প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৩ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৩
সুমাইয়া জাহান

আমি অবাক হয়ে নীরের দিকে তাকিয়ে আছি।এমন একটা কথা নীর কি করে বলতে পারলো?আর নীর এমন একটা কথা বলেও এমন এমন ভাব নিয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি।তখন আমি নীরকে দেখেই ওমন ভাবে তাকিয়ে ছিলাম।কারণ নীর আমার দিকে রক্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো।হয়তো ভাইয়ু এখনো ওকে কিছু বলেনি সেইজন্য আমাকে আর রাতুল কে একসাথে দেখে এমন করছে।পাশে তাকিয়ে দেখি রাতুল এখনো ওর শেরওয়ানি দেখছে।আমার দিকে ওর খেয়াল নেই তাই এই সুযোগেই আমি আস্তে আস্তে নীর কাছে গেলাম।আমি সব কিছু বললে হয়তো ও আর আমাকে ভুল বুঝবে না।কিন্তু আমি মুখ খোলার আগেই নীর বলতে লাগলো,

—- ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিস আমি সাইন করে দিবো।আমি চাই না তোর সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকুক। যে মেয়ে স্বামী থাকা সত্বেও আরেকজন কে বিয়ে করার জন্য বিয়ের শপিং করতে আসে! তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
তখন থেকেই এইভাবে তাকিয়ে আছি নীরের দিকে। কিন্তু ওর ভাবান্তর নেই। তাই বেশ শান্ত গলায় বললাম,
—- ঠিক আছে বিকেলে ভাইয়ু তোর কাছে পেপার’স নিয়ে যাবে সাইন করে দিস।আমি আর তোর মতো একজনের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক রাখতে চাই না।আর হে এই শুক্রবার আমার বিয়ে। বিয়েতে কিন্তু আসবি!
—– আসতে তো হবেই আফটার অল আমারই হবু প্রাক্তন বউয়ের বিয়ে বলে কথা!আমি না থাকলে কি বিয়ে হবে নাকি!চিন্তা করিস না সময়মতো চলে আসবো।তোর বিয়ের আগাম খবর পেয়ে গিফটও কিনতে চলে এসেছি।তা বল কি গিফট চাই তোর!

—- আমার হবু বর থাকতে তোর থেকে গিফট নিতে যাবো কেন?বরং তুই বল আমাদের বিয়ে উপলক্ষে কি গিফট চাস!যা চাইবি তাই পাবি!রাতুল আবার তোর মতে কিপ্টে লোক না!তুই যদি এখন পুরো শপিং মলও চাস তাহলেও তোকে কিনে দিবে।
—- কই তোর হবু বরকে তো এখনো পর্যন্ত দেখতেই পেলাম না।নাকি ভয়ে লুকিয়ে আছে!আর তুই তার হয়েই এতো সাফাই গাইছিস!হাউ ফানি!
কথাগুলো বলে নীর হাসতে শুরু করলো।নীর হাসি দেখে রাতুলও আড়ালে থাকতে পারলো না।আসলে তখন তূবা নীরের কাছে আসতে নিলে রাতুল দেখে ফেলে।এতে রাতুলের সন্দেহ হয়।তাই তূবার পিছু পিছু রাতুলও আসে।তূবা নীরের কাছে যেতেই রাতুল আড়ালে লুকিয়ে পরে।আর এই সবই নীর দেখে ফেলে।তাই তখন তূবা কিছু বলতে না দিয়ে ওইকথা গুলো বলে।তূবা প্রথমে বুঝতে পারেনি নীরের কথা তাই তারপর নীর ইশারা করে রাতুলের কথা বলতেই তূবা সব বুঝে যায়।তাই তূবাও নীরের সাথে তাল মিলিয়ে এইসব বলছে।রাতুল এতোক্ষণ চুপচাপ সবকিছু শুনলেও নিজেকে কিপ্টে বলাতে খুব গায়ে লেগেছে।তাই রাতুল যে মোটেও কিপ্টে না সেটা প্রমান করার জন্যই ওদের সামনে আসছে।
নীর হাসতেছে এর মাঝেই পিছন থেকে রাতুল বলে উঠলো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- এক্সকিউজ মি মিস্টার নীর চৌধুরী!
আমি আর নীর দুজনেই অবাক হওয়ার ভান করে রাতুলের দিকে তাকালম।রাতুল আস্তে আস্তে আমাদের সামনে হিরো স্টাইলে আসলো।নীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- চলুন আপনার যা ইচ্ছে তাই নিয়ে নিন। আজকে সব বিল আমি পে করবো।
—- না থাক আমি আজ একটু বেশিই শপিং করবো। আপনার টাকায় এতো শপিং করলে আমার খারাপ লাগবে ভাই! আমি চাই না আমার জন্য আমি এতোগুলা টাকা নষ্ট করেন!
ইনোসেন্ট ফেইস করে নীর বললো।রাতুলের তো চোখ চিকচিক করে উঠলো।বলতে গেলে অতি আনন্দ চোখে জল এসে পরেছে।চোখের পানি মুছে নীরের কাঁধে হাত রেখে বললো,
—- ভাই তুমি তো তূূবার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে।সেই হিসেবে তুমি তো ওর বিয়েতে একটা ট্রিট পেতেই পারো। এটা না হয় ট্রিট ভেবে নেও।প্লীজ না করো না!তাহলে কিন্তু আমি কষ্ট পাবো।

—- ঠিক আছে ভাই তুমি যখন এতো করে বলছো নাহয় বেস্ট ফ্রেন্ডর ট্রিট ভেবে এটা নিচ্ছি।
কথাটা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো নীর।আমি এখন বহুকষ্টে নিজের হাসি আঁটকে রেখেছি।এমনিতে আমার শপিং করতে তেমন একটা ভালো লাগে না।কিন্তু শত্রর টাকায় শপিং করার লোভটা সামলাতে পারছি না তাই আমিও এখন ঠিক করেছি আচ্ছা মতো শপিং করে নিবো।এই সুযোগ আবার পরে নাও পেতে পারি।মনের মধ্যে এখন লাড্ডু ফুটছে জামাইকে নিয়ে শত্রুর টাকায় শপিং ভাবতেই কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব আসছে।আমার ভাবনার মাঝে নীর আবার বলে উঠলো,
—- তূবা আমার সাথে আস তো!আসলে রাতুল ভাই কিছু মনে করো না আমার সব জিনিস আমি আবার তূূবার সাথেই কিনি।ওকে ছাড়া আমি এখন কিছু কিনতেই পারিনা!অভ্যাসে গেছে তো!
রাতুলের দিকে তাকিয়ে বেশ ইতস্তত বোধ করে বললো।তবে সবটাই যে নাটক সেটা আমি জানি। কিন্তু আমি কবে ওর সাথে শপিংয়ে আসলাম সেটাই তো মনে পরছে না!আরে দূত আমি নিজে লাস্ট কবে শপিংয়ে আসছি তাই তো ভুলে গেছি আর ওর কথা কি করে মনে রাখবো!এগুলোই ভাবছি তখনই পাশ থেকে রাতুল বললো,

—- আমি কিচ্ছুটি মনে করবো না।বললাম না তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো।আর আজ থেকে তূবার মতো আমি তোমার বন্ধু!
তারপর নীর আমাকে নিয়ে ওখান থেকে আরেকটা শপে ঢুকলো।আমি এখনো ভেবেই চলেছি নীরের সাথে আমি কবে শপিংয়ে আসলাম।এখন যেহেতু রাতুল সামনে নাই তাই প্রশ্ন করতে আর কোনো বাঁধাও নেই। তাই আর নিজের ছোট্ট মাথাটাকে না খাটিয়ে নীরকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
—- নীর আমার না কিছুতেই মনে পরছে না তোর সাথে কবে শপিংয়ে আসছি?
প্রশ্ন টা শুনে নীর আমার দিকে এমন একটা লুক দিলো মনে হয় আমি এখন ওকে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনকে আমার সামনে হাজির করতে বলেছি!কি আজব! একটা সহজ প্রশ্ন করেছি পারলে বলবে না পারলে বলবে না সিম্পল! এতে এতো এমন ভাবে তাকানোর কি আছে!যত্তসব! বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে তাকিয়ে মহোদয় এভার মুখ খুললনে।

—- জীবনে কোনোদিন আসলে তারপর তো মনে পরবে!ডাফার!আমি তোর একবছরের বিয়ে করা বর। আমার সাথে জীবনে কোনোদিন শপিংয়ে আসিসনি।আর ওই ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হতে না হতেই নাচতে নাচতে চলে আসলি শপিংয়ে?ইচ্ছে করছে তোকে এখানেই পুঁতে রেখে যাই!
নীর প্রচন্ড রেগে কথা গুলো বললো।আমি বোকা হেঁসে বললাম,
—- ওহ্ এই ব্যাপার!নো প্রবলেম এরপর থেকে তোর সাথে প্রতিদিনই শপিং এ আসবো!
কোনোরকমে কথাটা বলেই আশেপাশের তাকাতে লাগলাম এখানে অনেক দারুণ দারুণ কালেকশনের লেহেঙ্গা রয়েছে।লেহেঙ্গা গুলো দেখতে দেখতেই নীরকে বললাম,
—- তুই না বললি তোর কি কি যেন কেনার আছে তাাহলে এখানে কেন আনলি?সে যাইহোক এখানের লেহেঙ্গা গুলো কিন্তু দারুণ আমি ভাবছি কয়েকটা নিবো এখান থেকে।আফটার অল শত্রুর টাকায় কিনবো বলে কথা!একটু বেশি করে না কিনলে খারাপ দেখাবে!

—- লজ্জা করে না অন্য ছেলের টাকায় লেহেঙ্গা কিনতে চাস!কেন রে তোর বরের টাকা কি কম পরে গেছে?
এই ছেলে তো গিরগিটির থেকেও বেশি রং বদলায়!একটু আগে তো রাতুলের টাকায় শপিং করার জন্য এতো এতো নাটক করলো এখন আবার এইসব বলছে?আল্লাহ গো দড়ি ফালাও আমি উইঠা যাই এই গিরগিটির সাথে আর থাকতে পারবো না।এ আমাকে যে কোনোদিন পাবনা পাঠিয়ে দিবে!রাগ আমার মাথায় উপর উঠে গেছে এখন।রেগে বোম হয়ে বললাম,
—- তাহলে একটু আগে ওগুলো কি ছিলো?ওই ব্যাটা রাতুলের টাকায় শপিং করার জন্য আমি নাটক করছি না তুই?
—- আমি কখন বললাম তুই করছোস?কিন্তু সেটা শুধু আমার জন্যই!রাতুলের টাকা আমি শপিং করবো তুই না!

—- তাহলে এখানে কেন এনেছিস?তোর জন্য লেহেঙ্গা কিনতে? ?
—- আমার এতো সুন্দর পেত্নীর মতো একটা বউ থাকতে আমার জন্য জন্য কেন লেহেঙ্গা কিনতে যাবো?আমার পেত্নী বউয়ের জন্যই কিনবো।তবে অন্যের টাকায় না নিজের টাকায় কিনবো!
—- গিরগিটি কোথাকার! ?
দিলো আমার এতো সুন্দর একটা মুড নষ্ট কইরা!কোথায় ভাবলাম শত্রুর টাকায় একটু আনন্দ করবো!কিন্তু না আমার সেই আনন্দের মধ্যেও বালতি বালতি পানি ঢেলে দিলো!ভালো লাগে না জীবনডা তেজপাতা হইয়া গেলো গো!মাগো কোন দুঃখে তুমি এই নিরিহ অবলা বাচ্চাটাকে এই নিষ্ঠুর দানবের হাতে তুইলা দিলা?তোমার একটুও করুনা হইলো না গো?

আমি শত্রুর টাকায় শপিং করতে পারিনি সেই দুঃখে মনমরা হয়ে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ করে নীর অনেক গুলো লেহেঙ্গা এনে কাউন্টারে রাখলো।সব গুলোই অসম্ভব সুন্দর!কিন্তু এতো গুলো লেহেঙ্গা একসাথে এখানে রাখার মানে কি?অবাক নয়নে বলে উঠলাম,
—- এতোগুলা লেহেঙ্গা এখানে রেখেছিস কেন?
নীর লেহেঙ্গা গুলো প্যাক করতে দিয়ে আমার দিকে ভ্রু উঁচু করে বললো,
—- চোখ কি বাড়িতে রেখে এসেছিস নাকি?দেখতে পাচ্ছিস না এগুলো কেনার জন্য রেখেছি!
চোখ দুটো আমার বেড়িয়ে আসার উপক্রম! যদি পারতো এখুনি বেড়িয়ে হাতে চলে আসতো।এখানে কম করে হলেও পঁচিশটার মতো লেহেঙ্গা হবে।আর সব গুলোই ভারী কাজের।আমি এতো গুলো লেহেঙ্গা একসাথে নিয়ে কি করবো?একবার লেহেঙ্গা গুলোর দিকে তাকাচ্ছি তো একবার নীরের দিকে তাকাচ্ছি। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি লেহেঙ্গা গুলো অসহায় ফেস করে বলছে,

—- বোইন আমাদের দিকে তাকাইয়া লাভ নাই! আমি ইচ্ছে করে আসতে চাইনি তোর এই বজ্জাৎ জামাই আমাদের কে জোর করে তোর উপর চাপাইয়া দিতেছে।
রাগী গলায় নীরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—- ওই ফাজলামো পেয়েছিস? আমি এতোগুলা লেহেঙ্গা দিয়ে কি করবো?
—- আই ডোন্ট কেয়ার!এগুলো মাথায় পরবি না পায়ে পরবি সেটা তোর ব্যাপার!
ভালো করেই বুঝতে পারছি তখন রাতুলের টাকায় কয়েকটা কিনবো বলেছি বলে এখন তার প্রতিশোধ নিচ্ছে!এখন ওকে হাজারবার বারণ করলেও শুনবে না।একে তো হাড়ে হাড়ে চিনি! পৃথিবীর সবথেকে বড়ো ঘাড়ত্যাড়া একটা!তাই আর কথা বাড়ালাম না।এরকম ভাবেই আরো অনেক কিছু কিনলো।আমার গুলো নিজেই পেমেন্ট করলো।আর নিজের গুলো রাতুলের টাকায়!
আমাদের শপিং শেষ করে রাতুলের কাছে আসলাম।কিন্তু এই রাতুল এখনো সেই শেরওয়ানিই দেখে চলেছে!এতো মনে হয় আজ সারাদিনেও কিচ্ছুটি কিনতে পারবে না।কেন যে এর সাথে আসতে গেলাম!মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে নীরকে বললাম,

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২২

—- যা তো ওই হাবাগোবারে একটা শেরওয়ানি সিলেক্ট করে দে না হলে বাকি জীবনটা আমাদের এখানেই কাটাতে হবে!
—- হুম তাই তো দেখছি!এই হাবা কি জীবনে এর আগেরবার বিয়ের শেরওয়ানি করতে কয়দিন লাগাছে রে?
চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাতেই বোকা হেঁসে বললো,
—- না মানে এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি!
তারপর রাতুলের কাছে চলে গেলো।রাতুলের সামনে গিয়েই একটা শেরওয়ানি হাতে নিয়ে প্রশংসার ঝুলি খুলে বসলো।অনেক পাম টাম দিয়ে অবশেষে একটা শেরওয়ানি সিলেক্ট করাতে পারলো নীর।
রিমির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। কিন্তু কেউই কোনো কথা বলছে না।বেশ অনেকক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙ্গে ছেলেটা বললো,

—– আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না আপনি বিয়েতে রাজী হয়ে যাবেন।আমার তো এখনো মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি!আমি সেই কবে থেকে আপনাকে পছন্দ করি।কখনো ভাবতে পারিনি আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে!
—– আমিও না!যাইহোক আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার বাকী আছে?
নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত রেখে বললো রিমি।ছেলেটা মাথা নেরে বললো,

—- না না আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই!
তারপর ছেলেটার থেকে বিদায় নিয়ে রিমি নিজের ঘরের দিকে চলে এলো।ঘরে এসেই নিজের যতো গয়না ছিলো সব খুলে ফেললো।এমনকি ওদের দেওয়া আন্টিটাও।তারপর নিজে বসে ফুপিয়ে কেঁদে দিলো।নিজেকে আজ পাগল পাগল লাগছে।আসলে
সকালে রিমি বিয়েতে রাজি হওয়ার পর পাত্র পক্ষরা আজ সন্ধ্যাতেই বিয়ের পাকা কথা বলতে এসেছে।রিমিকে ওদের অনেক আগে থেকেই পছন্দ ছিলো।এতোদিন রিমি রাজি ছিলোনা বলে তারাও চুপ করে ছিলো।কিন্তু যখন শুনলো রিমিই রাজি বিয়েতে তাই আর দেরি না করে সোজা চলে এসেছে বিয়ের পাকা কথা বলতে।একটু আগেই রিমিকে আর পাত্র কে আলাদা করে কথা বলতে ছাঁদে পাঠিয়েছিলো।

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৪