ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২
Mahfuza Akter

রাতের অন্ধকারে চারদিকে বেশ থমথমে পরিবেশ, কিছুক্ষণ পর পর ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এতোক্ষণে হয়তো অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছে! কিন্তু শ্রুতির চোখে ঘুম নেই। রাতের বেলা জেগে বসে থেকে নিজের একাকিত্ব অনুভব করা আর অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলাটা তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
কিছু একটা ভেবে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো শ্রুতি। নিজের বিকৃত চেহারাটাকে বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সে। ফর্সা মুখের বাঁ পাশে চোখের কোণা থেকে শুরু করে থুতনি পর্যন্ত পুরো গালটা এমনভাবে ঝলসে গেছে যে, তাকে দেখতে প্রচন্ড বীভৎস লাগছে। চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো শ্রুতির। কিন্তু এ কান্নার পেছনে নিজের মুখশ্রী হারানোর পাশাপাশি আরো কিছু হারানোর বেদনা রয়েছে। তা যে কাউকে বলাও যায় না, সওয়াও যায় না।

—আমাকে যদি এতোটাই অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলতে হতো, আমার জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে ফেলাটাই যদি ভাগ্যে ছিল, তাহলে আমায় এ পৃথিবীতে কেন পাঠালে? আমার কপালে কি একটুও সুখ লেখা নেই, আল্লাহ? সব হারিয়ে চলে এলাম, তবুও সেই ভয়ানক অতীত আমার পিছু ছাড়ছে না। জীবনটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, এখানে প্রতিটা মুহূর্ত-ই যন্ত্রণার!
শ্রুতি মাটিতে বসে বসে কাঁদছে এমনসময় মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেল। মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল এক বয়স্ক বৃদ্ধা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নীল পাড়ের সাদা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা টানা থাকলেও সামনের দিকের সাদা চুল গুলো দৃশ্যমান। মুখের সাদা চামড়া বয়সের কারণে কুঁচকে গেলেও ঝলমলে হাসির কারণে তাকে দেখতে বেশ লাগে। তাকে দেখেই শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—মিনহা জি, তুমি এখানে? এতো রাতে এখানে কীভাবে এলে?
শ্রুতির কথা শুনে মিনহা হেসে উঠলো। বড্ড হাসি পাচ্ছে তার, কিন্তু শ্রুতির জন্য তাড়াতাড়ি হাসি থামিয়ে বললো,

—কীভাবে এলাম আমায় জিজ্ঞেস করছিস? এতো বোকা বলেই তো তোকে নিয়ে আমার চিন্তা!
শ্রুতি গাল ফুলিয়ে বললো,

—মিনহা জি, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বলে অগত্যা জিজ্ঞেস করে ফেলেছি। আর তুমি আমাকে অপমান করছো!!

—আচ্ছা, আর রাগ করতে হবে না। এখন বল, এভাবে কাঁদছিস কেন?
শ্রুতি ব্যস্ত হয়ে বললো,

—অনেক কিছু ঘটে গেছে, মিনহা জি। আমি কীভাবে কী করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো, তবে কবেই পৃথিবীর পাঠ চুকিয়ে দিতো। কিন্তু আমি তা করিনি, করবোও না। তবে আজ যা ঘটলো, এরপর আমি কী থেকে কী করবো? আজ……
মিনহা শ্রুতিকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

—হয়েছে, হয়েছে। তোকে কিছু বলতে হবে না। আমি সবই জেনেছি। তবে আমার মনে হয়, সময় খুব তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে।

—সময়? কিসের সময়?

—কিসের সময় বুঝতে পারছিস না? খুব দ্রুত তোকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে। তবে শুধু তুই একা না, আরো কয়েকজনকেও তিক্ত সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। তোকে এতো অসহায় হয়ে, দুর্বল হয়ে থাকলে চলবে না। শক্ত হ, কঠোর হ, নয়তো ধাক্কা সহ্য করতে পারবি না।

বলেই মিনহা ঘুরে চলে গেল। শ্রুতির চোখ দুটো আবার ঝাপসা হয়ে আসছে। শায়লা রুবাইয়াত শ্রুতির পাশে বসে বললো,

—কাঁদিস না, মা! মানুষের জীবনে দুঃখ আসে, আবার সুখও আসে। দুঃখের সময় ধৈর্য্য ধারণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

–“আমি এসিড ভিক্টিম বলে কি আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই? আমার বিকৃত চেহারার কথা যখন মানুষ জানবে, তখন তো সবাই আমায় দূর দূর করবে! আমি কীভাবে কী করবো, মা? চুপ করে থেকো না, উত্তর দাও। আর যদি আভাস কোনো ভাবে জানতে পারে আমার কথা, তখন কী হবে?”

কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে দিলো শ্রুতি। শায়লা রুবাইয়াতও বুঝতে পারছেন না কী বলে তার মেয়েকে সান্ত্বনা দিবেন। নিয়তি আজ তাদের কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে!

অন্ধকার একটা ঘরে নিজের রকিং চেয়ারে বসে আছে আভাস। বুকে জড়িয়ে রেখেছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার ছবি। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ খুলে তাকালো আভাস।
ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল স্নেহা,

—আজ হঠাৎ এভাবে শ্রুতির ছবি নিয়ে বসে আছো যে?
আভাস নিজের চোখের পানি মুছে বললো,

—মনে পড়ছে অনেক ওর কথা। আজ যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো আমি সুখী হতাম! আমার সুখের একমাত্র কারণই হলো শ্রুতি। অথচ, আজ ও আমার থেকে কতো দূরে! এতোটাই দূরে যে আর কখনোই ফিরে আসবে না। আমি আজও #ভুলতে_পারিনি_তাকে , স্নেহা। কোনোদিন পারবোও না।
আভাস একটু থেমে আবার বললো,

—আমার মনে হচ্ছে শ্রুতি আমার অনেক কাছে আছে। কেন এমন মনে হচ্ছে আমার? শ্রুতি কীভাবে আমার কাছাকাছি থাকবে? আচ্ছা, আমার ভালোবাসায় কি কোনো ঘাটতি ছিল? হয়তো আমি ওকে মুখ ফুটে কখনো মনের কথা বলিনি! তার জন্য আল্লাহ কেন ওকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল? কেন আমার সবকিছু অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল শ্রুতি?
স্নেহার চোখেও পানি চলে এসেছে। স্নেহাকে কাঁদতে দেখে আভাস বললো,

—অনেক রাত হয়ে গেছে, তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। কালকে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।

—হুম, মায়ের সাথে কথা হয়েছে তোমার? মা কি এখনো রেগে আছে তোমার রাজশাহী শিফট হওয়া নিয়ে?

—জানি না, কথা হয়নি এখনো।

স্নেহা আর কথা বাড়ালো না, নিজের ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলো। ঘরটা আগে থেকেই অন্ধকার ছিল, বাইরে থেকে একটু-আধটু আলো আসায় সবকিছু অনেকটাই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বারান্দার দরজা খোলা থাকায়। স্নেহা দরজা লাগিয়ে বেড সাইড টেবিল থাকা ল্যাম্পটি অন করতে যাবে ঠিক এমনসময় বারান্দার দিকে নজর যেতেই মনে হলো, দরজা দিয়ে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। স্নেহা তাকাতেই ছায়াটা সরে গেল। স্নেহা আর কালক্ষেপ না করে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে নিবে, তখনই টেবিলের ওপরে আগুন জ্বলে উঠলো। স্নেহা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
স্নেহার চিৎকার শুনে আভাস পাশের রুম থেকে ছুটে এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে।

—হোয়াট হ্যাপেন্ড, স্নেহা? চেঁচালি কেন? দরজা খোল। কী হলো? আমি দরজা খুলতে বলছি না! আই সেইড ওপেন দ্য ডোর। ড্যাম ইট।

স্নেহা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। স্নেহাকে দেখে আভাস অবাক হয়ে বললো,

—কী হয়েছে? এভাবে কাঁপছিস কেন? আর এই এসির নিচেও এভাবে দরদর করে ঘামছিস? স্ট্রেঞ্জ!
স্নেহা আভাসকে ঝাপটে ধরে বললো,

—ভাইয়া, কেউ রুমে এসেছিলো। আর ঐ টেবিলটাতে আগুন জ্বলে উঠেছিলো।

—হোয়াট? হ্যাভ ইউ গোন ম্যাড? এতো রাতে তোর ঘরে কে আসবে? আর টেবিলে আগুন জ্বলবে কীভাবে? আগুন জ্বললে তো আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার কথা, তাই না?

—আমি সত্যি বলছি, ভাইয়া। তুমি গিয়ে দেখো।

আভাস রুমে ঢুকে লাইট জ্বালালো। টেবিলের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখ কপালে উঠে গেছে। টেবিলের ওপর একটা হলদেটে কাগজ পড়ে আছে, যার ওপরের আর নিচের অংশ পোড়া। এমনকি কাগজটি আশেপাশে ছাই পড়ে আছে, যে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, এখানেই আগুন ধরেছিল। স্নেহা বলে উঠলো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১

—দেখলে তো, ভাইয়া! আমি বলেছিলাম না আগুন জ্বলছিল!

আভাস কাগজটা হাতে নিতেই দেখলো, কাগজের ওপর কিছু লেখা আছে। লেখাটা এরকম:
“অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, স্নেহা। তোমাদের সাথে দেখা হবে আশা করি। অতীত হানা দিবে খুব তাড়াতাড়ি। অনেক অপ্রিয় কিছু অপেক্ষা করছে তোমার আর আভাসের জন্য।
ইতি,
তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। ”
স্নেহা কাগজটা আভাসের হাত থেকে নিয়ে পড়ে অবাক হয়ে গেল।

—আমাকে কেন ধন্যবাদ জানালো? আমাদের অতীত হানা দেবে মানে কী? আর অপ্রিয় কিছু বলতে কী বলেছে? কে আছে এসবের পেছনে?

আভাস চিন্তিত স্বরে বললো,

—বুঝতে পারছি না। হয়তো কিছু একটা আছে, যা আমাদের অজানা। তুই এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি তোর রুমে আছি।

স্নেহা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। আভাস বসে বসে ভাবতে লাগলো। কী ঘটতে চলেছে তার জীবনে? কে এই অজ্ঞাত ব্যক্তি?

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৩