প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৬ || bangla golpo

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৬
সুমাইয়া জাহান

—- ভালোই ভালোই সাইন টা করবেন নাকি আমাকে আঙ্গুল বাঁকাতে হবে ভাইজান!
আরমান সিকদারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কথাটা বলেই একটা বাঁকা হাসি দিলো রঞ্জন।আরমান সিকদার তো ঘৃণায় ওর না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ করে বসে আছে।তার এখন আর মৃত্যু ভয় নেই। বরং মৃত্যু টাই যেন এখন তার বড্ড প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।কি করে এতোগুলা বছর বিবেকহীনের মতো এই নরপশু টাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে প্রিয়জনদের এতো কষ্ট এতো অপমান করলো!নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে আজ!

তূবা আর রাতুল কে নিজের বাড়ির দিকে পাঠিয়ে এখন আরমান সিকদারের থেকে বাকি অর্ধেক সম্পত্তি নিজের নামে করার জন্য আরমান সিকদারের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জোরজবরদস্তির করে সাইন করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আরমান সিকদার সাইনও করছে না আর অন্য দিকে মুখ করে আছে।এবারও আরমান সিকদার কে চুপ করে থাকতে দেখে রঞ্জন এবার রেগে গেলো।ধমক দিয়ে বললো,
—- আমাকে কি আপনার বাড়ির জি চাকর মনে হচ্ছে! এই লাস্ট বারের মতো বলবো সাইন টা করে দেন।নাহলে কিন্তু প্রানে বাঁচতে পারবেন না!
আরমান সিকদার মুখ অন্য দিকে তাকিয়েই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

—– মৃত্যুর তো আমার সেদিনিই হয়ে গেছে যেদিন একসাথে তিনজনের করবরে মাটি দিয়েছিলাম।যদিন হারিয়েছিলাম প্রানপ্রিয় বন্ধু আর বোনকে।হারিয়েছিলাম সব আনন্দ সব হাসি।জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছি।আর দরকার নেই এই জীবন! যা ইচ্ছা তাই করতে পারিস আমার সাথে!কিন্তু আমি কোনো সাইন করবো না।
—– নিজের মেয়ের মৃত্যুর ভয়ও নেই?
রঞ্জনের এই কথাটায় চমকে উঠলো আরমান সিকদার। আকুতিমিনতি করে বলতে লাগলো,
—- রঞ্জন তুই আমার সাথে যা ইচ্ছা তাই কর। কিন্তু আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দে প্লীজ!দেখ তোর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিবো কিন্তু আমার মেয়েটার কিছু করিস না প্লীজ!
—- তাহলে তো সাইন টা করে দিতে হবে ভাইজান! আপনার মেয়ের কিচ্ছুটি করবো না তার বিনিময়ে সাইন টা করে দিবেন।আর নাহলে আপনার মেয়েকে জ্যান্ত দেখতে পাবেন না।
—- নায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া!!!!!
রঞ্জনের শেষের কথাটা শুনে আরমান সিকদার জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।পর মুহূর্তেই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—- তুই যেখানে বলবি যা বলবি তাই করবো শুধু আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দে!
মুহূর্তেই রঞ্জনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তারপর একটা পেপার’স আরমান সিকদারের দিকে এগিয়ে দিলো। আরমান সিকদার পেপার টা নিতে নিলেই রঞ্জনের পিছন থেকে একটা কন্ঠ ভেসে আসে।
—- কাকু কোনো পেপারে কোনো রকম সাইন করবেন না।
উক্ত কথাটা শুনে এখানে উপস্থিত সবাই চমকে যায়।ঘুরে তাকাতেই দেখতে পায় নীর রঞ্জনের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে উক্ত কথাটা বলেছে। তূর্যও অপর পাস থেকে রঞ্জনের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আছে।সবার চোখে এখন বিস্ময় শুধু রঞ্জন ছাড়া যেন এসব ও আগে থেকেই জানতো!
—- বাবা নীর তোরা দুইজনই অনেক খেলিয়েছিস আমাকে কিন্তু বাবা তোরা যে বড্ড কাঁচা খেলোয়াড়! ভালোই নাটক সাজিয়েছিলি তিনজনে মিলে।প্রথমে তূবাকে দিয়ে তোর বিরুদ্ধে যাওয়ার নাটক করলি।সত্যি বলতে আমিও প্রথমে সবটাকে সত্যিই ভেবেছিলাম। কিন্তু তোদের পিছনে লোক লাগিয়ে সত্যি টা জানতে পারলাম।তারপর আমিও তোদের মতো একটা নাটক সাজিয়ে নিলাম।আমার মতো পুরনো খেলোয়াড়ের সাথে তোরা যে টিকতে পারবি না বাবারা!যাক একদিক থেকে ভালোই হলো সবার গল্প আজ এখানেই শেষ করে দিবো।

রঞ্জন কথা গুলো একনাগাড়ে বলেই একটা বিশ্রী হাসি দিলো। তারপর আবার বললো,
—- তোদের সবার কলিজা তূবা যে এখন আমার কাছে বন্দি!এখানে একটা গুলি চললে ওখানেও চলবে!পারবি তো আমাকে গুলি করে তোদের কলিজার টুকরার মৃত্যু দেখতে?কি হলো সব দম ফুরিয়ে গেলো?
কথাগুলো বলে আবারও বিশ্রী হাসিতে ফেটে পরলো।এদিকে নীর আর তূর্য দু’জনের চোখে মুখেই ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো।দুজনেই গান সরিয়ে হাত উপরে করলো।প্রথমে তূর্য খুব ভয়ার্ত সুরে বললো,
—– প্লীজ এমন করবেন না কাকাবাবু!এই দেখুন আমরা গান সরিয়ে নিয়েছি।আমার পরীকে ছেড়ে দেন প্লীজ!
পাস থেকে নীরও ভয়ার্ত গলায় বললো,
—- কাকাবাবু আপনি যা বলবেন আমরা তাই করবো কিন্তু তূূবাকে ছেড়ে দেন প্লীজ কাকাবাবু! প্লীজ!
বলতে বলতেই রঞ্জনের সামনে হাত জোর করলো নীর।রঞ্জনের মুখে আরো একদফা হাসি ফুটে উঠলো।অবশেষে নীর চৌধুরীকে তার সামনে মাথা নোয়াতে হলো!এই আনন্দ কোথায় রাখবে সে?তাই ভেবে পাচ্ছে না।

—– কি ভাবলেন কাকাবাবু আমরা এমন করবো?কাকাবাবু আপনি পুরোনো খেলোয়াড় হতে পারেন।কিন্তু এটা কেন ভুলে যাচ্ছে যুগ পাল্টে গেছে!এযুগে আপনাদের মতো পুরোনো খেলোয়াড়রা ঠিকতে পারবে না।সময় এখন আমাদের যে!আপনি ঢালে ঢালে চললে আমরা চলি পাতায় পাতায়।আপনি আমাদের প্লান জানতে পেরেছেন আমরা চেয়েছি বলে!আমরা ইচ্ছে করেই আপনাদের কে আমাদের প্লান জানিয়েছি।আপনার টোপেই আপনাকে ধরলাম।
নীর দুই হাত ভাজ করে ঠোঁটে বাঁকা ঝুলিয়ে কথা গুলো বললো।পাস থেকে তূর্যও বললো,
—- পাপ বাপকেও ছাড়ে না কাকাবাবু! এতো বছর অনেক পাপ করেছেন। এবার তো শাস্তি ভোগ করতেই হবে কাকাবাবু!
নীর আর তূর্যের কথা শুনে রঞ্জন চমকে উঠলো।আরমান সিকদারও কম চমকালো না।কিন্তু মুখ ফুটেও কিছু বললো না কারণ উনার মনে হচ্ছে নীর আর তূর্য বড়ো কোনো প্লান করেছে।এদিকে রঞ্জনের মাথায় কিছুই ঢুকছে না।তারপরও জোর গলায় বললো,
—- ভুলে যাস না তূবা কিন্তু আমার কাছেই আছে!আমার একটা ইশারায় ওকে শেষ করে দেবে আমার লোকেরা!
—- রিয়েলি??

একই স্টাইলে দাঁড়িয়ে খুব শান্ত ভাবে পাল্টা রঞ্জন কে প্রশ্ন টা করলো।তূর্য ভিষণ শান্ত!ওদের দেখে মনে হচ্ছে এখানে কিছুই হয়নি।রঞ্জন ওদের এমন ব্যবহারে রীতিমতো অবাক।তারপর রেগে বললো,
—- আমার সাথে তোরা মজা করছিস?দাঁড়া এখুনি ওকে শেষ করতে বলছি!
বলতে বলতেই ফোনটা হাতে নিলো ফোন করার জন্য! ফোনে নাম্বার ডায়াল করার আগে পিছন থেকে নারী কন্ঠে কেউ একজন বলে উঠলো,
—- কাকাবাবু এতো কষ্ট করে ফোনের ব্যালেন্স শেষ করে আমাকে ডাকতে হবে না।আমি নিজে থেকেই এসে পরছি!
রঞ্জন পিছনে ঘুরতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো।কারণ তূবা রাতুলের গলায় ছুরি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নীর তূবাকে দেখেই লম্বা একটা হাসি দিয়ে বললো,
—- একদম পারফেক্ট এন্ট্রি মিসেস চৌধুরী!
পাস থেকে তূর্য এসে নীর এক কাঁধে নিজের কনুই রেখে বুক ফুলিয়ে বললো,
—- দেখতে হবে না কার ট্রেনিং!
—- আরে রাখো তোমাদের কথা আগে তো কাকাবাবুর ব্যবস্থা করে নেই। তারপর এগুলা বলার অনেক টাইম পাবা!

রাতুলের গলায় ছুরি ধরা অবস্থায় থেকেই বললাম আমি।এদের নিয়ে আর পারা যায় না এতো সিরিয়াস একটা মুডে আছি তার মধ্যেও এদের রসিকতা ঢুকাতে হবে।নীর রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বললো,
—- তা কেমন দেখলেন আমার বউকে কাকাবাবু?
নীরের কথায় রঞ্জন আরো চমকে উঠলো।প্রতিটা বাবা মায়েরই দূর্বলতা হচ্ছে তাদের সন্তান।রঞ্জনও তার ব্যাতিক্রম না।তার সব কিছুই তো তার একমাত্র ছেলের জন্যই করে।আর আজ সেই ছেলের গলায় ছুরি দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছে।আবার নীরের মুখে আমার বউ কথাটা শুনে আরেক দফা চমকালো।কপালে ভাজ পেলে বিস্ময় নিয়ে বললো,
—- তোর বউ মানে? তোর সাথে তো ডিভোর্স হয়ে গেছে আর রাতুলের সাথে ওর একটু আগেই তো বিয়ে হলো তাহলে এখনো ও তোর বউ থাকে কি করে?
—- কাকাবাবু আমি বললাম না আপনি পুরোনো দিনের খেলোয়াড় তাই এ-যুগের সাথে পারবেন না।কাবিননামা টা আপনি দেখেছিলেন?ওরা যেটাতে সাইন করছে যেটা আদেও কোনো কাবিননামা ছিলো তো!একটু চোখ কান খোলা রেখে চলবেন তো!
নীরের কথায় রঞ্জন প্রচন্ড অবাক হয়ে বলে,
—- ওইটা কাবিননামা ছিলো না???

—- আগগে না কাকাবাবু!কাজি সাহেব ওরা যে কাগজে সাইন কটরছে ওইটা একটু দেখান তো!
নীরের কথায় কাজী লোকটা দাত কেলিয়ে একটা কাগজ রঞ্জনের দিকে ধরলো।ওইটা অফিসের একটা অপ্রয়োজনীয় কাগজ। যেখান নিচে দুই জায়গায় আমার আর রাতুলের সাইন আছে।নীর আবারও বললো,
—- আর কি যেন বলছিলেন ডিভোর্সের কথা কাকাবাবু!আপনিও না কাকাবাবু! কালকে ডিভোর্স দিয়ে আজকে আবার বিয়ের পিরিতে কি বসা যায়!এটুকু বুদ্ধি তো থাকা দরকার ছিলো।এর থেকেও বড়ো কথা আমাদের কোনো ডিভোর্স হয়নি। সেটা দেখেছিলেন ওইটা নকল পেপারস ছিলো।
রঞ্জন এবার রেগে গেলো।এতোগুলা বোকা বানানো হলো তাকে?রেগে পাসের একটা ফুলদানিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়।আর চিৎকার দিয়ে বলে,

—- কি হচ্ছে টা কি এখানে?
—- কেন বাবা তুমি যা করেছো তাই আজ তোমার সাথে হচ্ছে! কেন এখন খারাপ লাগছে নাকি?
রাতুলের এমন কথা অবাকের চরম পর্যায় চলে যায় রঞ্জন।ঘুরে তাকাতেই আরো অবাক। এখন আর রাতুলকে তূূবা গলায় ছুরি ধরে নেই।রাতুল সম্পুর্ন মুক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে মনমরা হয়ে উক্ত কথা গুলো বললো।একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে রাতুল আবার বললো,

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৫

—- অবাক হচ্ছো বাবা?আমিও অবাক হয়েছিলাম কালকে তোমার কথা শুনে!আমি ভাবতাম তোমার শুধু আরমান কাকুর সম্পত্তির উপর লোভ তাই তূবাকে ঘরের বউ করে সম্পত্তির ভাগিদার হতে চাও।আর তোমার কালো ব্যবসার কথাও আমি জানতাম।আমি সেইদিন তোমার বলা কথা গুলোই তূবাকে বলেছিলাম।আমি ভেবেছি হয়তো এগুলো সত্যি তাই তূবাকে জানানো প্রয়োজন! ভাগ্য ভালো ছিলো সেদিন তূবা আমার কথা বিশ্বাস করে নীরকে ভুল বোঝেনি।আমি কখনো ভাবতেও পারিনি তুমি খুন করেছো তাও আবার একটা না চারটে খুন!কালকে যখন তুমি উকিল কাকুর সাথে কথা বলছিলে তখন আমি তোমার রুমের পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম।আর তখনই তোমার সব কথা শুনে ফেলি।তারপর নীর আর তূর্যের থেকেও তোমার ব্যাপারে সব জানি।তারপর থেকেই আমিও ওদের সাথে মিলে তোমার সব খবরাখবর ওদের দিতে থাকি।এরপরই আমরা সবাই মিলে এই প্লান করি।তুমি এতোটা নিচ আমি কখনো ভাবতেও পারিনি।

একনাগাড়ে এতো গুলো কথা বলে এবার দম নিলো রাতুল। বলতে গেলে আমাদের সবারই এখন রাতুলের জন্য খুব খারাপ লাগছে।শতো হোক বাবা তো!রাতুল সাহায্য না করলে হয়তো আজ আমরা সবাই শেষ হয়ে যেতাম।আমি এসবের কিছুই আগে থেকে জানতাম না এমন কি কিসে সাইন করেছি তাও খেয়াল করিনি তখন এতোটাই শকড এর মধ্যে ছিলাম।আমাকে আর রাতুল কে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাতুলের বাড়ির উদ্দেশ্য।কিন্তু গাড়িটা থামে একটা গোডাউনের সামনে গিয়ে এটা অবশ্য রঞ্জুর রঞ্জনেরই প্লানের একটা অংশ ছিলো।সুযোগ বুঝে রাতুল আমার হাতে একটা ছুরি দিয়ে বলে ওর গলায় ধরতে আমি প্রথমে অবাক হই। তারপর ও বলে একটাই একমাত্র পথ এখান থেকে পালানোর।তাই আমি আর কিছু না ভেবে ওর গলায় ছুরি ধরে কোনো রকমে পালিয়ে এখানে আসি। বাকিটা তো আপনারা জানেনই!

প্রেমের সাতকাহন পর্ব ২৭