প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৮ || সুমাইয়া জাহান

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৮
সুমাইয়া জাহান

দুদিন পর………
আমি সামনে দাঁড়িয়ে একটা অনেক বড়ো সাইক্লোন! তবে এই সাইক্লোন টাকে যে আমি আমার একমাত্র আদরের ভাইয়ুটার জন্য বানিয়েছি।তাই আমার দিকে আসা সেই রিমি নামক সাইক্লোন টা তো আমার দিকে আসবে সেটা তো ভাইয়ুর দিকেই যাবে।আসলে সেইদিন আমি যেই দুইটা বিয়ের কার্ড দিয়েছিলাম সেখানে একটা ছিলো ভাইয়ুর বিয়ের কার্ড।রিমি বেচারি এইকয়দিনে আমার ভাইয়ুটার শোকে এতোই কাতর ছিলো যে কার্ড টা আর খুলে দেখেনি।কিন্তু আজ কিভাবে যেন কার্ড টায় চোখ বোলাতে গিয়ে কনের জায়গায় নিজের নাম দেখে রীতিমতো অবাক!তারপরই কার্ড নিয়ে আমার কাছে মানে আমার বর্তমান শশুর বাড়ী চৌধুরী ম্যাশনে।আমি তো জানতামই এমটা হবে তাই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ওর সামনে বসে বসেই খুব শান্ত ভাবে আইসক্রিম খাচ্ছি আর ওর দিকে মনযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছি ওর কিছু বলার অপেক্ষায়!কিন্তু সেই কখন থেকেই ও শুধু রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।রাগের কারণে মুখে বেচারি মুখে কিছু বলতেও পারছে না! এবার চোখ মুখ শক্ত করে মুখ খুললো আমার অতি প্রিয় হবু রিমি ভাবী!

—- এইসবের মানে কি তূবা!
ওর মুখ খুলতে খুলতে আমার দুইটা আইসক্রিম শেষ হয়ে গেছে।এখন তৃতীয়টায় কামড় মারবো এমন সময় বিয়ের কার্ডটা দেখিয়ে প্রশ্ন টা ছুরলো আমার দিকে!মনটাই খারাপ হয়ে গেলো এইটা শেষ করতে দিলে কি হতো ওর!তাতে কি? ওর প্রশ্নে আমার আইসক্রিম খাওয়া আটকাতে পারবে নাকি?আগে আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে তারপর বললাম,
—- কিসের মানে জানতে চাস?
—- তূবা একদম রাগাবি না এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে!তূর্যের বিয়ের কার্ডে আমার নাম কিভাবে?
—- কনে তুই হলে নামটা কি অন্যের হবে গাদি!
আইসক্রিম খেতে খেতেই বললাম।কিন্তু ও যে এখন কিছুই বুঝতে পারছে তা খুব ভালো করেই জানি!হিহিহি!আমি কেন বোঝাবো ওকে?যার বউ সে বোঝাবে হুম!আর সেইদিন রিমির বাড়ির লোকেরা যখন এসেছিলো সেইদিনে রিভেঞ্জ টা তো নিতে হবে!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

রিমি আমার কথা শুনে নিজের মনেই হিসেব মিলাতে লাগলো।কিন্তু কিছুক্ষণ ভেবেও যখন কোনো কিছু মেলাতে পারলো না তখন আমার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন ছুরলো।
—- উফফ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!প্লীজ পুরোটা ক্লিয়ার করে বল!
আমার এতোক্ষণে তিন নাম্বার আইসক্রিম টাও খাওয়া শেষ।উঠে দাঁড়িয়ে আইসক্রিমের তিনটা কাঠি খুব যত্ন করে হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরোতে বেরোতেই বললাম,
—- একমিনিট অপেক্ষা কর তোর জবাব দুই মিনিটেই পাঠাইতেছি!
রিমি আমার এহেন কান্ডে বোকা বনে গেলো।ও বুঝতেই পারছে না কি হচ্ছে ওর সাথে কি হচ্ছে !বিস্ময় নিয়ে আমার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমি মিটমিট করে হাসতে হাসতে ভাইয়ুকে খুঁজতে লাগলাম। আজকে ভাইয়ুও এ বাড়িতে এসেছে।একটু আগে মামনীর সাথে কথা বলতে গেছে।তাই মামনীর ঘরের দিকেই যাচ্ছি। মামনীর ঘরের সামনে যেতে না যেতেই হঠাৎ করে খাম্বার মতো কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম।পরে গিয়ে ব্যাথা তো বেশি পাইনি কিন্তু ভিষণ ভয় পেয়েছি কারণ হঠাৎ করে দরজার মাঝখানে খাম্বা আসলো কোথা থেকে?তবে কি কোনো জিন!

—- বাচাচাচাচাচাও আমায় কেউ বাঁচাও গো!আমারে জিনে মাইরা ফেলাইলো গো!আমারে কেউ বাঁচাও!বাঁচাও! বাঁচাও!
—- থাম বোইন আমি জিন না রক্তে মাংসে গড়া মানুষ!
এতোক্ষণ চিৎকারটা চোখ বন্ধ করেই দিয়েছি এখন ভাইয়ুর গলা শুনে চট করে চোখ খুলে দিয়ে যখন দরজার মাঝখানে ভাইয়ুকে আবিষ্কার করতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।কোথায় ভেবেছিলাম জীবনে প্রথম বার জিন দেখবো।তা আর হলো না!মনমরা হয়ে বললাম,
—-ওহ্ তুমি!
—- হুম আমি! রক্তে মাংসে গড়া মানুষ জিন!এখনো উঠবি নাকি সারাজীবন নিচেই বসে থাকবি!
হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো ভাইয়ু।আমি ভাইয়ুর হাতটা ধরে উঠতে নিলে পায়ে ব্যাথা কুঁকড়ে উঠলাম।ডান পাশের পা টা মনে হয় মুচকে গেলে এতোক্ষণ টের পাইনি এখন পায়ের উপর ভর দিতেই ব্যাথাটা অনুভব হচ্ছে।ভাইয়ু আমার দুই বাহু ধরে কোনো রকমে দাঁড় করিয়ে আমার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—- পেলি তো ব্যাথা!
—- ভাইয়ু গো আমি এইখানে ব্যাথায় মরে যাচ্ছি আর তুমি আমায় বকা দিচ্ছো!তুমি খুব নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছো দিনে দিনে।
একহাতে পা ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে কথাগুলো বললাম।আমি তো কথা গুলো এমনি বলেছি কিন্তু ভাইয়ু আমার কথায় প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো।

—- পরী কোথায় লেগেছে বল!বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে করিনি!আচ্ছা এখুনি ডক্টরের চল!আর হে এনিয়ে একটা কথাও বলবি না!আমি তোর কোনো কথা শুবো না এখন আমরা ডক্টরের কাছে যাচ্ছি!
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে ভাইয়ু জোর করে আমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো।দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময়ই নীরের সাথে দেখা হয়ে গেলো।নীরকে দেখেই আমার মুখ হাসি ফুটে উঠলো।এই যাত্রায় মনে হয় বেঁচে যাবো।
—– নীর এই দেখ ভাইয়ু আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে! আমাকে বাঁচা!
ভাইয়ু ?
নীর আমার আমার কথা শুনে আমার দিকে একবার ভালো করে পরক করে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ভাইয়ুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—– তূর্য ভাইয়া কি হয়েছে ওর ওকে এইভাবে ধরে রেখেছো কেন?
ভাইয়ু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হতাশ কন্ঠে বললো,
—– কি আর বলবো তুই তো ওকে খুব ভালো করেই চিনিস কেমন ও!তারপরই তখনকার সব বললো ভাইয়ু নীর কে!

নীর কথাগুলো শুনে চোখ বুজে নিলো।ওর ভাব ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারছি না রাগ করলো না অন্য কিছু!কিছুক্ষণ পর চোখ খুলেই আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝাঁঝালো গলায় ধমক দিয়ে উঠলো,
—- আমি জানতাম এমন কিছু একটা ঠিক করবি!হাঁটার সময় তো চোখ কপালে নিয়ে হাঁটিস তাই না!
জোরে ধমক দেওয়াতে আমি কেঁপে উঠলাম।এতোক্ষন মামনী আর রিমি উপরের ঘরে ছিলো নীরের হুংকারে সবাই বেড়িয়ে আসলো।মামনী তো অবাক হয়ে নীরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—- নীর তুই ওকে এইভাবে বকাবকি করছিস কেন?আর তুর তুই বা ওকে এইভাবে ধরে রেখেছিস কেন?
এখানে কি হচ্ছে কিছুই না বুঝতে পেরে একবার আমার দিকে একবার ভাইয়ুর দিকে একবার নীরের দিকে তাকাচ্ছে! রিমিরও একই অবস্থা একে তো বেচারি এমনিতেই কনফিউজড হয়ে আছে এখন আবার এইসব দেখে আরো কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে! নীর মামনীর কথা শুনে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মামনীকে বললো,

—- সেটা তোমার এই আদরের মেয়েকে জিজ্ঞেস করো!তার গুনো কীর্তির তো শেষ নেই!
শেষের কথাটা দাঁতে দাঁত চেপে বললো।নীরের এইটুকু কথাই বুঝে গেছে আমি কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি।কারণ এই দুইদিনে এবাড়িতে এসে আমি একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি। কখনো দেয়ালের সাথে টাক খেয়ে মাথা ফুলিয়ে আলু বানিয়েছি কখনো কফি খেতে গিয়ে গরম কফি হাতে ফেলেছি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! তাই সবার ধারনা হয়ে গেছে!
—- তূর্য ভাইয়া তোমার যাওয়া লাগবে না আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে তুমি কয়দিন পর বাড়ি এসেছো মায়ের সাথে থাকো আমি নিয়ে যাচ্ছি ওকে!
নীরের কথায় আমার ভাবনার ছেঁদ ঘটলো।নীর কথার জবাবে ভাইয়ু কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীর ভাইয়ুকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললো,
—- তুমি চিন্তা করো না আমি ওকে ঠিক সামলে নিতে পারবো!

ভাইয়ু আর কিছু বললো না কারণ ভাইয়ুও জানে তার পরে আমাকে কেউ সামলাতে পারলে একমাত্র নীরই পারবে! তারপর নীর আমাকে ভাইয়ুর থেকে নিয়ে আমাকে ধরে ধরে গাড়িতে উঠিয়ে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য রওনা দিলো। কোথায় ভেবেছিলাম এই যাত্রায় বেঁচে যাবো তা না এখন সেই ডক্টরের কাছেই যেতে হলো।দূত ভালো লাগে না!সেইদিনও হাতে কফি পরাতে আমার ভোলা ভালা হাত টাকে ব্যান্ডেজ করে কুমড়ো বানিয়ে দিয়েছি!বুঝিনা এতো অল্পতেই এমন করার কি আছে?আমি মুখে দুই হাত দিয়ে এসবই ভাবছি পাশ থেকে নীর গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
—- এখন মন খারাপ করে লাভ নেই যখন কাজ গুলো করিস তখন মনে থাকে না তার ফল কি হবে!
—- আমার কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিতে হবে না!নিজের কাজ কর!
আমি বেশ রেগেই কথাটা বললাম।নীর যেন আমার কথায় বেশ মজা পেলো তাই আমাকে আরেকটু রাগানোর জন্য বললো,

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৭

—- কারো একজনের পা যেই পরিমাণে ফুলেছে মনে হয় তিন চারটা ইনজেকশন লাগবেই লাগবে!তখন আবার আমাকে কেউ বলতে আসতে পারবে না!
আমি এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম।আমি ইনজেকশনে ভয় পাই সেটা জবে থেকে জেনেছে তবে থেকেই কথায় কথায় আমায় এইটা নিয়ে ক্ষেপায়!আমি যদি কোনোদিন ওর কোনো একটা দুর্বলতা জানতে পারি না তাহলে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিবো মজা হুম!শুধু একবার জানতে পারি ওর দুর্বলতা টা!আমি এসবই ভাবছি তখনই নীর পাশ থেকে বলে উঠলো,
—- নিজেই নিজেকে খুঁজে বেড়ালে তো কোনোদিনও পাবি না!
ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম।কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।ও একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে আবার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বলতে লাগলো,
—– আদা জল খেয়ে তুই তো আমার দুর্বলতা খুঁজে বেড়াচ্ছিস!আর আমার একমাত্র দুর্বলতা হলো তুই! নিজেই নিজে খুঁজে বেড়ালো কোনোদিন পাবি না!আমি জীবনে তোর মতো গাদা আর দু’টো দেখিনি!
প্রথম কথা গুলো ঠিক ছিলো কিন্তু শেষের কথাটায় আবার রাগটা বেড়ে গেলো।এই ছেলে শোধরাবার নয়!ভালো কথা এর সহ্য হয় না!

—– তুই গাদা তোর বউ গাদা!
—- আমিও তো তাই বললাম!যাক নিজেই যখন স্বীকার করলি তখন তো আর কিছু বলার নেই।
ইচ্ছে করছে এখন নিজের মাথায় নিজে ফাটাই ওকে গালাগাল করতে গিয়ে নিজেকেই গালাগাল করে ফেললাম।কি করে ভুলে গেলাম এই বজ্জাতের বউ আমি সয়ং!আপাদত নিজের মুখ না খোলাই ভালো নাহলে আবার কি উলটো পালটা বলে ফেলবো কে জানে!তাই মুখে আংগুল দিয়ে চুপ করে আছি।এদিকে নীর আমার অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসছে।ইচ্ছে করছে ওর ওই মাথাটাকে ক্রিকেট বল৷ বানিয়ে এক ছক্কায় চাঁদে পাঠিয়ে দেই কিন্তু এখন তো আমি মুখ খুলবো না তাই চুপচাপ সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই!

তূর্য আর রিমি ছাঁদে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ! কিন্তু তূর্য কিছুতেই কিছু বলছে না।আসলে তূর্য জানতো না তূবা রিমিকে বিয়ের কার্ড আগেই দিয়ে এসেছে!রিমি এবার বেশ বিরক্ত হয়ে বললো,
—- তূর্য আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষায় আছি সবটা শোনার জন্য! এখানে আমার জীবন নিয়ে প্রশ্ন তার তুমি এভাবে চুপ করে আছো কেন?আমি জানতে চাই সবটা!
তূর্য এবার ঠিক করলো আর কোনো ভনিতা না সরানীর সবটা আজই বলে দিবে।তাই নিজেকে প্রস্তুত করলো বলার জন্য!

প্রেমের সাতকাহন শেষ পর্ব