অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩
ইফা আমহৃদ

চোখের অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে বইয়ের উপর পড়ছে। খানিকটা ভিজে গেল বইয়ের পাতা। তবুও থামলো না আমার কান্না‌। শব্দহীন চাপা রাখা সেই কান্না। মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে শরীরটা। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ সেই কান্না। একহাতে ফোনটা কর্নপথের কাছে ধরে রাখা, অন্যহাতে বইয়ের লাইন টানছি। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে শোনা গেল ভাইয়ার কন্ঠস্বর..

— “আরে পাগলী কাঁদছিস কেন? খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। তুই যদি এমন করিস তাহলে কিন্তু আর ফিরবো না।”
শব্দহীন কান্নার শব্দ এবার যেন শব্দময় হয়ে উঠলো। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম..
— “আসতে হবে না তোকে! সারাজীবন ওখানে থাক তুই। আমিও যেথায় ইচ্ছে চলে যাবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভাইয়ার সাথে করা বলার মাঝ পথে কারো চরণ ধ্বনি কানে এলো আমার। মাথা তুলে দরজার দিকে অবলোকন করতেই অরিশ ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। সে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে খপ করে ফোনটা নিয়ে লাইন কেটে দিল। আচম্বিতে এমন হওয়াতে মাথার উপর দিয়ে গেল সবকিছু। মুখ ভাড় করে আঙুল তুলে বললাম..
— “ফোন নিয়েছেন কেন আমার? আমার ফোন দিন?”

— “কেন? এতোক্ষণ আমার নামে কেঁদে কেটে সমুদ্র বানিয়ে বিচার দিয়ে বুঝি হয়নি। আরো বিচার দিতে হবে? এতো পানি কোথায় পাস, একটু বলবি? আচ্ছা তোর চোখজোড়া কি প্রশান্ত মহাসাগরে পাইপের সাথে জোড়া দেওয়া।
মাঝে মাঝে মনে হয়, তোর চোখের পানিগুলো একত্রিত করলে তাকেও হার মানাবে।”

ভেংচি কেটে নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলাম আমি। এই লোকটার সাথে কথা বলবো না জীবনেও। কিন্তু আমার সেই কথা রইলো না বেশিক্ষণ। আমার খুব কাছে বসে পড়লেন তিনি। ফোনটা বইয়ের উপরে রেখে হাতজোড়া আমার কাঁধে রাখলেন। এতেও প্রতিক্রয়া দেখালাম না আমি। বিনিময়ে একগাল চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলেন আমায়। সামনে গড়িয়ে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিলেন তিনি। স্বযত্নে চোখ দুটো মুছিয়ে দিলেন। আদুরে গলায় বললেন..

— “কি হয়েছে পিচ্চি? তারুণ্যের কথা মনে পড়ছে?”
ঠোঁট উল্টে সায় দিলাম আমি! হ্যাঁ ভাইয়ার কথা প্রচুর মনে পড়ছে। পেছন থেকে বালিশ এনে কোলের উপর রাখলো সে। আমার মাথাটা সেখানে রাখলেন। গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল..
— “আমি তারুণ্যের মতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড় পিচ্চি!”

নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে মাথা হেলিয়ে দিলাম তার কোলে। তিথি স্বযত্নে গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এটাই আমার বৈশিষ্ট্য। কেউ গালে হাত বুলিয়ে দিলে অতি শ্রীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়ি।
কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। মুখ খুললো অরিশ ভাইয়া। বলল..– “আজকে ভার্সিটিতে যাস নি কেন?”
বিপরীতে দৃঢ়ভাবে মাথা গুঁজে দিলাম তার পেটে। একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল..

— “শরীরটা ভালো লাগছিল না.। তাই যাই নি?”
— “শরীর না মন!”
তার একরোখা প্রশ্নে কোনো জবাব দিলাম না আমি। সত্যিই আমার মন ভালো ছিল না। তাই যাইনি। ভাইয়ার হাতটা মাথার গহিনে নিয়ে বলল..
— “কালকে আমার ক্লাস আছে। মিস্ যাতে না-হয়‌।”

বিনিময়ে এবারও প্রতিউত্তর দিলাম না আমি। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল নিরবতায়। গুটিয়ে রাখা আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো সে। স্বযত্নে কিছু একটা করলো হাতের আঙুলে। মুখের উষ্ণ গরম ফুঁ দিলো। অতঃপর গভীর ভাবে অধর ছুয়ে দিল হাতের উল্টো পিঠে। চোখের সামনে হাত এনে বলল..
— “দেখ তো কেমন লাগছে?”

বেষ্টিত লোচন যুগল মেলে তাকালাম আমি। নখের উপর ব্রাউন্ড কালার্স নেলপলিশ দেখে কদাচিৎ হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। নিমেষেই মন ভালো হয়ে গেল আমার। তট জলদি উঠে বসলাম আমি। মন দিয়ে নখগুলো দেখতে লাগলাম। পরক্ষণেই অন্যহাত এগিয়ে দিলাম তার দিকে। দাঁত কেলিয়ে বললাম..
— “এই হাতেও দিয়ে দে..। মানে দিয়ে দাও”

সাথে সাথে চোখ গরম করে তাকাতেই বচন পাল্টে গেল আমার। বাকি নখে নেইলপলিশ দিতে লাগলো সে। হাতে দেওয়া শেষ হতেই পা এগিয়ে দিলাম। এবার ভ্রু কুঁচকালো সে। সূচালো কন্ঠে বলল..
— “এখন তোর পায়েও আমি হাত দিবো।”

নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করলো এবার। আমার চেয়ে কতোবড়, তার দিকে কি-না আমি পা এগিয়ে দিয়েছি। ভাবা যায়। খুশিতে মানুষ আত্মহারা হয়, আর আমি বুদ্ধিহারা হলাম। ততক্ষণাৎ পা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই খপ করে ধরে ফেলল ভাইয়া। নিজের কোলে নিয়ে নখে নেইলপলিশ লাগিয়ে দিলেন। পা সরিয়ে অন্যপায়ে নিয়ে সেটাতেও লাগিয়ে দিলেন। অবশেষে হাতে অবস্থান করা নেলপলিশের কৌটা আমার হাতে দিয়ে দিলেন। সামনের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন..

— “গুড নাইট পিচ্চি!”
হুট করে কি হলো আমার জানা নেই। এক লাফ দিয়ে ভাইয়ার কোলে উঠে দুহাতে জড়িয়ে নিলাম তাকে। আমার এমন ব্যবহারে তিনি অবাক হলেন কি-না জানা নেই। পরপর দুইবার গালে অধরের স্পর্শ দিয়ে বলল..
— “গুড নাইট এন্ড থ্যাংক ইউ!”
— “তুই খুশি তো?”
— “খুব খুব খুবইইইইই।”

আজ খুব সকালে ঘুম ভঙ্গ হলো আমার। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর ফলে এমন হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলাম। আজকে অরিশ ভাইয়ার ক্লাস আছে। কালকে বারবার বলেছে, আজকে যাতে তার ক্লাস মিস্ নাহয়। কিন্তু নিচে কারো উপস্থিতি অনুভব করতে পারলাম না। মামনির কি তাহলে এখন ঘুম ভাঙ্গে নি। কিন্তু সে তো বেলা বেশি করে উঠে না। তাই চুপচাপ মামুনির রুমের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু সেই অবধি পৌঁছাতে সক্ষম হলাম না।

তার আগেই ডাক পড়লো অরিশ ভাইয়ার দিদার। পিছিয়ে নেমে এলাম। তিনি মুখে পান চিবুতে চিবুতে সোফায় বসে আছেন। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে পানের রস পড়ছে। তিনি তা টিস্যু পেপার দিয়ে পরিস্কার করে নিচ্ছেন। শুধুমাত্র তারজন্য প্রতি মাসে অধিক টিস্যুর প্রয়োজন পড়ে। দিনের ৩২ খানা পান না খেলে তার চলে না। এটা নাকি তার অভ্যাস। এদিকে দাঁত গুলো টকটকে লাল। দেখতে বিচ্ছিরি লাগছে। দিদার এমন দাঁত দেখলে বরাবরই আমার ইচ্ছে করে, ওয়াশরুমে ব্যবহৃত ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করিয়ে দিতে। আচ্ছা সেই ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলে ঝকঝকে হবে তো। না-কি অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ভেংচি কাটলাম আমি। এদিকে টিস্যু দিয়ে মুখ পরিষ্কার রাখে। কিন্তু দাঁতের যত্নের বেলায় নাম নেই। যত্তসব। হাই তুলে বললাম..

— “ডাক দিলে কেন?”
— “আজকে ভোরের দিকে তোর মামনি আর মামা গ্ৰামের বাড়িতে গেছে। দুদিন পরে ফিরে আসবে। এই দুদিন তুই রান্না করবি! বুঝতে পেরেছিস। এবার যা সকালে নাস্তা বানিয়ে ফেল। ওরা খেয়ে ভার্সিটিতে যাবে তো..
ভ্রু কুঁচকে গেল আমার! তুলনামূলক কিছুটা উপরে অবস্থান করলো। শেষে কিনা আমি রান্না করবো। তা খাওয়ার উপযুক্ত থাকবে তো না-কি শুধু বাস্কেট ভরবে। অনেকবার মামুনির কাছে রান্না শিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু শিখতে দেয়নি। মাথা নিচু করে বললাম..

— “দিদা আমি তো কখনো রান্না করিনি! কিভাবে রান্না করব..
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি মুখ খুললেন..
— “পারো না তাতে কি হয়েছে। এখন পারবে..! সারাদিন মহারানীর মতো খেলে চলবে না। একটু কাজও করতে হবে। কি জানো বলে ঐটাকে (কিছুক্ষণ ভেবে) ইউটিউব। এটা দেখে রান্না করবে। আর এটায় কোনটা কতটুকু পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে। লেখা আছে.

মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে তার এগিয়ে দেওয়া লিস্ট-টা নিয়ে কিচেনে ছুটলাম।
অরিশ ভাইয়ার জন্য কফি, বাকিদের জন্য লেবু চা। সাথে ডিম সিদ্ধ। পরোটা, সবজি ভাজি করলাম। আমি একটাই যে করেছি তা নয়। আমার পাশে বসে ফ্লীমি স্টাইলে ডায়লক দিয়ে গেছে দিদা। সবজি কাটতে গিয়ে হাতের করতলের কিছুটা অংশ কেটে গেছে। রক্ত বেরিয়েছে স্বল্প পরিমাণে। মাথা নত করে সহ্য করে নিয়েছি, সেই যন্ত্রনাটা। হালকা টু শব্দটি করলে হয়তো আবার আমার পরিবারকে টেনে নিয়ে আসবে সে। সেটা হতে দিলাম না। মানুষের শারীরিক আঘাতের চেয়ে মানসিক আঘাত-টা বেশি তীব্র হয়।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২

ঘরে এসে আরেক দফা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এতোক্ষণ কিচেনে থাকার কারণে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। এর চেয়ে ভালো উপায় জানা ছিল না আমার। ফ্রেশ হয়ে কাঁটা হাতে মলম লাগিয়ে নিলাম। শরীরটা প্রচুর দূর্বল লাগছে। কিন্তু পাত্তা দিলাম না। ছুটলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪