ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২০ || নীল ক্যাফের ডায়েরী

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ২০
Mahfuza Akter

আভাস ঘরে ঢুকে শ্রুতিকে বেশ গম্ভীরমুখে বললো,
—ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে নাও। আজই আমরা রাজশাহী চলে যাবো।
রাজশাহী যাওয়ার কথা শুনে শ্রুতি আভাসের দিকে তাকাতেই দেখলো রাগে ওর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,

—এখন এই অবস্থায় আমরা এখান থেকে চলে যাবো? স্নেহা আপুর তো সবে মাত্র জ্ঞান ফিরলো! ওনাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে আমরা কীভাবে চলে যাই?
আভাস শান্ত গলায় বললো,
—সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। তন্ময়কে বলে আমি স্নেহাকে রাজশাহীর কোনো হসপিটালে শিফট করাচ্ছি।
—আপনি এতো রেগে আছেন কেন? আর এভাবে হুট করে বাড়ি ছাড়তে চাচ্ছেন কেন?
—কারণ হলো এটা।

বলেই একটা মাঝারি সাইজের কাচের বোতল শ্রুতির হাতে ধরিয়ে দিলো আভাস।
শ্রুতি কিছুক্ষণ বোতলটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—এটা কিসের বোতল? ভেতরে তো পানির মতো কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে!
আভাস দাতে দাত চেপে বললো,
—পানি না, এটা একধরনের তেল। সেদিন সিঁড়িতে এই তেলটাই ঢালা হয়েছিল। এটা নরমাল সব তেলের চেয়েও কয়েক গুন বেশি তৈলাক্ত।
—এটা আপনি কোথায় পেলেন?
—আরিহা খানের ঘরে।
শ্রুতি চোখ বড়বড় করে বললো,
—কীইইইইই?

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

—আমি প্রথমেই এমন কিছু একটা সন্দেহ করেছিলাম, আর এখন? এখন সেটাই সত্যি হলো! উনি সিঁড়িতে তেল ঢেলেছিলেন তোমার জন্য। এখনো কি আমায় চুপ করে থাকতে বলবে?
শ্রুতি মাথা নিচু করে বললো,
—আপনি রেডি হোন, আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।
আভাস একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—আমি জানতাম, তুমি এমনটাই বলবে। কী যে এতো দরকার ঐ আরিহা খানের রহস্য জানার আমি সেটাই বুঝতে পারলাম না!
আভাস রেগেমেগে নিজের কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। শ্রুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবকিছু গোছগাছ শুরু করে।
বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় আরিহা খান তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। আভাসের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

—এই ভরদুপুরে কোথায় যাচ্ছিস, আভাস? তাও আবার এই মেয়েটাকে নিয়ে! আর তোদের হাতে এতো ব্যাগপত্র কেন?
আভাস কিছুক্ষণ আরিহা খানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল শ্রুতির হাত ধরে।
আরিহা খান অবাক চোখে একদৃষ্টিতে আভাসের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। আভাসের এমন আচরণ মাঝে মাঝে আরিহা খানের মনে গভীর ভাবে দাগ কাটে। তিনি ভেবে পান না, আভাস কেন তার সাথে এমন রূঢ় আচরণ করে। আচ্ছা, শ্রুতিকে মারতে চাওয়ার ব্যাপারে কি আভাস কিছু জেনে ফেললো? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? আরিহা খান কিছু না বললে তো আর কারো সাধ্য নেই সত্যিটা জানার। আর যদি জেনেই থাকে, তাহলে কখনো কিছু বললো না কেন? আভাসের এতো ক্ষোভের কোনো কারণই আরিহা খান খুঁজে পাচ্ছেন না।

তন্ময় সেই কখন থেকে স্নেহাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু স্নেহা খাবার মুখেই নিচ্ছে না। তন্ময় অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
—কী বাচ্চামো করছো, স্নেহময়ী? খাবারটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।
স্নেহা ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
—আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত খাবো না।
—বললাম তো আভাস এসে তোমাকে সবকিছু বলবে।
—কেন? আপনি কিছু জানেন না?
—আভাসের মুখেই না হয় শুনে নিও। এখন খেয়ে নাও, প্লিজ। ওষুধ খাবার টাইম হয়ে যাচ্ছে। খাবার না খেলে ওষুধ খেতে পারবে না, আর ওষুধ না খেলে তো সুস্থও হতে পারবে না!
স্নেহা শুকনো হাসি দিয়ে বললো,

—ওষুধে আমি কখনোই ঠিক হবো না। আমি জানি, আমি আর কখনো হাঁটাচলা করতে পারবো না। তোমরা আমার কাছে মুখ ফুটে কিছু না বললে কী হয়েছে? আমার শরীরের অবস্থা আমি বেশ………..
স্নেহার কথা শেষ হওয়ার আগেই তন্ময় রেগে চিল্লিয়ে বললো,
—জাস্ট শাট আপ, স্নেহা। রাগ উঠাবে না আমার একদম।

আকস্মিক চিৎকারে স্নেহা হালকা কেঁপে উঠে। তন্ময়ের এমন বাঘের মতো হুংকার দিয়ে ওঠাকে সে বরাবরই ভয় পায়। তন্ময় স্নেহার এমন ভীতু চেহারা দেখে কিছুক্ষণ জোরে শ্বাস নিয়ে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাভাবিক হতেই স্নেহার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে, চোখ লাল হয়ে পানি টলমল করছে। স্নেহা কখনো তন্ময়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেনি, তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই দৃষ্টি তার কাছে অচেনা ও এর মর্মার্থ তার অজানা।
স্নেহা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তন্ময় ওকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে মাথার ব্যান্ডেজের ওপর ক্রমাগত ওষ্ঠস্পর্শ করতে থাকে। স্নেহা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকায় হতভম্ব হয়ে তন্ময়ের বুকের অনবরত কম্পন শব্দ অনুভব করছে। পিনপতন নিস্তব্ধতার মাঝে তন্ময় হঠাৎ আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো,

—স্নেহময়ী!!!
স্নেহা হালকা নড়েচড়ে উঠলে তন্ময় ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
—আ’ম সরি, স্নেহময়ী।
স্নেহা অবাক হয়ে বললো,
—কেন?
—বকা দিয়েছি, তাই? তুমি যখন সেন্সলেস ছিলে, তখন তোমায় প্রমিস করেছিলাম কখনো বকা দিবো না।
স্নেহা তন্ময়ের এমন কথা শুনে হেসে দিলো। তন্ময় জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—কিছু শুনতে পাচ্ছো?
—হুম, আপনার হার্টবিট শুনছি।
—এই হার্টবিট এতো সুন্দর ভাবে চলছে শুধু তোমার জন্য। এটার পাসওয়ার্ড যে তুমি! সেদিন তোমার ঐ অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীটাই উল্টে গেছে। হার্টটাও দু টুকরো হয়ে যেত যদি তুমি চোখ না খুলতে। প্লিজ, স্নেহময়ী! আই ব্যেগ টু ইউ। কখনো তোমার ফিজিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে আমার কাছে এসব উল্টাপাল্টা কিছু বলবে না। আমার সহ্য হয় না। তুমি আছো এতেই আমি খুশি। তবে তুমি একদম আগের মতো হয়ে উঠবে, স্নেহময়ী। আই প্রমিস, আই শেল লেফট নো স্টোন আনটার্নড!

হঠাৎ কারো কাশির শব্দ শুনে তন্ময়-স্নেহা হকচকিয়ে উঠে স্নেহাকে ছেড়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো, আভাস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তন্ময় জোরপূর্বক হেসে বললো,
—আরে তোরা। বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়!
আভাস চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
—কী করবো বল? এখানে যে কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে, সেটা তো আমি জানতাম না!
স্নেহা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে আছে। তন্ময় ভ্রু কুঁচকে বললো,
—এই তোর লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই, তাই না? নিজের ছোট বোনকে নিয়ে এসব উদ্ভট কথা বলছিস! আমার বোনের সাথে তুই বোধ হয় কোনো রোমান্টিক কথা বলিস না? তখন আমি কিছু বলি তোদের?
—তুই কোনোদিন দেখেছিস আমাদেরকে ওসব কথা বলতে?
—দেখিনি তো কী হয়েছে? বলেছিস তো অবশ্যই! যাই হোক, তোর বোনকে এখন খাওয়া!
আভাস অবাক হয়ে বললো,

—মানে? স্নেহা এখনো খাস নি?
স্নেহা মাথা নিচু করে বললো,
—আমায় আগে বলো, আমরা কেন হুট করে রাজশাহী চলে এলাম? তুমি কেন এতো রেগে ছিলে কালকে?
আভাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রুতির এক্সিডেন্ট থেকে স্নেহার এক্সিডেন্ট পর্যন্ত যে আরিহা খানের হাত আছে, সেটা খুলে বললো। স্নেহা বজ্রাহত হওয়ার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়েই চলেছে।

কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটলেও আরিহা খানের মনোভঙ্গির কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার মনে এখনো জ্বলছে শ্রুতির প্রতি আক্রোশের আগুন। তার সেই আগুনে ঘি ঢালছে নাতাশা।
রাতের থমথমে নিস্তব্ধ রাস্তায় ধীর গতিতে পা চালিয়ে হাঁটছে আভাস আর শ্রুতি। চাঁদের মৃদুমন্দ ক্ষীণ আলোয় সবটাই অনেকটা পরিষ্কার দেখাচ্ছে। হালকা বাতাসের ঝাপটার শীতল স্পর্শে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতির সৃষ্টি করছে। আভাস নিজের ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে শ্রুতির বাঁ হাতের তর্জনী ধরে মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,

—আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো, জানো? এক পূর্ণিমা রাতে আমার মিষ্টিপাখির আঙুলে আঙুল রেখে সুনশান-নিস্তব্ধ রাস্তা ধরে হাঁটবো। আমাদের মুখে বিরাজ করবে প্রাপ্তির হাসি। যদিও আজ পূর্ণিমা নয়, তবুও চাঁদ তো আছে!
শ্রুতি মুখ বাকিয়ে বললো,
—আসতে তো চাইছিলেন না! আর এখন ইচ্ছের কথা বলছে!
আভাস শ্রুতির এমন গাল ফুলানো দেখে হাসলো, কিন্তু কিছু বললো না। অনেকক্ষণ হাঁটার কারণে শ্রুতি ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসে পড়লো। হাঁপিয়ে উঠে বললো,
—আমি আর হাটতে পারবো না। অনেক পানির পিপাসা পেয়েছে।
আভাস হতাশ গলায় বললো,

—এখন পানি কোথায় পাবো? হাঁটতে না পারলো চলো কোলে করে তোমাকে নিয়ে যাই।
—এতদূর কোলে করে নিয়ে যাবেন? আপনার মাথাটা পুরোই গেছে! ঐ যে একটা চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে, ঐখান থেকে পানি নিয়ে আসুন।
আভাস শ্রুতির আঙুলের ইশারা অনুযায়ী লক্ষ করে দেখলো, অদূরে একটা ছোট দোকান থেকে মিটিমিটি আলো দেখা যাচ্ছে। আভাস মাথা নাড়িয়ে বললো,
—অসম্ভব!!!! আমি এখানে তোমাকে একা ফেলে অতদুর যাবোই না।
শ্রুতি অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
—বোঝার চেষ্টা করুন, আভাস। আমার পা চলছেই না, আবার গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।
আভাস অবশেষে রাজি হয়ে উল্টো দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু দু পা এগুতেই বারবার পিছনে ঘুরে শ্রুতির দিকে তাকাচ্ছে। শ্রুতি এটা দেখে আপনমনে হাসলো। হঠাৎ কেউ জোরে চিৎকার করে বললো,
—হেল্প, হেল্প!! কেউ বাঁচাও আমাকে।

শ্রুতি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, একটা ঝোপের আড়াল থেকে বারবার একই কথা কেউ বলছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো আভাসকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েলি কন্ঠ শুনে শ্রুতির ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। হয়তো কোনো মেয়ে বিপদে পড়েছে বলেই এমনভাবে চিৎকার করছে। মন বলছে ছুটে যেতে আর মস্তিষ্ক বলছে আভাসের জন্য অপেক্ষা করতে। অনেকক্ষণ যাবৎ মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে মনটাই জিতে গেল আর শ্রুতি ঝোপের দিকে পা বাড়ালো।
অনেকক্ষণ পর, আভাস পানির বোতল হাতে ফিরে এসে দেখলো, শ্রুতি নেই। আভাস আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোথায় শ্রুতিকে পেল না। দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে আভাস চিৎকার করে শ্রুতিকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কোনো উত্তর পেল না।
শ্রুতি শ্রান্ত পায়ে যতই এগুচ্ছে, ততই সেই শব্দটা নিকটবর্তী ঠেকছে। পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে। অবশেষে শ্রুতি এসে একটা খোলা মাঠে নিজেকে আবিষ্কার করলো। অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে সে মাটিতে বসে পড়ে।
হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো, কেউ হু হা করে হাসতে হাসতে বলছে,

—যাক, অবশেষে পাখি খাঁচায় ধরা দিয়েই দিলো! এতো সহজেই তোকে হাতের নাগালে পেয়ে যাবো ভাবতেই পারিনি!
শ্রুতি অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো, আরিহা খান শয়তানি হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
—আপনি? আপনি এখানে কেন? তার মানে, আপনি আমায় প্ল্যান করে এখানে এনেছেন?
—হ্যাঁ, ভেবেছিলাম তোদের বাড়িতে গিয়েই আজ তোর কোনো ব্যবস্থা করবো। কিন্তু রাস্তায় এসে দেখি, তুই এখানেই বসে আছিস। তাই ঐ রেকর্ডিং টা কয়েকবার বাজাতেই তুই চলে এলি। আমি জানতাম, তুই অনেক দয়ালু, তাই এটা শুনে বসে থাকতে পারবি না।

—কেন নিয়ে এলেন আমায় এখানে?
—তোকে মারবো বলে। আজই তোর জীবনের শেষ দিন!
শ্রুতির চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—কী শত্রুতা আপনার আমার সাথে? কী বিগড়ে দিয়েছি আমি আপনার? কী ক্ষতি করেছি আমি? বারবার কেন আমায় মারতে চাইছেন? আমার সতীত্ব নষ্ট করে, চেহারা নষ্ট করে কি আপনার শান্তি হয়নি?
আরিহা খান অবাক হয়ে বললেন,
—সতীত্ব নষ্ট করেছি মানে?
—জেনেও না জানার ভান করছেন? আগে বলুন আমায় কেন মারতে চান আপনি?
আরিহা খান হিংস্র গলায় বললেন,
—কারণ তোর বাবা, রুবাইয়েত আহমেদ।
শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,
—কী?

—হ্যাঁ। তোর বাবাকে ভালোবাসতাম আমি। এখনো তার ছবি না দেখলে আমার দিন কাটে না। তোর বাবা আমায় বলেছিল বিয়ে করবে, কিন্তু পরবর্তীতে সে শায়লাকে বিয়ে করে পরিবারের পছন্দ মতো। তারপর আমি আর তাকে খুঁজে পাইনি। যখন আমি তোদের বাসায় ভাড়ায় উঠলাম, তখন তোদের দেখে বুঝতে পারিনি। কিন্তু শায়লা রুবাইয়াত নাম শুনে আমি তোদের চিনে ফেলি। রুবাইয়েত মারা গেলেও শায়লার প্রতি আমার একটা ক্ষোভ ছিল। আর তারজন্যই আমি তোকে লক্ষ্য বানাই। তুই মরে গেলে শায়লা একদম নিঃস্ব হয়ে যাবে।

—তারজন্য আমায় রেপ করানোর কী দরকার ছিল? একেবারেই মেরে দিতেন!
—আমি তোকে রেপ করানোর কথা বলিনি! শুধু মেরে চেহারাটা নষ্ট করে দিতে বলেছিলাম যেন কেউ তোকে না চিনতে পারে। হয়তো ঐ ছেলেগুলো নিজেরা এমনটা করেছে। এ ব্যাপারে আমার কোনো হাত নেই।
—এখন তো আর আমার মা বেচে নেই। আমাকে মেরে আপনার আর লাভ কোথায়?
—তোর বাবা আমাকে ঠকিয়েছে। শুধু মাত্র তোর বাবার আশায় আমি আমার স্বামীকে মারতেও দ্বিধা বোধ করিনি। রুবাইয়েতকে পেলে ওর কাছে যাওয়ার পথে আমার স্বামী কাটা হয়ে দাঁড়াতো। তাই নিজ হাতে তাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। আর আজ তোকে মেরে তোর বাবার সব অস্তিত্ব মুছে দিবো আমি।
আরিহা খানের কথা শেষ হতে না হতেই আভাস এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

—বাহ! বাহ! এতো পাপের বোঝা নিয়ে কীভাবে ঘুরছেন আপনি? আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে! এতোদিন আপনাকে মা ভাবলেই আমার আফসোস হতো। আর আজ তো আমার এটা বলতেই ঘৃণা হচ্ছে যে, আপনি আমার জন্মদাত্রী মা। ছিঃ!
আরিহা খান কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
—আভাস, আমার কথাটা………
আভাস চোখ মুছতে মুছতে বললো,
—কী কথা, হে? কী কথা? তুমি আমার বাবাকে খুন করেছো শুধু মাত্র নিজের স্বার্থের জন্য! পাগল হয়ে গেছিলে তুমি! তাই কোনোকিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। আমাকে, স্নেহাকে, আমাদের বাবাকে ঠকিয়েছো তুমি। ইউ আর আ বেট্রেয়ার।
আরিহা খানের হাত থেকে রিভলবারটা পড়ে গেল। নিজের সন্তানের মুখে নিজেকে প্রতারক বলে সম্বোধন শুনে আরিহা খান স্তব্ধ হয়ে গেছে।
আভাস তাকে জিজ্ঞেস করল,
—তুমি শ্রুতিকে মারবে, তাই না?

আভাস শ্রুতির কাছে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে দাড় করালো। আরিহা খানের পায়ের কাছ থেকে রিভলবারটা এনে শ্রুতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—এই সেই ব্যক্তি, যে কিনা তোমাকে মারতে চেয়েছিল, তোমার রেপড এবং এসিড ভিক্টিম হওয়ার জন্য দায়ী উনি। আমার বাবার খুনি উনি। এখন সব কিছু র প্রতিশোধ তোমায় নিতে হবে। নাও, শ্যুট হার।
শ্রুতি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—আভাস, আমি কীভাবে…….

—জানি না, আই সেইড শ্যুট হার। ওনি যেন বেঁচে না থাকে। ওনার বাচার কোনো অধিকার নেই। গুলি চালাও, প্লিজ।
আরিহা খান এতোক্ষণ ঘোরের মাঝে ছিলেন। সৎবিৎ ফিরে পেতেই দেখেন যে, শ্রুতি তার দিকে বন্দুক তাক করে আছে। আরিহা খান পালানোর জন্য পা বাড়াতেই শ্রুতি চোখ বন্ধ করে বন্দুকের নলে চাপ দেয়। একাধারে চারটা গুলি ছুঁড়তেই আরিহা খানের রক্তাক্ত দেহ মাঠের পেছনে থাকা খাদে পড়ে যায়। শ্রুতির হাত থেকে রিভলবারটা মাটিতে পড়ে গেল। সে নিজের দুই হাতের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝরাচ্ছে। হঠাৎ আরেকটা গুলির আওয়াজ আসতেই শ্রুতি চমকে উঠে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো আভাস তাকে কভার করে দাঁড়িয়ে আছে, দূর থেকে নাতাশা জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো,

ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব ১৯

—-আভাস!!!!!
শ্রুতি বুঝতে পারলো, নাতাশা তাকে গুলি করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আভাস তার সামনে এসে দাঁড়াতেই গুলিটা আভাসের পিঠে লেগেছে। আভাস মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই শ্রুতি চিৎকার দিয়ে উঠলো। আভাসের মাথা কোলে তুলে নাতাশার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো সে। মাটি থেকে বন্দুকটা নিয়ে নাতাশার উদ্দেশ্যে গুলি ছুঁড়তে লাগলো শ্রুতি।
আভাস ব্যথায় ছটফট করছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে কিছু বলতে চাইছে। শ্রুতি আভাসের মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
—কিছু হবে না আপনার। আমি কিচ্ছু হতে দিবো না। আমি এখুনি ভাইয়াকে কল দিচ্ছি।
শ্রুতি উঠে দাড়াতে যাবে এমনসময় আভাস আঁটকে দিয়ে বললো,
—সব সমস্যার সমাপ্তি হলো। অনেক ভালোবাসি তোমায়, মিষ্টিপাখি। অনেক বেশি ভালোবাসি।
বলেই চোখ বন্ধ করে নিলো আভাস।

?বর্তমান?
ডায়েরিটা এখানেই শেষ হতেই অশ্রু নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো ডায়েরিটাকে। চশমার আড়ালে থাকা চোখ জোড়া অসম্ভব লাল ও জলসিক্ত।
অশ্রু নিজের চোখ মুছতে মুছতে বললো,
—আই মিস ইউ, পাপা। আই মিস ইউ আ লট।
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা হাসিমুখে বললো,
—কেমন লাগলো বার্থডে গিফট টা?
অশ্রু ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বললো,
—আমার চোদ্দ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় গিফট ছিল এটা, ফুপি।
—তবে আভাস-শ্রুতির কাহিনী কিন্তু আরো বাকি আছে। জুনিয়র ভাবির কাছ থেকে শুনতে হবে সেটা। এই ডায়েরিটা সে পুরো কমপ্লিট করেনি।

ভুলতে পারিনি তাকে শেষ পর্ব