যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১৪ || সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১৪
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি

চোখের উপর অপরিচিত কত গুলো মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকায় ইয়ামিন। পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশে দেখে বুঝতে পারলো সে এখন হসপিটালের সাদা চাদরে লেপ্টে আছে। হাসপাতালের এই রুমটিতে ভিন্ন যন্ত্রপাতি। ইয়ামিনকে চোখ খুলতে দেখেই, সাদা ফিনফিনে ড্রেসের এক নারী চেঁচিয়ে উঠে, “জ্ঞান ফিরেছে উনার” বলে বেরিয়ে গেলেন। আরেকজন নার্স ইয়ামিনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ামিন চোখ ঘুরিয়ে চাইলো। রুমের মাঝে থাকা বড় জানালা দিয়ে আসা রোদের ঝকঝকে আলো পড়ছে তার পায়ে। ইয়ামিন শুধালো,

“আমি এখানে?”
নার্সটি এগিয়ে এলো। সাদা ফিনফিনে কাপড়ে শ্যাম বর্ণের ছিপছিপে শরীরের তরুণী। স্মিত হেসে বলল,,
“আপনি হাসপাতালে!”
ইয়ামিনের মাথায় চিন্তা ভাজ পড়লো। বলল,
“আমি এখানে কি করে এলাম?”
“আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিল স্যার!”
চমকে উঠে বলল ইয়ামিন,
“এক্সিডেন্ট? কই আমার তো মনে পরছে না কিছু?”
নার্সটি কি বলবে বুঝতে পারলো না। তার মাঝেই ঘরটিতে ঢুকলেন সাদা পোশাকে আধা-পাকা চুলের এক মাঝ বয়সি লোক। হাসি হাসি মুখে বলল,
“এখন কেমন আছেন আপনি?”
“আমার কি হয়েছে? বুঝতে পারছি না!”
লোকটির মুখে অন্ধকার নেমে এলো যেন। ঘামতে লাগলো কিছুটা। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলল,
“আপনি এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। আজ দশ দিন যাবত কোমায় ছিলেন।”
ইয়ামিন অবিশ্বাসের সাথে বলল,
“অসম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি গাড়িতে ছিলাম। চোখের সামনে আবাছা হয়েছিলো শুধু। এক্সিডেন্ট হয় নি। আপনি মিথ্যা বলছেন!”

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

“আমি কেনো মিথ্যা বলবো?”
“ইয়ামিন বাবা তুই উঠেছিস?”
ডাক্তারের কথার মাঝেই কালো ছাপের সাদা শাড়ি পরা এক মধ্য বয়সী নারী কেবিনে প্রবেশ করলো। মুখে মাধুর্য ভরপুর। ছেলের এমন বেহাল দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো। পিছনেই ইয়ামিনের বোন আয়দা দাঁড়িয়ে ফুপাচ্ছে। জাম রঙ্গা সুতি জামায় আবরিত তরুণীর বাচ্চা সলুভ কিশোরী মুখ লাল হয়ে আছে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,
“তোমরা কাঁদছো কেন?”
মা ইয়ামিনের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
” আজ কতদিন পর তোকে চোখ খুলতে দেখেছি বাবা। সেই যে গেলি রাগ করে, মেয়েদের ছবি দেখিয়ে ছিলাম বলে, আর হবে না বাবা। তুই যখন বলবি! তখনি বিয়ে করাবো!”
ইয়ামিন আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কিসের বিয়ে মা? আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি আবার কিসের বিয়ের কথা বলছো?”
আয়দার দিকে তাকিয়ে ইয়ামিন জিগ্যেস করলো,
“আয়দা? তুমি তোমার ভাবি খোঁজ পেয়েছো? কোথায় আছে জানো কিছু?”

আয়দা আর তার মা একে অপের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। দুজনেই কান্না ভুলে গেলো। ইয়ামিন যেন আজিব কথা বার্তা বলছে। দুজনেই হতবাক, হতবিহ্বল হয়ে বলল,,
“কি যা তা বলছো ভাইয়া কিসের বিয়ে? কিসের ভাবি? বাই এনি চান্স! তুমি লুকিয়ে চুরিয়ে বিয়ে করোনি তো? ”
ইয়ামিনের মা হতাশ হলেন। আবেগী হয়ে বললেন,,
“আমরা চাই তুমি বিয়ে করো! তাই বলে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে? কত শখ ছিলো, এক মাত্র ছেলেকে বিয়ে করাবো ধুমধম করে! আর…”

কথার মাঝেই ইয়ামিন চিৎকার করে উঠলো। হাতের মাঝে লাগানো ক্যানুলার টেনে ছিঁড়ে ফেললো। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,
“আমার সাথে তোমরা মজা করছো মা? আমি কি মিথ্যা বলছি? এক জলজ্যান্ত মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। দাদাজান আমাদের সেই মাতাব্বরের কাছ থেকে আমাদের ছুটিয়ে আনলেন! আর তুমি বলছো কিসের বিয়ে? ”
ইয়ামিন অনেক বুঝাতে চাইলো লাভ হলো না। কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছে না। ইয়ামিন তার মা-বোনকে সব বললো। তাতেও লাভ হলো না উল্টো তার মা কান্না জুড়ে দিলো ছেলের হলো কি? লাষ্ট না পেরে সে বলল,,
“মা দাদাজানকে ডাকো উনি সব জানেন!”
“তোর দাদাজান আউট ওফ টাউন!”
ইয়ামিনে রাগে গা রি রি করে উঠলো এবার। সবার উপর চাপা রাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলো। ডাক্তার পথ আটকাতেই আরো ক্ষেপে গেলো ইয়ামিন। কেবিনের সব তছনছ করে বেড়িয়ে গেলো । ডাক্তার সহ নার্সরা আতঙ্ক নিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে। ইয়ামিনের পিছনে ছুটলো তার বোন আয়দা। ভাইয়া, ভাইয়া বলে পিছন থেকে ডেকেও লাভ হলো না বিশেষ।

আকাশে ফট ফট করছে জ্যোৎস্না। কী নিথর, সুন্দর এই রাত্রি। রাত্রির আকাশে সব তারাইএখন খুব স্পষ্ট। ইয়ামিন তাকিয়ে আছে রাতের আকাশের এই বিশাল উদারতায়।চোখ দুটি শূন্যে ফেলেই ইয়ামিন অস্ফুষ্ট ভাবে বলল,
” মহুয়া তুমি আমার কল্পনা নয়, আমার অংশ আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমি খুঁজে বের করবোই তোমাকে।যে যাই বলুক আমার মন জানে আমি ভুল নই, তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো ভুল নয়। সব সত্যি, বাস্তব। ”
আজ হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দু দিন। মহুয়া খোঁজ করেও ইয়ামিন পায়নি। মাতব্বর নিজেও অস্বীকার করে বসে আছে সব। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল,,
“কি যাতা বলছেন ছোট সাহেব? আপনারা সম্মানী মানুষ আপনাদের সাথে এসন করলে আল্লাহ পাপ দিবো আমাগে তবা, তবা। এত বড় পাপিষ্ঠ আমি কল্পনায় ও হইতে পকরবো না।”
ইয়ামিনের মনে চাপা সংশয় জাগে। ডাক্তারের কাছে যেতেই তারা জানায়,
“আপনার মাথায় চাপ পড়েছে বেশি। ইউ হ্যাভ ইমাজিনড এভরিথিং। ”

ইয়ামিনের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। হাসপাতাল থেকে ফিরে সে তার ফোন চেক করেছিলো। কিছু পায়নি। কিন্তু তারিখের দিক তার চোখ আটকায়। একদিনের ব্যবধানে সব কিভাবে পাল্টে যায়? নিশ্চয়ই সবাই মিথ্যা বলছে? আচ্ছা সবাই কি তাকে পাগল ভাবচ্ছে? সে কি পাগল হয়ে গেছে??ইয়ামিন নিজের চুল টেনে ধরে। মহুয়া দেয়া শেষ চিঠিটির কথা মনে পড়তেই তার গাড়ির দিকে ছুঁটে। কিন্তু কি আশ্চর্য গাড়ি নেই! তার গাড়ি কই গেলো? ইয়ামিন তার মাকে জিজ্ঞেস করতেই জানায়,
“গাড়ি ড্যামেজ হয়েছিল। সার্ভিসিংয়ের পাঠিয়েছি কাল চলে আসবে!”
ইয়ামিন শুধু সময় গুনতে লাগলো। একমাত্র সেই চিঠিটি তার সব রহস্য খুলতে পারে। মহুয়া নামের চিঠি প্রেমিকা আছে,তার ভালবাসা, অনুভতি, অনুযোগ এত ঠুনকো না। সে তার মহুয়াকে খুঁজে বের করবেই। ইয়ামিন আকাশের দিকে তাকালো,আর্তনাদ করে বলল,,
“কোথায় লুকিয়ে আছো তুমি! আমি জানি তুমি আমার বাস্তবতা। আমার কল্পনা নয়। প্লীজ কাম ব্যাক!”

যুগলবন্দী পায়রা পর্ব ১৩

সন্ধ্যা হয়েছে অনেকখন। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে হুট করেই চারিদিকে স্ব স্ব বাতাস বইছে। সারা দিনের ভ্যাপসা গরম মলিন হয়ে মিষ্টি বাতাসে সতেজ করে তুলেছে চারপাশ। দূরের গাছ-পালা গুলোও বাতাসে সরলতায় মুগ্ধ হয়ে দোল খাচ্ছে যেন। কেউ কেউ মিষ্টি বাতাস গায়ে মাখাতে ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই যেন আকাশের বুক চিঁড়ে নেমে আসবে হিমশীতল বাড়িধারা। মহুয়া যেন তারই অপেক্ষাতে ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এলো-মেলো চুল গুলো বাতাসের তালে তাল মিলাচ্ছে। মহুয়া তাকিয়ে আছে দূরের সেই দোল খাওয়া গাছের দিকে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর আর ঘন কালো মেঘের ন্যায় জমে থাকা কষ্ট মুছে ফুরফুরে করে দিচ্ছে মুহুর্তে। মহুয়ার বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। চোখের কোনের জল ছলছল করে উঠলে গড়িয়ে টুপ করে ঝড়ে যেতে পারলো না। ইচ্ছে করলেও মন খুলে হু হু কান্নার করতে পারেনা। তার বেলায় যেন নিষিদ্ধ কান্না করা। তাহলে যে বলে, ” কিছু হলেই মেয়েরা কাঁদে! কান্না নাকি মেয়েদের অস্ত্র! “কই তার বেলা এই অতি সত্যটি মিথ্যা কেন হয়ে যায়??

পুরো দুনিয়া আলোকিত করে ভয়ংকর এক বাজ পড়লো কোথাও। নিচ থেকে জাহানারার কন্ঠ ভেসে আসতেই নেমে যেতে গিয়েও থেমে গেলো মহুয়া। ততক্ষণে বৃষ্টি আকাশের বুক চিঁড়ে নিচে নেমে আসচ্ছে ফোঁটা ফোঁটা। বৃষ্টির গরম ফোঁটা মাহুয়ার শরীর-ও ভিজিয়ে দিচ্ছে যেন। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই মহুয়ার। না আছে এখন নেমে যাওয়ার তারা। মহুয়া তাকিয়ে আছে ছাদের কার্নিশে উড়ে এসে মাত্রই বসা শুভ্র পলকের একটি কবুতরের দিক। মাহুয়া ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজা থেকে রক্ষা করতেই কোলে তুলে নিলো কবুতরটিকে।মনে পরে গেলো তার হাজারো স্মৃতি, ভালোবাসা, আবেগ অনুযোগ। সে কবুতরটি চিলেকোঠার ঘরে রেখে নেমে এলো। বুকে মাঝে চাপা কষ্ঠে দু ফোঁটা জল মনের অজান্তেই গড়িয়ে পরলো। ইয়ামিনের জন্য মন পুড়ে ছাই হচ্ছে। আচ্ছা? ইয়ামিন কি তাকে খুঁজবে? নাকি সে সত্যি ভুলে যাবে তার মরিচীকা কে??

যুগলবন্দী পায়রা শেষ পর্ব