অনুভুতির অন্তরালে গল্পের লিংক || ইফা আমহৃদ

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১
ইফা আমহৃদ

— “মামুনি! ও মামুনি, কোথায় তুমি? তোমার ছেলে আজকে সবার সামনে আমার গালটাকে মেরে খাল বানিয়ে দিয়েছে। কি বলবে না তুমি?”

হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বললাম আমি। তদানীং আমার পেছনে এসে দাঁড়ালেন মহাশয়। পেছন থেকে বেনুণী টেনে ধরলেন। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলাম এবার। পুনরায় মামুনি বলে চিৎকার করে উঠলাম। মামুনি খুন্তি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কিচেন থেকে। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগে অরিশ ভাইয়া দূরত্ব বজায় রেখে সরে দাঁড়ালেন আমার থেকে। ভদ্র ছেলের মতো দুহাত সামনে রেখে ঠিকঠাক হলেন। মামুনি অরিশ ভাইয়াকে এতো শান্তশিষ্ট দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। কেন জানি ভাইয়ার এমন ভাবাবেগ সহ্য হলো না আমার। আজ নয় কোনো কালেই সহ্য হয়না। মুখের ভঙ্গিমা বদল করে, ছলছল নয়নে বললাম..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “মামুনি, দেখ এই গালটায় দুটো চড় মেরেছে‌। লাল হয়ে গেছে। এখন তোমার কাছে বিচার দিয়েছি তাই আবার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলেছে। তোমার বিশ্বাস না হলে ভাইয়ার হাত দেখো।”
মামুনি অরিশ ভাইয়ার দিকে রুদ্ধ চোখে তাকালেন। খুন্তি তুলে বললেন..
— “অরিশ এই বয়সে কি মার খেতে চাস? কেন বারবার মেয়েটার পেছনে লাগিস বল তো?”

মামুনির কথায় এবার কান্না পেয়ে গেল আমার। বরাবারই কেউ আমার হয়েছে কথা বললে এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। আজকেও তার ব্যাতিক্রম নয়। এগিয়ে গিয়ে মামুনিকে জড়িয়ে ধরলাম। হাউ মাউ করে নাকে কান্না শুরু করে দিলাম। আমার এই কান্না নতুন কিছু নয়, সবাই বেশ পরিচিত। বিরাগী হয়ে মামুনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন..– “তুমি আমার মা, না-কি তরীর?”

ধপাধপ পায়ে হেঁটে উপর থেকে মামা নেমে এলেন। এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, কিছু একটা হয়েছে। দূর থেকে আমাদের পর্যবেক্ষন করে এগিয়ে এলেন তিনি। অরিশ ভাইয়ার কাঁধে চপল মেরে বলল..
— “মাইয়া মানুষ মানেই ছিঁচকাদুনে। কিছু হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেয়‌। তোর মায়ের কাছে থাকতে থাকতে তরীরও একই অবস্থা হয়েছে।”

এতেই যেন অতিশয় ক্ষোভে ফেটে পড়লেন মামুনি। খুন্তি তুলে বললেন..
— “ভাইয়া মানুষ মানে কি? বেশ তো ছিঁচকাদুনে মাইয়া মানুষের রান্না খেতে হবেনা, রান্না করে খাও..
বলেই খুন্তি হাতে নিয়ে তেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। মামা টলমলে নয়নে অবলোকন করলো। ইমোশনাল হয়ে কি থেকে কি বলে দিয়েছে হিসেব নেই তার। এখন পড়লেন মহা মুশকিলে। যেমন ধপাধপ পায়ে হেঁটে এসেছিলেন, তেমন ধপাধপ পায়ে হেঁটে প্রস্থান করলেন। বাকি পড়ে রইলাম আমি আর অরিশ ভাইয়া। তাকে ভেংচি কেটে যেই-না উপরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম অমনি কান টেনে আটকে দাঁড়ালেন। চিৎকার করতে চাইলে মুখ চেপে ধরলেন। হুমকি দিয়ে বললেন..– মুখ থেকে আরেকটা স্বর বের হলে, এখানে সব ফাঁস করে দিবো? তাড়াতাড়ি ব্যাগপত্র নিয়ে আমার রুমে আয়!

তার হুমকি শুনে ফিচেল হাসলাম আমি। তিনিও বত্রিশ পাটি মেলে দিলেন। আমার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে চলে গেলেন তিনি, রেখে গেলেন এক আকাশ সমপরিমাণ দূশ্চিন্তা।
ফ্লাসব্যাক___

আমি তরী। বাবা মা নেই বললেই চলে। আমার জন্মের সময় রক্তশূন্যতায় পৃথিবীর ছেড়েছেন তিনি। বাবা থেকেও নেই। ছোট বেলা থেকে মামা মামুনির কাছে মানুষ হয়েছি। আছে একটা বড় ভাই। তার নাম তারুণ্য। মায়ের মৃত্যুর পূর্বে ঠিক করে রেখেছিলেন, তরী তারুণ্য। তিনি হার্ট সার্জন। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন শেষবার তার মুখ দেখেছিলাম। এখন অবশ্য মনে নেই। তবে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু চাইবা মাত্র হাজির।

অরিশ ভাইয়া আমার মামাতো ভাই। ইভেন্ট আমাদের ভার্সিটির প্রোফেসর। দ্বিতীয় ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে বসে আছি আমি। আমার সন্নিকটে বন্ধুমহল। নুডুলস খাচ্ছি বসে বসে। আমার খাওয়ার মাঝেই চোখজোড়া আটকে গেল অদূরে অরিশ ভাইয়ার দিকে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতের একটা ডাইরী। রোদ্দুরের মাঝে শার্টটা এক প্রকার লেপ্টে আছে শরীরে। ললাটে বিন্দু বিন্দু জল কণা। ফর্সা মুখটা রোদে লালচে আঁকার ধারণ করেছে। তবুও রোদের মাঝখানে দাড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বরাবরই ভার্সিটিতে থাকাকালীন ভাইয়ার হাতে ডাইরীটা থাকে। এই ডাইরীটায় ক্লাসের সবকিছু নোট করে রাখেন আর বাড়িতে এনে আমার উপরে ঢেলে দেয়। মানে সবগুলো মুখস্থ করায়।

আমাদের ভার্সিটির আরেক-ম্যাম নিশি। ভাইয়ার সাথে কথা বলছেন। কথা বলাটা সামান্য পরিমাণে থাকলেও চলতো, কিন্তু মেয়েটা গায়ে হাত দিচ্ছি। ভাইয়াকে ম্যামের সাথে দেখে মাথা রক্ত উঠে গেল আমার। আমার সামনের টেবিলে একটা পিচ্চি বেলুন ফুলাচ্ছে। দুষ্টু বুদ্ধি এলো মাথায়। দুটো বেলুন ফুলিয়ে নিলাম। কামিজ ভেদ করে পেটের উপর রেখে ওরনা দিয়ে ঢেকে নিলাম। এবার আমাকে দেখতে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা লাগছে। ক্যান্টিনের সবাই আমার দিকে সন্দিহান নয়নে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে এগিয়ে গেলাম ভাইয়ার দিকে। দুইজন আমাকে দেখে নিজেদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কদাচিৎ ফাঁক হয়ে আছে ভাইয়ার মুখ। আমি হাত জড়িয়ে ধরলাম অরিশ ভাইয়ার। ইনোসেন্স ফেইস করে বললাম..

— “বাবুটা তখন থেকে চকলেট খেতে চাইছে আর তুমি এখানে এসে দাড়িয়ে আছো জানেমান। আমরা কিন্তু তোমার সাথে কথাই বলবো না।”
ভাইয়া এবার অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। ঠোঁট চেপে শব্দহীন হাসলাম আমি। ভাইয়ার ব্যবহৃত চশমাটা খুলে নিজের চোখে পড়ে নিলাম। আঢ় চোখে তার দিকে অবলোকন করলাম। এতোক্ষণ পড়ে মুখ খুলে বললেন..
— “অরিশ, এই বাচ্চা মেয়েটা কে?”

আপনাআপনি কোটর থেকে বেরিয়ে এলো আমার আমার চোক্ষুজোড়া। বাচ্চার মা সাজতে এসে শেষে কি-না বাচ্চা হয়ে গেলাম। ইচ্ছে তার চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলি। জেদ ধরে অরিশ ভাইয়াকে দেখিয়ে বললাম..
— “এইযে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখছো? তার বাচ্চার মা..

আর কিছু বলার আগেই সেই পিচ্চি ছেলেটা চলে এলো আমাদের মাঝে। আমার পেটের দিকে ইশারা করে বলল..
— “এই মেয়েটা আমার বেলুন নিয়েছে ভাইয়া।”
ছেলেটা এগিয়ে এসে বেলুন নেওয়ার চেষ্টা চালালো। হলো তার বিপরীত। বেলুনটা ফুটে গেল। সাথে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। অরিশ ভাইয়া তেড়ে তাকালেন আমার দিকে। নিশি নামক মেয়েটা তো ইতিমধ্যে হা হা করে হেঁসে উঠেছে। ছেলেটাকে থামাতে মৃদু শব্দে চপল মারলেন আমার গালে। এতেই কাজ হয়ে গেল।

লাইভ কনভারসেশন চলছে। দেখায় মন দিয়েছে আরশি। নয়ন জোড়া নিবন্ধ টিভির মাঝে। পৃথিবীর সব ধ্যান ভাবনা টিভির ছেলেটিকে নিয়ে। রুমে প্রবেশ করলাম আমি। আরশিকে এভাবে টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালাম। অপূর্ব আহসান-কে নিয়ে কি পেয়েছে মেয়েটা বোঝার চেষ্টা চালালাম। এই কনভারসেশন দেখবে বলে আজকে ভার্সিটিতে যায় নি। শুধু সে নয় অনেকেই অনুপস্থিত ছিল। আমার জল্পনা কল্পনার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো আরশি। অধর ছুয়ে দিলো টিভির গ্লাসের উপর। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত অপূর্বের জায়গায় অন্য একটা মোটা সোটা কালো লোক ছিলো। নাক ছিঁচকালাম আমি। বললাম..

— “ছিঃ ছিঃ। শেষে কিনা চাচাকে
আরশি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে আমার সামনে এসে বসলেন। মুখ কালো করে বলল..
— “এই অপূর্বের একটা ছবিও কোথাও পেলাম না। এতো দিন অপূর্ব মনে করে যে ছেলেটার সাথে কথা বলেছি, সেটা এখন জেলের আলু পরোটা খাচ্ছে। একটু পর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এই ভিডিওটাও ডিলেট করে দিবে।
একবার এই ছেলেটাকে হাতের মুঠোয় পাই, বিয়ে না করে ছাড়বো না। ছাড়বো না মানে ছাড়বো না।”
শেষে কথাটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে সে। অতঃপর বেডের উপর উঠে সাউন্ড সিস্টেম চালু করে শুরু হয়ে গেল তার নাচ।

এদিকে টেনশনে পড়ে গেলাম আমি। একটু পরে আমাকে না পেয়ে মহাশয় নিজে এসে হাজির হবে। আমার ভাবতে দেরী ওমা তার আস্তে দেরী হলো না। সাউন্ড সিস্টেম টা অফ করে সামনাসামনি দাঁড়ালেন আমার। আমাকে তার রুমে যেতে বললেন।

— “তাড়াতাড়ি রুমে আয়। খবরদার আমাকে যেন আসতে না-হয়।”
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড় লাগালাম তার রুমের দিকে। ভেতরে ভয়ে ভয়ে কম্পিত হচ্ছি বারবার। খবরদার শব্দটি সচরাচর ব্যবহার করেন না। একবার ব্যবহার করলে, তার অন্যথা হয় না।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২