শেহজাদী পর্ব ১৫ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ১৫
Arishan Nur

মিরার বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যাচ্ছেনা। ওলরেডি বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। দুপুরবেলা ছিলো জন্য রাস্তা ফাঁকা পেয়েছিল ইমান। নাহলে ঘন্টার উপরে লাগত আসতে মিরার বাসায়। মোড়ের কাছে এসেই জ্যামে আটকা পড়ে সে।এতে অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। সে কাঁপা হাতে ফোনের স্ক্রিন দেখে নিলো। তিনটা আটচল্লিশ বাজে। আড়াইটার দিকে অফিসে ঢুকেছিল সে।জ্যাম ছুটার কোন নামই নেই। না পেরে ইমান গাড়ি একপাশে সাইড করে রেখে হাঁটা শুরু করলো।

হেঁটে নয় প্রায় দৌড়ে মিরার বাসায় গেল সে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই তার চোখ আটকে যায়। সদর দরজা হাট করে খোলা। ভেতর থেকে মিরার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মেয়েটার কান্নার আওয়াজে ইমানের নিশ্বাস ভারী হতে লাগে। সে এগিয়ে গেল। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উচিয়ে সবটা দেখতে লাগলো।
সোনালী আপু সোফায় বসে হাঁপাচ্ছে আর জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মিরা পাশে বসে গুনগুনিয়ে কাঁদছে। এসব দেখে ইমানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

সে দ্রুত পায়ে মিরা আর সোনালী আপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বলে, আপু! কি হয়েছে তোমার?
মিরা এবং সোনালী আপু দুইজনেই ইমানের দিকে তাকালো। ইমানকে দেখে মিরার গা বেয়ে ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল। সে তো ইমানের কথা ভুলেই গিয়েছিল! আপু নিজ থেকে গেট খুলে দেওয়ার পর ইমানের কথা আর মনে ছিল না তার৷ ইমানকে যে ফোন দিয়ে সাহায্য চেয়েছিল সেই কথা মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সোনালী আপু টেনে টেনে নিশ্বাস নিয়ে বলে, এখন কিছুটা ভালো লাগছে। তুই তো জানিস, আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। দুপুরে খাওয়ার পর হুট করে নিশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। ইনহেলার খুজে পাচ্ছিলাম না।বাসায় কেউ নাই যে সাহায্য নিব। ফোন যে করব সেই ফোনও হাওয়া হয়ে গেছে। এরমধ্যেই পেটে ব্যথা শুরু হলো। মনে হচ্ছিল আর বাঁচবো না। আজকে এই বন্ধ ফ্ল্যাটেই মরে পড়ে থাকব।
ইমান জোর গলায় বলে, আপু চুপ করো!

সোনালী আপা তাও গড়গড় করে বলে, ভাগ্যসি সময় মতো মিরু এসেছিল নাহলে আমার বাচ্চাটা আজকে আর এই পৃথিবীর মুখ দেখত না। এরপর সে ফোলা পেটে হাত দিয়ে বড় করে একটা দম ছাড়লো এবং ইমানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো, তুই কিভাবে আমার অসুস্থতার খবর পেলি?
ইমান লক্ষ করে, আপুর মুখটা ব্যথায় লাল হয়ে গেছে। সারা মুখ ঘামে চিপচিপ করছে। এবং সে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে । সে যে অসুস্থ বোধ করছে এটা দৃশ্যমান! তখনি মিরার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে ইমানের কানে।

সে মিরাকে ধমক দিয়ে বলে, মিরা তুই এত বলদ ক্যান রে? মাথাভর্তি গোবর আছে তোর? আপুকে নিয়ে হসপিটাল যাস নি কেন এখনো?
মিরা কান্না থামিয়ে দিল ধমক খেয়ে। কিন্তু কিছু বললো না।
সোনালী আপু বলে উঠে, আহা মেয়েটাকে বকিস না। ও ফার্মেসী থেকে ইনহেলার কিনে না আনলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এখন ভালো লাগছে তো।
ইমান আপুর কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মিরাকে প্রশ্ন করে, ম্যা ম্যা করে রামছাগলের মতো কাঁদার কি আছে?

মিরা ইমানের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে বলে, সর‍্যি। আসলে আপনার কথা মনে ছিল না। অস্থিরতার জন্য একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম ইনফর্ম করার কথা । ফোন করে যে বলব সব ঠিক আছে সেটা মনে ছিলো না।
ইমান জোড়ালো গলায় বলে, আমায় মনে রাখার দরকার ও নেই। প্রয়োজন ফুরালে ভুলে তো যাবিই।
এরপরে ফোঁস ফোঁস করে বলে, দরকার পড়লে আই নিড ইউ আর প্রয়োজন ফুরালে আই ফরগেট ইউ!

মিরা অনুতপ্তবোধ করতে লাগলো। কিন্তু সোনালী আপু কি তার একার বোন? ইমানের বোন হয় না? নিজের বোনের হেল্প করা তো তার দায়িত্ব। তাহলে এতো কথা শুনানোর কি আছে? আজব পাবলিক! হ্যাঁ মিরা সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু নিজের জন্য তো না।তাদের বোনের জন্য ইমানের কাছে সাহায্য চেয়েছে। বাসায় কেউ ছিল না। ঘাবড়ে গিয়েছিল সে।এমন পরিস্থিতিতে কেউ পাশে থাকলে সাহস বাড়ে।
মিরা নম্র গলায় বলে, মানুষ মানুষের জন্য। বিপদে মানুষ অপর মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে তাই না?

ইমান রেগে ফেটে পড়ে বলে, তুই তো মানুষ না। তুই হচ্ছিস আস্ত এক বলদ। হা করে বসে না থেকে আপুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলি না ক্যান?
মিরা বলে উঠে, আপু সুস্থ আছে এখন।
— কোথায় দেখলি সুস্থ আছে? আমি তো দেখছি তার হাত-পা কাঁপছে। তুই আসলেই কানি। না কানি না আমার মনে হয় তুই ইচ্ছা করেই যাসনি!
মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। কি যা-তা বলছে ছেলেটা!

ইমান এতেই ক্ষান্ত হলোনা। সে আরো বলে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে তোর কোন শক্রুতা আছে তাই না? এইজন্য আমাদের ক্ষতি করার ধান্দায় থাকিস!
মিরা ঠোঁট উলটে বসে রইল। বহুদিন পর ইমান তার সঙ্গে আগের মতো করে কথা বলছে।
মিরা ঠোঁট কামড়ে উত্তর দেয়, ড্রাইভার খেতে গেছে। আমি একা কিভাবে আপুকে নিয়ে হাসপাতালে যাব?

ইমান বাজখাঁই গলায় বলে, একা একা বিদেশে যাইতে পারিস আর দেশে নিজের বড়বোনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তোর এতো ঢং! এইসব কিছু তোর চক্রান্ত! সত্যি সত্যি বল তো! কার হয়ে কাজ করছিস তুই?
মিরা উত্তর না দিয়ে চুপ রইল।
সোনালী আপু ইমানের হাত ধরে বলে, আমি ঠিক আছি গত পড়শু চেক আপ করিয়েছি।
ইমান সোনালী আপুর দিকে তাকালো। আপু কিঞ্চিৎ হেসে বলে, এখন ঠিক আছি। এক গ্লাস পানি খাওয়া।

ইমানের আগেই মিরা দৌঁড়ে গেল পানি আনতে।
তখনি আপা চিৎকার দিয়ে বলে, এই!
ইমান হচকচিয়ে উঠে বলে, কি হয়েছে আপু?
— তোর ভাগ্না নড়াচড়া করছে।
— মানে?
— মানে বাবু কিক দিচ্ছে।
— সত্যি!
— হ্যাঁ!

ইমান ফেলো পেটের দিকে তাকালো অদ্ভুত ভাবে। বিশ্বাস হয়! এই ছোট্ট পেটে একটা মানুষ আছে। যে কিনা কিছু দিন পর পৃথিবীতে আসবে। সে মুচকি হাসলো।
মিরা পানি এনে আপুকে দিলো। আপু এক নিমিষেই পানি পান করে মিরাকে বলে, দেখ! তোদের ভাগ্না ফুটবল খেলছে।
মিরা এক গাল হেসে আপুর পেটে হাত বুলালো। এরপর বললো, আপু তুমি শুয়ে রেস্ট নাও।
সোনালী আপু বলে, ইমান আয় ভাত খা!
ইমান শটাং হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, নাহ। যাই তাহলে। তুমি সাবধানে থাকো। আর দাদী কই? দেখলাম না ওনাকে।

মিরা জবাব দিলো, দাদী আম্মু-আব্বুর সঙ্গে গাজীপুর জমির এক কাজে গেছে।
সোনালী আপু মিরাকে তাড়া দিয়ে বলে, মিরু যা! তরকারি গরমে দে।যা। দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করিস না।
ইমান থমথমে গলায় বলে, দরকার নাই।
— দরকার আছে কিনা নাই এটা আমি বুঝব। আজকে শুটকির তরকারি টা খুব মজা হয়েছে। আয় টেবিলে বস। হাত-মুখ ধুয়ে আয়।
— না। আমি লাঞ্চ করে এসেছি।
সোনালী আপু বলে, কি খাইছিস?
— স্যান্ডউইচ।
— স্যান্ডউইচ খেয়ে পেট ভরে? মিরু তুই দাঁড়িয়ে কেন আছিস? যা!

মিরা সময় নষ্ট না করে রান্নাঘরে গেল। ভাত, তরকারি গরম করতে দিয়ে ফ্রিজে দেখলো কাবাব আছে কিনা! নাহ ফ্রিযে কাবাব রাখা নেই। আগে তো সবসময় থাকত!
অগত্যা মিরা খাবার নিয়ে গিয়ে খুব সুন্দর করে টেবিল সাজালো। ইমান হাত ধুয়ে এসে চুপচাপ বসে খাওয়া শুরু করলো। সোনালী আপুও তার পাশে এসে বসে টুকটাক গল্প করতে লাগলো।
সোনালী আপু জোর করে আরো এক চামচ ভাত ইমানের প্লেটে তুলে দিয়ে বলে, তুই আর আগের মতো আসিস না কেন? নানীকে দেখতে মন চায় না?

ইমান খেতে খেতে জবাব দিলো, কাজের প্রেসার। আগেও একবার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। নানীর সঙ্গে ডেইলি কথা হচ্ছে ফোনে।
— ফোন আর সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ কি এক জিনিস?
— এক না হলেও চলার মতো করে চালানো যায়।
— মিরাকে এখনো ভালোবাসিস?
ইমান চমকে উঠে। খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার৷ সে আপুর দিকে তাকালো। আপুও তার দিকেই তাক করে তাকিয়ে আছে ররহস্যজনক হাসি হাসছে। ইমান কিছু একটা বলত কিন্তু তার আগেই মিরা বেগুন ভাজা নিয়ে উপস্থিত হলো।
সোনালী আপু বলে উঠে, বেগুন ভাজা কই পেলি?

ইমানের সামনে বেগুন ভাজা রেখে মিরা উত্তর দিলো, মাত্র ভেজে আনলাম।
সোনালী আপু হালকা হেসে বলে, কই আমার জন্য কোনদিন তুমি কিছু বানাও নাই আর ইমানের জন্য বেগুন ভাজি করো। বাহ! বাহ!
মিরা খুবই ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। সোনালী আপু তো এতো গল্পবাজ ছিল না আগে। সবকিছুই প্রেগ্ন্যাসি মুড সুয়িং।

মিরাকে অবাক করে দিয়ে ইমান বেগুন ভাজা না নিয়েই খেয়ে উঠলো। এতে বড্ড কষ্ট পেল মিরা। এতো কষ্ট করে সে বেগুন কাটলো। এরপর ভাজি করলো। ভাজি করার সময় গরম তেল হালকা তার বুড়ো আঙুলে এসে লেগেছিলো।এতো কষ্ট করে মিরা বেগুন ভাজা বানালো অথচ ইমান মুখে ও দিলোনা। মিরার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
সোনালী আপুর কাছ থেকে ইমান বিদায় নিয়ে নিজের গন্তব্য রওনা হলো। বিদায় বেলায় মিরাও আপুর পাশে ছিল কিন্তু তাকে কিছু বললো না সে। এজন্যও মিরার খানিক টা অভিমান হলো। একটা বার বলতে তো পারত সে, আচ্ছা মিরা যাই তাহলে?ওই যে! একবার যেভাবে বলেছিল সেভাবে কি পারত না আজো বলতে?

সন্ধ্যা নাগাদ মিরার আব্বু, আম্মু এবং দাদী ফিরে এলো। ততোক্ষনে ইরাও ভার্সিটি থেকে এসে রেস্ট নিচ্ছিলো। আব্বু-আম্মু আসার পর পর মিরা চা-নাস্তা নিয়ে তাদের রুমে গেল। রুমে আম্মু ছিল না। সে বাথরুমে গোসল করছিলো। আব্বু একা রুমে বসে ছিল। মিরাকে খাবার হাতে ঢুকতে দেখে সে বারান্দায় চলে গেল। এতে পুনরায় আহত হলো মিরা। কিন্তু সেও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। বাবার রাগ ভেঙে তবেই আরামের ঘুম ঘুমাবে সে।
মিরা বাবার পেছনে পেছনে বারান্দায় গিয়ে কাতর গলায় বলে, বাবা?
মিরা বাবা পেছনে না ফিরেই বলে, কি হয়েছে?

— তুমি এখনো আমার উপর রাগ করে থাকবে? আমি ক্ষমাপ্রার্থী তো! আর কতবার ক্ষমা চাইব?
উনি বলে উঠে, ক্ষমা চাইলেই কি সব ঠিক হয়ে যায় মা?
অনেকদিন পর মিরা বাবার মুখে মা ডাক শুনলো। সে হালকা হেসে বলে, বাবা আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসি।
এবারে মিরার বাবা তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ভালো তো আমিও বাসি তোমাকে। তাই বলে তুমি ভুল করলেও তোমাকে শাসন করব না এটা তো হবে না।
মিরা মাথা নিচু করে ফেলে।

শেহজাদী পর্ব ১৪

উনি বিরামহীন ভাবে বলে, ইমানের বাবার কাছে আমার কোন সম্মানই থাকলো না! ছেলেটার সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনা তোমার জন্য। বুবু অসুস্থ হওয়ার পর পর বলেছিল, আমার ছেলেটাকে দেখে রাখিস। ও যেন কষ্ট না পায়। বুবুর কথাও রাখতে পারলাম না। বিয়ের আসরে ছেলেটা সবার সামনে অপমানিত হলো। আমি মামা হয়ে রক্ষা করতে পারলাম না। আমার মৃত বুবুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও রাখতে পারিনি। বুবু মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলেটা সৎমায়ের সঙ্গে থাকলো। তুমি জানো না? ইমানের সৎ মা কেমন মহিলা? তোমার পালিয়ে যাওয়ার পর না জানি ছেলেটাকে কত কথা শুনানো হয়েছে।

মিরার চোখ ভরে উঠলো। সে পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝেতে ঘঁষছে। এই প্রথম সে ইমানের কষ্ট অনুভব করছে৷
উনি এক দন্ড থেমে বলে, ছেলেটা এখনো বিয়ে করেনি। একবার প্রতারিত হয়েছে জন্য হয়তোবা দ্বিতীয় বার সাহস পাচ্ছে না।
মিরা কাঁপা গলায় বলে, বাবা! তোমার রাগ ভাংগানোর জন্য যেটাই করতে হবে আমি চোখ বুজে সেটাই করব৷

— আমি তোমার উপর রেগে নেই মা। আমি শুধু চাই ইমান সুখে থাকুক। ছেলেটার অনুভূতি নিয়ে খেলার অধিকার আমাদের নেই।
মিরা চুপ রইল। ইমান কি সুখে নেই?
মিরার বাবা উলটো মুখ হয়ে বলে, আমি চাই তোমার আর ইমানের যেন বিয়ে হয়৷
মিরার বুকটা ছ্যাত করে উঠে।এটা কি আদৌ সম্ভব?
উনি বললেন, এটাই তোমার কাছে আমার শেষ চাওয়া।

শেহজাদী পর্ব ১৬