শেহজাদী পর্ব ১৬ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ১৬
Arishan Nur

ইমান গাড়ির কাছে এসেই অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তার প্রিয়, আদরের গাড়ির একটা কান নেই! মানে গাড়ির একটা লুকিং গ্লাস নাই। চোর চুরি করে নিয়ে গেছে। ইমান পারলে কেঁদে দেয়। তার খুবই প্রিয় গাড়ির লুকিং গ্লাস চুরি হয়ে গেলো! ভাবতেই কষ্ট লাগছে তার। মনে মনে পুরান ঢাকার মানুষের সততার উপর চৌদ্দ গুষ্টিসহ লেকচার মারলো!

দেরি না করে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইমারজেন্সি বাটন টিপে গাড়ি চালাচ্ছে আর মনে মনে লুকিং গ্লাস চোরকে গালি দিচ্ছে। পথিমধ্যে একবার এক ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামিয়েও ছিল। ভাগ্যিস ফাইন করেনি। দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে৷
ইমান যখন বাসায় ফিরে তখন প্রায় সন্ধ্যা। আযান এখনো দেয়নি। তবে দশ মিনিটের মধ্যে আযান পড়ে যাবে। আজকে সকালে ফযরের নামাজ মিস গেছে। উঠতে পারেনি সে। ফোনে এলার্ম দেয়া তাও জাগনা পায়নি!

বাসায় এসে ঢুকতেই আরেকদফা অবাক হয় সে। ড্রয়িংরুমে ইমানের একমাত্র ছোট ভাই সাদ সোফায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সাদকে এভাবে সোফায় পড়ে থাকতে দেখে ইমান ভ্রু
কুচকে বলে, সাদ কি হয়েছে তোর? এভাবে লেটে পড়ে আছিস ক্যান?
সাদ শোয়া থেকে আধশোয়া হয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, ভাইয়া, তুমি জানো না তো কি হয়েছে আজ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাদের চেহারায় আনন্দ ভাব ফুটে উঠেছে। তার মানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সাদ অগুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে খুবই পছন্দ করে। প্রায় প্রতিদিন ই আজব এবং উদ্ভট সব কাজ করবে এই ছেলে। এইতো গত মাসের কোন এক শুক্রবারে সে এক রিকশাওয়ালাকে বাসায় আনলো। কারন জিজ্ঞেস করলে বললো,রিকশাওয়ালার হাতে রান্না করা রুই মাছ দিয়ে কাঁচা কলার তরকারি খাবে। এমন অদ্ভুত কাজ সাদ করে বেড়ায়। মূলত কাজ-কর্ম নাই জন্যই এসব করে কুল পাচ্ছে। সাইকোলজিতে পড়াশোনা করার পর ও বেকার। বাবার অফিসেও বসে না। অন্য কোথায়ও জবের ট্রাই করেনা। সে নাকি চিরবেকার থাকবে বলে শপথ করেছে।

ইমান বলে উঠে, তোকে কি কেউ গণধোলাই দিয়েছে?
সাদ হালকা চুপসে গিয়ে বলে, উহু। আমাকে কেন গণধোলাই দিবে? খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটেছে। বসো পাশে। পুরাটা ডিটেইলস এ বলি নাহলে বুঝবা না। বস।

ইমান না চাইতেও বসে পড়লো। সাদের ফাউল কথা শোনার ইচ্ছা নেই তবুও মুখের উপর বলা যায়না এই কথা।অভদ্রতা দেখায়। তার উপর সাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ আগে কথা হয়েছিল। এই সাত দিনে সে এতোটাই বিজি ছিল যে পরিবারের কারো সঙ্গেই কথা হয়নি। কিংবা কারো গরজ পড়েনি তার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার! আচ্ছা ইমানের নিজের মা বেঁচে থাকলেও কি শত ব্যস্ততার মাঝে তার সঙ্গে কথা হত না? নাহ! নিজের মা হলে শত কেন হাজার ব্যস্ততা থাকলেও ইমান দিনে পাঁচবার দেখা করত! রাতে এসে ঠিকই মাকে সঙ্গে নিয়ে ডিনার করত। ব্রেকফাস্ট টাও মায়ের সঙ্গেই বুঝি করা হত! মায়ের পুরনো স্মৃতি মনে হতেই ইমানের বুকটা ভার হয়ে আসে।

সাদের কথায় তার ঘোর ভেঙে যায় । সাদ বলে উঠে, ভাইয়া কই হারায় গেলা? আমার কথা শুনো! আজকে দুপুরে ঢাকা ভার্সিটির দিকে গিয়েছিলাম এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে। হালিম চত্ত্বরের খিঁচুড়ি খাওয়ার জন্য। তো ফ্রেন্ডরা মিলে হৈচৈ করে ফেরায় সময়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি হুট করে কথা নাই বার্তা নাই একটা দস্যি মেয়ে এসে আমার গায়ে পড়লো। টাল সামলাতে না পেরে ওই ডানাকাটা পরী মেয়েকে নিয়েই নিচে পড়ে গেলাম। নিচে একটা ইটের খোয়া পড়া ছিল। ইটের টুকরো দিয়ে পিঠে এমন ব্যথা পাইলাম!

— স্যাড।
সাদ মুখে এক চওড়া হাসি ঝুলিয়ে বলে, স্যাড না ভাইয়া। ওই যে ডানা কাটা পরীর উষ্ণ ছোঁয়ায় আমার কি যেন হয়ে গেল! বলো একসঙ্গে নিচে না পড়লে কি ওনার সাধিন্ন্য পেতাম? বল? বল?
ইমান একটা হাই তুললো।

সাদ এবারে কিছুটা লাজুক লাজুক হয়ে বলে, ভাইয়া, আই ফল ইন লাভ উইথ দিস উইংলেস ফেইরি! লাভ এটা ফার্স্ট স্লাইট! পেহলা নাজার মে পেয়ার জিসে কেহতা হ্যা!এক দেখায় প্রেম!
ইমান হাসি পেল। সে হাসি চাপিয়ে বলে, দেখ পরীর প্রেমে মানুষ পড়েনা। তুই কি জ্বীন?
সাদ মুখ ভোতা করে বলে, উফো! তুমিও না।ভাইয়া কিচ্ছু বুঝোনা। আমার পিঠে ব্যথাটাকে আর ব্যথাই মনে হচ্ছেনা। আমার মনে হচ্ছে, প্রেমে পড়া মধুর এক অনুভূতি!

ইমান মনোযোগ দিয়ে সাদের কথা শুনলো। সাদের বলা কথাটি কি সত্য? আসলেই কি প্রেমে পড়ার অনুভূতি মধুর? কি জানি? হয়তোবা সাদ সঠিক!
“কিন্তু ভুল মানুষের প্রেমে পড়া অভিশাপ!”
সাদ আরো কিছু বলত বোধহয় কিন্তু আযান শুরু হওয়ায় ইমান তাকে সেই সুযোগ দিলো না। সে ড্রয়িং রুম থেকে হেঁটে হেঁটে নিজের রুমের দিকে যাওয়া শুরু করলো উদ্দেশ্য ওযু করে সালাত আদায় করা।

মিরা বাবার কথা শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে খুব পর লাগছে এই মূহুর্তে মিরার কাছে। শেষ চাওয়া মানে কি? বাবা এভাবে কেন বললো? মেয়ের কাছে তিনি যতোবার ইচ্ছা ঠিক ততোবারই আবদার করতে পারেন।যতো ইচ্ছা শাসন করবেন!
শেষ আবদার, প্রথম আবদার আবার কি? কই মিরা তো অবলীলায় ছোট্টকাল থেকে বাবার কাছ থেকেই সব আবদারের ঝুলি নিয়ে বসে থাকে! তার কান্না পাচ্ছে খুব। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, আব্বু, তুমি যা চাও তাই হবে।

মিরার বাবা জয়নুল সাহেব গলা খাঁকিয়ে বলে উঠে, মা তুমি তো আমার ইচ্ছা, অনিচ্ছার পরোয়া করোনা। নিজের যা মন চায় তাই করো।
এই কথা শুনে মিরার খুব করে কান্না করে দিতে মন চাচ্ছিল। বাবাকে কিভাবে বুঝাবে সে, ছয় বছর আগের মিরা আর এখনকার মিরার মধ্যে ঢের তফাত আছে। আগের বোকা মিরা আর নেই। এখন আর সহজে প্রতারিত ও হয়না সে। বিচক্ষণ হয়েছে সে বড় আব্বুর মতো। এবং এই মূহুর্তে সে অনুতপ্ত ও! ইমানের সঙ্গে করা অবিচারের জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। দরকার হলে সে ইমানের পা ধরেও ক্ষমা চাইবে!
জয়নুল সাহেব বলে উঠে, আযান দিয়ে দিয়েছে। যাও রুমে যাও। আমি নামাজে যাব।

— আচ্ছা, আব্বু।
মিরা বাবার রুম থেকে বের হয়ে একবার ইরার রুমে উঁকি দিলো। ইরাকে সে ফোন চালাতে দেখলো।
মিরা রুমে ঢুকে বলে, তোর পরীক্ষা কেমন হলো?
ইরা ফোন চালাতে চালাতে জবাব দেয়, ভালো।
— নেক্সট এক্সাম কবে?
— এক্সাম শেষ। এখন শুধু ল্যাব ভাইভা বাকি।
— তার মানে আজকে আর পড়বি না রাতে?
— না। কড়া একটা ঘুম দিব।
মিরা বলে, কিছু খাবি?
— না।

— চল না ডিজে মামার ঝালমুড়ি খাই! আমার অনেক খেতে মন চাচ্ছে। কত দিন হলো খাই না!
— কে যাবে আনতে?
— ড্রাইভারকে পাঠাব।
— এখন সন্ধ্যা। ঝালমুড়ি রাতে বসেনা। কালকে দিনে পাঠাও।
মিরা মুখ গোমড়া করে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। কালকে পাক্কা খাব৷
— তুমি খেয়ো। আমি বাইরের খাবার তেমন খাইনা। আনহাইজেনিক লাগে।
মিরা বলে উঠে, ইশ! স্ট্রিটফুড যে পুরান ঢাকা বাসিন্দা পছন্দ করেনা তাকে পুরান ঢাকা থেকে ধাক্কা মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া দরকার।
ইরা হালকা হাসলো।

মিরা তার রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই সে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো।
এরপর মোবাইলে হেডফোন সেট করে, তা কানে গুজে দিলো। রুমের জানালার পর্দা খুলে দিয়ে ইরা লাইট বন্ধ করে দেয়। এরপর একটা রেকর্ডিং অন করে চোখ বুজে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
রেকর্ডেড অডিও থেকে বাজতে লাগে, হ্যালো গাইস! আমি ইমান বলছি আপনাদের সবার প্রিয় সো “প্রিয়তমা” থেকে৷ সবাই কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন? আজকের ওয়েদার লক্ষ করেছেন? ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দে অন্য এক ভূবণ মনে হচ্ছে । ওয়েদারটা চমৎকার তাই না? আজকের এই মেঘলা দিনে নিশ্চয়ই কাজে মন বসছে না? মনটা নিশ্চয়ই চাচ্ছে প্রিয়তমাকে পাশে বসিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাই, হাতে হাত ধরে ভালোবাসা মাখা গল্প করি?

বর্ষার প্রথম দিন আজ। সবাইকে শুভ আষাঢ়! বৃষ্টি সবারই ভালো লাগে! কথিত আছে, বৃষ্টি নাকি ভালোবাসার সাক্ষী! বৃষ্টি জানে আপনি আপনার মন কাকে সপে দিয়েছেন!
এটুকু শুনেই ইরা অডিও অফ করে দেয়। ইমান ভাইয়ের কন্ঠ সে বেশিক্ষণ শুনতে পারেনা। হায়েস্ট রেকর্ড আছে, চার মিনিট শোনার। এর বেশি শুনতে পারেনা সে। কেমন যেন লাগে তার!মনে হয় তার কণ্ঠ আরেকটু শুনলেই শরীর নিস্তেজ হয়ে যাবে।বুক ধড়ফড় করে তার। আবার বেশিক্ষণ না শুনেও থাকতে পারেনা৷ ইমান ভাইয়ার কণ্ঠ শুনলেই তার কান্না পায়। কেন যেন খুব কান্না পায়! হিঁচকি তুলে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চায়।

সে দ্রুত ফোন অফ করে দিলো। ইরা সবসময়ই ইমানের রেডিও সোয়ের রেকর্ডিং গুলো অতি গোপনে লুকিয়ে সবার আড়ালে শুনে। তার কেন যেন মনে হয়, কেউ যদি তাকে এ অবস্থায় দেখে ফেলে, তাহলে তার মনের ভেতরের খবর অব্দি জানতে পারবে! ইরা ফোনের দিকে তাকালো। এতেই সে বেশ লজ্জা পেল। লজ্জা বা ভয়ে তার ঠোঁট কাঁপতে লাগে। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে অডিও রেকর্ডিং শোনার বাজে অভ্যাসটা আপু বিদেশে চলে যাওয়ার পর থেকে হয়েছে। তখন কেবল কলেজে উঠেছে সে।এই অসুখটা সে ছ’বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে। এই অসুখ কেন সারে না? আবার ইরা চায় ও না এই অসুখ সেরে যাক!
কখনো কখনো রোগে আক্রান্ত থাকাও শ্রেয়!

মিরা নিজের রুমে এসে বসল। এরপর আলমারি খুলে নিজের পুরনো জামা-কাপড় গুলো নেড়েচেড়ে দেখলো। কিছু প্রিয় জামা হাতে ধরে বসে থাকলো। নিজের ডায়েরি নিয়ে কয়েক পাতা আগেরবলিখা পড়লো। কিসব হিজিবিজি লিখত সে, ভাবতেই হাসি পাচ্ছে।

হুট করে সে ফোন বের করে ইমানের নাম্বারে কল লাগায়।রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ কল ধরছেনা। মিরা টানা চারবার কল দিলো। তবুও তার কল রিসিভ হলোনা। এবারে সে বড় আব্বুর রুমে গিয়ে তার মোবাইল এনে সেই ফোন থেকে ইমানকে কল দেয়।

শেহজাদী পর্ব ১৫

এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইমান দুইবার রিং হতেই রিসিভ করে বলে, আসসালামু আলাইকুম। মামা। কিছু বলবেন?
ইমানের কণ্ঠ শুনেই মিরার কেমন যেন লেগে উঠে। মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। মিরার বুকের বাঁ-পাশে খুব জোরে আঘাত লাগলো ।
সে বলে উঠে, আমি মিরা। আমার ফোন কেন ধরেন নি?
— ওহ। আমি ব্যস্ত আছি।

মিরা আর কিছু বলবে তার আগেই কল কেটে গেল। মিরা পুনরায় ডায়াল করলে ফোন অফ
দেখালো। মিরার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। মন চাচ্ছে ফোন দুইটা ভেঙে গুরগুর করে দিক! মানে নিজেকে কি ভাবে সে? তার ফোন কেন ধরবে না? অন্য সবার ফোন ধরা জায়েজ আছে শুধু তার ফোন ধরলেই অপরাধ হয়ে যায়? মিরার এতো রাগ লাগছে যে সে নিজেই নিজের চুল ধরে টানলো।
এরপর এক গ্লাস পানি খেয়ে পড়ার টেবিলে বসে ডায়েরীতে আঁকা-আঁকি করে রাগ কমাতে লাগে। মনের অজান্তে লিখছে, সে নিজেও জানে না কি লিখছে।গটাগট লিখে যাচ্ছে অবিরাম । অথচ মমস্তিষ্ক জানেও না সে কি লিখছে!

যখন হুশ এলা এবং ডায়েরীর লেখা পড়লো। সে চমকে উঠে।
সারা পৃষ্ঠা জুড়ে ইমানের নাম লেখা! ছোট, বড়, মাঝারি সব ধরনের সাইজে ইমান নামটা লেখা ।

শেহজাদী পর্ব ১৭