প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৭ || bangla valobashar golpo

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৭
সুমাইয়া জাহান

—- ইচ্ছে ছিলো আপনাকে নিজ হাতে শাস্তি দেওয়ার! কিন্তু রাতুলের কথা ভেবে আপনাকে আইনের হাতে তুলে দিচ্ছি।নাহলে বুঝিয়ে দিতাম বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি!
কথাটা বলেই তূবা হনহন করে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।সবাই ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।নীর কিছুক্ষণ স্থীর হয়ে থেকে একটা ফুস করে শ্বাস ফেলে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
—- অফিসার উনাকে নিয়ে যান!
—- অবশ্যই! তবে হে মিস্টার চৌধুরী অসংখ্য ধন্যবাদ আপনারা কিছু না করে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য! আইন যথা যোগ্য শাস্তি দিবে।

পুলিশ অফিসারের কথার বিনিময়ে নীর একটা মলিন হাসি দিলো।আসলে শুধু তূবার না নীর আর তূর্য দু’জনেরই ইচ্ছা ছিলো রঞ্জকে নিজ হাতে শাস্তি দেওয়ার!কিন্তু রাতুল তার ছেলে হয়ে বাবার অন্যায়ের পক্ষ না নিয়ে উল্টো ওদের এতো সাহায্য করলো।এতো বড়ো একটা সেক্রিফাইস করলো নিজের বাবাকে ওদের হাতে তুলে দিলো তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও রাতুলের কথা ভেবে রঞ্জনকে আইনের হাতে তুলে দিলো।নীরের থেকে বিদায় নিয়ে পুলিশ অফিসার বাকি পুলিশ দের অডার দিলো রঞ্জন কে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রঞ্জন কে যখন নিয়ে যাওয়া হয় তখন একবার রাতুলের দিকে তাকায়।কিন্তু রাতুল ওর দিক থেকে মুখ সরিয়ে নেয়।এতে রঞ্জন বেশ কষ্ট পায়।ছেলের হাতে শিক্ষা পেয়ে রঞ্জন আজ সত্যি নিজের করা এতো গুলো কাজের জন্য অনুতপ্ত! তাই তো রাতুলের মুখ থেকে কথা গুলো শোনার পর যখন পুলিশ আসলো ওকে অ্যারেস্ট করার জন্য তখন একবারের জন্যও পালানোর চেষ্টা করেনি নিজের ইচ্ছায় ধরা দিয়েছে।শেষবারের মতো ছেলের মুখ টাকে দেখে নিয়ে চলে গেলো ওদের সাথে! হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না ছেলের মুখটা!

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

রাতুল উপরে শক্ত থাকলে ভিতরে ভিতরে কিন্তু সে ভিষণ ভাবে ভেঙ্গে পরেছে।আর যাইহোক কোনো সন্তান নিজের বাবা-মার শাস্তি হোক এটা চায় না।সে শতো খারাপ হলেও!তেমনই রাতুলেরও বাবাকে শাস্তি পেতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অন্যায়ের শাস্তি তো পেতেই হবে!এই ভেবেই নিজের মনকে বারংবার শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে।রঞ্জনকে যখন গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় তখন গাড়ি টার দিকে তাকিয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি জরিয়ে আনমনে বলে উঠলো,

—– কেন করলে এমন টা?আমি কি তোমার কাছে কখনো এতো কিছু চেয়েছি?আমি তো শুধু তোমাকেই চেয়েছি!
নীর আর তূর্য এসে রাতুলের কাঁধে হাত রাখলো।ওরাও বুঝতে পারছে রাতুলের অবস্থা টা!কিন্তু ওদের কাছে রাতুলকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষাই নেই।একটু খানি পাশে থাকা ছাড়া!পুরো বাড়ি জুড়ে নীরবতার চাদরে ছেয়ে গেছে।কারো মুখে কোনো কথা নেই। শুধু ভারী দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া!

আরমান সিকদার তো নিজেকে রঞ্জনের মতো সমান অপরাধী ভাবছে।কি করে একটুও না ভেবেই আশরাফ কে সব দোষের ভাগীদার বানিয়ে দিলো।বন্ধুর মৃত্যুর পর একবারের জন্যও খোঁজ নিলো না তার পরিবারের! একবারের জন্যও জানতে চাইলো না তাঁরা বেঁচে আছে না মরে গেছে!নীর!তাকে তো দেখতেই পারতো না!অথচ সেই নীরই তাদের পরিবার টাকে এতো আগলে রেখেছে।সব বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে এসেছে।আজ কোনো মুখ নেই নীর আর নীলিমার সামনে দাঁড়ানো!তাই চশমা টা খুলে চোখের পানিটুকু মুছে আবার চশমা টা চোখে লাগিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো আরমান সিকদার।একটু এগোতেই নীর পিছন থেকে বলে উঠলো,

—– কাকু আজও কি আমায় ক্ষমা করবে না?
আরমান সিকদার নীরের কথায় চমকে উঠলো।চমকে তো উঠবেনই! যাদের কাছে লজ্জায় ক্ষমা চাইতে পারছেন না বলে পালিয়ে যাচ্ছেন তাদের মুখ থেকে চমকানো টাই তো স্বাভাবিক! অবাক নয়নে বললেন,
—- কি বলছো কি তুমি? আমার কাছে কিসের জন্য ক্ষমা চাও?অন্যায় তো করেছি আমি তাহলে তুমি কেম ক্ষমা চাচ্ছো?
—- আসলে কাকু আমি তো তোমাকে না জানিয়েই তূবাকে বিয়ে করেছি আবার মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে খুুব খারাপ ব্যবহারও করেছি তাই! বিশ্বাস করো এগুলো একটাও আমি ইচ্ছে করে করিনি!
মাথা নিচু করে কথা গুলো বললো নীর।আরমান সিকদার নীরকে যতো দেখছে ততোই মুগ্ধ হচ্ছে। একদম তার বাবার মতোই হয়েছে।মুচকি হেঁসে নীরের কাঁধ একহাত রেখে বললো,
—– তুই যা করেছিস সব তো আমাদের ভালোর জন্যই করেছিস।ক্ষমা চাওয়ার কথা তো আমার! আমি তোদের সাথে এতো অন্যায় করেছি যে তোদের সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ নেই তাই চলে যাচ্ছিলাম।কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই আমায় ক্ষমা করে দিয়েছিস হয়তো!জানিস তুই একদম তোর বাবার মতোই হয়েছিস!কিন্তু এখন আফসোস নীলিমার কাছে আমি কোন মুুখ নিয়ে দাঁড়াবো?ও কি আমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে?

—– তোমায় এসব কথা কে বলেছে বলোতো কাকু?মা তো সব সময়ই তোমার কথা বলে কাঁদতে থাকে।সেইদিন তোমার সাথে ওইরকম ব্যবহার করার পর সারাদিন কেঁদেছে।তোমার উপর মা একটুও রাগ করে নেই!তুমি যদি একবার বলো মাকে বোন বলে ডাকো তাহলে দেখবে ছুটতে ছুটতে এখানে চলে আসবে।মা তোমাকে খুুব ভালোবাসে কাকু!
—– তাই নাকি?তাহলে তো আমার বেয়াইন সাহেবাকে এখুনি খবর দিতে হয়!দাঁড়া পাগলি টাকে এখুনি নিয়ে আসছি এ বাড়িতে! আজ আমি নিজে যাবো পাগলিটাকে ফিরিয়ে আনতে।তুই বরং এখন তোর বউয়ের রাগ ভাঙ্গা! খুব রেগে আছে!
শেষের কথা দুটো নীরের কানের কাছে এসে বললো আরমান সিকদার। নীর এতে মাথা চুলকে লাজুক হাসলো।আরমান সিকদার তো হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন নীলিমাকে আনতে।

নিজের রুমে এসে হাতের কাছে যা পেয়েছি সব ফেলে দিয়েছি। তবে একটাও ভাঙ্গিনি!জিনিসের উপর মায়া লাগে তাই শুধু ফেলেই দিয়েছি ভাঙ্গিনি। খাটের উপর বলে বিছানা চাদর খামছে ধরে চোখ বন্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি।কাল থেকে আমি কি অবস্থার মধ্যে গেছি তা শুধু আমি জানি! নীর কি করে পারলো আমাকে ধোয়াসার মধ্যে রেখে এতো কষ্ট দিতে!আজ যদি সত্যি সত্যি ওইরকম হতো তাহলে?ওকে এর শাস্তি পেতেই হবে।কি ভেবেছে টা কি?যা ইচ্ছা তাই করবে?আমাকে একটা বার ফোন কর বললে কি হতো?আর নিজের ফোনটাও বা বন্ধ করে রাখার কি ছিলো?এসবই ভাবছি হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হলো হালকা চোখ খুলে দেখলাম নীর এসেছে।আবার দেখো কেমন দাঁত কেলাচ্ছে!ইচ্ছে করছে এক ঘুসিতে দাঁত গুলো ভেঙ্গে ফেলেলি।ওর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করাতে চুপসে গেলো। যতোটা সাহস নিয়ে এসেছিলো সব বোধহয় উড়ে গেছে। কিন্তু আমার সব ধারণা ভুল প্রমানিত করে হঠাৎ করেই দরজাটা লাগিয়ে দিয়েই আমার খাটের উপর ধপাস করে শুয়ে পরলো।

অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছি আমি। হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।কি ছেলে বাবা!দেখছে আমি এতো রেগে আছি কোথায় আমার রাগ ভাঙ্গাবে তা না নিজেই আরাম করে শুয়ে পরেছে।একে তো আমি জিন্দেগীতেও বুঝতে পারবো না।কোমরে দুইহাত রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
—– এখানে শুইয়ে পরলি কেন?
—– আশ্চর্য! তোর মতো গাদা আমি আর একটাও দেখেনি!ঘুমাবো বলেই শুয়েছি!
রাগ আমার এখন সপ্তম আকাশে! খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।কত্তো বড়ো সাহস আমাকে গাদা বলছে!হাতের কাছে যা পাচ্ছি তাই ওর দিকে ছুরে মারছি।
—– আমি গাদা তাই না!আজ তোর একদিন কি আমার যতোদিন লাগে লাগুক! কিন্তু তোকে আজ ছাড়বো না।
নীর সামনে একটা বালিস কে ঢাল হিসেবে রেখে আমার এই বজ্রাঘাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে আর বলছে,

—- এবারের মতে ক্ষমা করে দে! আমি আর কোনো দিন বলবো না।আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম গাদাকে গাদা বলতে নেই!
আমি তো আরে রেগে গেছি! ইনসাল্টের উপর ইনসাল্ট!তাই এবার দুই হাতে ছুরতে লাগলাম।একটা সময় হাঁপিয়ে বসে পরলাম।নীরও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।আবারও এসে ধপাস করে শুয়ে পরলো।উল্টো হয়ে শুয়েই বললো,
—- এবার বল এতো রেগেছিলি কেন?
আমি হা করে একবার ওর দিকে তাকালাম।এই ছেলে জীবনে শোধরাবে না!তাই বনিতা না করে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলাম,
—- কাল থেকে এসবের মানে কি ছিলো?
—- কিসের?
দায়সারা ভাব নিয়ে উল্টো আমাকেই প্রশ্ন করছে।কথাটা যেন আমার কাটা গায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করলো।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললাম,

—— হোয়াট ‘কিসের’?কালকে একটা সাইন করা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিলি!হোক সেটা নকল আমি তো আর জানতাম না।তারপর থেকে ফোনটাও বন্ধ করে রাখলি জানিস আমার কি অবস্থা হয়েছিলো!বাবা নাহয় ওদের ব্যাপারে কিছু জানতে না কিন্তু আমি তো সবটাই জানতাম।তাও আমার থেকে লুকিয়ে এসব করার মানে কি?আমাকে তো একটা বার সব কিছু জানাতে পারতি?নাকি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করে এসব করেছিস?অ্যন্সার মি!
নীর শোয়া থেকে উঠে শান্ত ভাবে বসে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—- তোর কথা শেষ? তাহলে একবার ওই কোনার দিকে তাকা!
হাত দিয়ে ইশারা করে বললো।সেই হাত অনুসরণ করে ওইদিকে তাকাতে চমকে উঠলাম।কারণ ওখানে দেয়ালে একটা ক্যামেরা।একটু ছোটো আর দেয়ালের মতো সাদা হওয়াতে সহজে বুঝা যায় না ক্যামেরা টা।কিন্তু আমার ঘরে এটা কে লাগালো?

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৬

—- এইটা কিন্তু সিসি ক্যামেরা! তুই যা করেরিস সবই এটার মাধ্যমে রঞ্জন কাকু দেখতে পেতো।তাই তোকে এমন ধোয়াসার মধ্যে রেখেছি।রাতুল আমাকে ঠিক সময়ে এই খবর টা দিয়েছিলো তাই আমি এটার ব্যাপারে জানতে পারি।নাহলে আমি কখনোই জানতাম না রঞ্জন কাকু আমাদের উপর নজর রাখতে এখানে আগে থেকেই ক্যামেরা ফিট করে রেখেছে।তাই উনাকে দেখানোর জন্যই তোর সাথে এমন করেছি।তোর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ঝরলে আমার বুকে কতোটা লাগে তোকে বোঝাতে পারবো না।কথা দিচ্ছি আমি যতোদিন বেঁচে আছি কোনোদিন তোর ওই চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও ঝরতে দিবো না ইনশাআল্লাহ!
ওর কথাগুলো শুনে ভালো লাগা ছেয়ে গেলো সারা শরীরে! আমি সত্যি খুব লাকী ওর মতো একজন জীবনসঙ্গী পেয়ে।

মামনী আর বাবা মিলে ঠিক করছে আমাদের যেহেতু এখনো ইসলামী মতে বিয়েটা হয়নি তাই তারা আজ রাতে বিয়ের যে সময়টা ঠিক করা ছিলো সেই সময়ে আমাদের বিয়ে দিবে।কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী নই আবার বিয়ে করতে।মামনী এসে জোর করিয়ে একটা নতুন শাড়ী পরিয়ে পাক্কা বিয়ের কনে সাজিয়ে দিয়েছে।লাল টুকটুকে বিয়ের বেনারসি গহনা খোঁপায় বেলীফুলের এক গুচ্ছ মালা গাঁথা। আরো কতো কি!নীরকেও গোল্ডেন কালারের শেরওয়ানি পরিয়েছে বাবা আর ভাইয়ু মিলে।তবে ও মুখে না বললেও ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে খাড়া!সেই আগের কাজী লোকটাকেই ডাকা হলো।আসলে উনি আমাদের খুব পরিচিত তাই উনাকেই বারবার ডাকালে আজ কিন্তু উনারও অবদান আছে উনি যদি কাবিননামার সাথে ওই কাগজ টা ডুকিয়ে না দিতেন তাহলে এতোক্ষণে হয়তো অন্য কারো বাড়ির বউ হয়ে যেতাম।উনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই! অবশেষে আমাদের শরিয়ত মতে বিয়েটা হয়ে গেলো।এখন আমি সম্পুর্ন রুপে নীরে অর্ধাঙ্গিনী!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৮