ভুলতে পারিনি তাকে গল্প || Mahfuza Akter || SA Alhaj

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১
Mahfuza Akter

—“তোমার এই এসিডে ঝলসানো, বীভৎস চেহারাটা নিয়ে সবার সামনে আসতে লজ্জা করে না? কীভাবে আসো এই বিকৃত চেহারাটা নিয়ে ভার্সিটিতে?”
শ্রুতি তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটিতে প্রবেশ করার সময় হুট করে একটা মেয়ে তার সামনে এসে এসব কথা বলতে শুরু করে। শ্রুতি শকড হয়ে গেল একথা শোনার সাথে সাথে। তাহলে কি সবাই জেনে গেল যে, সে একজন এসিড ভিক্টিম?

আশেপাশে সবাই মেয়েটার দিকে অবাক চোখে তাকালো। পাশ থেকে একজন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল,
—“কিন্তু আনহা, তুমি কীভাবে জানলে যে, এ মেয়েটার চেহারা ঝলসানো?”
আনহা নামের মেয়েটা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

—“দুদিন আগে ওয়াশরুমে দেখেছিলাম। তোমাদের বিশ্বাস না হলে তোমরা ওর মুখ খুলে দেখো!”

শ্রুতি আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারে যে, সবাই কৌতুহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার হয়তো ইচ্ছে হচ্ছে শ্রুতির চেহারাটা একবার দেখার। কিন্তু এই মুখ যদি সবাই একবার দেখে, তাহলে কেউ আর তার ধারেকাছেও ঘেঁষবে না। এমনিতেও শ্রুতি কারো সাথে মিশে না। তবে সবাই যদি জেনে যায়, তাহলে সবসময় দূর দূর করবে তাকে। শুধু মাত্র এসিড ভিক্টিম বলে আজ সে এতোটা অবহেলিত! শ্রুতির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে তো কাউকে নিজের মুখ দেখায় না আর না কারো সাথে কথা বলে! তাও আজকে তাকে এসব কথা শুনতে হচ্ছে।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

শ্রুতি ভয়ে আশেপাশে একবার তাকিয়ে ছুটে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেল। অনেকে আটকাতে চেয়েও পারেনি। শ্রুতি যে হুট করে এভাবে দৌড়ে চলে যাবে, সেটা কারো চিন্তা জগতের মধ্যে ছিল না। আনহা রাগে গজগজ করতে করতে তার বন্ধুদের বললো,

—“আটকাতে পারলি না মেয়েটাকে? দুদিন ধরে খুঁজে আজকে বের করতে পারলাম। আবার পালিয়ে গেল! এখন কীভাবে খুঁজে পাবো ওতো বড় ডিপার্টমেন্ট থেকে? ”
স্নেহা আনহার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
—“আরে, বাদ দে তো! মেয়েটার ফেস ঝলসানো তো কী হয়েছে? ওদের মতো অসহায় মানুষদের কি পড়াশোনা করার অধিকার নেই? ”
আনহা ভেংচি কেটে বললো,

—“যদি তুই দেখতি, তাহলে এসব বলতি না! কতোটা ভয়ংকর লাগে, এমন চেহারা দেখতে!! ভাবলেই আমার গাঁ শিউরে ওঠে। মুখের ডান সাইড পুরোটা কালচে হয়ে গেছে। আমি তো দেখেই চিৎকার দিয়েছিলাম, তাই আজ একটু সিনক্রিয়েট করে তোদের সবাইকে দেখাতে চাইলাম। তা আর হলো কই? ধুররর!!!”

আনহা বিরক্ত হয়ে চলে গেল। এদিকে স্নেহা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, “এই আনহা এতো নটাংকি কেন? হতে পারে মেয়েটা এসিড ভিক্টিম, তাই নিয়ে এতো ঘাটাঘাটির কী আছে? এমনটা তো আমাদের নিজেদের কারো সাথেও হতে পারতো! তখন কি এমন করতে পারতাম? ”

এদিকে কেউ একজন আড়াল হয়ে স্নেহার গতিবিধি দূর থেকে লক্ষ করছে, যা সবার অজানা। স্নেহার ভাবনা বুঝতে পেরে তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।

ক্লাসে ঢুকে শ্রুতি রোজকার মতো আজও সবার লাস্টের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। একটু আগের ঘটনা মনে পড়তেই চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে। আজ আরেকটু হলেই সবাই তার নষ্ট হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ফেলতো। দেখে হয়তো অনেকে ভয় পেত, অনেকে চিৎকার দিত, আবার অনেকে আফসোস করতো! ভার্সিটির প্রতিটা কোণে তাকে নিয়ে আলোচনা হতো। অনেকে ব্যাঙ্গ করে এটা-সেটা বলতো। আজ অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে, কিন্তু কতোদিন এভাবে পালিয়ে যাবে?
প্রতিদিন শেষের দিকেই একা একা বসে শ্রুতি। এ ক্লাসের কারো সাথেই শ্রুতি তেমন একটা মিশে না, যদিও এখন সে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে সে। খুব দরকার পড়লে একটু-আধটু কথা বলে শুধু প্রয়োজনের তাগিদে। শুধু মাত্র নিজের এই বিকৃত চেহারাটা দেখানোর ভয়ে সে কারো সাথে বন্ধুত্ব করে না।

হঠাৎ ক্লাসে টিচার প্রবেশ করায় সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শ্রুতিও নিজের চোখ মুছে নেকাব ঠিক করে নিলো। সবার সাথে তাল মিলিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল শ্রুতি। সে কি ঠিক দেখছে নাকি এটা তার কল্পনা? এতো বছর পর আবার সেই একই ব্যক্তির সম্মুখীন হতে হলো তাকে? নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেন? সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না শ্রুতির। কিন্তু কি আর করার? ক্লাসের মাঝখানে তো আর বের হয়ে যাওয়া ঠিক হবে না! আর গলা শুনে যদি আবার চিনে ফেলে!! তাই এখানে চুপচাপ বসে ক্লাস করাটাই বেটার বলে মনে হলো শ্রুতির।

ক্লাসে টিচার ঢোকার পর থেকে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ, এই স্যারটা নতুন, কেউ কখনো দেখেনি। তারওপর, ছেলে-মেয়ে একসাথে ওনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। স্যারের কথা শুনে সবাই ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো।

—“হ্যালো, এভ্রিওয়ান। আমাকে কেউই চিনতে পারেননি হয়তো! অনেকেই ভাবছেন, আমি নতুন টিচার। আমি এক বছর ধরে এই ভার্সিটিতে আছি। আমার নাম আরহাম খান আভাস। আমি আগে উইকেন্ডে ক্লাস নিতাম, এখন ফুল-টাইমেও নেব।”

আভাস সবার কাছে যার যার পরিচয় জানতে চাইছে। এদিকে শ্রুতি ভয়ে ভেতরে ভেতরে গোমরাচ্ছে। আজ যদি আভাসের কাছে ধরা পড়ে যায়! আভাস তো শ্রুতির উপস্থিতি পর্যন্ত অনুভব করতে পারে! গলা শুনলে আর রক্ষা পাবে কীভাবে?
দেখতে দেখতে শ্রুতির কাছে চলে এলো আভাস। শ্রুতি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর বুকের ভেতরে মনে হয় কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে! সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। আভাস শ্রুতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। কিন্তু ওকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। একে তো বোরকা পরেছে, তারওপর মুখটা নিকাব দিয়ে এমনভাবে ঢেকেছে যে, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ চোখ দুটোই যথেষ্ট আভাসের জন্য!

—“এই চাহনি তো অবিকল শ্রুতির মতো! এই চোখের মায়ায় আমি বারবার হারিয়ে যেতাম। আমার ভেতরেও সেই পাঁচ বছর আগের পুরোনো অনুভূতি খুঁজে পাচ্ছি আমি। শ্রুতির কাছাকাছি থাকলেই এমন অদ্ভুত অনুভূতি হতো আমার। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? শ্রুতি কীভাবে এখানে আসবে? ”
ভাবতে ভাবতে শ্রুতিকে অগত্যা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আভাস,

—“তুমি,,,,,,, তুমি শ্রুতি, তাই না? ”

আভাসের এমন প্রশ্ন শুনে শ্রুতি অবাক হয়ে যায়। ও তো ভেবেছিলো, হয়তো সন্দেহ করবে! কিন্তু এভাবে ডিরেক্ট নাম জিজ্ঞেস করে ফেলবে, সেটা ভাবতেও পারেনি।
শ্রুতির চোখের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

—“এই যে, এটাই সেই চোখ! সেই একই দৃষ্টি, একই চাহনি! আমি এতোটাও ভুল হতে পারিনা। বলো, তুমিই শ্রুতি, তাই না? ”
শ্রুতি নিজের গলার স্বর হালকা মোটা করে বললো,

—“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, স্যার! আমার নাম অদ্রিতা রুবাইয়াত। ”

আভাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

—“কী?? তুমি সত্যিই শ্রুতি নও?”

—“নো স্যার। ”

আভাস মনে মনে ভাবলো,

—“সত্যিই তো! শ্রুতি কীভাবে হবে ও? আর ওর গলাটাও তো আলাদা লাগছে! কিন্তু আমি কী করে ভুল হই? আমার ওকে চিনতে ভুল হলো?”

—“আচ্ছা, সিট ডাউন। হয়তো আমারই ভুল!”

বলেই সামনে চলে গেল আভাস। আভাস ক্লাস নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবদিক থেকেই তাকে শ্রুতির ভাবনা ঘিরে রেখেছে! সেই অতীতের স্মৃতি গুলো আজ তার ভেতরটায় বড্ড নাড়া দিচ্ছে। কোনো রকমে ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলো আভাস। ভেতরটা অনেক বেশি জ্বলছে আজ, হয়তো সেই পুরোনো ঘা আবার তরতাজা হয়ে উঠছে। কিন্তু আভাসের ভেতরের হাহাকার আর আর্তনাদ গুলো কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কষ্ট জিনিসটা সত্যিই খুব অদ্ভুত।
শ্রুতি আর কোনো ক্লাস না করে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে দেখলো, ওর মা উঠানে বসে বসে পাটি বুনছে। শ্রুতি কাঁদতে কাঁদতে ওর মায়ের কোলে গিয়ে মাথা রাখলো। শায়লা রুবাইয়াত (শ্রুতির মা) শ্রুতিকে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বললো,

—“কাদছিস কেন, মা? কেউ কি তোর মুখ দেখেছে? কেউ কিছু বলেছে? বল আমায়! না বলে এভাবে কাঁদলে আমি বুঝবো কীভাবে? ”

শ্রুতি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,

—“মা, উনি এখানে চলে এসেছেন। উনি এসে গেছেন, মা।”

—“কে এসেছে?”

—“আভাস! আরহাম খান আভাস। ”

-চলবে তো?

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২