হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৪+৪৫

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৪+৪৫
তোয়া নিধী দোয়েল

গল্পটা ভীষণ পুরোনো! সময়টা ছিলো এক বর্ষার শেষ দিকটা। গ্রামের ধানখেত সবুজে ঢেকেছে। পথঘাটে কাদা, অথচ বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণ। তখন শুরু হয় এক কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রেমের উপাখ্যান!
প্রেমটা ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছিলো তা জানা নেই মুজাহিদের। যতটুকু মনে পড়ে— উচ্চমাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষার দিন; কলেজ প্রাঙ্গনে এক কাঁঠাল গাছের নিচে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। এক বন্ধুর অপেক্ষায়। সকালের দিকে বৃষ্টি শেষে ঝলমলে রোদের আভা চারিদিকে। সেই মূহুর্তে স্কুল ও ছুটি হয়েছিলো। কলেজ আর হাই-স্কুল পাশাপাশি থাকার দরুন— মাঠে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা।
কিছুক্ষণ পর তাঁর বন্ধু আজিজ হল থেকে বেরিয়ে তাঁর কাছে এসে হাতে একটা চিরকুট গুঁজে বলেছিলো—

-বন্ধু, এই চিঠিটা ওই মেয়েটাকে দিয়ে আয়। মেয়েটাকে আমার অনেক দিন ধরে ভালো লাগে। কিন্তু, বলতে পারিনি। যা তুই আজ প্রস্তাব টা দিয়ে আয়।
আজিজের কথা শুনে মেজাজ চড়ে গেছিলো মুজাহিদের। একে তো মাত্র পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছে৷ তার উপর ও রেজাল্টের চিন্তা না করে মেয়ের চিন্তা করে বেড়াচ্ছে। মুজাহিদ সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে-ঘোরাতে বলেছিলো—
-সর। আমি পারবো না৷ তুই গিয়ে দিয়ে আয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই বলে সাইকেল নিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু, বন্ধুর পীড়াপীড়িতে অবশেষে রাজি হয়েছিলো। সাইকেল কাঁঠাল গাছের সাথে রেখে চিরকুটটা নিয়ে; ও দূরে দু’টা মেয়ের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো। দু’জনের পরনে ছিলো সাদা থ্রি-পিস। দুই বেণী করে সামনে রেখেছিলো। তবে, একজনের চুলগুলো একটু লম্বা, আরেকজনের চুলগুলো ছোট।
মুজাহিদ বুঝতে পারছিলো না; আজিজ কোন মেয়েটার কথা বলেছিলো। ও দ্বিধান্বিত হয়ে লম্বা চুলের মেয়েটিকে ডেকে চিরকুটটা দিয়েছিলো৷ মেয়েটার চোখ ছিলো ডাগর-ডাগর। গায়ের রঙ অত ফর্সা নয়। তবে আবার শ্যাম ও নয়। মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলো মুজাহিদের দিকে। চিরকুটটা না নিয়েই তাঁর বান্ধবী কে নিয়ে মুজাহিদের পাশ কাটিয়ে চলে গেছিলো। পরপরই আজিজ দৌড়ে এসে মুজাহিদের কানে চড় মেরে বলেছিলো—

-ধুর, এই মেয়েটা না। ওর পাশের টা ছিলো।
মেয়েটার চাউনিতে বিব্রত হয়ে গেছিলো মুজাহিদ। মেয়েটা কী ভাবলো ওকে কে জানে! ও চিরকুটটা আজিজের হাতে দিয়েই সাইকেল নিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেছিলো।
পরের দিন— কৃষ্ণ মাস্টার ডেকেছিলো মুজাহিদকে। সেই হাই-স্কুল থেকে মুজাহিদকে স্নেহ করতেন তিনি। পরীক্ষা কেমন হয়েছে সেই খবর নিতেই মুজাহিদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মুজাহিদ মনের সুখে সাইকেল চালিয়ে কৃষ্ণ মাস্টারের বাড়িতে আসছিলো। বাড়ির গেটের মোর ঘুরতেই— এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো! বাড়ির গেট দিয়ে বেরোচ্ছিলো দুই রমণী। মুজাহিদের সাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে— মুজাহিদ সহ এক রমণী পড়ে গিয়েছিল কাদায়! পাশ থেকে অন্য মেয়েটি বলে ওঠেছিলো—

-আ রে রে… ববিতা!
মুজাহিদ দ্রুত চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছিলো— ববিতা নামে মেয়েটি চোখ মুখ খিঁচে কাদায় বসে রয়েছে। তাঁর বই-খাতা গুলো ও কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। দু’জনের শরীরই কাদায় মাখা-মাখি। মুজাহিদ চিনতে পারে; এই সেই কালকের মেয়েটি! যাকে মুজাহিদ ভুলে চিরকুট দিতে গেছিলো। সাইকেল সরিয়ে ওঠে মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বাড়ির রাখাল এসে বলেছিলো—
-আরে ববিতা দিদি! পড়লেন ক্যামনা? দুক্কু পাইছেন না? ওঠেন ওঠেন।
ববিতা, মুজাহিদের দিকে তাকিয়ে একটু তেজি স্বরে বলেছিলো—
-দেখে চলতে পারেন না? কি অবস্থা করলেন দেখেছেন?
ববিতার বান্ধবী মিঠাই এসে ববিতাকে তুলতে সাহায্য করে। মুজাহিদ কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া বই-খাতা গুলো কে তুলে; ববিতার কাছে দিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলেছিলো—

– দুঃখিত আমি। দেখতে পাই নি।
রাখাল এগিয়ে এসে বলেছিলো—
– ববিতা দিদি, আহেন ধুইয়া লন গতর। জাহিদ দাদা, আপনে ও আহেন। আমি জল উঠিয়া দেই।
রাখল চলে গেলে ববিতা, মুজাহিদের আগে তার পিছু পিছু গেছিলো। মুজাহিদ পরে গিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ববিতার শরীর ধোয়া শেষ হলে— ববিতা ক্ষুণ্ণ মন নিয়ে জায়গা ত্যাগ করে। যাওয়ার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মুজাহিদের দিকে তাকিয়ে ছিলো ববিতা। মুজাহিদ আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো। ববিতা দৃষ্টির বাহিরে যেতেই— মুজাহিদ কাদা পরিষ্কার করতে-করতে রাখালের কাছে ববিতার সম্পর্কে খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করে ছিলো।
এই ভাবে চলতে থাকে দিন। মুজাহিদের চিন্তাধারার তখন শুধু ববিতা। হৃদয়ের সঙ্গোপনে বাজে একটি নামের রেণু। মনে বাজে এক গীত—

‘তোমারে দেখিবার মনে চায়
দেখা দাও আমায়,
তোমারে দেখিবার মনে চায়!’
মুজাহিদ রোজ স্কুল ছুটির সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো; ববিতা কে একটা বার দেখার জন্য। এতে ববিতা বিব্রতবোধ করতো। তবে, মনে মনে যে সেও এই সর্বনাশে পা দিয়েছে তা হয়তো জানা ছিলো না মুজাহিদের!
একদিন মুজাহিদ যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো; তখন দেখতে পায়— ববিতা লাল শাড়ি পরে, মাথার কেশ গুচ্ছো আলগা করে; একটা সাত-আট বছরের ছেলেকে নিয়ে কদম ফুল পাড়ার করছে। তবে গাছ টা ভীষণ উঁচুতে থাকায় ব্যর্থ হচ্ছে। ছেলে টা ও গাছে ওঠতে নারাজ। তাই এক নাগাড়ে ছেলেটাকে বকে ও যাচ্ছিছিলো। তখন মুজাহিদ এসে এক গুচ্ছ কদম পেরে দেয়। ববিতা কুণ্ঠাবোধ করলে ও ফুল গুলো নিয়ে নেয়। যাওয়ার পথে মুজাহিদ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ব্যক্ত করে তাঁর হৃদয়ের সঙ্গোপনে কথা!

সেইদিন ববিতা কোনো উত্তর না দিলে ও পড়ে তাঁর বান্ধবী কে দিয়ে উত্তর দিয়ে দেয়। নারী মানুষ কি না! সরাসরি প্রণয়নের কথা বলতে আড়ষ্টতা কাজ করে।
তারপর…মধুর সময়, স্মৃতি গুলো পেরোতে থাকে। প্রতিদিন দেখা না হলে ও প্রায় বিকেলে নদীর ঘাটে গল্প করতো তাঁরা। এক সাথে সুরু রাস্তায় হাঁটতো। ববিতার স্কুল ছুটির পর প্রায়ই রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে বাদাম খেতো। বাড়িতে জানাজানি হওয়ার ভয়ে কোনো চিঠি আদান-প্রদান হতো না। মুজাহিদ কথা দিয়েছিলো— ‘খুব তাড়াতাড়ি সে তাঁকে ঘরে তুলবে!’

কিন্তু, ভাগ্য বেশিদিন সায় হলো না। একদিন নদীর ঘাটে বসে ছিলো তাঁরা দু’জন। মুজাহিদ পেপারে মোড়ানো কিছু বের করে। তাতে এক মুঠো লাল রেশমি চুড়ি। চুড়ি গুলো পড়ানোর সময় সেখানে উপস্থিতি হয় ববিতার ভাই ফারুক। অনেক দিন ধরেই গ্রামবাসী ওদের দু’জন কে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তাঁদের ধারণা বিয়ের আগে দু’জন ছেলে- মেয়ের মেশা মানে অনেক বড় পাপ। ফারুক এসে মুজাহিদ কে একটা চড় মেরেছিলো। তারপর ববিতাকে টানতে-টানতে সেখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলো।

চুড়ি গুলো সিমেন্ট বাঁধানো সিঁড়িতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলে ভেঙে যায়। সাথে তাঁদের ভাবা স্বপ্ন গুলো ও। মুজাহিদ ব্যথিত হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরে। ভাইয়ের কাছে আর্জি জানায়— সে বিবাহ করবে ববিতা কে। মা সমতুল্য ভাবি হুমাইরা ও কে ও শতবার অনুরোধ করে। মুজাহিদের তখন নিজের রোজগার করার সামর্থ্য ছিলো না। তাই আলামিন ঘোর আপত্তি করে। কিন্তু, দিনে দিনে মুজাহিদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। একে তো ববিতার কোনো খোঁজ নেই। কোনো চিঠি কিংবা না বাড়ি থেকে বেরোয়। মিঠাইকে দিয়ে ও কোনো খবর পাঠানি। ববিতাদের বাড়ির সেই কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো মুজাহিদ; কিন্তু, প্রাণ-প্রিয়ার কোনো খোঁজ পেতেন না।

মুজাহিদের শরীরের সাথে মনের অবনতি দেখে হুমাইরা স্বামীকে রাজি করিয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠায় সেই বাড়ি। কিন্তু, ফারুক তাকে যা তা বলে অপমান করে দেয়। বাড়িতে এসে সেই রাগ স্ত্রী আর ভাইয়ের উপরে ফলায়।
ওদিকে মুজাহিদ কে না দেখতে পেয়ে ও যে ববিতা সুখে আছে এ ধারণা ভুল। তাকে একটা ঘরে তালা বদ্ধ করে রেখেছে ফারুক। কাউকে তার সাথে দেখা করতে দিতো না। মাকে দিয়ে খাবার পাঠাতো। কিন্তু, সেই খাবার ও খেতো না। সব চেয়ে বড় কথা ববিতার শরীরে বাসা বেঁধেছিলো এক ভয়ংকর রোগ!

শুধু রক্ত-বমি হতো৷ জ্বর, বুকে ব্যথা সহ আরও নানা ধরনের উপসর্গ। অনেক দিন ধরেই এই উপসর্গ দেখা দিলে ও তা ওতো পাত্তা দিতো না কেউ। যখন দিনে দিনে আরও শরীর খারাপ হতে থাকে; তখন একটা ডাক্তার আনা হয় বাড়িতে। ডাক্তার জানায় ওর শরীরে রাজরোগ (যক্ষ্মা) বাসা বেঁধেছে। এই রোগের একটাই চিকিৎসা। তা হলো মৃত্যু! ওইদিকে ফারুক ও এক বনেদি পরিবারে বোনের বিয়ে ঠিক করেছে। ববিতা যখন জানতে পেরেছিলো এই কথা তখন ভেবেছিলো মুজাহিদের সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু, যে রোগ ওর দেহে বাসা বেঁধেছে; সেখানে পালিয়ে গেলে ও বেশি দিন সংসার করতে পারবে না। তাই, ও সিদ্ধান্ত নেয়, মৃত্যুই যখন হবে তাহলে আর ঘর বেঁধে লাভ কী?
বিয়ের কিছুদিন আগে বন্ধ ঘর থেকে বের করে ববিতাকে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু, কোনো কিছু তেই ববিতার মন বসছে না। সেই একটা চিঠি আর একটা ছবি একটা ঘামে করে পাঠায় মিঠাইকে দিয়ে।

মুজাহিদ নিজের ঘরে এসে জানালার সামনে বসে রয়েছে। রাতের আঁধারে দক্ষিণা বাতাস বইয়ে আসছে। যার শীতল স্পর্শ প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম। কিন্তু মুজাহিদের ব্যথিত, দগ্ধ হৃদয়ে তা স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়! সে নীরবে ভাবে চলেছে পুরোনো সেই কথা, সেই মূহুর্ত গুলো৷ মানুষ টা দূর দেশে পাড়ি জমালেও তাঁর ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ মুজাহিদ। তাঁর ধারণা মতে, ভালোবাসা মানুষের জীবনে কখনো দ্বিতীয়বার আসে না। আর যদি আসে তাহলে তা ভালোবাসা নয়! সে কেবল মোহ-মায়া! তাই তো এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ও মুজাহিদ তাঁকে সেই শুরুর মতই ভালোবাসে।

এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে প্রিয় মানুষের সাথে কাটানো মূহুর্ত গুলো নিসন্দেহে কোনো প্রেমিক মানবের কাছে ভীষণ মূলবান! তবে, সেই মূহুর্ত গুলো মনে হয় দ্রুত চলে যায়। মুজাহিদ বসা থেকে ওঠে বিছানার নিচে ঝুঁকে। বিছানার নিচ থেকে একটা জলপাই রঙের পুরোনো টিনের বক্স টেনে বের করে। প্রায় জায়গায় রঙ ওঠে জং ধরে গেছে। ভেতরে খুব সীমিত জিনিস। সে সেটা নিয়ে পূর্বের জায়াগায় যায়। টেবিলের উপর রেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছোট চাবি বের করে। বক্সটার তালা খুলে পুনোরায় জানালার সামনে বসে। তার ভিতরে পুরোনো কিছু ফতুয়া আর পাঞ্জাবি৷ মুজাহিদ সেই সবের ভেতর থেকে একটা ছোট বক্স বের করে। টিনের বক্স পাশে রেখে সেই ছোট বক্স টা খুলে। তাতে এক নারীমূর্তির ছবি এবং একটা পুরোনো চিরকুট! চিরকুটের পৃষ্ঠা হলুদ-হলুদ রাঙা। মুজাহিদ সেই নারীমূর্তির ছবিটা চোখের সামনে ধরে।

ভীষণ স্নিগ্ধ একটা মুখশ্রী। ডাগর আঁখি যুগল। তাতে গাঢ় করে কাজল লেপটানো। পরনে লাল টকটকে শাড়ি। লম্বা কেশ গুচ্ছ মোটা বেণী গেঁথে ডান পাশে রাখা। বাঁ হাত গালের কাছে মুষ্টি বদ্ধ করে রাখা। ঠোঁটে বিস্তীর্ণ এক হাসি৷ হাসির মাঝে বোঝা যাচ্ছে ঠোঁটের নিচে গাঢ় কালো তিল।
মুজাহিদের চোখ ছলছল করে ওঠলে ও ঠোঁটে ফোটে অজানা মৃদু হাসি। কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে যত্ন করে পাশে রাখে। তারপর সেই পুরোনো চিরকুটের ভাঁজ করা পৃষ্ঠা খোলে। তাতে থেকে ভ্যাপসা পুরোনো গন্ধ ভেসে আসছে। তবে সেই গন্ধের থেকে মুজাহিদের নাকে ভেসে আসছে প্রিয়তমার শরীরের শেষ ঘ্রাণ! শেষ ছোঁয়া!

প্রিয় প্রথম প্রেম‚
এক বুক আক্ষেপ আর এক আকাশ পরিমাণ ভালবাসা নিয়ে জানাই— আর বোধহয় একসাথে পথ চলা হবে না…! এই কথাটা লিখতে গিয়ে কতবার থেমে গেছি, জানো? না কলমটা কাঁপে নি। বুকটা কেঁপেছে ভীষণ ভাবে! কারণ হয়তো এটা আমার শেষ চিঠি। শেষ… একেবারে শেষ!
অনেক কথা বলার ছিলো তোমার কাছে। অনেক পথ চলা বাকি ছিলো তোমার সাথে। অথচ, এখন একটুকুও সময় নেই হাতে। সৃষ্টিকর্তা নিজে সব কিছু বন্ধ করে দিলেন!
কিছু কথার জন্য সময় চেয়ে নেওয়া যায় না। কিছু পথ এক সাথে চলা যায় না। কিছু ভালোবাসা দীর্ঘদিন বাসা যায় না! কিছু ক্ষেত্রে অপূর্ণতাই শ্রেয়!

আজ কিছু লুকোনো কষ্টের, না বলা কথার হিসেব দিতে বসেছি।
তোমার মনে আছে— আমাদের প্রথম প্রেমে পড়ার ঘটনা? আমাদের অল্প পথ পাড়ি দেওয়ার ঘটনা? তুমি বলেছিলে “আমরা দুজন একসাথে হাঁটব, একদিন ঠিকই হাঁটব, সমস্ত পথ পেরিয়ে, সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে এক হবো…!” সেদিন আমার প্রাণে সুখের ফোয়ারা বয়ে গেলে ও— আর তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে!
আজ সময়, সমাজ, শরীর— তিনজন একসাথে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের মাঝখানে।

আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। অন্য কারও সঙ্গে। কথাটা বলতে আমার হৃদয় কাঁপছে। যেদিন তোমার প্রেমে পড়েছিলাম; সেইদিনই ভেবেছিলাম স্বামী রূপে কাউকে পেতে হলে আমি তোমাকেই নিবো। তবে, আজ আমি ব্যর্থ!
আমি তোমার হতে পারলাম না। কারণ আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে এক ব্যাধি। তোমাকে বলা হয়নি; এ নীরব, নিষ্ঠুর এক অসুখ। ডাক্তারের ভাষায় সময় সীমিত। আবার সমাজ আমাকে কলঙ্কিনী বলে আখ্যায়িত করেছে। এত বোঝা আমি আর বইতে পারলাম না।

আমি জানি, তুমি একদিন পড়বে এই চিঠিটা। হয়তো জানবে, আমি আর নেই। তবে জেনো, আমি ভালোবেসেছিলাম! তোমাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিলাম!
আজকের পর হয়তো আমার জন্য আর কোনো অপেক্ষা থাকবে না তোমার মনে। আর সেই অপেক্ষাকে মুক্তি দিতে চলে যাচ্ছি আমি নিজেই।
আমি যাবো… চলে যাবো সব হিসেবের বাইরে।
আমার চিঠিটা রেখে যাচ্ছি তোমার জন্য। কোনো দিবসে নয়, কোনো অশ্রুবিন্দুতে নয়—
শুধু রেখে যাচ্ছি তোমার হৃদয়ের এক কোণে।
আমার মৃত্যুকে দুঃখ ভেবো না।

এটা এক ধরণের মুক্তি। শরীরের থেকে, সমাজের থেকে, আর সেই ভেঙে যাওয়া স্বপ্নগুলোর থেকে।
আমার ভালোবাসা কখনও মরবে না, বিশ্বাস রেখো। হয়তো আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। তবে, ভালোবাসা গুলো নক্ষত্রের মত জ্বল-জ্বল করবে তোমার জীবনে। এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আমি নিজেকে উৎসর্গ করছি। ভালো থেকে আমার প্রথম প্রেম!
ইতি
এক অভাগীণি রমণী

যেদিন চিঠিটা মুজাহিদের কাছে পৌঁছিয়েছিলো— সেই মূহুর্তেই মুজাহিদ ছুটে গিয়েছিলো প্রিয়তমার নিকট। কিন্তু, প্রিয়তমা ততক্ষণে হাজারো আক্ষেপ, অভিমান নিয়ে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন না ফেরার দেশে। চিঠিতে ববিতা বলেছিলো নিজেকে উৎসর্গ করবে। কিন্তু, পরে জানা যায় আত্মহত্যা করার আগেই ইনফেকশন পুরো শরীরে ছড়িয়ে গিয়েছিলো তাঁর। বিয়ের দিন সকালেই না ফেরার দেশে পৌঁছিয়েছে। মুজাহিদ তাঁর কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে অঝোরে চোখের জল বিসর্জন দিয়েছিলো। চিৎকার করে ছিলো। কিন্তু নিয়তি ছিলো তার নিজ গতিতে!

মুজাহিদ চিঠি টা পরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চেয়ারে হেলান দেয়। চোখের কোটরে জমে থাকা তপ্ত জল গড়িয়ে নামে। পুরুষ মানুষের কান্না ভড্ড বেমানান! সেই চোখ বন্ধ করে প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে মনে-মনে ঐ চিরকুটের উত্তর লিখে—
‘তুমি কখনো পুরোনো হবে না আমার কাছে। তোমাকে, আমি আজও শুরুর মতই ভালোবাসি! শতাব্দী ফুরিয়ে গেলে ও তোমার প্রতি মায়া, ভালোবাসা কিছুই কমবে না।
তুমি আমার অসমাপ্ত স্বপ্ন , যা চিরদিন আমার জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি কোণে লেখা ছিলে আর থাকবে। কিন্তু, কখনো পূর্ণ হবে না। তবুও আমি তোমাকেই ভালোবাসি! শেষ নিশ্বাস অব্দি বাসবো। তবে, আমার জীবনের শেষ পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা থাকবে— আমি তোমাকে পাগলের মত ভালোবেসে ও পাইনি!’
ইতি
এক দুর্ভাগা পুরুষ।

আদনান, তুর্কিকে পিছন থেকে জড়িয়ে বসেছে। ডান কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে মৃদু দুলছে ওরা। আদনানের দীর্ঘ বক্তব্যের পর তুর্কি শান্ত কণ্ঠে বলে—
– স্যার, চাচ্চুকে দেখে তো বোঝা যায় না; যে উনি এত কষ্টে থাকেন। সব সময় আপনাদের সাথে হাসা-হাসি, হৈ-হুল্লোড় করেন।
আদনান ওকে ছেড়ে নিজের দিকে ঘোরায়। তুর্কির কপালে থাকা চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলে—
– পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে— যাঁদের ভেতর টা পোড়া, দগ্ধ। কিন্তু, বাইরে থেকে দেখে মনে হবে— এদের মত প্রানবন্ত, সুখী মানুষ বোধহয় আর কেউ নেই!
তুর্কি কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ মৌন থাকে। তারপর বলে—

-আচ্ছা স্যার, আপনার সাথে ও তো আমার যায় না। আপনি কই এডুকেটেড, ম্যাচিউর, শান্ত-শিষ্ট ভালো মানুষ।
অপর দিকে, কই আমি এক গণ্ডমূর্খ, ইমম্যাচিউর, অভদ্র মেয়ে। যে সারাদিন দৌড়া-দৌড়ি, হৈ-হুল্লোড় করতে পারলে বাঁচে। তাহলে কেনো ভালোবাসলেন আমায়?
তুর্কির কথায় আদনানের মুখে মৃদু হাসি ফোটে। ও তুর্কিকে বক্ষস্থলে আবদ্ধ করে বলে—
-এইদিকে আসো বলছি। সত্যি বলতে আমার জানা নেই, ম্যাডাম। কেনো তোমাকে ভালোবাসলাম! একদিন তোমাকে দেখলাম। হুট করে প্রেমে পড়লাম! তারপর সেই থেকে আজ অব্দি শুধু ভালোইবেসে যাচ্ছি। শুধু ভালোইবেসে যাচ্ছি!

আদনানের কথায়, বুক থেকে মাথা তুলে তাকায় তুর্কি। চোখ বড়-বড় করে বলে—
-সত্যি আপনি বললেন আমাকে ভালোবাসেন? সত্যি এইটা আপনার মুখ দিয়ে বের হলো? আল্লাহ্!
তুর্কির কথায় ভঙ্গিতে আদনান শব্দ করে হেসে উঠে। তুর্কি বিস্মিত কণ্ঠে বলে—
– স্যার, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন?
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কী?
তুর্কি, আদনানের হাত ধরে বলে—

– প্রায় সব মেয়েই তাঁর প্রেমিক বা ভালোবাসার মানুষের কাছে ভালোবাসা প্রকাশ কর‍তে লজ্জা পায়। আর আমিই পৃথিবীতে এক বেহায়া মেয়ে, যে লজ্জা পাওয়া তো দূর, চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ম অনুযায়ী ভাত খাওয়ার মত করে— তাঁর স্বামীকে বলে ভালোবাসি, ভালোবাসি আর ভালোবাসি। আর এই কথায় তাঁর স্বামী তাকে বিন্দু মাত্র পাত্তা দেয় না! তারমানে যখন কোনো স্বামী বুঝতে পারে তাঁর বউ তাকে ভীষণ ভালোবাসে— তখন সে নিজেকে মেসি মনে করে। আর বউকে ফুটবল! ফুটবল কে গোলপোস্টে পাঠিয়ে মেসি এত বড় হয়েছে! অথচ ফুটবলের কোনো নামই নেই! কেউ ফুটবলের তারিফ করে না!
আদনান ওর কথা শব্দ করে হেসে ওঠে। তুর্কি, আদনানের হাসি দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলে—

– হাসছেন কেনো? অসভ্য লোক৷
আদনান কিছু বলে না। তুর্কি আবার বলে—
-হয়েছে। হাসা বন্ধ করুন। চলুন বের হবো।
আদনান হাসি থামিয়ে বলে—
-কই?
তুর্কি, আদনানের হাত ধরে বিছানা থেকে নামতে-নামতে বলে—

-আরে কাল বাড়িতে অনুষ্ঠান না। সবার জন্য টুক-টাক কিছু কিনতে হবে। আর তার থেকে ও বড় কথা— আপু তো কিছুই নিয়ে আসেনি। কাল আপু কী পড়বে? তাই, আম্মুকে বলে বের হবো আমরা। তাড়াতাড়ি চলুন।
আদনানকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না তুর্কি৷ ওকে তৈরি হতে বলে; ও হুমাইরার ঘরে চলে যায়। হুমাইরার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দু’জন বের হয় টুক-টাক কেনাকাটা করার জন্য। প্রায় সবার জন্য কিছুনা-কিছু কেনাকাটা করে। দু’জন বাহিরে কিছু মুহুর্ত উপভোগ করে। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাতের খাবার বাইরে খেয়ে আসলে ও — বাড়ির কাছে সেই চায়ের দোকানের সামনে নামে। দু’জন শিরিষ (কড়ই) গাছের নিচে বসে চা উপভোগ করে। মাঝে-মাঝে উচ্চস্বরে হেসে উঠে দু’জন।
চা শেষ হলে দু’জন বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। তুর্কি আদনানের ডান বাহু ধরে হাঁটছে। হাঁটতে-হাঁটতে বলে—

– স্যার, পা ব্যথা করছে৷ হাঁটতে ইচ্ছা করছে না।
আদনান ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে—
-কোলে নেই?
তুর্কি ভেবেছে আদনান হয়তো ওর সাথে মজা করছে। তাই, ও-ও মজা করার জন্য বলে—
-ওকে।
আদনান, হাতের ব্যাগ গুলো ওর দিকে এগিয়ে দেয়। তুর্কি ও কোনো কিছু না ভেবে হাত বাড়িয়ে ব্যাগ গুলো হাতে নেয়। আদনান ওর দিকে ঝুঁকে পাঁজা কোলে তুলতে গেলে— তুর্কি এক লাফে দূরে ছিঁটকে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে—
-আরে আমি তো মজা করেছি। সত্যি-সত্যি নিতে বলেছি নাকি? আর এই রাস্তায় এই ভাবে গেলে মানুষ তাকিয়ে থাকবে। সরুন।
আদনান ওর বাধা উপেক্ষা করে বলে—

-চুপচাপ এই দিকে আসো।
এই বলে ওর দিকে এগিয়ে ওকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। তুর্কি হাতের ব্যাগ গুলো সহ জোরে আদনানের গলা জড়িয়ে ধরে। আদনান হাঁটতে-হাঁটতে বলে—
-মানুষের কাজই ভাবা। আর আমার কাজ আমার বউয়ের অসুবিধা গুলোকে সুবিধা করে দেওয়া। বুঝলেন, ম্যাডাম?
তুর্কি মৃদু হেসে উপরে-নিচে মাথা নাড়ায়। সুরু অন্ধকার পথ ধরে এগোতে থাকে ওরা।

উপমাকে তৈরি করছে তুর্কি। হালকা গোলাপী রঙের একটা শাড়ি পড়েছে উপমা। তুর্কি খুব যত্ন করে চুলের খোঁপা করে দিচ্ছে। থানার সব ঝামেলা সকালে গিয়ে মিটিয়ে এসেছে রেজুয়ান-উপমা। রাতে রেজুয়ান রুমে ছিলো না। তাই, উপমা সাথে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি নি৷ সকালে রেজুয়ান নিজে থেকে এসে ওকে নিয়ে গেছে। ঘণ্টাখানেক আগে এসে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হতে বসেছে। তুর্কি ওকে তৈরি করতে-করতে হাজারো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। তার এক-এক করে উত্তর দিচ্ছে উপমা।
-আচ্ছা আপু, তুমি তো আমাদের সাথে চলে আসতে পারতে। তাহলে আসলে না কেনো?
উপমা চুড়ি পড়তে-পড়তে বলে—

-ঝামেলা হতো। কারণ সাথে আদনান স্যার ছিলো। যদি আব্বু কোনো ভাবে জানতে পারতো স্যার আমাকে সাহায্য করেছে— তখন ঘটনা আরও বিগড়ে যেতো। স্যারের সম্মান যেতো। আর আব্বু যে— যদি স্যারের ক্যারিয়ারে কোনো ঝামেলা করতো। তাই স্যার সহ সবাইকে ঝামেলা মুক্ত রাখার জন্য আমি একাই পালিয়ে এসেছি।
উপমার কথা শুনে তুর্কির হাত ক্ষণকালের জন্য থামে। সত্যি তো, যদি কোনো ঝামেলা হতো৷ উপমা কত দিক দিয়ে ভেবে কাজ করেছে। তুর্কি উপমাকে সম্পূর্ণ তৈরি করে দিয়ে বললো—

– বাহ্! আপু। এত কিছু ভেবেছো তুমি।
উপমা কিছু বলে না। তুর্কি, উপনাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে—
-খুব মিষ্টি লাগছে, আপু। আমার দেবর তো পুরো পাগল হয়ে যাবে তোমাকে দেখে।
তুর্কির কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে উপমা। দৃষ্টি চঞ্চল করে বলে—
-সর। আজগুবি কথা।
-বাহ্! আমার আপু আবার লজ্জা ও পায়।
উপমা, তুর্কিকে নিজের দিকে এনে বলে—
-খুব পাকামো শিখেছো।

-তোমার বড় জা হই। তোমাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তো আমাকেই নিতে হবে তাইনা।
উপমা হেসে তুর্কিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। দরজা ঠেলে ভেতরে আসে হুমাইরা। হাতে একটা ছোট গয়নার বক্স। এই বাড়িতে আসার পর— উপমার সাথে হুমাইরার বেশি কথা হয়নি। রাতে ও আসেন নি।
ওদের দিকে এগিয়ে এসে তুর্কির হাতে বক্স দিয়ে তাতে থাকা সোনার হার বের করে। এই একই ডিজাইনের একটা হার তুর্কির ও আছে। এই বাড়িতে যেদিন এসেছিলো— সেইদিন হুমাইরা দিয়েছিলো। হুমাইরা হারটা নিয়ে উপমার গলায় পড়িয়ে দেয়। উপমা আয়নার দেখে হুমাইরার মুখ। মা কেমন হয় ওর জানা নেই৷ মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় তাও ও জানে না। শুধু সূচির মুখে শুনেছে। তাই তেমন কোনো অনুভূতি ও টের পেলো না। হার পরানো শেষ হলে— হুমাইরা তুর্কির উদ্দেশ্যে বলে— উপমাকে নিয়ে নিচে নামতে।

আদনান কে ডাকতে রুমের দিকে আসে তুর্কি। তবে দরজার কাছে এসে ভেতরে একটা সুন্দর মূহুর্তের সাক্ষী হয়ে। আদনান-মুজাহিদ মিলে রেজুয়ানকে জোর করছে কিছু একটা নিয়ে। ওদের ওট্টোহাসি, কথার শোরগোলে গম-গম করছে রুম জুড়ে। আদনানের পরনে তুর্কির সাথে মিশিয়ে মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি৷ মুজাহিদের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মুজাহিদের দিকে চোখ পড়তে মূহুর্তের জন্য থমকায় তুর্কি। লোকটা এত হাসতে পারে! এত হাসাতে পারে! অথচ তাঁর বুকের যে এত ক্ষত কে বোঝে! তুর্কি ওদের-ওদের মত ছেড়ে দিয়ে জায়গা ত্যাগ করে। রেজুয়ান টেবিলের ওই পাশে গিয়ে বলে—

-বাপের ভাই, ভাই পাঞ্জাবি কেন পড়তে হবে? এই ভাবে গেলেই তো হয়।
মুজাহিদ, আদনানকে বলে—
-বাচ্চা, ওই সাইড দিয়ে যা। পাঞ্জাবি তো পড়তেই হবে। নতুন জামাই বলে কথা। জামাই-জামাই একটা ভাইব আনতে হবে না।
আদনান ওই পাশ দিয়ে যায়। আর মুজাহিদ এই পাশ দিয়ে। অনেকক্ষণ জবরদস্তি করার পর ওরা সক্ষম হয় কাজটি সম্পূর্ণ করতে৷ আদনান-মুজাহিদ বিছানায় গিয়ে বসে। রেজুয়ান পাঞ্জাবির ঠিক করতে করতে বলে—
-কী দরকার এই সব পড়ার। অসহ্য লাগে আমার।
মুজাহিদ বলে—
-এত দিন না বিয়ের জন্য পাগল ছিলি? আর এখন অসহ্য লাগে? মাত্র একদিনেই বিরক্ত হয়ে গেছো? আর তো দিন পড়েই রইছে।
আদনান চলন্ত কথা উপেক্ষা করে বলে—

-বাপের ভাই, এই ফারুক যে সেই ফারুক কোনো দিন তো বলো নাই। আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেদিন গিয়েছিলে— সেই দিন ও তো বললে না।
মুজাহিদ, আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে—
– তোর বিয়ের প্রস্তাবের আগের দিন রাতে আমাকে শিখিয়ে দিলি— এই এই বলবে। আমি তো তাই মুখস্থ করে বলেছিলাম। কিন্তু, ফারুকের কোনো ছবি দেখিয়ে ছিলি? আমি তো শুধু নাম শুনেছিলান। আমি তো আর জানতাম এই ফারুকই সেই ফারুক।
আদনান আপন মনে ঠোঁট উল্টায়। কথা ঠিক। ওই দিকে রেজুয়ান তৈরি হয়ে আসে৷ মুজাহিদ আর কথা না বাড়িয়ে ওঠে দাঁড়ায়৷ আদনানের হাত টেনে ওকে ও ওঠায়। তিন চাচা-ভাতিজা এক সাথে ঘর থেকে বের হয়।

বাড়ি ভর্তি মানুষ। এক রাতের মধ্যেই ভালোই আয়োজন করেছে আলামিন। সব চেয়ে অবাক করার বিষয়— এই কাজ সে একাই করেছে। টাকা যত লাগে সে নিজেই দিয়েছে। হুমাইরা এতে একটু দ্বিধান্বিত। এত কিপটে লোক কীভাবে এত টাকা ভাঙলো আল্লাহ জানে!
উপমাকে বৈঠক খানায় সোফায় বসানো হয়েছে। লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে। সবার খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ। মোহোনা-সূচনা এক নাগারে ছবি ক্লিক করে যাচ্ছে। তুর্কি পাশে বসে একজনের উপর নজর রাখছে।
ওদের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে আদনান, মুজাহিদ সহ আরও অনেকে পুরুষেরা আড্ডা জমিয়েছে। আদনান কথার ফাঁকে-ফাঁকে শতবার তাঁর বধূকে অবলকন করছে৷ তুর্কির পরনে মেরুন রঙের শাড়ি। লাল শাড়ি পড়তে- পড়তে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে৷ তাই গতকাল মেরুন রঙের শাড়ি এনেছে৷ যদিও আদনান কাছে এইটা লাল শাড়ি। দেখতে নাকি লালের মতই!

লম্বা চুল গুলো মাঝ বরাবর সিঁথি করে ঘাড়ের কাছে নিয়ে ঢিলে করে খোঁপা করেছে। কানে ছোট সাদা ফুলের দুল। গলায় আদনানের দেওয়া সেই লাভ পার্ল নেকলেস৷ হাতে এক মুঠো মেরুন রঙের চুড়ি। তবে অবাক করার বিষয়, আজ তুর্কি আদনানের দিকে তাকাচ্ছে না। এতে আদনান ভীষণ বিরক্তবোধ করছে। আজ কি ওকে সুন্দর লাগছে না? যে বউ ওকে সব সময় চোখে হারায়; সেই রমণী একবার ও দেখছে না! না কি মেয়েটা কোনো বিষয় নিয়ে রাগ করলো! হাজার ভাবনা মাথায় নিয়ে ওঠে দাঁড়ালো আদনান।

মূলত, তুর্কি কোহেলির উপর নজর রাখছে। সকালে এসেছে কোহেলি। সেই থেকে তুর্কি বাজ পাখির মত নজর রাখছে ওর উপর। কোনো ভাবেই আদনানের আশে-পাশে ঘেঁষতে দিবে না। কোহেলি কে দেখতে-দেখতে হঠাৎ চোখ পড়ে আদনানের উপর। যে ওর দিকে এগিয়ে আসছিলো। তুর্কির নজর পড়তেই আদনান ইশারা করে উপরে আসতে। ইশারা করে আদনান সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে যায়। আদনানের ইশারায় তুর্কির হৃদস্পন্দন কিঞ্চিৎ বেড়ে যায়। ও ধুকপুক্ হৃদয় নিয়ে ওঠে দাঁড়ায়৷ কয়েক পা এগোতেই সামনে এসে হাজির হয় কোহেলি। হেসে জিজ্ঞাসা করে—

-কেমন আছো?
কোহেলি কে দেখে তুর্কির বিরক্ত লাগলে ও সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলে—
– জি ভালো। আপনি?
-এই তো। চলে যাবো— তাই দেখা কর‍তে আসলাম।
তুর্কি ভাবলেশহীন হয়ে বিড়বিড় করে বলে—
-তাড়াতাড়ি বিদায় হোন!
কোহেলি ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কী বললে?
-কিছু না। আমি যাই। আমার কাজ আছে। বর ডাকছে।
এই বলে তুর্কি, কোহেলিকে এড়িয়ে চলে যেতে নেয়। তবে, তার আগেই হুমাইরা এসে বলে— উপমাকে নিয়ে খাবার ঘরে আসতে। দেরি যেনো না করে। তুর্কি একবার উপরে তাকায়। আদনান কিসের জন্য ডাকলো— তা তো জানা হলো না। তার উপর উপমা ও কিছু খাই নি সকাল থেকে৷ তাই, ও নিচে নেমে উপমার কাছে যায়। ওকে নিয়ে খাবার ঘরে চলে যায়।

ও দিকে আদনান, অধির অপেক্ষায় অপেক্ষারত বউয়ের জন্য। কিন্তু, তুর্কির কোনো পাত্তা নেই। তাই, বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়। মুজাহিদের ডাকে খাবার ঘরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে তুর্কি খাবার পরিবেশ করছে। আদনান ধীর পায়ে হেঁটে এসে তুর্কির পাশ কাটিয়ে চেয়ারে বসে। তার পাশে বসে মুজাহিদ। রেজুয়ানকে দেখতে না পেয়ে মুজাহিদ বলে— রেজু কে নিয়ে আসছি৷ তুর্কি, আদনানের প্লেটে খাবার বাড়তে গেলে আদনান ক্ষীণ স্বরে বলে—
-খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে? ডেকেছিলাম বোধহয়।
তুর্কি মাছ ভাজির প্লেট আর গোশতের বাটি এগিয়ে এনে বলে—

-যাচ্ছিলাম তো। কিন্তু, মাঝ পথে এক ডাইনির সাথে দেখা হয়েছিলো। তাই…
কথা শেষ হওয়ার আগেই আবারও হুমাইরার ডাক ভেসে আসে—
-কামরুন, এই দিকে শোনে যাও তো মা।
তুর্কি আর কথা শেষ করতে পারে না। আদনানের প্লেটে দুই পিস মাছ ভাজি দিয়ে বলে—
-খেতে থাকুন। আমি এসে গোশত দিচ্ছি।
আর দেরি করে না তুর্কি। ছুটে চলে যায় হুমাইরার ডাকে। আদনান বউয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

তুর্কি, উপমাকে রুমে দিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। উপমা শান্ত হয়ে ফুল বিছানো বিছনায় বসে রয়েছে। একটা গোলাপের পাপড়ি নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আঙুলের ফাঁকে গুঁজে নাড়াচ্ছে। আনমনে ভেবে চলছে কিছু। কিছু-মূহুর্ত পর রুমে ঢুকে রেজুয়ান। হাতে একটা ব্যাগ।
উপমা রেজুয়ানের উপস্থিত টের পেয়ে আড়চোখে তাকায়। রেজুয়ান রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে। ধীর পায়ে হেঁটে হেসে বিছানার কাছে দাঁড়ায়। হাতের ব্যাগ বিছানায় রেখে দিয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে—
-চেঞ্জ করে নেও।

এই বলে উলটো ঘুরে নিজে চেঞ্জ করতে যায়। উপমা মাথার ওড়নার পিন খোলার চেষ্টা করে৷ কয়েকটা খুললে ও বাকি গুলা খুলতে হিমশিম খায়। তাই, বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। আয়নায় দেখার চেষ্টা করে। রেজুয়ান পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে টি-শার্ট পড়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পড়তে দেখে উপমা মাথার ওড়না খোলার চেষ্টা করছে। রেজুয়ান হাতের তোয়ালে বারান্দায় মেলে ভেতরে আসে। উপমা আয়নায় দৃষ্টি রেখে, রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে—

– এইটা একটু দেখো তো। খুলতে পারছি না।
রেজুয়ান উপমার দিকে এগিয়ে এসে পিন খোলার চেষ্টা করে। সমস্যা হচ্ছে, পিনটা চুলের সাথে এমন ভাবে প্যাঁচিয়েছে যে— চুলের খোঁপা না খুললে খোলা সম্ভব হবে না। রেজুয়ান, উপমার উদ্দেশ্যে বলে—
-খুব বাজে ভাবে আটকিয়েছে। খোঁপা খুলতে হবে। চেয়ারে বসো।
উপমা কোনো কথা না বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে। রেজুয়ান ওর খোঁপা থেকে একটা-একটা করে ক্লিপ খুলতে থাকে। খোঁপায় লাগানো হলুদ গোলাপ ও খুলে। উপমা হাতের চুড়ি, আংটি খোলে। কানের দুল খোলার সময় আয়নাতে দৃষ্টি পড়তে দেখে— রেজুয়ান ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ওর খোঁপার ক্লিপ; ওড়না খোলতে মত্ত। ওর মাথার এলোমেলো চুল গুলো বাতাসের দরুন উড়ছে।

রেজুয়ান, ওর ওড়না খুলে আয়নায় তাকায়। দু’জনের দৃষ্টি সংযোগ হতেই উপমা দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। রেজুয়ানের চাউনিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত বসা থেকে ওঠে দাঁড়ায়। বিছানার কাছে গিয়ে ব্যাগ থেকে শাড়ি, তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।
রেজুয়ান ওর আড়ষ্টতা দেখে ম্লান হাসে। উপমা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে মুখ মুছে তোয়ালে, পরনের আগের শাড়ি বারান্দায় মেলে দিয়ে আসে। তবে রুমের কোথাও রেজুয়ানকে দেখতে পায় না। ছেলেটা কি আজও বাইরে থাকবে। মেজাজ চড়ে যায় উপমার। খুব তো ওর পিছু-পিছু ঘুরতো— তো আজ কেনো ওর থেকে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়ায়! উপমা ধীর পায়ে হেঁটে বিছানায় গিয়ে বসে। মনে-মনে ক্ষোভ প্রকাশ কর‍তে থাকে রেজুয়ানের প্রতি।
ক্ষণ-মূহুর্ত পেরোনোর পর— দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে রেজুয়ান। ওর হাতে খাবারের ট্রে।টেবিলের রাখতে-রাখতে বলে—

-এসো খেয়ে নেও। দুপুরে তো ভালোভাবে খাওনি।
রেজুয়ানের কাজে চরম বিস্মিত হয় উপমা! ও এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে রেজুয়ানের দিকে৷ রেজুয়ান, টেবিলের অপর থেকে জগ নিয়ে পানি নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে উপমার দিকে তাকায়। দেখে উপমা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কী? এসো।
উপমা শোধবোধ ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়ায়। রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে—
-তুমি?
-আমি খেয়েছি সন্ধ্যায়।
-রাত তো অনেক হয়েছে। সন্ধ্যার খাওয়া এখনো আছে? বসো।

মূলত রেজুয়ান সন্ধ্যার কথা বললে ও— ও সন্ধ্যায় খায়নি। দুপুরে আদনান-মুজাহিদের সাথে খেয়েছিলো। আর না খেয়ে ও বেশিক্ষণ থাকয়ে পারে না। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে টেবিলে বসে। উপমা টেবিলের কাছে গিয়ে খাবার বাড়ে। তবে সমস্যা হচ্ছে রেজুয়ান প্লেট একটা এনেছে। তাই বলে—
-দাঁড়াও। প্লেট আরেকটা নিয়ে আসি।
উপমা বাধা দিয়ে বলে—
-দরকার নেই। একটা তেই খাবো।
রেজুয়ান চলন্ত পা যুগল থামিয়ে বলে—
– সমস্যা হবে না?

উপমা ডানে বামে মাথা নাড়ায়। রেজুয়ান পুনোরায় চেয়ারে বসে। দু’জনকে আড়ষ্টতা জেঁকে ধরলে ও এক প্লেটে খাবার শেষ করে। খাওয়া শেষ হলে উপমা প্লেট ওঠাতে যায়; রেজুয়ান বলে
-তুমি হাত ধুয়ে আসো। আমি ওঠাচ্ছি।
এই বলে প্লেট সহ ট্রে নিচে নিয়ে যায়। উপমা হাত ধুয়ে এসে বিছানায় বসে। চেয়ারে ওড়না দেখতে পেয়ে সে-টা বারান্দায় মেলে দিতে যায়। গভীর রাত হওয়ায় দূরের সব কিছু অস্পষ্ট। ওড়না মেলে দিয়ে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়ায় ও। তারপর ঘরে এসে দেখে রেজুয়ান বিছানা ঝাড়ছে। বিছানায় ছিঁটানো ফুল গুলো ঝেরে এক পাশে রাখছে। উপমা ধীর পায়ে হেঁটে আসে। বালিশ ঠিক করে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। উপমার উদ্দেশ্যে বলে—

-তুমি রেস্ট করো। আমার একটা কাজ আছে। একটু বের হবো।
উপমা, রেজুয়ানের দিকে এগিয়ে এসে বলে—
-কই যাবে?
-একটা কাজ আছে।
-কী কাজ?
রেজুয়ান কিছুক্ষণ ভেবে বলে—
-এক ফেণ্ডের বাসায় যাবো।
উপমা ভ্রু কুঁচকে বলে—
-এত রাতে?
রেজুয়ান উপরে-নিচে মাথায় নাড়িয়ে বলে—
– হ্যাঁ, খুব দরকার। যাবো আর আসবো। তুমি রেস্ট করো।
এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় রেজুয়ান। উপমা ওর যাওয়ার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসে। ছেলেটা কাল রাতে ও বাইরে ছিলো। আজ ও গেল। নতুন বউ ঘরে রেখে বাইরে যায় কে? কিছুক্ষণ আনমনে ভেবে রেজুয়ানের জন্য এক পাশে জায়গা রেখে অন্য পাশে গা এলিয়ে দেয়।

সারাদিন হৈ-হুল্লোড়, আমদ-ফুর্তি করে ঘরের দিকে আসে তুর্কি৷ সুরু বারান্দা পেরিয়ে রুমের সামনে এসে ক্ষণকালের জন্য দাঁড়ায়। দরজা ভিড়ানো। রুমের ভেতর থেকে সামান্য নীল আলোর রেখা দৃশ্যমান হচ্ছে। আদনান তো অনেক আগেই রুমে এসেছে। তাহলে ঘর এই রকম অন্ধকার করে রেখেছে কেনো? লোকটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
ও আর কিছু না ভেবে ভিড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। রুমের ভিতরে প্রবেশ করে মূহুর্তের জন্য থমকায়! নীল আলোয় পরিলক্ষিত হচ্ছে— আদনান বিছানার সামনে চেয়ারে বসে রয়েছে। এক পা অন্য পায়ের উপর তোলে মৃদু দোলাচ্ছে। ডান হাতের কনুই চেয়ারের হাতলে রেখে, হাতের পাঁচ আঙুলের মুষ্টি ঠোঁটে ঠেকানো।
বিছানার চাদর সহ; ফ্লোরে গোলাপের পাপড়ি ছিঁটানো। তবে গোলাপের ঘ্রাণের থেকে তীব্র ভাবে ভেসে আসছে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ! বোধহয় রজনীগন্ধা ফুল ও আছে বিছানায়। সব কিছু দেখে তুর্কির কপালে ভাঁজ পড়ে। এইসব লোকটা কখন করলো!

আদনান, তুর্কির উপস্থিতি দেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে তুর্কির দিকে এগোতে-এগোতে; মন্থর কণ্ঠে বলে—
-খুব ব্যস্ত ছিলেন, ম্যাডাম। সারাদিন আপনার দেখা পেলাম না।
তুর্কি ঠোঁটে আঁকা হাসি নিয়ে; হাত বাড়িয়ে লাইট অন করতে গেলে—আদনান বাধা দেয়। ওর সামনে এসে এক হাত বাড়িয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে। অন্য হাত দিয়ে ওর বাড়ানো হাত ধরে বলে—
-উঁহু! লাইট অন করো না। এই দিকে আসো।
তুর্কি ক্ষীণ কণ্ঠে বলে—
-এই সব কখন করলেন, স্যার?
আদনান ওর কথার জবাব না দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খায়। তার পর বলে—
-দরজা লক করো।
তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার খোলা দরজা দেখে বলে—
-আপনি করুন।
আদনান ওর কপালে-কপাল ঠেকিয়ে বলে—
-আমি বিজি!
তুর্কি, আদনানের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে, দুই হাত মালার কত করে আদনানের গলা জড়িয়ে ধরে। মৃদু হেসে বলে—
-আমি ও বিজি!
আদনান এক ভ্রু উঁচু করে বলে—
-আচ্ছা!

এই বলে আদনান, ওই হাত বাড়িয়ে; দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে তুর্কির কোমড়। নিজের আরও কাছে এনে তুর্কির গলায় মুখ গুঁজে চুম্বন করে পূর্বের স্বরেই বলে—
– আমি তোমার থেকে বেশি বিজি!
আদনানের অধরের স্পর্শে চোখ খিঁচে ফেলে তুর্কি। আদনানের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে-করতে বলে —
-সরুন। অসভ্য লোক।
আদনান মোহময় কণ্ঠে বলে—

-উঁহু। থাকো কিচ্ছুক্ষণ। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ! সারাদিন একটা বার কাছে আসো নি। এখন আর দূরে যেও-না।
আদনানের কথা মৃদু হাসে তুর্কি। সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরে ওকে। দীর্ঘক্ষণ এক গভীর আলিঙ্গন শেষে সারা-দিনের মনের ক্লান্তি শেষ করে দু’জন। আদনান ওকে মুক্ত করে দেয়। তুর্কি খোলা দরজা বন্ধ করে দেয়। আদনান হাত বাড়িয়ে তুর্কির হাত ধরে বিছানার দিকে যেতে থাকে। যেতে-যেতে বলে—
-আমি সাজাইনি। হয়তো মীমের রুম ডেকোরেশনের সময় এই রুম ও করে গেছে।
তুর্কি প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। ছিঁটানো গোলাপের পাপড়ি পেরিয়ে যায় দু’জন। বিছানার কাছে গিয়ে তুর্কি পা তুলে দুই হাঁটু বুকের সাথে মিশিয়ে বসে। আদনান বাধা দিয়ে বলে—

-উঁহু! দুই পা ভাঁজ করে বসো।
-কেনো?
-আরে বসো।
তুর্কি দুই পা ভাঁজ করে ঋজু হয়ে বসে। আদনান ওর কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তুর্কি মৃদু হেসে আদনানের মাথার চুলে ওর হাত ডুবিয়ে দেয়। আদনান চোখ বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস নেয়৷ এর পর চোখের পাতা মেলে বলে—
– আগামীকাল তোমার সিটির রেজাল্ট দিবে।
এত সুন্দর একটা মূহুর্তে; এত কুৎসিত একটা টপিক তোলায় তুর্কির হাসি মূহুর্তেই মিলিয়ে যায়। এই লোকটা এমন কেনো? ও ভেবে পায় না। কোন বর এত সুন্দর একটা মূহুর্তে রেজাল্ট এর মত ভয়ংকর কথা তুলতে পারে। তুর্কি রাশভারী কণ্ঠে বলে—

– স্যার, আপনাকে মাঝে মাঝে আমার চিংড়ির মত লাগে।
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে—
-মানে?
তুর্কি, আদনানের চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে—
-মানে, চিংড়ির মাথায় মল থাকা সত্ত্বেও; চিংড়ি যেমন প্রায় সবার— প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকে। আপনি ও আমার কাছে ঠিক তেমন! আপনার মাথায় সমস্যা থাকলে ও আপনাকে আমার ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে! একদম ভয়ংকর ভালো লাগে!
তুর্কির কথায় আদনান সিলিং থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তুর্কির দিকে তাকায়। চোখ ছোট-ছোট করে বলে—
-আচ্ছা! তাই? আগামীকাল রেজাল্ট দিক। শুধু কোনো সাবজেক্টে ফেল করে দেখো। তারপর তোমাকে বোঝাবো এক মাসে কয় দিন! পড়াশোনা ফেলে, সব সময় আমার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া তোমাকে শেখাবো!
তুর্কি ভাবলেশহীন হয়ে বলে—

-কোনো সমস্যা নেই, স্যার। জীবন সঙ্গিনী হিসেবে আমি হচ্ছি, তেলাপোকা! তেলাপোকাকে যেমন ঝাটা-ঝাড়ু দিয়ে পিটালে ও উড়ে কাছে চলে আসে; আমি ঠিক তেমন বেশরম! আপনি আমাকে যতই মারুন, কাটুন এমনকি বাপের বাড়ি দিয়ে আসুন। আমি ঠিকই উড়ে আপনার কাছে চলে আসবো। কারণ, আমার সোয়ামি ছাড়া আমি এক মূহুর্ত ও থাকতে পারবো না!
আদনান, তুর্কির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তুর্কি আদনানের চাউনি দেখে বাঁ চোখ মারে। ঠোঁটে আঁকা হাসি নিয়ে বলে—

-আই লাভ ইউ, স্যার। আপনাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি।
আদনান হাত বাড়িয়ে তুর্কির কপালে থাকা চুল কামে গুঁজে দিয়ে স্বভাবতঃ নাকে টোকা দেয়। তুর্কি চোখ খিঁচে বলে—
– স্যার, উঠুন। আবার প্রথম থেকে আসুন।
তুর্কির কথা বোধগম্য হয় না আদনানের। তাই ও কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বলে—
-মানে?
তুর্কি, আদনানকে উঠিয়ে বলে—

–শুধু মানে মানে করেন কেনো? বোঝাতে চেয়েছি—আমি ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবো। আপনি ফের থেকে রুমে ঢুকে আমার ঘোমটা তুলবেন। আমাদের বিয়ের রাতে তো ঘোমটা খোলা দূর— আমার কাছেই আসেন নি। আমি উলটো গেলাম; তবুও আমাকে পাত্তা দিলেন না। তো, আজ যখন ফের ওই রাতের মত আমাদের রুমটা সাজানো হয়েছে— এইটার সৎ ব্যবহার করা যাক। তাড়াতাড়ি বাহিরে যান। আবার ফের থেকে আসুন।
আদনানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে; তুর্কি ঠেলে-ঠুলে ওকে বিছানা থেকে নামায়। তারপর দরজার খোলে ওকে বের করে। নিজে বিছানার মাঝখানে এসে দুই হাঁটু বুকের সাথে মিশিয়ে বসে। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় বড় করে ঘোমটা টানে। তারপর আদনানের উদ্দেশ্যে বলে—

– স্যার, আসুন!
তুর্কির ডাক শুনে ভেতরে আসে আদনান। দরজা বন্ধ করে তুর্কির সামনে বসে। তুর্কি নতুন বউয়ের মত মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে বসে রয়েছে। আদনান মৃদু হেসে ওর ঘোমটা উপরে তোলে৷ তুর্কির ঠোঁটে আঁকা হাসি৷ আদনান ওর দুই গাল ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে—
– মাশাল্লাহ্! আমার পিচ্চি বউ!
আদনানের মুখে ‘পিচ্চি’ কথাটি শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে আদনানের বাহুতে চড় মারে তুর্কি। মুখ বাঁকিয়ে বলে—
– অসভ্য লোক! কিসের পিচ্চি?
আদনান শব্দ করে হেসে দুই হাত মেলে দিয়ে বলে—

-এই দিকে আসেন, ম্যাডাম।
-যাবো না।
আদনান ওর হাত টেনে বলে—
-আরে আসো। মান করো না। আদর দেই!
-লাগবে না। সরুন।
তুর্কির বাধা থাকা সত্ত্বেও আদনান ওকে নিজের কাছে এনে বক্ষস্থলে আবদ্ধ করে। মাথায় চুম্বন করে গম্ভীর ভাবে আবদ্ধ করে। তুর্কি ওর ঠুনকো রাগ টুকু দূর সরিয়ে স্বামীকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে। হর্ষাবেশ কণ্ঠে বলে—
-জানেন স্যার, মাঝে মাঝে মনে হয় আপনাকে আপনারা থেকে চুরি করে; আমার হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখি৷ যাতে কখনো আপনি আমার থেকে দূরে না যেতে পারেন।
আদনান মৃদু হেসে ওর পিঠ সহ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে—

– তোমাকে তো বলেছিই— পৃথিবীতে সব থেকে নির্মল কঠিন সত্য হচ্ছে মানুষ মরণশীল! এই মানবজীবন ভীষণ ক্ষণস্থায়ী। এক সেকেন্ডের ভরসা নেই। সবাইকে পৃথিবীর মায়া একদিন ত্যাগ করতে হবে। তবে এই টুকু ওয়াদা তো করতেই পারি— যদি সৃষ্টিকর্তা চান তবে মৃতু ব্যতীত, তোমার আমার দূরত্ব অসম্ভব ম্যাডাম। চিন্তা মুক্ত থাকো।
মৃত্যুর কথা উঠতেই তুর্কির বুক কেঁপে ওঠে। স্মৃতির পাতায় ভাসমান হয় মুজাহিদ আর ববিতার বিচ্ছেদের কথা। ও দ্রুত আদনানের বুক থেকে মাথা তুলে কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে বলে—
-আপনি সব সময় মৃত্যুর কথা বলেন কেনো? ভালো লাগে না আমার।
আদনান ওর গালে হাত রেখে বলে—

-এইদিকে আসো।
তুর্কি এক ঝটকায় আদনানের হাত সরিয়ে বলে—
– সরুন। ঘুম আসবো আমি৷ ভালো লাগছে না আমার।
এই বলে তুর্কি বালিশ টেনে শুতে যায়। আদনান বাধা দিয়ে ওর দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে—
– সরি সরি, ম্যাডাম। আর বলবো না। রাগ করো না।
তুর্কি অন্য দিকে তাকায়। আদনান বাহু ছেড়ে দুই হাত তুর্কির গালে রেখে ওর নিচু করা মুখশ্রী কিঞ্চিৎ উপরে তোলে। নিজের মুখ একটু ঝুঁকিয়ে ওর অধরে-অধর ছুঁইয়ে দেয়। তুর্কি আঁখি যুগল সহসা বন্ধ হয়ে যায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। প্রগাঢ় এক চুম্বন শেষে আদনান ওর ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে নেয়। চেপে ধরে বক্ষস্থলে। তুর্কি, আদনানের বুকের শার্ট হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলে—

-আর কখনো এই সব বলবেন না। আমার ভীষণ ভয় লাগে, স্যার! ভীষণ ভয় লাগে!
আদনান ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলে—
– ওকে, ম্যাডাম।
তুর্কি আরও শক্ত করে চেপে ধরে আদনানকে। বুকে মুখ গুঁজে বলে—
– ভালোবাসি, স্যার! আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।
আদনান মৃদু হেসে ওকে বক্ষস্থল থেকে ওঠায়। ওর দুই গালে হাত দিয়ে বলে—
– স্যার, ডাকটাকে ফেলে দেও তো। শুনতে শুনতে আমার কানে জং ধরে গেছে। বলো ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, আদনান! ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি!’
তুর্কি কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে গাল থেকে আদনানের হাত সরিয়ে দেয়। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে—
– ধ্যাৎ! আপনার নাম ধরে ডাকবো পাগল নাকি আমি? সরুন ঘুম আসবো আমি।
আদনান ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে—

-তোমার কথা আমি রেখেছি না? যেভাবে আসতে বলেছিলে এসেছিনা? তো আমি এখন কিছু চাইছি সেটা দিবে না কেনো? আর বাসর রাতে বর বউয়ের কাছে কিছু চাইলে দিতে হয়।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
-মোটে ও আজ আমাদের বাসর রাত না। এইটা বোনাস। ভাইয়ের ঘর ডেকোরেশনের সময় আমাদের টা ও ভুলে করে গেছে।
– হ্যাঁ, করে তো গেছে। তার মানে বাসর রাতই। আর যে রাতই হোক, তোমার কাছে আমি কিছু চাইছি সেটা আমাকে দিবে না?
তুর্কি, আদনানের চোখের দিকে তাকায়। নীল আলোয় আদনানের চোখে-চোখ পড়তে আড়ষ্টতা ওকে আরও জেঁকে ধরে। আদনান আবার বলে—

– সারা দিন তো আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ করো। তাহলে এইটা বলতে সমস্যা কী?
তুর্কি, আদনানের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে বলে—
– আচ্ছা, লাইট অফ করে আসুন।
আদনান ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কেনো?
-আমি বলছি তাই। যান।
আদনান ওকে ছেড়ে লাইট অফ করতে যায়। যেতে-যেতে বলে—

– অথচ কাল রাতে বললো, সব মেয়েরা ভালোবাসা প্রকাশ কর‍তে লজ্জা পেলেও নাকি ও পায় না। লল!
তুর্কি মুখ বাঁকায়। আদনান লাইট অফ করে আসে। পুরো রুম গভীর অন্ধকারে ঢেকে যায়। স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। শুধু বিছানায় ছিড়িয়ে-ছিঁটিয়ে থাকা ফুল গুলোর সুবাস ভেসে আসছে৷ আর শব্দ হচ্ছে তুর্কির হৃদ যন্ত্রের! আদনান ওর সামনে এসে বসলে ও অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে আদনানকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দেয়। ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করে—
– আমি তোমাকে ভালোবাসি, আদনান! ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আমার নিজের থেকে ও তোমাকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ, আদনান!
আদনান ও মৃদু হেসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে—

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৩

-ইউ টু তুর্কি ম্যাডাম!
আদনানের মুখে ‘তুর্কি’ ডাক শুনে তুর্কি আবিষ্কার করলো আদনান বোধহয় এই প্রথম ওর নাম বললো! সব সময় তো ‘পিচ্চি বউ, বেগম-সাহেবা, ম্যাডাম’ এই সবই বলে৷ তুর্কি দ্রুত আদনানের বুক থেকে মুখ তুলে বলে—
– আপনি আমার নাম বললেন?
আদনান ওর দুই গালে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—
– হুঁশ…এই দিকে আসো!’

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪৬