজাহিদ, আলামিন, মুমিনুল)
পাল তুলে দাও, দাও দাও দাও। (ছেলে মেয়ে উভয়ে এক সাথে)
প্রেমের ও জোয়ারে
ভাসাবো দোঁহারে— বাঁধন খুলে দাও,
দাও দাও দাও। (ছেলে মেয়ে উভয়ে এক সাথে)।।’
এইটুকু লিরিক্স সবাই আরেকবার গায়। তবে সবাই চোখ বন্ধ করে দুলে দুলে গায়। শুধু তুর্কি আর আদনান দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে গাচ্ছে। তুর্কির মাথায় তো সব সময় বদ বুদ্ধি ঘুরে। গান শেষ করে আদনানকে একটা ফ্লাইং কিস নিক্ষেপ করে। আদনান চোখ বন্ধ করে ঠোঁট টিপে হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
সারাদিন ব্যস্ততার শেষে ফোন হাতে নেয় রেজুয়ান। বিছানায় গা এলিয়ে নেট অন করে। টুং করে একটা এসএমএস ফোনে আসে। পরিচিত একটি নাম্বার থেকে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা এসেছে ‘Hi’! বার্তাটা প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ এসেছে। বার্তা টা চোখে পড়তেই শোয়া ছেড়ে ওঠে বসে। দ্রুত হাতে টাইপিং কিরে ‘কাঠগোলাপ!’
সুরু নীরব রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আদনান-তুর্কি। মাঝে মাঝে দু-একটা অটো, রিকশা যাচ্ছে। বাড়ির সবাই আগে চলে গেছে। ওরা দু’জন আলাদা আসছে। কিন্তু, বাড়ির রাস্তায় ঢুকিতেই ওদের রিকশা নষ্ট হয়ে গেছে। আর কয়েক কদম এগোলেই বাড়ি। তাই আর কোনো রিকশা নেয়-নি।
সারাদিন লাফালাফি, হৈ-হুল্লোড় করে তুর্কি এখন কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যথার নাটক শুরু করেছে। এক হাত কোমড়ে দিয়ে অন্য হাত দিয়ে আদনানের বাহু শক্ত করে চেপে ধরেছে৷ ব্যথিত কণ্ঠে বলে,
– স্যার, আর হাঁটতে পারছি না। ব্যথায় মরে গেলাম।
আদনান বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
-তো রিকশা নিতে মানা করলে কেনো?
আদনানের সাথে নীরব রাস্তায় হাঁটবে বলে তুর্কি রিকশা নিতে মানা করেছে। কিন্তু ফাজিল লোকটা তো প্রতিক্রিয়াই নেই। কই বউ হাঁটতে পারছে না বলে, এই নির্জন নিরব রাস্তায় বউকে পাঁজা কোলে তুলে হাঁটবে তা না। যত সব।
– হাসপাতালে তাহলে কাল সকালে যাই?
হাসপাতালের কথা শুনে তুর্কি আদনানের বাহু ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।,
-কোনো প্রয়োজন নেই স্যার। আমি এক দম সুস্থ।
আদনান হাঁটা থামিয়ে বলে,
-একটু আগে তো হাঁটতে পারছিলে না। হাসপাতালের নাম শুনে সুস্থ হয়ে গেলে?
– কেনো স্যার? আমার সুস্থ হওয়াতে আপনার ভালো লাগছে না? আপনার এত গুলা টাকা যে বাঁচিয়ে দিলাম। এর বিনিময়ে আমাকে আপনার লাভ ইউ টু বলা উচিত!
মুখ বাঁকিয়ে আগে আগে হাঁটা দেয় তুর্কি। আদনান পিছন থেকে ডাকে,
-বেগম সাহেবা!
আদনানের ডাকে থেমে যায় তুর্কির পা যুগল। লোকটা কি তাহলে ওর কথা শুনবে? ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আদনান কয়েক পা হেঁটে এসে বলে,
– থ্যাংকস! এত সুন্দর একটা সারপ্রাইজ আ্যরেঞ্জ করার জন্য! আমার লাইফে ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট সারপ্রাইজ ছিলো এটা।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩২
-থ্যাংকস দিয়ে কী করবো? এর বদলে লাভ ইউ টু বলে দিন!
আদনান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
-চলো একটা কাজ করি। আমার নাম চেঞ্জ করে আই লাভ ইউ রেখে দেই। এতে তোমার ডাকতে সুবিধা হবে।
তুর্কি চমৎকার করে হেসে বলে,
-ওকে। আর আমার নাম আই লাভ ইউ টু রেখে দিন। এর অজুহাতে অন্ততঃ আপনার মুখ থেকে এইটা তো শুনতে পারবো!