যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১২ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১২
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়চ্ছে। ঘর শীতল। মৃদু টিমটিম লাল-নীল আলো।বিছানার পাশে ছোট ছোট মোম জ্বলজ্বল করছে। বাসর রাতের মতো সাজানো ঘরটি আজ ইয়ামিনের। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবচ্ছে। মহুয়া তার অংশ হয়ে গেছে। অথচ তার যে একটি অতীত আছে! তাতো বলার সুযোগ পায়নি। তো কি হয়েছে তখন পায়নি? আজ রাতটুকু তো পেয়েছে? নতুন সম্পর্কে গড়ে উঠার আগে অবশ্যই পুরাতন সম্পর্কে জানানো দরকার? ইয়ামিন মনে মনে স্থীর করে ফেললো আজ সব বলবে সে মহুয়াকে সব শোনার পর যদি সে চায়! নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে? তাহলে তাই হবে। ইয়ামিন গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। সেই মুহূর্তে দরজা বাহিরে শোনা গেলো একদল কিশোরী, তরুণীর খিলখিল শব্দ।তারা দরজা ঠেলে মহুয়াকে ভিতরে নিয়ে এলো।সুন্দর মুখশ্রীর আর পিটানো শরীরের চকচকে ঝকঝকে লাল লেহেঙ্গা। খিলখিল করে হেসে এগিয়ে এসে বলল,

“ভাইয়া টাকা দাও। নয়তো বউ কিন্তু নিয়ে পালিয়ে যাবো!”
তারপর খানিক ফিসফিস করে বলল,
“সারা রাত পরে কিন্তু কাছে পাবে না!”
মেয়েটির কথায় হাসির রোল পড়লো। ইয়ামিন কাছে এসে মেয়েটির কান চেঁপে ধরে বলল,
“আয়দা খুব পেকে গেছিস তুই!”
কানে ধরতেই “ব্যাধা পাচ্ছি” বলে ন্যাকামো কান্নার ভঙ্গি করে বলে,,
“এই ভাইয়া ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি কিন্তু। আমি কিন্তু সত্যি বলছি, টাকা নাই বউ, ফউ নাই। ভাবিকে নিয়ে চলে যাবো হুম!”
ইয়ামিন হেসে দিলো। আয়দার চুলে জোরে টান দিয়ে বলল,
“ড্রামা কুইন। নাটক, ফাটকে নাম লিখিয়ে ফেল। ভালো ইনকাম হবে তোর। আমার টাকা গুলো বাঁচবে!”
ইয়ামিন ১০ হাজার টাকা একটি বান্ডিল বের করতেই ছু মেরে নিয়ে গেল আয়দা।বান্ধবীদের সাথে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলল,
“আমি যত টাকাই ইনকাম করি না কেন! ভাইয়ের টাকাতো নিবোই, ইহাতে আলদা মজা আছে যে!”
ইয়ামিন হাসলো। মহুয়ার দিক একপলক তাকিয়ে বসতে বলল।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো মহুয়া। ইয়ামিন কাঁধ বাকিয়ে এক বার তাকিয়ে আবার বাহিরে তাকালো। মহুয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আমার পাশে এসে দাঁড়া-ও। ”
মহুয়া কাচুমাচু হয়ে ইয়ামিনের পাশে দাঁড়ালো। অনেকটা জড়তা কাজ করছে। ইয়ামিন কোনো ভণিতা ছাড়াই বলতে শুরু করলো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

” অনার্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। টগবগ জোয়ান, ভার্সিটির সেরার খাতায় আমার নাম। সব স্টুডেন্ট, শিক্ষকের আকর্ষণ। আমার ধারণা ছিলো পড়াশোনার বাহিরে কোনো দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সব পাল্টে এক তরুনী আগমন ঘটলো আমার জীবনে।ধাপিয়ে প্রেম শুরু হলো আমাদের। বেপরোয়া ভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো যেন ছিলো আমাদের কাজ।”
এ পর্যায় একটু হাসলো ইয়ামিন। পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠতেই চোখের কোনে টলমল করে উঠলো বিষাদ। ইয়ামিন বিছানায় হেলে বসলো। মহুয়া তাকিয়ে রইলো যন্ত্রণায় নিঃশেষ হওয়া মানবটির দিকে।ইয়ামিন আবার বলতে শুরু করলো,
“আমার তানিশার ধারণাও ছিলো তোমার মতো। খুব চাইতো পায়রা প্রেম করবে। তার প্রেমের সাক্ষী হবে আকাশ, চাঁদ, তারা, বৃষ্টি, গাছ-পালা। কিন্তু হলো না। তাই মনে দুঃখ পুষিয়ে রাখতো সব সময়। তাই আমি বার্থডেতে পায়রা গিফট করি। কিন্তু সে হোস্টেলে থাকতো বলে পায়রা আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি। আমার বাসায় তানিশা প্রায় আসতো। পায়রাদের সাথে খেলতো। আমি সব ক্যামেরাবন্দি করে রাখতাম।”

আবার হাসলো ইয়ামিন। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো কয়েক ফোঁটা। মহুয়া ইয়ামিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ইয়ামিন এবার বাচ্চাদের মতো কাঁদে দিলো। মহুয়া ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ইয়ামিন মহুয়াকে ঝাঁপটে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো। মহুয়ার চোখেও বৃষ্টি নামলো। আকড়ে রাখলো ইয়ামিকে। ইয়ামিন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“সব ঠিক ছিলো। তাহলে কেনো এমন হলো? সে কেনো চলে গেলো? কেন চলে গেলো? আমরা তো এক সাথে বাঁচবো, মরবো বলেছিলাম। সে কেন তার ওয়াদা ভাঙ্গলো!জানো সাদা কাপড়ে মোড়ানো ওর রক্তে লাল হওয়া মুখখানি ভুলতে পারি না। এই দুই হাতে ওর মুখ স্পর্শ করেছি। তানিশার রক্তে লাল হয়েছিল আমার হাত। আমি ভুলতে পারি না। পারি না ভুলতে।”

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১১

কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা। ইয়ামিন এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহুয়ার কষ্ট হচ্ছে। কি বলবে এখন ইয়ামিনকে? কি বলা উচিত এ মুহূর্তে? ইয়ামিনের আম্মু অবশ্য সব বলেছেন। তানিশা মেয়েটি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কোনো এক ট্রাক চাপা দিয়েছিলো তানিশার সি এন জিকে আর সেখানেই তানিশা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। মহুয়ার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বান বের হয়। ইয়ামিনের দিকে পানি এগিয়ে দিলো। এক ঢুক পানি খেয়ে ইয়ামিন আবার জানালার ধারে এসে ঠাই নেয়। রাতের নিকেশ কালো অন্ধকারে ঢাকা চারিপাশ।ইয়ামি আবার বলতে শুরু করলো,
“তানিশা চলে যাওয়ার পর আমি নিজেকে বন্ধ করে ফেলি ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই। আমার সঙ্গী হয়ে উঠে পায়রা। ”
“পায়রা?”

“হে পায়রা! সাদা পালকে ঘেরা নির্জীব প্রাণী! ”
মহুয়া অবাক হয়ে চাইলো ইয়ামিনের দিক। মনে মাঝে কেমন ভয় ভয় করছে। সারা শরীর হালকা কাঁপুন দিচ্ছে। মহুয়া শুকনো ঢুক গিললো। ইয়ামিন হেসে বলল,
“৯০ দশকের পাগলো প্রেম আমিও করেছি মহুয়া!”
মহুয়া হা হয়ে গেলো। পরের কথা টুকু শুনে শরীর শিরশির করে উঠলো।

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১৩