অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২
ইফা আমহৃদ

সেই কখন থেকে কান ধরে উঠবস করে যাচ্ছি। অরিশ ভাইয়া গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে উঠবস থামিয়ে দিবো, তার কোনো উপায় নেই। অরিশ ভাইয়ার ডান হাতে স্টিলের স্কেল। যদি এখানেও ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ হতো ঠিক আছে। না, তেমন কিছু হলো না। পকেট থেকে নিজের মুঠোফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে দিলো।

আমি সিউর, এই ভিডিও দিয়ে পরেরবার আমাকে ব্লাকমেইল করবে। আমি কিছুতেই এমন হতে দিবো না। তট জলদি কান ছেড়ে পা নামিয়ে উল্টো ঘুরে সর্বশক্তি দিয়ে দিলাম দৌড়। এতে হয়তো ভাইয়ার সহ্য হয়নি‌। হাতের মাঝে বন্দী স্কেলটা ছুঁয়ে মারল আমার পায়ের পাতা বরাবর। সাথে সাথে পায়ের টাকনুতে লেগে থেমে গেল চরণ। আঘাতপ্রাপ্ত হলো চরণ। পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়লাম নিচে। ব্যাথায় চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো আমার। ফোঁপাতে ফোঁপাতে তার দিকে তাকাতেই ক্ষোভে পূর্ণ হয়ে এলো শরীর। সামান্য একটুর জন্য আমাকে এভাবে আঘাত করতে পারল।
অরিশ ভাইয়া উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে এগিয়ে এলো দুকদম। মাটি থেকে স্কেল-টা তুলে নিলো। এক হাঁটু গেড়ে ভাঁজ করে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “পালাতে চেয়েছিলি না, পালা এবার। যা পালিয়ে যা। আমার কথার অবাধ্য হলে এর চেয়ে ভয়ংকর ফলাফল হয়। এবারের মতো এইটুকু, পরের বার আরো..
সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। ব্যাথায় আমার অবস্থা শোচনীয় আর তিনি ভাষণ দিচ্ছে। একবার যাই এখানে থেকে আর আসবো না। অম্বুতে পূর্ণ হলো আঁখি জোড়া। তার অগোচরে মুছে নিলাম। মাটিতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম। সক্ষম হলো না। পায়ের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম। পড়ে গেলাম নিচে।

আমার অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসলেন তিনি। মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন। নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে গলা জড়িয়ে ধরলাম তার। একদম কাছাকাছি মিশে গেলাম আমি। আরো একবার ক্রাশ খেলাম তার সৌন্দর্যে। আমি যখন তার ভাবনার বিভোর তৎক্ষণাৎ তিনি ফেলে দিলো বেডের উপরে। কোমড়ে ব্যাথা পেলাম খানিকটা। সূচালো চোখে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। তিনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলল..

— “আই নো দ্যাট, আমি দেখতে সুন্দর। তাই বলে এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। শুধু শুধু নজর লেগে যাবে। এখন নজর ফোঁটা পড়তে পারব না।”
ভেংচি কাটলাম আমি। অরিশ ভাইয়া কাবার্ড খুলে মলম নিয়ে এলো। মলমটা স্বযত্নে পায়ে লাগিয়ে দিলেন। শেষে ওয়ান টাইম লাগিয়ে দুগালে চাপ দিলো। হাত সরালো না। গালে হাত রেখেই বললেন..
— “এভাবে গাল ফুলিয়ে রাখতে নেই পিচ্চি, তোকে দেখতে ভয়ংকর লাগে। তিন আঙ্গুলের বাচ্চাদের এতো ভয়ংকর হতে নেই।”

এতেই যেন আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলাম। ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম..
— “একদম আমাকে তিন আঙ্গুলের পিচ্চি কিংবা বাচ্চা বলবেন না। আমি মোটেও তিন আঙ্গুল নই। তাছাড়া আমি গাল ফুলাবো, নাক ফুলাবো যা ইচ্ছে তাই ফুলাবো। তাকে আপনার কি?”
এতে তার কপাল যে কুঁচকে গেছে বেশ বুঝতে পারছি। যেই আপনি ডাকার জন্য আমাকে শাস্তি দিলো, সেই আপনি ডেকে ফেললাম। তবে এটাই আমার বৈশিষ্ট্য। কারো সাথে রাগ করলে তাকে আপনি বলে সম্বোধন করি। আমি মনে করি, তুমি আর তুই বলে সম্মোধন মানুষকে প্রিয় করে তোলে। আপনি সম্মোধন পর পর লাগে।
আমার ভাবনায় ছেদ ঘটল তখন, যখন অরিশ ভাইয়া আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। তেলের বোতলটা হাতে এগিয়ে দিয়ে দিয়ে বলল..

— “এখন তো আর কান ধরে উঠবস করতে পারবি না। তারচেয়ে বরং বসে বসে তোর ছোট হাতে আমার মাথায় তেল দিয়ে, হাত বুলিয়ে দে..! এটা তোর শাস্তি।”
অতঃপর তিনি নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। এটা নতুন কিছু নয়, মাঝে মাঝে তিনি আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে আর আমি তার চুলগুলো সানন্দে টেনে দেই। তার ধারণা আমার এই ছোট হাতজোড়া তার মাথায় রাখতে, তিনি সকল ক্লান্তি থেকে অবসর পায়। কিন্তু আমার হাত মোটেও ছোট না।
আমিও কথা বাড়ালাম না। হাতে তেল নিয়ে প্রতিটি চুলের ভাঁজে লাগিয়ে দিতে লাগলাম। এই কাজটা করতে বরাবরই আমার খুব ভালো লাগে।

ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে গভীরতম হচ্ছে। নিদ্রায় নয়নজোড়া মেলে রাখা দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার জন্য। ততক্ষণে হয়তো ভাইয়া গভীর তন্দ্রায় মগ্ন হয়ে গেছেন। মাথাটা হেলিয়ে দিলাম বেডের কিনারায়। হাই তুলে লোচন যুগল বন্ধ করে নিলাম। হাতজোড়া তখনও নির্বিকার ভাবে অরিশের চুলে বন্দী। হাতজোড়া খসে পড়লো নিচে। কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম, জানা নেই।

ভোরের প্রথম সোনালী আলো
স্বপ্ন নতুন জাগিয়ে গেলো,
শিশির ভেজা ঘাসের পাতায়,
তোমার হাতের আলতো ছোয়ায়,
ফুটলো সকাল কাটলো রাত,
তাই মিস্টি মুখে জানাই তোমায়
“সুপ্রভাত”

সূর্যের উত্তাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বাইরের উষ্ণ হাওয়া জানালা ভেদ করে ঘরে উঁকি দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ করতে করতে ৯টার কাঁটা ছাড়িয়ে। মধ্য রাতে ঘুমানোর ফলে এখনো ঘুম গভীর। হঠাৎ মুখের উপর পানি পড়াতে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। সামনেই অরিশ ভাইয়া ফাঁকা গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে বাকি নেই, গ্লাসের বাকি পানিটুকু আমার দেহে। মুখ কুঁচকে বললাম..
— “অরিশ ভাইয়া তুমি আমার রুমে কি করছ?”
— “কানের নিচে চড় পড়লে ঠিক মনে পড়বে। আমি তোর রুমে নয়, তুই আমার বাড়িতে, আমার রুমের, আমার বেডের উপর আরাম করে ঘুমিয়ে আছিস! বুঝলি?

অপমান বোধ হলো আমার। থাকবোই না এই বাড়িতে। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। কিছুদূর গিয়ে মনে পড়লো আমার চুলগুলো খোলা। ফিরে এলাম চুলের কাঁটা নিতে। যতবার আমি অরিশ ভাইয়ার রুমে ভুলে ঘুমিয়ে গেছি, তখনবার কাঁটা হারিয়ে গেছে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু উঁকি দিলাম। অরিশ ভাইয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ না করেই বললাম..

— “ভাইয়া তুমি আবার আমার কাঁটা নিয়েছ? তুমি জানো না, আমার ভাইয়া বাড়িতে নেই। সে না থাকলে কে আমাকে কাঁটা কিনে দিবে?”
হেয়ার ব্রাশ-টা জায়গা মতো রেখে আমার দিকে কয়েকপা এগিয়ে এলেন তিনি। মাথাটা নিচু করে বলল..
— “আমি তো মেয়ে মানুষ, এতোবড় চুল সামলাতে তোর ব্যবহার করা কাঁটা, নিজের চুলের ব্যবহার করি। নে তাহলে খুলে নে.., ডাফার!”
শেষের কথা ধমকের সুরে বলল তিনি। মৃদু কেঁপে উঠলো আমার শরীর। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উল্টো ঘুরে নিজের রুমে চলে এলাম।

সবাই ইতিমধ্যে নাস্তার টেবিলে বসে পড়েছে। আমিও চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। মামনি দুটো পরোটা সাজিয়ে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। চোখের ইশারায় খেতে বলল। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে বড় বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আরশির পায়ের নিউ কালেকশন পায়েল-টা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। ভাইয়াকে বলতে চেয়েও পারি না, তাই ইতোহস্ত নিয়ে বললাম..

— “মামা, আমাকে কিছু টাকা দিবে। আসলে..
কথা শেষ করতে পারলাম না, তার আগেই শোনা গেল তৃতীয় ব্যাক্তির কন্ঠস্বর..
— “দে, দে ওকে তোর সব টাকা দিয়ে দে! অলক্ষী, অপয়া মেয়েটাকে সব দিয়ে দে। না দিলেও সমস্যা নেই। কিছুদিন পরে তোর সব কিছু খেয়ে ফেলবে‌। যেমনটা ওর মাকে খেয়েছে।”

রুটির টুকরো টা মুখে দেওয়ার মতো শক্তিটুকু অবকাশ নেই শরীরে। হাত থেকে খসে পড়লো নিচে। সাথে যোগ দিলো অশ্রু ধারা। গড়িয়ে পড়ার আগেই ক্লান্ত হাতে মুছে নিলাম। আমি কি সত্যিই অপয়া, অলক্ষী। নিজের মাকে শেষ করেছি। আমি তো আমার মাকে নিজের চোখেই দেখেনি, তাহলে কিভাবে খেয়ে ফেলেছি। এখানে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না আমার। খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উপরে যাওয়ার পথে তাদের কথা কানে এলো আমার। মামা বলছেন..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১

— “কিসব বলছো তুমি? কষ্ট পাবে তো! মেয়েটার মা নেই, বাবা থেকেও নেই। বড় ভাই বাড়িতে নেই।”
দিদা তার কথা থেকে নড়লেন না। আরো দুটো পরোটা ছেলের প্লেটে দিয়ে বললেন..
— “ঠিকই তো বলেছি! ওর জন্য ওর মা মরেছে। বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের অশান্তিতে..
ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এলো কন্ঠস্বর। তাদের কথা আর কানে এলো না। বেলকেনিতে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। সব পাখিদের দিন শেষে যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে, কিন্তু আমার সেই জায়গা-টা নেই।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩