রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ১৪ || লেখিকা : স্বর্ণা সাহা

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ১৪
লেখিকা : স্বর্ণা সাহা

ব্রেকফাস্ট শেষ করে, সবকিছু ওভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেই ঘরে চলে এলো দিশানী। ঘরে যাওয়ার আগে সুজাতাকে বলে গেছে,
“সুজাতা যদি এগুলো পরিষ্কার না করে,তাহলে আজকে দুপুরে দিশানী নিজের জন্য ছাড়া কারো জন্য রান্না করবে না, দুপুরে সবাইকে না খাইয়ে রাখবে”
অগত্যা সুজাতাকে হার স্বীকার করতে হলো।

দিশানী রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই দেখে তিনটে মিসডকল, নীলাদ্রি কল করেছিলো। দিশানী রান্নাঘরের ওদিকে থাকায় বুঝতে পারেনি। দিশানী কল ব্যাক করতেই নীলাদ্রি ফোন ধরলো।নীলাদ্রি ফোন ধরতেই দিশানী বললো,,
—ফোন দিয়েছিলেন যে?
—তোমার কি অবস্থা সেটা জানার জন্য ফোন দিয়েছিলাম,ওদের শিক্ষা দেওয়া শুরু করলে নাকি এখনো ভেজা বেড়াল হয়েই বসে আছো?
দিশানী হেসে ফেললো। তারপর উত্তর দিলো,
—উহু!ভেজা বেড়ালের চ্যাপ্টার ক্লোজড। কালকে রাতে না খাইয়ে রেখেছিলাম ওদের!আর আজকে সকালে আমার শাশুড়িমাকে ঘর পরিষ্কার করতে দিয়েছিলাম!আর নিরাকে দিয়ে জামা-কাপড় ধুইয়ে নিয়েছি।

—বাবাহ্!প্রথম দিনেই মাত করে দিলে দেখছি।
—মাত কই দিলাম, এটা তো সবে শুরু। আমার সাথে কম অন্যায় তো ওনারা করেনি, সবকিছুর পাই টু পাই হিসেব নেবো আমি। এতো সহজে ছাড়বো নাকি?
নীলাদ্রি দিশানী কে সাব্বাশী দিয়ে বললো,,
—এই না হলে দিশুপাখির মতো কথা। মাই জংলী বিল্লি ইজ ব্যাক!
দিশানী শান্ত গলায় বললো,,
—আপনার জংলী বিল্লি?
—সরি!মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
—হুম!
—রাখছি!
—সকালে খেয়েছেন?
—না, এখনো না!তবে খাবো
—সকালের খাবার দুপুরে খাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?
—আরে না তা কেনো হবে? কিছুক্ষন পরই খাবো!
—আপনারা ডাক্তাররা যদি অনিয়ম করে তাহলে রোগীরা আপনাদের থেকে কি শিখবে বলুন তো?
—আচ্ছা বাবা সরি!ভুল হয়ে গেছে আমার এক্ষুনি খাচ্ছি।
—হুম খান!বাই
—বাই!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দিশানী দুপুরবেলা আজ নিমপাতা ভেজেছে। এর আগের দিন কথাগুলো মজা করে বললেও আজকে সত্যি সত্যি নিমপাতা ভেজেছে দিশানী, তবে আজকে শুধু নিরার জন্য নয়,সবার জন্য।
খাবার টেবিলে,
দিশানী ভাত বেড়ে সাথে নিমপাতা ভাজা দিয়ে সবাইকে সার্ভ করলো। সবাই জিজ্ঞেস করলো,
“কি এটা?”
দিশানী হাসিমুখে সুন্দর করে উত্তর দিলো,
—তেমন কিছু না,নিমপাতা ভাজা।
সবাই চমকে উঠে জোরে বলে উঠলো,
—কি? নিমপাতা ভাজা!
দিশানী ভ্রু কুঁচকে বললো,,

—আপনাদের সবার রিয়াকশন দেখে মনে হচ্ছে আমি আপনাদের নিমপাতা ভাজি না বিষ খাওয়াচ্ছি। আরে বাবা এতো চমকানোর কি আছে? নিমপাতা ভাজাও তো একটা খাবার নাকি?
নিরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,,
—এর থেকে বোধহয় বিষও ভালো ছিলো!
দিশানী বললো,,
—এটা পাওয়াও কঠিন ব্যাপার না কিন্তু!এনে দেবো বিষ? খাবে?
নির্ঝর রেগে গিয়ে বললো,,
—কি শুরু করেছো তোমরা? চুপ করো!আর এসব কি রান্না করেছো দিশানী? এসব কি খাওয়া যায় নাকি?

—কেনো? তোমরা এমন ভাব করছো যেনো নিমপাতা মানুষ কোনোদিনও খায়নি!
সুজাতা দিশানীকে বললো,
—বৌমা তোমাকে তো মাছের ঝোল রান্না করতে দেখলাম তাহলে এসব কি?
দিশানী বললো,,
—আগে নিমপাতা ভাজা দিয়ে ভাত খাবেন তারপরে মাছের ঝোল দেবো তার আগে কিছু দেওয়া হবে না। যে নিমপাতা দিয়ে ভাত খাবেনা সে মাছের ঝোল পাবেনা, সিম্পল!
সবাই বহু কষ্টে জল দিয়ে গিলে গিলে নিমপাতা ভাজা দিয়ে ভাত খেলো। সবার মুখগুলো দেখার মতো ছিলো।
এভাবেই প্রতিবাদী দিশানী সবাইকে শিক্ষা দিতে থাকলো। দেখতে দেখতে এক মাস হয়ে গেলো।নিরা, সুজাতা, নির্ঝরকে অতিষ্ট করে ছেড়ে দিয়েছে দিশানী।

সুজাতা নির্ঝরকে বললো,
—ডিভোর্স যেদিন হবে দেখা যাবে, এখন থেকে মেয়ে দেখতে শুরু করে দেই কি বলিস?
—যা ভালো বোঝো করো!
নিরা বললো,,
—বৌদির ব্যবহারগুলো জাস্ট আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, বৌদি এখন কাটার মতো আমাদের গলায় বিঁধে আছে যাকে না আমরা গিলতে পারছি না উগলিয়ে দিতে পারছি।
নির্ঝর বললো,,
—ওকে আমরা ভয় পেতে শুরু করেছি ও এটাই ভাবছে এখন।ওকে আগের মতো টাইট দিতে হবে আবার।
—ঠিক বলেছিস
সুজাতা বললো,

—পাশের বাড়ির দিদি আমাকে একটা মেয়ের কথা বলেছে, ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। বাড়ি বেশি দূরে না আর মেয়ের বাড়ির পরিবারও বেশ বড়োলোক,কালকে শুনছিলাম বৌমা নাকি ওর বান্ধবীর বাড়ি যাবে।একবারে রাতে খেয়ে আসবে, এই সুযোগ! চল মেয়েটাকে যেয়ে একবার দেখে আসি।
নিরা বললো,,
—ওনারা কি ডিভোর্সি ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি?
—হুম!শুনলাম তো রাজি। আর ছেলেদের কেউ দোষ ধরে নাকি? ছেলে তো ছেলেই হয়, সে ডিভোর্সি হোক আর না হোক, তাতে কি যায় আসে!তাহলে কালকে আমরা মেয়ে দেখে আসি, কি বলিস নির্ঝর?
নির্ঝর উত্তর দিলো,,
—যা ভালো বোঝো তাই করো, আমার কোনো প্রব্লেম নেই।

দিশানী সকাল সকাল বের হয়ে গেলো মেঘার বাড়িতে, আজকে সারাটা দিন মেঘার বাড়িতে মেঘার সাথে কাটাবে দিশানী, রাতে নয়তো দুপুরে অবশ্য নীলাদ্রির আসার কথা আছে।দিশানী মেঘার বাড়ি পৌঁছতেই মেঘা এসে দিশানীকে জড়িয়ে ধরলো, অনেক দিন পরে দুজনের দেখা। দুজন ভেতরে ঢুকেই একের পর এক গল্প জুড়ে দিলো। দুই বান্ধবী অনেক দিন পর একসাথে হলে যা হয় আরকি।দুপুরবেলা সৌম্য আর নীলাদ্রি মেঘাদের বাড়িতে এসে পৌঁছলো। সৌম্য এসে দিশানী আর মেঘাকে গল্প করতে দেখে বললো,,

—দুই বান্ধবীর গল্প মনে হয় আজকে আর শেষ হবেনা!
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নীলাদ্রি সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকলো কারণ নীলাদ্রি সবাইকে দিশানীর ব্যাপারে কিছু বলবে। সবাই ড্রয়িংরুমে এলে নীলাদ্রি দিশানীকে বলে,
—ডিভোর্স এর পর কি করবে কিছু ভেবেছো?
দিশানী মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,,
—না, যা ভাগ্যে আছে তাই হবে!
—তার মানে নিজে থেকে কিছুই করবে না?
—কি করার আছে আমার?
নীলাদ্রি দিশানীকে একটা কাগজ দিয়ে বললো,,
—এটা ধরো!
দিশানী কাগজটা নিয়ে বললো,

—কি এটা?
—নিজেই দেখো!
দিশানী কাগজটা খুলে দেখলো একটা প্রাইভেট ভার্সিটির ফর্ম!দিশানী অবাক হয়ে নীলাদ্রিকে জিজ্ঞাসা করলো,,
—এই ফর্ম দিয়ে আমার কি কাজ?এটা দিয়ে আমি কি করবো?
—কি আর করবে!ফর্ম পূরণ করে জমা দেবে!
—পাগল নাকি!আমি আবার নতুন করে ভার্সিটিতে ভর্তি হবো নাকি?
—হলে ক্ষতি কি? নিজের জীবনটাকে আবার গড়তে দোষ কোথায়?
—নীলাদ্রি এটা প্রাইভেট ভার্সিটির ফর্ম!আপনি বুঝতে পারছেন না এখানে পড়া আমার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব না।
নীলাদ্রি দিশানীর অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,,

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ১৩

—আমি সব ভেবে চিন্তেই এই ফর্ম নিয়ে এসেছি, তুমি প্রাইভেট ভার্সিটির ফিনান্সিয়াল ম্যাটার নিয়ে টেনশন করছো তো!প্রয়োজন নেই, এটার দায়িত্ব যখন আমি নিয়েছি তখন এটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও!
—না!এটা খারাপ দেখায়, আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, যেটুকু করেছেন সেটাই অনেক আর প্রয়োজন নেই।
—আমাকে এতোটা পর ভাবছো কেন? আমি তো তোমাকে বলেছিলাম আমাকে নিজের একটা ভালো বন্ধু মনে করতে তাহলে এখন এতো হেসিটেশন কিসের?
—আপনি আমার দিকটা বুঝছেন না নীলাদ্রি, এটা ভালো দেখায় না।
—আচ্ছা বেশ ধার হিসেবে নাও!পরে ফিরিয়ে দিও।তবুও নিজের জীবনে ঘুরে দাঁড়াও, আবার নতুন করে জীবনটাকে শুরু করো, আমার এটুকু অনুরোধ রাখো, প্লিজ!আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি, প্লিজ!

নীলাদ্রি হাতজোড় করে কথাগুলো দিশানীকে বললো। দিশানী নীলাদ্রির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,,
—এতো কেনো করছেন আমার জন্য? কি লাভ এতে?
নীলাদ্রি মুচকি হেসে বললো,,
—সবকিছুর জন্য লাভ-ক্ষতির চিন্তা করতে হবে এর তো কোনো মানে নেই তাইনা? তবে এর উত্তর আমি একদিন দেবো। কিন্তু আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করো!এই অনুরোধটুকু রাখো।

রঙহীন জীবনের রঙ পর্ব ১৫