শেহজাদী পর্ব ১৪ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ১৪
Arishan Nur

ইমান অবাক হয়ে বলে, লাইফ পার্টনার মানে?, এইসব কি বাজে বকছেন ভাই? মাথা ঠিক আছে আপনার? লাইফ পার্টনার মানে কি জানেন? এইসব কোন ধরনের মজা?
এবারে মিরাও চুপ থাকলোনা। সে উঠে দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে বলে উঠে, মিস্টার চৌধুরী এইসব কি? কি বলছেন আপনি তা কি জানেন?

মিস্টার চৌধুরী দুইজনের রিয়্যাকশন দেখে খানিকটা ভড়কে গিয়ে নিজের চুলে হাত দিয়ে বলে, ইয়ে মানে আমি কি লাইফ পার্টনার বলেছিলাম নাকি?
ইমান চড়া গলায় বলে, তো?
— ওহো, টাং অফ মিস্টেক! বিসনেস পার্টনার বলতে গিয়ে লাইফ পার্টনার বলে দিয়েছি। ইমান তুমি তো জানোই আমি ইংলিশে একটু কাঁচা৷

ইমান নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো৷ মিস্টার চৌধুরীর কথা ভুল না। সে আসলেই ভুলভাল ইংরেজি বলে। একটা ভুল ইংরেজি বলার জন্য ইমানের জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম!

মিরা মিস্টার চৌধুরী আর ইমানের দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা কিছুতেই। মিস্টার চৌধুরী কেন তাকে ইমানের লাইফ পার্টনার বলল? সে কি ইমানের বৌ হয়ে গেল? একসময় হওয়ায় কথা ছিল! ভাগ্যের সহায় ছিল জন্য ইমানের সঙ্গে বিয়ে হয়নি তার! আচ্ছা ইমানের স্ত্রী হলে কি হত? এতোদিনে তাদের ছয় বছরের দাম্পত্য জীবন হত। ছয় বছরে নিশ্চয়ই তাদের ঘর আলো করে বাচ্চা-কাচ্চা আসত? একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। ছেলেটা প্রচন্ড ঠাণ্ডা স্বভাবের আর মা নেওটা হত আর মেয়েটা ভারী দুষ্ট। দুই বাচ্চা নিয়ে সারাটা দিন মিরার সময় ব্যস্ততায় কেটে যেত।
মিস্টার চৌধুরীর কথায় মিরার ঘোর কাটে। উনি মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আই এম সর‍্যি মিস?
মিরা বলে উঠে, আমার নাম মিরা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— ওহ! মিস মিরা, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার ঘটকালি করতে ভালো লাগে কিন্তু বিশ্বাস করেন আপনাদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ও আমার মাথায়া আসেনি। বিসনেস পার্টনার বলতে গিয়ে ভুলে লাইফ পার্টনার বলে দিয়েছি।

মিরা হালকা গলায় বলে, আপনার ভুলের জন্য আর একটু হলে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত৷
বলে ইমানের দিকে আড় চোখে তাকালো সে। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় মিইয়ে গেল। একটু আগের ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো তার৷ ইশ কি আজেবাজে ভাবছিলো সে!ভাগ্যিস একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়া চিন্তা-ভাবনা জানতে পারেনা!

ইশ কি লজ্জা! আচ্ছা যদি সত্যি সত্যি ছয় বছর আগে তার ইমানের সঙ্গে বিয়ে হত আর এখন যদি সে দুই বাচ্চার মা হলে, বাচ্চা দুইটাকে সামলাতে পারত? মায়েরা পারেনা এমন কোন কাজ নাকি পৃথিবীতে নেই! মিরাও যখন মা হবে দেখা যাবে বাচ্চা সামলানো থেকে অফিসে কাজ করা সবই একা হাতে পারবে! আচ্ছা সে এসব কি আবোলতাবোল ভাবছে?

ইমান এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবারে বলে উঠে, আমি তাহলে যাই? আমার অফিসে কাজ আছে।
মিরাও তড়িঘড়ি করে বলে, আমার ও কাজ আছে।
ইমান শুধু একবার তাকে তীক্ষ্ম চোখে দেখলো। কিছু বললো না। এবং গটগট করে হেঁটে সামনে পা বাড়ালো।
মিরাও তাকে অনুসরণ করে তার পিছু নিল। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই মিরা ইমানকে ডেকে উঠে আবারো।

কিন্তু ইমানের মধ্যে কোন ভাবান্তর হলোনা। সে যেন মিরাকে চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
মিরা বড় বড় পা ফেলে ইমানের সামনে এসে দাঁড়ালো এবং পথ আটকে বলে, কেমন আছো?
ইমান একটু হলেও চকিতে উঠে। কি সহজ প্রশ্ন কিন্তু এর উত্তর টা? এই প্রশ্নের উত্তর টা কেন এতো কঠিন! ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ম্যাথ গুলো ও তো এই প্রশ্নের চেয়ে কত্তো সহজ ছিলো। ইমান কেন পারছে না মিরাকে সোজাসাপ্টা বলে দিতে যে সে ভালো আছে। সরাসরি মিথ্যা বলার তেমন অভ্যাস নাই তার। কারো মুখোমুখি এবং চোখাচোখি হয়ে সেই ব্যক্তিকে ইমান মিথ্যা বলতে পারেনা। গলায় কথা আটকে আসে। আবার আত্মসম্মানের জন্য বললেও পারছে না যে সে ভালো নেই। রাতে ঠিক মতো ঘুম আসেনা।

ইমানকে চুপ থাকতে দেখে মিরা আবারো বলে, চুপ আছেন যে? জিজ্ঞেস করছি কেমন আছেন?
— ভালো।
–ফুপার শরীর কেমন এখন?
— ভালো।
মিরা একদন্ড চুপ রইল। সে ভেবেছিল ইমান ও বুঝি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু নাহ সে কিছু জিজ্ঞাসা না করে সামনে পা বাড়ালে, মিরা নিজ উদ্যোগে বলে উঠে, এখন কি অফিসে যাবেন?
ইমান সরু চোখে একবার মিরার দিকে তাকালো এবং চেহারায় বিরক্তি ভাবে এনে বলে, না। শ্বশুড়বাড়ি যাব।

ইমানের বিরক্তিভরা কণ্ঠে করা সামান্য রসিকতাটাও মিরা ধরতে পারলোনা। ইমানের যে একটা শ্বশুড়বাড়ি থাকতে পারে এটা যেন মিরার হিংসুটে মন মানতেই পারছে না। আচ্ছা মিরা কি খুব হিংসুটে? তার এই বৈশিষ্ট্য তো আগে প্রকাশ পায়নি? ইমানের বিয়েই বা কবে হলো?ইমানের বিয়ে হয়ে গেছে অথচ মা একবারও তাকে জানায়নি? অথচ বাসার বাথরুমের বেসিনের কল নষ্ট হওয়ার খবর তাকে যত্ন করে আম্মু জানাত কিন্তু এতো বড় একটা খবর তাকে দিতে ভুলে গেল? মায়ের উপর অভিমান হচ্ছে তার! এই মূহুর্তে ইমানের উপর ও রাগ লাগছে? ছেলেটা এতো বিয়া পাগলা কেন? বিয়ে-বিয়ে করে পাগল হয়ে যায়!

বৌ ঘরে না আসলে যেন সে মরে যাচ্ছে!
ইমানের বৌ দেখতে কেমন? নিশ্চয়ই খুবই মিস্টি একটা মেয়ে। যে সবসময়ই চোখে চশমা পড়ে। শাড়ি পড়তে ভালোবাসে। বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে কাকভেজা হয়!
মিরা আরেকদফা চমক খায়। এগুলো তো তার স্বভাব। সে চোখের চশমা ঠিক করে মনমরা হয়ে বলে, তোমার শ্বশুড়বাড়ি কোথায়?

ইমানের ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি ফুটে উঠে, সে উত্তরে বলে, চাঁদে। যাবে নাকি?
মিরা আরো কিছু একটা বলত কিন্তু ইমান তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ানো।
মিরা বোকা হয়ে চেয়ে থাকে। মাই গড! পৃথিবীবাসী এতো আপডেটেড হয়ে গেল যে এখন চাঁদে বসবাস করা শুরু করে দিয়েছে! কি সাংঘাতিক!
মিরা বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার কে কল দিলো।

ইরার পরীক্ষা মাত্র শেষ হলো। তার পরীক্ষা ভালো হয়েছে। শুধু ভালো না খুব খুব ভালো এর উপরে কিছু থেকে থাকলে সেরকম হয়েছে৷পরীক্ষা টা নিয়ে সে ভারী চিন্তিত ছিলো। যাক ভালো হয়েছে।
ভার্সিটি থেকে বের হলো সে। মাথার চুল গুলো তেলে চিপচিপ করছে।

সে আজকে গাড়ি ছাড়াই বাসায় ফিরবে। গাড়ি নিয়ে আপু বের হয়েছে৷ ইরা গাড়ি ছাড়া তেমন চলাচল করেনা। যেখানেই যায় গাড়ি করে যায়। ভার্সিটি থেকে বের হতেই কড়া রোদ এসে গায়ে হানা দিলো। ইরার রোদ, বৃষ্টি খুব বিরক্ত লাগে৷ সে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে রইল যদি কোন রিকশা পায় সেই আশায় । কিন্তু ভর দুপুর হওয়ায় খালি কোন রিকশা পেল না সে। একটু সামনের মেইন রোড। ওখানে রিকশা স্ট্যান্ড আছে। সে ঠিক করলো হেঁটে হেঁটে মেইন রোড অব্দি যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ৷

সে হাঁটা ধরে। কিছু দূর আগাতেই তার চোখ কপালে। দুই-তিন টা ইয়া মোটা মোটা কুকুর রাস্তার মাঝে ঘুরঘুর করছে৷ একটা কুকুর আরেকটা কুকুরের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। ইরার কুকুর ভীতি আছে। এতো বড় হওয়ার পরও কুকুর দেখলে বাচ্চাদের মতো ভয় পায়। এর পেছনে একটা কারণ ও আছে। ছোট থাকতে একবার কুকুর তাকে কামড় মেরেছিল। এরপর ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। এইজন্য কুকুর ভীতি তাকে চড়াও করে ধরে আছে।

সে ভয়ে চুপটি করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা একটা কুকুর তার দিকে তাকিয়ে ঘেউ করে উঠে।
ইরা ভয়ে চিৎকার করতে করতে পেছনের দিকে ভো দৌড় দিলো। এই দৌড় জীবন রক্ষার্থে দিল সে। ডানে-বামে কিছু না দেখেই রাস্তা বরাবর দৌড়াচ্ছে সে।

হুট করে কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খায় সে এবং হুড়মুড়িয়ে ধপাস করে নিচের দিকে হেলে পড়ে।কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, সে ব্যথা পেলনা। চোখ বন্ধ করে থাকায় দেখতে পেল না কিছু কিন্তু অনুভব করলো কেউ একজন তার কোমড় চেপে ধরে আছে। সে তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে দেখে, একটা চাপ দাড়ি ওয়ালা ছেলে তাকে নিয়ে রাস্তায় মাটির সাথে লেপ্টে আছে। ইরা একদম ছেলেটার মুখোমুখি পড়ে আছে। ছেলেটার খাড়া নাকের সঙ্গে নিজের বোচা নাকটা ঈষৎ লেগে গেছে।

সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো এবং ঝারি মেরে বলে, অসভ্য কোথাকার?
ছেলেটা রাস্তায়ই বসে নিজের শার্ট ঝারা দিয়ে, তাকে অনুকরণ করে বলে, অসভ্যী কোথাকার!
ইরা ভ্রু কুচকে বলে, অসভ্যী আবার কি জিনিস?
— অসভ্যের ফিমেইল ভার্সন।
ইরা এহেন কথা শুনে নির্বাক হয়ে যায়। এই শব্দ আবার বাংলা অভিধানে কবে যুক্ত হলো?

মিরা বাসায় ফিরলো আধ ঘন্টার মাঝে। সিঁড়ি দিয়ে ফ্লাটে উঠে বেল বাজিয়ে মিনিট দশ অপেক্ষা করলো সে।কেউ গেট খুলছেনা দেখে সে কিছুটা বিচলিত হলো। উপায় না পেয়ে দরজা ধাক্কালো। গেট ভেতর থেকে লক করা। কিন্তু আশপাশ শান্ত থাকায় সে ভেতর থেকে সোনালী আপার গোঙ্গানোর ধ্বনি পেল। মিরার আত্মা কেঁপে উঠে। আপুর কিছু হলো না তো?
সে জোরে আওয়াজ তুলে বলে, আপু? আপু তুমি ঠিক আছো?

ভেতর থেকে কেবল কান্নার আওয়াজ আসছে। মিরা উদভ্রান্তের ন্যায় হয়ে পড়লো। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কি করবে সে? মিরার কান্না পাচ্ছে। সে ফোনের ডায়াল লিস্টে গিয়ে বড় আব্বুকে কল দিলো কিন্তু তার ফোন বন্ধ। বাবা আজকে সকালে গাজীপুর গিয়েছে মাকে সঙ্গে নিয়ে।
বিপদ আসলে সব দিক দিয়েই কেন রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়?

শেহজাদী পর্ব ১৩

মিরার মাথায় ইমানের নাম ভেসে ওঠে। সে দেরি না করে ইমানের আগের নাম্বারে কল দেয়। খুব করে দোয়া করতে লাগে যেন ইমান সিম না পরিবর্তন করে।
ওপাশ থেকে ইমান রিসিভ করতেই মিরা কান্না করতে লাগে।
ইমান উতলা কণ্ঠে বলে, মিরা?
মিরার কান্না আওয়াজে কিভাবে ইমান তাকে চিনে ফেললো তা জানা নেই মিরার। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ইমান!

— কি হয়েছে কি তোর? তুই ঠিক আছিস?
মিরা নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে, খুব বিপদ হয়ে গেছে। তুমি আসো প্লিজ। আই নিড ইউ ব্যাডলি!
মিরার বলা শেষ কথাটাই যথেষ্ট ছিলো ইমানকে তার কাছে ছুটে আসার জন্য। মিরার প্রতি সকল অভিমান, রাগ তুচ্ছ করে উদভ্রান্তের ন্যায় অফিস থেকে বের হলো সে।চোখে অন্ধকার দেখছে ।যে করেই হোক তাকে মিরার কাছে যেতে হবে। পৃথিবী এঁফোড়-ওঁফোড় হলেও সে যাবে! মিরার কাছে যাবে! তাকে যেতেই হবে! এটা হচ্ছে এক তরফা ভালোবাসার শক্তি!

শেহজাদী পর্ব ১৫