ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৩ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৩
Mahfuza Akter

শ্রুতি আয়নার সামনে বসে বসে নিজেকে দেখছে। মনে হচ্ছে আয়নায় ফুটে ওঠা প্রতিচ্ছবিটা তার দিকে আঙুল তুলে বলছে,
—কী এতো দেখছো? নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া চেহারাটা? পাঁচ বছর আগেও তোমার এই মুখ দেখলে মনে হতো সূর্য যেন হলুদ আভা ছড়াচ্ছে! আর আজ? সবসময় কি শুধু নিজের ভাগ্যকেই দায়ী করবে? এখনো সময় আছে। নিজেকে কি একটু স্ট্রং করতে পারবে না?
শ্রুতি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। আজ কেন যেন কান্না আসছে না,বরং হাসিই পাচ্ছে। আয়নার মধ্যেও কতো কিছু কল্পনাতে আসে! হঠাৎ শায়লা রুবাইয়াত বাজখাঁই গলায় বললেন,

—তিনদিন হয়ে গেছে, শ্রুতি। পড়াশোনা কি ছেড়ে দিবি তুই? ভার্সিটিতে যাস না কেন?
—মা, আভাস এখন থেকে রেগুলার আমাদের ক্লাস নিবে। প্রতিদিন ওনার সাথে কে লুকোচুরি খেলবে? আমি যাবো না ভার্সিটিতে, শুধু পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবো।
—এভাবে চললে তোর পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ আসবে। সবকিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে ভার্সিটিতে যা। তুই রেগুলার ক্লাস করবি এটাই আমার শেষ কথা।
বলেই শায়লা রুবাইয়াত নিজের ঘরে চলে গেলেন।
ভার্সিটির ভেতর ঢোকার সময় শ্রুতি নিজেকে ভীড়ের মাঝে আড়াল করে ঢুকলো। সবার শেষের সিটটায় বসতেই একটা মেয়ে এসে শ্রুতির সামনে দাঁড়ালো। মেয়েটা শ্রুতির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
—তুমি অদ্রিতা, রাইট?
শ্রুতি মাথা নাড়িয়ে বললো,
—হুম, অদ্রিতা রুবাইয়াত।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—আমি মুনতাহা। তুমি তো তিন বছর ধরে আমাদের সাথে এক ব্যাচে আছো, কিন্তু কারো সাথেই কথা বলো না কেন?
শ্রুতি আমতা আমতা করে বললো,
—আসলে, এমনি আর কি! আমি অনেক ইন্ট্রোভার্ট।
মুনতাহা হেসে বললো,

—সেটা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়।
শ্রুতি ও হেসে দিলো। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থির রইলো না। মুনতাহার একটা কথা শুনে শ্রুতির মুখ থেকে হাসি উড়ে গেল।

—আচ্ছা, আভাস স্যার তোমায় দেখে সেদিন ঐরকম রিয়েক্ট করলেন কেন? তোমাকে কি উনি আগে থেকে চিনেন?
শ্রুতি হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
—আরে না না, আমাকে উনি কীভাবে চিনবেন? আমি তো ওনাকে কখনো দেখিই নি! ওনার কোথাও ভুল হয়েছিল হয়তো!
—কিন্তু,,,,,
মুনতাহা কিছু বলার আগেই একজন টিচার ক্লাসে ঢুকলেন। মুনতাহা স্যারকে দেখে দৌড়ে নিজের সিটে চলে গেল। শ্রুতি অন্য টিচারকে দেখে মনে মনে বললো,
—আজকে কি আভাসের ক্লাস নেই? না থাকলে তো বেঁচেই গেলাম!
শ্রুতি আর কিছু না ভেবে স্যারের লেকচারে মনযোগ দিলো। একঘন্টা পর বেল বাজতেই টিচার ক্লাস ত্যাগ করলেন।

এখন মূলত আভাসের ক্লাস নেওয়ার পালা। ক্লাসে ঢুকতেই সে অনুভব করল, তার বুকের বাঁ পাশে থাকা ফাঁপা যন্ত্রটি অতিরিক্ত মাত্রায় লাফাচ্ছে। আভাসের ভ্রূকুটি কুঁচকে এলো মুহূর্তেই। এরকমটা কেন হচ্ছে?
আভাস ব্যাপারটা উপেক্ষা করে সবাইকে বসতে বললো। হঠাৎ শ্রুতির দিকে নজর যেতেই সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিনের পর থেকে আর ওকে দেখেনি। তিনদিন ধরে শ্রুতি ক্লাসে আসে না, সেটা আভাস ঠিকই বুঝতে পারছে। আভাস একপা একপা করে শ্রুতির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু আভাস যতই এগুচ্ছে, তার হার্টবিট ততই ফাস্ট হচ্ছে। এর আগে শুধু শ্রুতির কাছাকাছি থাকলেই এমন অদ্ভুত লাগতো। কিন্তু এই মেয়েটার কাছে যেতে এমন লাগছে কেন?
এদিকে শ্রুতি ঢোকের পর ঢোক গিলছে, তবুও গলা শুধু শুকিয়ে যাচ্ছে। তার দিকে এমন করে এগিয়ে আসছে কেন? ভয়ে কান্না করে দেওয়ার মতো অবস্থা শ্রুতির। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকছে সে।
আভাস শ্রুতির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

—অদ্রিতা রুবাইয়াত, রাইট?
শ্রুতি কেঁপে উঠে সামনে তাকালো। শ্রুতির ভীতু চাহনি দেখে আভাসের ভেতরের আবারও একটা কথাই নাড়া দিয়ে উঠলো,
—আমি এতোটাও ভুল হতে পারি কীভাবে? এই দৃষ্টি যে সেই চোখ দুটোতেই আমি দেখেছি! তবে কি অদ্রিতা রুবাইয়াত-ই শ্রুতি? কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়! শ্রুতি রাজশাহীতে কেন আসবে? আর কী করেই বা আসবে?
ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে এসে শ্রুতিকে জিজ্ঞেস করলো,
—সো, মিস অদ্রিতা, আমার প্রিভিয়াস তিনটি লেকচার কি আপনি এটেন্ড করেছেন?
শ্রুতি মাথা নিচু করে ডানে বামে মাথা নাড়ালো।
—এভাবে ক্লাস এটেন্ড না করলে আপনার রেজাল্ট ডেফিনেটলি ভালো আসবে না, রাইট? আমি চাই না, আমার কোনো স্টুডেন্ট ড্রপ আউট হোক।
ড্রপ আউটের কথা শুনে শ্রুতি কনফিডেন্সের সাথে বললো,
—যেখানে চেষ্টা আছে, সেখানে হারার প্রশ্নই আসে না। আমি এখন থেকে রেগুলার ক্লাস করবো। তবে ক্লাস যদি নাও করি, তবুও আমি ড্রপ আউট হবো না। কারণ কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেই জেতার জন্য, তাদের মধ্যে শ্রু………

বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো শ্রুতি।
শেষের অসম্পূর্ণ কথা টা শুনে আভাস শকড হয়ে শ্রুতির দিকে তাকালো। তার মনে পড়ে যায় সেই কথাটা, যেটা সে শ্রুতিকে প্রায়ই বলতো,

—কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেই জেতার জন্য, তাদের মধ্যে আমার শ্রুতিও একজন।
একথা শুনে শ্রুতি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে আভাসের দিকে তাকাতো। সাথে সাথে দুজনেই হেসে দিতো।
আভাস কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

—কী বললে? কথাটা ফিনিস করো।

শ্রুতি থতমত খেয়ে নিজেকে বকতে লাগলো। কতটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে সে! এখন কী বলবে আভাসকে?

—স্যার, একচুয়েলি আমি বলছিলাম যে,তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবো আর কী?

আভাস কিছুক্ষণ শ্রুতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

—ওকে, নাও সিট ডাউন। আর আশা করি, লেকচার মিস দিবে না।

শ্রুতি বসে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল কেউ ওর গলা টিপে ধরে রেখেছে। কিন্তু সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ক্লাস শেষ হতেই আভাস বের হয়ে যাওয়ার আগে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বললো,

—মিস অদ্রিতা, ক্লাস শেষ করে আমার সাথে দেখা করে যাবেন।

বলেই বেরিয়ে গেল।
আভাস মনে মনে হাসছে আর ভাবছে,

—আমি বলিনি, তুমি বোঝোনি। আমি বলবোও না আর তুমি বুঝবেও না।

এদিকে ক্লাসের সবাই শ্রুতির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তাদের দৃষ্টিতে অবাকতা, বিরক্তি আর হিংসা একসাথে কাজ করছে। শ্রুতির প্রতি আভাসের এমন আচরণ কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না।
কিন্তু শ্রুতির মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। সে বুঝে গেছে, আজ সে ধরা খাবে। আভাস কি তাকে চিনে ফেলেছে? কী অপেক্ষা করছে তার জন্য?

প্রফেসর তন্ময়ের রুমে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে স্নেহা। স্নেহার চোখে তন্ময় একজন অতিরিক্ত রকমের অদ্ভুত, গিরগিটির মতো একেক সময় একেক রং-এ নিজেকে মুড়িয়ে নেওয়ার মতো যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি। আপাতত তন্ময় টেবিলের ওপর কিছু পেপারস নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। স্নেহা তন্ময়ের সামনে বসেই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বললো,

—স্যার, আমায় আপনার পিয়ন দিয়ে ডাকিয়ে এনে এভাবে বসিয়ে রেখেছেন কেন? কিছু কি বলবেন?
তন্ময় নিজের কাজে মনোযোগ রেখেই বললো,
—অর্থাৎ তুমি আমাকে প্রশ্ন করছো?
স্নেহা আমতা আমতা করে বললো,
—না, মানে স্যার। আসলে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি তাই……..
তন্ময় স্নেহার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—মিড টার্ম পরীক্ষার খাতায় কী লিখেছো তুমি?
স্নেহার মুখটা পুরোই চুপসে গেল। মিড টার্ম পরীক্ষা সে সিরিয়াসলি দেয়নি, কোনো রকমে না পড়ে পরীক্ষা দেওয়া যেটাকে বলে। স্নেহার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে তন্ময় আবার জিজ্ঞেস করল,
—কী হলো? অন্য সময়ে তো মুখ বন্ধ করানো যায় না। ফ্রিকোয়েন্টলি বকবক করো, আমার কথা তো শুনোই না! এখন চুপ কেন? বল এক্সামে কী লিখেছো?
স্নেহা বুঝে গেছে এমনি এমনি ওকে ছাড়বে না। তাই বরাবরের মতোই তন্ময়কে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২

—কেন, স্যার? আপনি কি আমার খাতার লেখা গুলো পড়েননি? নাকি পড়তে পারেন না?
তন্ময় কতক্ষণ স্নেহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
—দাঁড়াও, তুমি বসা থেকে উঠে দাঁড়াও। আই সেইড, স্ট্যান্ড আপ!!
স্নেহা ধমক খেয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
—শুধু দাঁড়ালেই চলবে না, চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াও।
স্নেহা কোনো বাক্য ব্যয় না করে চেয়ারে দাঁড়িয়ে গেল। তন্ময় বললো,
—এবার কান ধরো।
স্নেহা ভালো করেই জানে যে, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। তাই একটু না বুঝার ভান করে বললো,

—কার কান ধরবো, স্যার?
তন্ময় বিরক্ত হয়ে বললো,
—কারটা আর ধরবা? আমারটা ধরেই বসে থাকো!
স্নেহা নিজের হাত দুটো তন্ময়ের কানের দিকে এগিয়ে নিয়ে ধরতে যাবে এমনসময় তন্ময় ধমক দিয়ে বললো,
—স্টপ ইট, ইডিয়েট। নিজের কান ধরো, নিজেরটা। তোমার ক্লাস শুরু হতে আরো আধ ঘন্টা বাকি, বেল বাজার আগপর্যন্ত এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
স্নেহা মিটমিটিয়ে হেসে কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বললো, একদম ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে।
শ্রুতি আভাসের রুমের কাছাকাছি যেতেই এমন একটা কথা শুনলো, যেটা শুনে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ৪