চন্দ্রাস্ত পর্ব ৫
ফারহানা কবীর মানাল
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ধরনীর একপাশে সূর্যের আলো অবশিষ্ট নেই। পাখিরা নিজেদের ঘরে ফিরতে ব্যস্ত। নাইমা কানের পাশ থেকে ফোন নামিয়ে রাখল। ঘন্টার বেশি সময় নিয়ে হাবিবকে সবটা খুলে বলেছে। সে শুধু শুনেছে, ছোট্ট করে বলেছে- আপাতত নববীকে এসব বলার দরকার নেই। অযথা দুশ্চিন্তা করবে।
তার কথায় নাইমা বিরক্ত হয়েছে ঠিক তবে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। নববীর শরীর ভালো না, স্বামী কাছে নেই বিধায় মনের অবস্থাও তরল। এই মুহূর্তে এসব শুনলে হয়তো সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। কে জানে হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। সে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
শরিফা বেগম রান্নাঘরে রোহানের জন্য নুডলস রান্না করছেন। ছেলেটার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। নববী তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নরম গলায় বলল, “আমার কাছে দেন। আমি করে দিচ্ছি।”
শরিফা বেগম চোখ তুললেন না। থমথমে গলায় বললেন, “আমি পারব। তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
সে আর কি বলবে বুঝতে পারল না। সবকিছু কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে৷ এক জায়গায় এসে দলা পাকিয়ে আছে। বিরক্তিকর পরিস্থিতি। সত্যিই বিরক্তিকর!
হাবিব ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকল। হোটেলের ঘরে মায়ার টান নেই। তবুও তাকে ফিরতে হয়েছে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। বাদশা ভাই সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোন কাজে হাত দিতে পারেনি। তার ভাগের কাজ শেষ করতে গিয়ে বাকি দু’জনের অবস্থা নাজেহাল। সজীব তো এক পর্যায়ে বলেই ফেলল, “শালা অসুস্থ না ছাই! সারাদিন ঘরে শুয়ে বউয়ের সাথে কথা বলার ধান্দা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হাবিব খানিকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করল। তার আর কিছু ভালো লাগছে না। ইসস! যদি নববী এখানে থাকত। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোবাইল বের করে নববীর নম্বরের কল দিলো। দু’বার রিং হবার পর নববী কল রিসিভ করল। মনম’রা গলায় বলল, “কেমন আছ? শরীর ভালো আছে?”
“সব ভালো আছে। তোমার কি অবস্থা?”
নববী সকালের ঘটনার কথা বলতে গিয়েও বলল না। এসব শুনলে অযথা দুশ্চিন্তা করবে তারা নিজেদের মত করে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে নিয়ে গেল।
মানিক মিয়া সোফায় পা তুলে বসে আছেন। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। দেয়ালে টানানো ঘড়িতে টিকটিক শব্দ হচ্ছে। তিনি চোখ তুলে ঘড়ির দিকে তাকালেন। মিনিটের কাটা দশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, আর দশটা মিনিট পেরোতে পারলে নয়টা বাজবে। মিলি সোফায় সামনে রাখা টি-টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখল। তরল গলায় বলল, “আব্বা, এত রাতে কে আসবে?”
মানিক মিয়া ভাবলেশহীন গলায় বললেন, “আমার দুই চারজন বন্ধুবান্ধব আসবে। তোর মা’য়ের কাছে গিয়ে দেখ রান্না কতদূর এগিয়েছে।”
“এভাবে হুট করে আসলে হয় নাকি? আগে থেকে বলবে না? এতসব রান্নাবান্না করতে মায়ের খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
“মায়ের কষ্ট হলে তুমি গিয়ে তাকে সাহায্য করো। এত বড় মেয়ে ঘরে থাকতে সে একা কেন সব কাজ করবে? জলদি যাও।”
মিলি আঁড়চোখে তার দিকে তাকাল। মানিক মিয়া কখনও এমন করে কথা বলেন না। আজ হঠাৎ কি হলো যে এভাবে কথা বলছেন। মিলি ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করল না। রান্নাঘরে মা’য়ের কাছে গেল। বলল, “কারা আসবে? কাদের জন্য এতসব আয়োজন করছ মা?”
“তোর বাবার বন্ধুুরা। স্কুলের পুরনো বন্ধু। বিকেলে বাজারে গিয়ে হঠাৎ দেখা হলো। দাওয়াত দিয়ে এসেছে।”
“ওহ আচ্ছা! আমার কোন সাহায্য লাগবে?”
“হ্যাঁ, এখানেই থাক। হাতে হাতে কাজগুলো শেষ করে ফেলি।”
রাত দশটা নাগাদ তার রান্না শেষ হলো। আয়োজনের কমতি নেই। পোলাও, কোর্মা, কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, মাছ ভাজা, শুকনো ডাল। অতিথিরা আগেই চলে এসেছে। বসার ঘরে বসে কথাবার্তা বলছে। মিলি মুখ হাত ধুয়ে ভালো দেখে একটা থ্রি-পিস গায়ে চাপালো। চুল আঁচড়ে মুখে পাউডার লাগলো। শত হলেও কাজের মেয়ের মতো সেজে অতিথিদের সামনে যাওয়া যায় না। মানিক মিয়া মিলিকে ডেকে পাঠালেন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “এই হচ্ছে আমার মেয়ে। ঘরের কাজকর্মে খুব পারদর্শী। আজকেও মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিয়েছে।”
মিলি বাবার মুখে প্রশংসা শুনে যতটা না খুশি হয়েছিল অন্যদের প্রশ্ন শুনে ঠিক ততটাই ঘাবড়ে গেল। বুড়ো মতো লোকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব প্রশ্ন করছে। কতদূর পড়াশোনা করছে, কোন পরীক্ষার রেজাল্ট কি, বন্ধুবান্ধব কতজন এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন। মিলি ভীষণ বিরক্ত হলো তবে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ কিছু বলতে পারল না। ভদ্র মেয়ের মতো উত্তর দিয়ে গেল। মানিক মিয়া বললেন, “মিলি রাতের খাবার দিয়ে দাও। সবাইকে ফিরতে হবে।”
মিলি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। তার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।
অতিথিরা চলে যাবার পরপরই মিলি তার বাবার কাছে গেল। বিরক্ত গলায় বলল, “এরা আপনার কেমন বন্ধু?”
মানিক মিয়া শান্ত চোখে তাকালেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “খোকন বাদে এদের কেউই আমার বন্ধু নয়। সবাই তোমাকে দেখতে এসেছে।”
“আমাকে দেখতে এসেছে মানে?”
“খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দিতে চাই। তাই দেখাশোনায় দেরি করিনি।”
“আব্বা, আমি এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই না। আগে একটা চাকরি বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”
“অন্যের ঘর ভা’ঙার জন্য আমি তোমাকে আমার ঘরে রাখতে পারব না।”
“এসব আপনি কি বলছেন আব্বা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“আমি কি বলতে চাইছি তা তুুমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছ। তোমার বয়স বেড়েছে। বিবাহযোগ্যা কুমারী মেয়ের গায়ে হাত তোলা অশোভনীয় বিধায় তোমাকে কিছু বলতে পারছি না।”
মিলি চুপ করে গেল। মানিক মিয়া দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, “একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে, রুচির দুর্ভিক্ষ কোথায় গিয়ে পৌঁছালে বিবাহিত ছেলেদের দিকে নজর দিতে পারে! ভাবতেই পারছি না!”
“আপনাকে এসব কথা কে বলেছে জানি না। তবে যে-ই বলুক মিথ্যা বলেছে। মা আমাকে বিয়ে দেবার জন্য এমন কিছু বলবে তা আমি আশা করিনি।”
মানিক মিয়া হাসলেন। অদ্ভুত গলায় বললেন, “মা’কে দোষ দিয়ে লাভ হবে না। সে আমায় কিছু বলেনি।”
“তাহলে কে বলছে?”
“মহিউদ্দিন সাহেব বলেছেন। ওই বাড়িতে যেসব কুকীর্তি করেছ সে-সবই বলেছেন। ভাবতেই পারছি না। কিভাবে এতটা নিচে নামতে পারলে? কিভাবে একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলার ক্ষ’তি করার কথা ভাবলে? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে? গায়ের র’ক্ত পানি করা টাকায় পড়াশোনা করিয়ে এই শিখিয়েছি?”
মিলি মাথা নিচু করে ফেলল। নরম গলায় বলল, “মনের কথা শুনেছি আব্বা। মনের ওপর কখনও জোর খাটানো যায় না।”
মানিক মিয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। কষিয়ে মিলির গালে একটা থা’প্প’ড় মা’র’লে’ন। মিলি একটু দূরে ছিটকে পড়ে গেল। তার মা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এসব কি করেন? সোমত্ত মেয়ের গায়ে কেউ হাত তোলে?”
“ইচ্ছে করছে গলা চে’পে মে’রে ফেলি। তোমার মেয়ে কি বলে জানো? সে হাবিবকে পছন্দ করে, নিজের মনকে আটকাতে পারেনি। ওই বাড়িতে গিয়ে নববীর ক্ষ’তি করার চেষ্টা করেছে। বিকেলবেলা মহিউদ্দিন সাহেব ডেকে নিয়ে সব বললেন। ছিঃ ছিঃ! লজ্জায় আমার মাথা কা’টা যাচ্ছিল।”
ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকাল। শক্ত হাতে মিলির মুখ চে’পে ধরে বলল, “তোর বাপ এসব কি বলছে? তুুই তোর বান্ধবীর সাথে যাসনি? হাবিবদের বাড়িতে গিয়েছিলি?”
মিলি চুপ করে রইল। মানিক মিয়া বলল, “এসব করতে তোর লজ্জা করে না? কেন করছিস এসব? হাবিব তোকে পছন্দ করে?”
“হাবিব পছন্দ করলে কি তোমরা আমার কথা মেনে নেবে?”
মিলির মা বলল, “কি শুরু করেছিস মিলি? কোন সুস্থ মানুষ কি এসব করতে পারে?”
মিলি বিড়বিড় করে বলল, “আমি সুস্থ নই, সুস্থ নই। আমি অসুস্থ, খুব অসুস্থ।”
রাতে আর কারো খাওয়া হলো না। খাবার-দাবার ওভাবেই পড়ে রইল। মানিক মিয়া খালি পেটে দুটো প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লেন। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তিনি এই কাজ করলেন। তার মাথার ভেতর সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা হচ্ছে।
মিলি দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে বসে আছে। বসে আছে অনেকটা স্তম্ভিত ভঙ্গিতে। তার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি জ্বলজ্বল করছে।
রাতের সময় সংখ্যা হিসাবে সবার জন্য সমান হলেও অনুভূতির হিসাবে এক নয়। কখনও তা চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়, কখনও বা যুগ-যুগান্তরের মত দীর্ঘ। মিলির মনে হলো- এমন দীর্ঘ রাত তার জীবনে এর আগে কখনও আসেনি। রাতভর বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে শেষ রাতে তার চোখে ঘুম নামল। বাইরে হালকা বাতাস বইছে। মাঝেমধ্যেই গাছের পাতায় সড়সড় শব্দ হয়। নববী চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নাইমা জেগে উঠে তার গায়ে হাত রাখল। ব্যস্ত গলায় বলল, কি হয়েছে? শরীর ঠিক আছে?”
নববী লম্বা শ্বাস নিলো। খানিকটা সময় চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।”
“চিন্তা করো না। সব ঠিক আছে।”
নাইমা নববীকে জড়িয়ে ধরল। পিঠের ওপর হাত রেখে অসম্ভব কোমল গলায় বলল, “সব ঠিক আছে। শান্ত হও।”
“তোমার ভাই, তোমার ভাইকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।”
“স্বপ্ন স্বপ্নই হয়। বাস্তবে এর কোন ব্যাখ্যা হয় না। চিন্তা করো না।”
“আমি দেখলাম- একটা কালো ছায়া ওকে আমার থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি খুব করে ছুটছি। নাগাল পাচ্ছি না।”
“এমন কিচ্ছু হবে না। তুুমি ভাইয়াকে কল দিয়ে কথা বলো। আমি পানি নিয়ে আসছি। ঘরে পানি নেই, শেষ হয়ে গেছে।”
নববী মোবাইল হাতে নিয়ে হাবিবকে কল দিলো। হাবিব ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “কোন সমস্যা হয়নি তো? এত ভোরে কল দিলে?”
নববী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তেমন কিছু হয়নি। তোমাকে খুব মনে পড়ছিল।”
তারা নিজেদের মত করে কথাবার্তা চালিয়ে গেল। নাইমা এসে পানি দিয়ে আবার চলে গেল। দীর্ঘ সময় কথা বলার পর হাবিব বলল, “রেডি হতে হবে। বাদশা ভাই ডাকতে এসেছে।”
নববী তাকে বিদায় জানিয়ে কল কে’টে দিলো। তার মন ভালো হয়ে গেছে আর ভয় লাগছে না।
সারাদিনের কাজের পর তারা তিনজন হোটেলে ফিরল। বাদশা বলল, “ফ্রেশ হয়েই খেতে আসবেন। আজ দেরি করতে পারব না।”
চন্দ্রাস্ত পর্ব ৪
হাবিব তার কথা অগ্রাহ্য করতে পারল না। তড়িঘড়ি হাত-মুখ ধুয়ে রেস্তোরাঁয় চলে গেল। হোটেলের সাথেই রেস্তোরাঁ, হোটেলে যারা ওঠে সবাই এখানেই খাওয়াদাওয়া করে। হাবিব দেখল- দু’জন এখনও আসেনি। সে এক কোণার দিকে একটা টেবিলে বসল। মিলি তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “হাবিব ভাই? কেমন আছেন?”
হাবিব চমকে তার দিকে তাকাল। মিলি হাতকাটা জামা পরছে, ঠোঁটে গাড় কমলা রঙের লিপস্টিক, চুল খোলা। হাবিব চোখ ফিরিয়ে নিলো। বলল, “তুমি এখানে?”
মিলি কথার জবাব দিলো না। শুধু হাসল। সেই হাসি দেখতে ভালো লাগল না।