প্রণয় বিরহ পর্ব ১৬

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৬
অর্ষা আওরাত

সময় বহমান। সে চলে যায় তার নির্দিষ্ট গতিতে। অপেক্ষার প্রহর গুনে না কারো জন্য। দেখতে দেখতে দশ দিন কেটে গেছে। ইহাদ ভাইয়া আর তার বউও চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে আরো অনেকদিন আগেই। আসি যথাসম্ভব তাদের থেকে দূরে রয়েছি। কোনো দরকার ছাড়া কারো সাথে কথা বলি না।

আর প্রিমা আপুকে এই বাড়িতে আসা পর্যন্ত দেখে যাচ্ছি রুমেই থাকে সর্বক্ষন!এতোক্ষন একলা একলা কি করে রুমের ভেতর আল্লাহই জানে। ঝেঠু কাউকে কিছু বলতে বারন করেছে কারন সে নতুন বউ তাকে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন। আমিও আর সেসব দিকে খোঁজ খবর রাখতে যাইনি। কারন আগের বার যখন বলতে গেছিলাম তখন খারাপ আমিই হয়েছি তাই এবার যথাযথ প্রমান সহ বলবো যদি কিছু বলি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি রুমে বসে আছি বৃষ্টি আপুর জন্য আপুকে সেই কখন আসতে বলেছি একটু গল্প করবো বলে আপু আসছে না দেখে সোফায় অলস ভঙ্গিতে বসে রয়েছি।

ওদিকে বৃষ্টির একটা ফোন আসা জুঁইয়ের রুমে আসতে দেরি হয়ে যায়। জুঁইয়ের রুমে আসার আগে ইহাদের রুম পড়ে তারপর জুঁইয়ের রুম। বৃষ্টি ইহাতের রুম ক্রস করে জুঁইয়ের রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখনি কিছু কথা কানে এসে বাজতেই বৃষ্টি থমকে দাঁড়ায়। দরজা ভেজানো পুরোপুরি লাগানো হয়নি। বৃষ্টি দরজার একটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে প্রিমার কথা বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে,

–“তুমি কিচ্ছু চিন্তা করো না বেবি! আমি ঠিক ইহাদকে বুঝিয়ে আমাদের কার্য হাসিল করে তবেই এই বাড়ি থেকে বিদেয় হবো। শুধু তিন মাস হয়ে যাক। আমার উদ্দেশ্য যে*
বৃষ্টির হাত লেগে ফুলদানীটি মাটিতে আছড়ে পড়ে যেতেই বিকট জোরে শব্দের সৃষ্টি হয় যার ফলে প্রিমা চুপ করে যায়! বৃষ্টি তড়িঘড়ি করে জুঁইয়ের রুমে গিয়ে একেবারে দরজা বন্ধ করে দেয়! বৃষ্টিকে এভাবে হাঁপাতে দেখে জুঁই বলে ওঠলো,
-“আপু কি হয়েছে তোমার? এভাবে হাঁপাচ্ছো কেনো তুমি?”

বৃষ্টিকে আর কিছু জিগেস না করে জগ থেকে ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয় বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি পানি খেয়ে দম নিয়ে বলতে লাগলো,
-“ইহাদ ভাইয়ার বউ ওই প্রিমা ওই মহিলা সুবিধার নয় রে! ওর অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ইহাদ ভাইয়াকে বিয়ে করার পিছনে যা সবার অজানা।”

বৃষ্টি আপুর কথা শুনে আমি একটুও চমকালাম না। কারন আমিতো কিছুটা হলেও টের পেয়েছি। শুধু উপযুক্ত প্রমানের অভাবে কাউকে কিছু বলতে পারছি না! আমাকে এমন আগের ন্যায় থাকতে দেখে আপু বলে ওঠলো,
–“এতো বড়ো একটা খবর দিলাম অথচ তুই এমন ভাব করে বসে আছিস যেনো তুই সবকিছুই জানতিস আত থেকে?”
–“সবকিছু না জানলেও কিছু তো জানতাম আপু।”

আমার কথার মানে যে আপু বুঝতে পারছে না সেটা আপুর চোখমুখ দেখেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। আপুর চিন্তা না বাড়িয়ে সবকিছু খুলে বললাম আপুকে। সবকিছু শোনার পর বৃষ্টি আপু কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর কিছুক্ষণ পর বললো,
-“তাহলে তো উপযুক্ত প্রমান ছাড়া আমাদের কথা কেউই বিশ্বাস করবে না।”
-“হ্যাঁ সেই জন্যই আমি চুপ করে আছি। সঠিক সময়ে ওই ভাবীর আসল রুপ বেরিয়ে আসবে তখন।”

বিকেলের দিকে মিসেস লুৎফা বেগম মানে ইহাদের মা ইহাদের রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন প্রিমাকে ডাকবার উদ্দেশ্য। রুমে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন প্রিমা আয়েসি ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন টিপছে! ওনি রুমের ভিতর গিয়ে বললেন,

–“প্রিমা নতুন বউ বলে কিছু বলিনি এতোদিন। আজকে আমার মা মানে তোমার নানী শাশুড়ি তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে। তাই অগ্রাহ্য না করে ওঠে আসো নিচে তাড়াতাড়ি।”
প্রিমা তার শাশুড়ী মায়ের কথার পৃষ্ঠে বলে ওঠলো,
-“কিন্তু মা তুমি তো জানোই আমি রান্না বান্না কিছুই পারি না।”

–“জানি না বললে তো হবে না। শিখে নিতে হবে তোমাকে। মানছি বাবার বাড়িতে কাজকর্ম করো নি কিন্তু এটা যে শশুর বাড়ী তাই সেটা মাথায় রেখো।”
প্রিমা কিছু বলবে তার আগেই ইহাদের মা রুম থেকে চলে গেলো আর ইহাদ রুমে প্রবেশ করেই প্রিমার বিরক্তকর চোখ মুখ দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
-“কি হয়েছে প্রিমা? মা কিসের জন্য রুমে এসেছিলো?”

–“কি জন্য আর আসবে বলো? এসেছে এক গাদা কাজ নিয়ে! তোমার নানীমা এসেছেন তার জন্য এখন আমাকে রান্না করতে হবে! যেখানে আমি কিনা আমার বাড়িতে সামান্য চা করেও খাইনি আর আজ আমাকে রান্না করতে বলা হচ্ছে!”
-“ঠিক করে কথা বলো প্রিমা! আমার নানী আমাকে অনেক ভালোবাসে সেক্ষেত্রে ওনার নাতবউয়ের হাতের রান্না খেতে চাওয়া বোধহয় অপরাধের কিছু না আমি মনে করি।”

-“কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো আমি এসব কাজ করতে পারি না ইহাদ।”
–“হ্যাঁ ধরেই পারবে না কিন্তু চেষ্টা করতে অসুবিধা কি? তুমি চেষ্টা করো নিশ্চয়ই একদিন সফল হবে।”
প্রিমা আর কোনো কিছু না বলে ইহাদের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলো নিচে! নিচে যেতেই ইহাদের মায়ের কথা অনুযায়ী ওযের্স্টান ড্রেস বদলে শাড়ি পড়ে আসার কথা বলতেই প্রিমা রাগে গজগজ করতে রুমে চলে আসে! রুমে আসতেই ইহাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়,

–“নিচে গিয়ে আবার ফেরত চলে আসলে কেনো?”
–“কি করবো আর! আমাকে তো তোমার মায়ের কথা মোতাবেক আর্দশ বউমা হতে হবে না? ওনার নাকি এই ড্রেস চলবে না তাইতো এখন রুসে এসেছি শাড়ি পড়তে!”
–“ঠিকআছে তোমার যখন এতোই অসুবিধা তাহলে তুমি থ্রি পিস পড়ে নাও। বিয়েতে তো উপহার পেয়েছো? সেখান থেকেই পড়ে নাও যেকোনো একটা।”

ইহাদ আর কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওদিকে প্রিমা রাগে গিজ গিজ করতে করতে থ্রি পিস পড়ে নিচে যায় রান্না করতে। নিচে যেতেই দেখতে পেলো ইহাদের মা আগ থেকে মাছ কুটে ধুয়ে রেখেছে সব্জি ও কুটে দিয়েছে।
-“প্রিমা তুমি তো কিছুই পারো না। সেক্ষেত্রে আমি তোমাকে সব্জি আর মাছ কুটে দিয়েছি এবার এরপরে বাকিটা তোমাকেই করতে হবে আমরা আর হেল্প করতে পারবো না। এবার শোনো রান্না কীভাবে শুরু করবে প্রথমে মাছ ভেজে নিবে……………..(রেসিপি জানিনা ?)

ইহাদের মা প্রিমাকে রান্নার সব পদ্ধতি বলে দিয়ে রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। প্রিমা তার শাশুড়ীর কথা অনুযায়ী প্রথমে মাছ ভাজতে গেলো। তেল গরম হওয়ার পরেই প্রিমা মাছ দূর থেকে কড়াইতে ছুঁড়ে দেওয়ায় গরম তেল এসে ছিটকে পড়ে প্রিমার হাতে! সঙ্গে সঙ্গে প্রিমা চিৎকার দিয়ে ওঠে! প্রিমার চিৎকারের আওয়াজ শুনে বাড়ির সবাই জড়ো হয় রান্নাঘরে। রান্নাঘরে প্রিমার হাত লাল দেখে বুঝতে বাকি রইলো না আর কি হয়েছে। ইহাদের মা বলে ওঠলো,

–“প্রিমা আমি তোমাকে বলেছিলাম যে তেল কাছ থেকে আস্তে দিতে হয় তুমি নিশ্চয়ই দূর থেকে দিয়েছো যার ফলে মাছের গরম তেল ছিটকে এসে পড়েছে তোমার হাত!”
প্রিমা কাঁদতে কাঁদতে বললো,

–“আপনারাই বা কোন আক্কেলে আমাকে রান্না করতে বলেছেন শুনি? সবাই তো বেশ ভালো করেই জানেন আমি রান্না পারি না তারপরেও ইহাদের নানীর জন্য আমাকে রান্না করতে বলছেন! আপনারাইবা কেমন মানুষ শুনি? আমি পারবো না কোনো রান্না করতে যার মন চাবে সে করে নিবে””

প্রিমা আর কোনো কিছু না বলেই হনহনিয়ে উপরে নিজের রুমে চলে গেলো! ওদিকে ইহাদ প্রিমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে! সে ভাবতে পারেনি প্রিমা কার মায়ের সঙ্গে এরকম ভাবে ব্যবহার করবে। ইহাদের বাবা এর মাঝেই বলে ওঠলো,

-“ইহাদ দেখলে তো এবার? তোমার বউ ঠিক কীরকম ব্যবহার করলো তোমার মায়ের সাথে! সে নতুন বউ বলেই এই দশ দিন আমরা তাকে কোনো কিছুই করতে বলিনি। সে নিজের মতন ছিলো কিন্তু আজকে শুধু তোমার নানীমার জন্য রান্না করতে বলেছি আর এই ব্যবহার তার?”
ইহাদ লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখে বললো,
–“প্রিমার হয়ে আমি তোমাদের সকলের কাছ থেকে হাতজোর করে ক্ষমা চাইছি। দয়া করে তোমরা ওকে ক্ষমা করে দিও।”

ইহাদের কথায় কেউ কোনো প্রিতউত্তর না করে নিজের মতন করে চলে গেলো! ইহাদ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে গিয়েই দেখতে পেলো প্রিমা হাতে মলম লাগাচ্ছে। ইহাদ বলে ওঠলো,
–“হাতের ক্ষতস্থানের অবস্থা কিরুপ?”

-“আপাততো মলম লাগিয়েছি ইহাদ কিন্তু জ্বালা এখনো কমেনি পুরোপুরি ভাবে। এখনো জ্বালা করছে।”
-“একটু পড় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু প্রিমা তোমার হাতের ক্ষত না হয় ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তুমি তোমার উশৃংখল ব্যবহার দিয়ে যে সবার মনে ক্ষতের সৃষ্টি করলে তার কি হবে?”
–“তুমি কি বলতে চাচ্ছো ইহাদ? স্পষ্ট করে বলো?”
ইহাদ প্রিমার কাছে গিয়ে বললো,

–“তোমাকে সামান্য রান্নাই করতে বলা হয়েছিলো তুমি তার জন্য কতো কথা শোনালে সবাইকে? এমনকি মা’কে আঘাত করে কথাও বললে এগুলো কি খুব প্রয়োজন ছিলো?”
–“ও তার মানে তুমি ওদের কথা দেখলে কিন্তু আমার যে হাত পুড়ে গেলো সেটা তো একবারও দেখলে না?”
–“শোনো প্রিমা তোমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর কোনো মেয়ে এরকম আয়েসি ভঙ্গিতে জীবন কাটায় না কিন্তু তুমি এতোদিন সেইভাবেই ছিলে! তাও আজ সামান্য রান্না করা নিয়ে কতো কান্ড করে দিলে! তুমি এক্ষুনি মা’য়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে প্রিমা!”

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৫

–“তুমি বললে আরই হলো নাকি ইহাদ! কি রকম মন মানসিকতা তোমার আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছো? এখন তো মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে আমার।”
–“তুমি ক্ষমা চাইবে মানে চাইবে প্রিমা আর কোনো কথা নয় যা হবে তার পরে!”
ইহাদ আর কোনো কিছু না বলে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো! বেরিয়ে যাবার আগে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলো! ওদিকে প্রিমা দরজা বন্ধ করে রুমে বসে কাউকে ফোন করতে লাগলো।

প্রণয় বিরহ পর্ব ১৭