শেহজাদী পর্ব ৩৩ || Arishan Nur || রোমান্টিক গল্প

শেহজাদী পর্ব ৩৩
Arishan Nur

মিরা আয়নার সামনে বসে সময় নিয়ে সাজছে। চুলগুলো ফ্রেঞ্জবেনী করে ডান কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। পরনে কালো কুর্তি। কুর্তিটা সুতির । বুকে ও হাতে লাল সুতোর কাজ করা কাজেই ম্যাচিং করে লাল ওড়নাও নিয়েছে সে। এই ড্রেসটা তারই ডিজাইন করা এবং গত রোজার ঈদে এই ড্রেসটা দারুণ সেল হয়েছিল। সে লাল রঙের লিপস্টিক লাগালো ঠোঁটে। এরপর কানে ঝুমকা পড়ল। হাতে চুরি পড়ার ইচ্ছা থাকলেও অবশেষে চুরি পড়লো না। চুরি পড়লে সাজটা বেশি চোখে লাগবে। এমনিতেই কানের ঝুমকোটা বেশ বড়সড়।

মিরার ফ্যাশন সেন্স বলে, যেদিন কানের দুল বড় হবে সেদিন গলায় কিছু না পড়াই বেটার। দুটো একসঙ্গে পড়লে মানায় না। তবুও সে গলায় একটা সোনার চিকন চেইন পড়ে নিল। সাজ-গোজ শেষ করে সে রুমের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সে দেরি করলে নিশ্চয়ই ইমান খোঁটা দেওয়া ছেড়ে দিবে না। খোঁটা খাওয়ার ইচ্ছা তার নেই। আপাতত ডিযে মামার ঝালমুড়ি খেতে চায় সে। কতোদিন হলো সে স্ট্রিটফুড খায় না! তার তো ফুচকার প্রতিচ্ছবি চোখে ভাসতেই জিভে জল চলে আসছে৷
সে ফোন হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। ড্রয়িংরুমে কেবল ইমান বসেছিল। আর কেউ নেই রুমে।
মিরা বিড়বিড়িয়ে বলে, বাঘের সামনে এসে পড়লাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইমান ফোন চালাচ্ছিল। মিরাকে আসতে দেখেছে সে। কিন্তু মাথা তুলে তাকায়নি। এবারে কথা বলার আওয়াজ শুনে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলে, কিছু বললে?
মিরা হচকচিয়ে উঠে বলে, না! না! আমি কোনদিন কিছু বলি কাউকে? আমি মোটেও বলিনি যে আপনি বাঘ! আপনাকে ভয়,,,,,,,
সে যেমন বেগে কথা বলা শুরু করেছিল ঠিক সেই বেগে কথা বলা থামিয়ে দিয়ে হালকা হেসে বলে, বাকি রা কই?
— বাঘ কে?
— বাঘ আবার কে? তবে বাঘ মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।সুন্দরবনে বাস করে৷ বাঘ হাম্বা-হাম্বা করে ডাকে।
— বাঘ হাম্বা হাম্বা করেনা!

মিরা ঠোঁট চেপে ধরে বলে, তাহলে কে হাম্বা হাম্বা করে?
— তুমি করো আর সঙ্গে গরুরাও করে।
মিরা ইমানের কথা শুনে ভেংচি কেটে বলে, আমি কোনদিন সরাসরি বাঘ দেখিনি তাই বাঘ কিভাবে ডাকে তা শুনিনি। জানিও না৷
ইমান হোহো করে হেসে বলে, থাক বাঘের ডাক শোনার লাগবে না। দেখা যাবে, বাঘের ডাক শুনতে গিয়ে তুমি বাঘের পেটে গিয়ে বসে আছো!
— কেন? আমি কি বাঘের বাচ্চা কিনা?

ইমান অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, এতো সাজ দিসো কেন? কার জন্য সেজেছো? আমার জন্য? আমার জন্য সেজে লাভ নেই। আমি তোমাকে পাত্তাও দিব না। গেট দ্যাট?
মিরা চুল ঠিক করে বলে, মেয়েরা নিজেদের জন্য সাজে। আমরা সাজতে ভালোবাসি। কারো জন্য সাজি না। তোমরা ছেলেরা নিজেদের এতো গুরুত্ব দাও কেন?
ইমান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা মাথায় তুলে রাখো তাই!

সেই সময় ইমানের ফোন বেজে উঠল। সে মিরার সামনেই ফোন বের করলো। স্ক্রিনের লেখা দেখার জন্য মিরা সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়লো। স্ক্রিনে বড় বড় করে লেখা, প্রিয়া৷ তার এহেন কান্ডে ইমান চোখ বড় করে তাকে ইশারায় ধমকায়। কিন্তু লাভ বেশি হলোনা৷ মিরা নাম দেখেই ক্ষ্যান্ত হলো শেষ অব্দি৷
প্রিয়া নাম দেখেই মিরার রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সে ভ্রু যুগল কুচকে তাকিয়ে রইল। তা বুঝতে পেরে ইমান উঠে বারান্দায় গেল। এরপর পাঁচ মিনিটের মতো সময় নিয়ে হেসে হেসে কথা বলতে লাগে।
বারান্দায় কাঁচের থাই লাগানো। মিরা কান পেতে শোনার চেষ্টা করেও কিছুই শুনতে পেল না। সে ভেতরে ভেতরে অস্থির হতে লাগে। এটাই নিশ্চয়ই ইমানের শেহজাদী। নাহলে এতো হাহা-হিহি কেন করবে! হুহ!

ইমান বেরিয়ে আসতেই মিরা দাঁত বের করে হেসে বলে, আপনি নিশ্চয়ই কোন জোকারের সঙ্গে গল্প করে আসলেন তাই না?
সে ভ্রু কুচকে বলে, সর‍্যি?
— না মানে হাহা করে তো হাসলেন খুব! নিশ্চয়ই জোকার জোক মারছিল রাইট?
ইমান একদন্ড থেমে বাকা হেসে বলে, উই আর হ্যাভিং ফান! সুইট টাইম স্পেন্ড উইথ মাই সুইটি!
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র মিরার মন চাচ্ছিল ইমানের সব চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে তাকে টাকলু বানিয়ে দিতে! তারপর নিশ্চয়ই এই টাকলুকে তার সুইটি-চুইটি-ঘুইটি বিয়ে করবে না! কিন্তু মানবিকতার খাতিরে মিরা তার চুল ধরে টানলো না!

কিছুক্ষণের মাঝে ইরা আসল। সে এসে মিরা আর ইমানকে একসঙ্গে কথা বলতে দেখে সন্দেহ ভরা চোখে তাকালো।
মিরা তাকে দেখে হালকা হেসে বলে, ব্যাপার কি? তুই শাড়ি পড়লি কেন?
ইরা অল্প কথায় জবাব দিলো, ইচ্ছা হলো!
— ইচ্ছা হলে তা পূরণ করা দরকার!
কথাটা ইমান বললো। ইরা সরাসরি তার দিকে তাকালো। তাদের চোখাচোখি হতেই ইমান সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলে, আমার ভাইকে দেখেছো? কই গেল ছেলেটা?
ইরা জানে সাদ নিচে গ্যারেজে আছে। তাকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে সে। কিন্তু এই মূহুর্তে বলতে ইচ্ছে করছে না। তারপর ও সে শুকনো গলায় বলে, আপনার ভাই গ্যারেজে আছে। চলুন বের হই।

— চল।
মিরা-ইরা এবং ইমান নিচে নামলো। আসলেই সাদ নিচে দাঁড়িয়ে জুতা পলিশ করছিল। তাদের আসতে দেখে সাদ বিরক্তিভাব নিয়ে বলে, মেয়ে মানুষ রেডি হতে এত্তো সময় কেন নেয়? বুঝি না! ভাইয়া তুমি বুঝো কিছু?
ইমান মিরাকে খোঁচা মেরে বলে, তাহাদিগেরা সাজিতে বড্ড ভালোবাসে। তাহারা নিজেদের আত্মতুষ্টির জন্য সাজে বৈকি।
মিরা বলে, ওলরেডি অনেক টাইম ওয়েস্ট করেছি। এবার গাড়ি তে উঠি?
ইমান বলে, ড্রাইভিং কি আমি করব?
সাদ বলে, করো!

সাদ আগেভাগেই পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। ইমান যে তাকে বলবে ড্রাইভিং সিটে এসে বসতে সেই সময়টাও পেলনা। একজন ব্যক্তি কোথাও বসে যাওয়ার পর তাকে উঠিয়ে অন্যখানে বসানো খুব রুড লাগে তার কাছে।
সে মধুর সুরে বলে, ইরামনি তুমি আমার সঙ্গে বসো।
মিরা ড্রাইভিং সিটের হ্যান্ডেল ধরতে যাচ্ছিল। ইমানের কথা শোনামাত্র সে থেমে গেল। এরপর চুপচাপ পেছনে গিয়ে সাদের পাশে বসে। সাদ তাকে দেখে স্বাভাবিক থাকলেও সে মনে মনে চাচ্ছে, ইরা যেন তার পাশে বসে। তা আর হলো কই?

ইরা ইমানের প্রস্তাবে দারুণ প্রফুল্ল হলো। মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার। তার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। সে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে৷
ইমান ড্রাইভিং সিটে বসে ফোনে গুগল ম্যাপ সেট করলো। তারা এখান থেকে সোজা বিউট বোডিং যাবে।তারপর অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। বেশিক্ষণ লাগবে না যেতে।ঘন্টা খানেক লাগবে। জ্যাম না থাকলেই হয়। তারা ওখানে থাকবেও আধঘন্টার মতো!

সাদ বলে, ভাইয়া গান ছাড়ো! গান ছাড়া জার্নি আর কোক ছাড়া বার্গার একই কথা!
ইমান মিউজিক অন করে দিলো। এরপর আপনমনে গাড়ি চালাতে লাগলো। সে তো জানে না! যাকে সে ছোটবোনের মতো শ্রদ্ধা করে আদর করে ইরামনি ডাকছে, তার মনে নিজের জন্য অন্যরকম বাসনা আছে!
ইরা আড়চোখে ইমানকে পরখ করতে লাগলো। তার মনটা ক্ষণে ক্ষণে উদাসীনতার চাদরে মুছড়ে যাচ্ছে। এই ছেলেটাকে দেখলে তার বুক ভারী হয়।

ইরা ইমানকে চোরা চোখে দেখলে কি হবে? ইমানের নজর তো মিনিটে দুইবার লুকিং গ্লাসে প্রতিফলিত হওয়া রমনীর চোখের দিকে! তার কাজল মাখা চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো দুঃসাহসিক নয় ইমান।
অপর দিকে, সাদ নামের একজন চঞ্চল, হাসিখুশি ছেলে তার ভালোবাসাকে অনুভব করতে চাচ্ছে! তার পাশে বসতে পারেনি জন্য আফসোস করছে।

সাধেই কি গুনী ব্যক্তি বলে গেছে, আমরা সবসময়ই ভুল মানুষকে ভালোবেসে থাকি! আচ্ছা ভুল মানুষকে যদি ভালোবাসতেই হয়– এটাই যদি নিয়ম হয়, তবে পৃথিবী থেকে ভালোবাসা উঠে যাক। প্রেমহীন এই দুনিয়া কেমন হবে? নিশ্চয়ই প্রেমহীনতায় গোলাপের রঙ ও ফিকে পড়ে যাবে?
আসলে ভালোবাসা আছে জন্যই জীবনটা এতো সুন্দর লাগে! ভুল মানুষকে ভালোবাসলেও জীবনটা সার্থক!

প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর তারা বিউটি বোডিং এসে পৌঁছে। ইরার মধ্যে তেমন কোন আগ্রহ নেই। সে বহুবার এই জায়গায় এসেছে৷ এক জায়গায় বারবার গেলে কি আর আগ্রহ রয়? প্রথমবারে যতো আগ্রহ থাকে সেটা দ্বিতীয়বারের সময় কমে যায়।
তবে সাদের প্রচুর আগ্রহ। সে তার ডিএসএলআর ক্যামেরায় রাস্তার ভিডিও থেকে এখানে এসেই ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে৷

মিরাও কম এক্সাইটেড নয়! পাক্কা ছ’বছর পর প্রিয় জায়গায় এসেছে সে। পুরান ঢাকার সবকিছুই তার প্রিয়। সিডনিতে গিয়ে ফরেনারদের কাছে কতো যে পুরান ঢাকার গল্প করেছে সে!
সাদ আর মিরা নেমে পড়লেও, ইরা নামতে পারেনি। গাড়ি যেখানে থামানো হয়েছে, সেই জায়গা ঘেঁষেই আরেকটা গাড়ি। এইজন্য একেবারে ঠিকঠাক করে পার্ক করার জন্য ইমান গাড়ি ঘুরালো। কিছু দূরে যেতে হবে পার্ক করার জন্য। একজনের বাড়ির গ্যারেজে পার্ক করা হবে গাড়ি। ড্রাইভার নেই যেখানে-সেখানে পার্কিং এ রাখাও যাবে না৷

ইরা যেহুতু নামতে পারেনি কাজেই আপাতত গাড়িতে তারা দুইজনেই একলা। দুইজনে অবশ্য একলা হয়না, দোকলা হওয়া উচিত!
ইরা বলে উঠে, ইমান আপনি আর রেডিওতে কাজ করেন না কেন?
ইমান ভ্রু কুচকে বলে, ইমান কি? ভাইয়া কে বলবে?
— সর‍্যি৷
— ইটস ওকে ইরামনি।
— আমার নামের সঙ্গে মনি যুক্ত করবেন না৷
— সেকি কিন্তু কেন?
— আমি এখন আর ছোট নেই৷
— আমার কাছে তুমি সবসময়ই ছোট থাকবে।

ইরা আর কিছু বললো না। হতাশা ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু । উনি কি এই জনমে তাকে কখনোই অন্য নজরে দেখবে না? কখনোই কি তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখবে না? চোখে চোখ রাখলে কি এমন ক্ষতি হবে?
গাড়ি পার্ক করে বাকি পথ হেঁটে মিরাদের কাছে আসতেই সাদের গোমড়া মুখ দেখে ইমান বলে, কিরে? মুখ কালো কেন তোর?

মিরা হাসতে হাসতে জবাব দেয়, বেচারার জায়গা পছন্দ হয়নি।
সাদ শুকনো গলায় বলে, আই এক্সপেক্ট মোর!
ইমান বলে এটা কিন্তু বহু পুরাতন! সম্ভবত ১৯৪৯ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে৷ এই বাড়ির মালিকের মেয়ের নামেই নাম রাখা হয়েছে বিউটি বোডিং। চল আগাই।
সাদ বলে, ময়লা-আর্বজনা পড়ে আছে। গাছের পাতায় ধুলো! এইসব দেখে ভালো লাগে?
— এটা আমাদের দেশের নাগরিকদের দোষ৷ দেশের কোন পর্যটন স্পট তারা সুন্দর ও পরিষ্কার রাখবেনা। এমন কি সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত দূষিত করছে৷

ইরা বলে উঠে, এখান থেকে ভালো নাও লাগতে পারে। সামনে চলো! জমিদার বাড়িটা দেখলে পছন্দ হবে তোমার।
সাদ এগিয়ে গেল। একটা লোহার গেট পেরিয়ে তারা ভেতরে ঢুকে যায়। গেটের ভেতরে ঢুকেই খালি জায়গা চোখে পড়লো। সেখানে বাগান করা। গাছগুলো অযত্নে বেড়ে উঠলেও বেশ শক্তপোক্ত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরাও প্রায় একশ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী! ফাঁকা জায়গায় অনেকে বাইক পার্ক করেছে। কিন্তু এদিকে বড় মামার পরিচিত একজনের বাসা থাকায় ইমান সেখানে গাড়ি পার্ক করে আসলো। পুরান ঢাকায় থাকার সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ হলো গাড়ি পার্ক করা নিয়ে ঝামেলা খুব! চারিদিক গিজগিজ মানুষ তার উপর রাস্তা খুবই সরু।দুইটা রিকশাই একসঙ্গে পাশ কাটানো দায়। সেখানে গাটি নিয়ে চলা খুব কঠিন।

বিউটি বোডিংয়ের বাগানে কয়েকটা জায়গায় ছাতার মতো ছাউনী দেওয়া। ছাউনীকে ঘিরে কয়েকটা কালো চেয়ার। চেয়ারে যুবক-যুবতীরা বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্থানীয় এরা। আবার আরেকটা দল শাড়ি পড়ে এসেছে। ওদের সঙ্গে ও ক্যামেরা!
বেচারা সাদ ক্যামেরা বন্ধ করে রেখেছে। সাদের হতাশা ভরা মুখ দেখে ইরার হাসি পাচ্ছে। বাচ্চাদের মতো স্বভাব তো!

সামনে এগিয়ে গেল সাদ। প্রথমের দিকে মেইন ফটক দেখে সে আকর্ষিত নাহলে ও সামনে যেতেই চোখে পড়লো, দোতলা একটি বাড়ি, বাড়িটা জমিদারী বাড়ি। এবং হলুদ রঙের পুরাতন আমলের নকশা করা গাথঁনী দেখে সে কিছুটা আশা পেল। ক্যামেরা অন করে পিকচার ক্লিক করা শুরু করে৷
ইমান মিরাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। সাদ নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইরার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে। গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে, বিউটি বোডিংয়ের ইতিহাস খুব সুন্দর করে ব্যানার টাঙ্গিয়ে একটা দেয়ালের সঙ্গে এঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কিসব জিজ্ঞাসা করছে সাদ তাকে৷ ইরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই ফাঁকে মিরা দৌঁড় লাগিয়েছে উপরের তলায়। মিরাকে একা ছাড়বে না জন্য ইমান ও পিছু নেয়৷
দোতলায় উঠলেই চোখ পড়বে, সারি সারি কক্ষ । এবং সঙ্গে একটা কলিডোর। করিডোরটার রেলিংয়ে টব আছে। মেঝেতে টাইলস নেই। কক্ষগুলোর দরজা সবুজ রঙ করা এবং তালাবদ্ধ।কক্ষগুলোর দরজার রুম নাম্বার দেওয়া।

মিরা আপাতত চার নাম্বার কক্ষের মুখোমুখি হয়ে কলিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটাকে কলিডোর ও বলা যায় না। সম্ভবত গ্রিলবিহীন বারান্দা এই জায়গাটার উপযুক্ত নাম হবে।
উম্মুক্ত বারান্দায় লেলুয়া বাতাস এসে মিরার চুল উড়িয়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে । অবাধ্য চুলগুলোকে মিরা সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। লাল ওড়নাটার একপাশ মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
ইমান তার দিকে চেয়ে আছে। মিরার সাজটা এই প্রাচীন বাড়িটার সঙ্গে মিলে গেছে। তাকে এই বাড়ির জমিদারের কন্যা মনে হচ্ছে! ইমান তার দিকে এগিয়ে গেল। দুজনে পাশাপাশি দাড়ালো। মিরা তার হাত দুটো গুটিয়ে রেখেছে। ইমানের খুব মন চাচ্ছিল, তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় আলতো করে চেপে আদর করতে।

মিরা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমি কিন্তু ভুলিনি?
সে হতভম্ব হয়ে বলে, কি ভুলোনি?
— কালকে আপনি ইচ্ছা করে আমার ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলেন তাই না? আমার সব মনে আছে৷ কেমন লুচু আপনি! বড় বোন, ছোট ভাইয়ের সামনে,,,ছিঃ ছিঃ বেশরম কোথাকার!
ইমান বাঁকা হাসলো এরপর বারান্দার দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে বলে, ত্রিকোনমিতির সূত্র তো মনে রাখবে পারোনা! এসব কিভাবে মনে থাকে? জলদি ট্যান থিটার সূত্র বলো।
মিরা মুখ ফুলিয়ে বলে, আপনি এখন আর আমার টিচার নন। আর এইসব ট্যান-ফ্যান দিয়ে আমার কোন কাজ নেই।

— ত্রিকোণমিতির প্রয়োজন সারাজীবন!
— ধূর। আপনি ইচ্ছা করে টপিক ঘুরাচ্ছেন।
— ও হ্যাঁ! শোন মিরা তোমাকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছা আমার একদমই নেই। কারন যে মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ করে, তাকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছা আমার একদমই নেই।
মিরা যে প্রচন্ডভাবে রেগে যাচ্ছে তা সে দিব্যি টের পাচ্ছে। রেগে গেলে মিরার নাকের ডগা খানিকটা লাল হয়। ইমান আশেপাশে তাকালো। এদিকে ভীড় নেই কোন। এছাড়া এখন দুপুর হওয়ায় ফাঁকাই আছে। সে টুপ করে মিরার নাকে একটা চুমু বসিয়ে দিল। মিরা হা হয়ে গেল। থমকে গেল সে। কিছু বলার মতো না শক্তি আছে, না সাহস! শুধু কেঁপে উঠে সে।

তবে ইমানের ঠোঁটের উষ্ণ পরশে তার রক্ত শীতল হয়ে গেল। রন্ধ্রে রন্ধ্রে উষ্ণতার পরশ ছেয়ে গেল। সে আবেশে চোখ বুজলো। রাগ, লজ্জা সবকিছুর মিশ্র অনুভূতিতে মিরা মিইয়ে গেল। বুকে ভীষণ জোরে হাতুড়ি পেটাতে লাগে কেউ। তিরতির করে ঘামা শুরু করলো সে। লাল নাকটা আরো লাল হয়ে উঠে৷
ইমান তাকে পাশ কাটিয়ে বারান্দার শেষ মাথায় চলে যায়। বারান্দার শেষমাথায় গিয়ে চারটার মতো সিঁড়ি আছে কিন্তু চার সিড়ির পর লোহার বেঁড়া দেওয়া। যার ফলে সিঁড়িতে উঠে বসলেও কেউ এর উপরে আর যেতে পারবে না। এবং তার পাশে আরেকটা কক্ষ। বলতে গেলে পর্যটকরা এখানে এসেই বেশিরভাগ ফটোশুট করে।

ইমান সিঁড়িতে গিয়ে বসতেই মিরা রেগেমেগে ফায়ার হয়ে তার কাছ আসলো। ইমান জমিদারী ভঙ্গিতে পা উঠিয়ে বলে, নাকটা লাল হয়ে আছে কেন? কিছু কামড়েছে?
মিরা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আপনি বেয়াদব!
— উহু আমি এই রাজ্যের রাজা আর তুমি সামান্য এক প্রজা। প্রজা মশাই যাও আমার জন্য চা আনো। রাজার চা খেতে ইচ্ছা করছে৷

মিরা সোজা তার সামনে এসে দাঁড়ালো এবং বললো, আপনি না মাত্র বললেন যারা বারান্দায় চুমু করে তাদের আপনি ব্রাশ করেন না!
ইমান তার কথা শুনে হেসে দিলো। মেয়েটা এতো পাগল কেন?
মিরা তাকে হাসতে দেখে আরো রেগে গেল। এবং ভয়াবহ এক কান্ড ঘটালো তাহলো, ইমানের ডান হাতে ভীষণ জোরে চিমটি কাটলো।
ইমান হতবুদ্ধি হয়ে বলে, চিমটি কেন কাটলে?
— বেয়াদপদের চিমটি কাটতে হয়৷

বিউটি বোডিংয়ের কক্ষগুলোতে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষেরা থেকে গেছেন। এখানে আগে আড্ডার আসর বসত এবং যারা আড্ডা দিত বা দেয় তাদের বিউটিয়ান বলে সম্বোধন করা হয় নাকি। কথাগুলো ইরা বললো।সাদ মনোযোগ দিয়ে শুনল। তারা উপরে উঠে আসছে।
ইরা আগে, সাদ পরে। সাদ তার অগ্রচরেই বেশ কিছু ছবি তুলে নিল। মেয়েটার প্রতিটা ছবিই জাস্ট ওয়াও। এতো সুন্দর কেন এই মেয়ে! ইরাকে দেখলেই তাকে জড়িয়ে ধরে ওর ওম পেতে মন চায় সাদের। এই নিষিদ্ধ চাওয়াটা যে পাপ!

চারজন একসঙ্গে হয়ে জোরো হলো। খাওয়া-দাওয়ার প্লানিং চলছে। প্রথমেই মিরা বলে উঠে, আগে লাচ্ছি খেয়ে নিই৷
সবাই মিরার প্রস্তাবে রাজী হলো। বিউটি বোডিংয়ে ভাত-ইলিশ মাছ ভাজী পাওয়া যায় যা কিনা বিখ্যাত। কিন্তু সাদ ইলিশ পছন্দ করেনা। এইজন্য এখানে তারা কিছুই খাবে না।শুধু ঢাকার বিখ্যাত লাচ্ছি খেয়ে চলে যাবে৷
বিউটির লাচ্ছির দোকানে এসে থামতেই দোকানদার তাদেরকে হাসি দিয়ে বলে, মামারা কি ঘুরতে আসছেন?
ইমান মৃদ্যু হেসে বলে, জি।

— কয় গ্লাস দিব?
— আপাতত চার গ্লাস দেন৷ লাগলে আবার দিব।
— বরফ বেশী দিব?
ইমান না বললেও মিরা বলে, এক্সট্রা বরফ দিবেন মামা৷
দোকানদার হেসে বলে, আচ্ছা মাম৷
বিউটির লাচ্ছি বানানোর কায়দাই আলাদা৷ ওরা দুটো পাত্রের মাধ্যমে লাচ্ছি বানায় এবং লম্বা একটা জিনিস দিয়ে দই ভাঙ্গে। ব্লান্ডার ব্যবহার করেনা। সাদ ভিডিও করলো। সএ আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করে, এখানকার স্থানীয়রা খুব আন্তরিক!

শেহজাদী পর্ব ৩২

লাচ্ছির দাম মাত্র চল্লিশ টাকা কিন্তু স্বাদ একশতে একশ। তারা আয়েশ করে লাচ্ছি খেল। যে পর্যটক বিউটি বোডিং এ আসবে অথচ লাচ্ছি খাবে না সে হচ্ছে গিয়ে একজন দুর্ভাগা!
মিরা আর সাদ পরপর দুই গ্লাস খেল। সম্পূর্ণ দই দিয়ে ঘণ করে বানানো লাচ্ছি। হালকা লেবুর ফ্লেবার আছে। মিস্টি একদম পারফেক্ট
খাওয়া শেষ করতেই ইমান তাকে ডাক দিয়ে বলে, মিরা এইদিকে শুনো।
মিরা গ্লাস রেখে তার কাছে গেল। ইমান খাওয়া শেষ করে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে৷ মিরা তার কাছে যেতেই সে মিরাকে নিয়ে আড়াল হয়ে গেল৷ মিরা ঘাবড়ে যায়। আস্তে আস্তে ইমান তার মুখটা মিরার মুখের সামনে আনতে লাগে।

সে লজ্জায় কুকরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে হাত দুটো দিয়ে কামিজ খামচে বলে, এটা পাবলিক প্লেস ইমান।
— পাবলিক প্লেস জন্যই করছি৷
মিরা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। ছেলেটার কি মান-সম্মান বলে কিছু নেই? পাবলিক প্লেসে কিস করবে? অসম্ভব! মিরা এ হতে দিবে না।

শেহজাদী পর্ব ৩৪