অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪
ইফা আমহৃদ

একের পর এক বেতের আঘাতে জর্জরিত হয়ে সলি হাতের তালু। রীতিমত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কাঁটা জায়গা থেকে। সেই যন্ত্রনা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। ক্রমাগত হাত জোড়া অবশ হয়ে আসছে। হাতের ফাঁক দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে বন্ধ নয়ন যুগল থেকে।‌ কিন্তু তাতে সামনে থাকা মানুষটির কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সে নিজের মতো মেরেই চলেছে।

একসময় মনে হলো, আঘাত করা থেমে গেছে। কিন্তু যন্ত্রনা রয়ে গেছে। তদানীং কিছুর আওয়াজ কানে এলো। পিট পিট চোখ খুলে তাকালাম আমি। আমার থেকে কিছুটা দূরে বেতের ভাঙ্গা অংশ পড়ে আছে আর ভাইয়া অন্যদিকে ফিরে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। হয়তো নিজের ভেতরকার রাগ কমানোর চেষ্টা করছেন। আমাকে এতো আঘাত দেওয়া মানুষটি আর কেউ নয়, অরিশ ভাইয়া ছিলেন। শব্দ করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমি মাথা নিচু করে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। একহাত দিয়ে আরেকটা হাত স্পর্শ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু স্পর্শ করার আগেই জ্বলে উঠল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পায়ের শব্দে ফিরে তাকালাম আমি। অরিশ ভাইয়া আবার এসেছে। এবার কি করবে তা জানা নেই আমার। এগিয়ে এলেন আমার কাছে। রক্তচক্ষু করে তাকালেন আমার দিকে। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আমার। তাকে কখনো এতো রাগতে দেখি নি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল..
— “যখন পড়া শিখে আসতে পারো না তখন ভার্সিটিতে আসো কেন? বাড়িতে বসে থাকবে। ফার দ্যাট, আমার ক্লাসে পড়া না শিখলে, আসবে না। তার শাস্তি আরো ভয়ানক হবে। আউট..
শেষের কথাটা উচ্চারণ করলেন সর্বশক্তি দিয়ে। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললাম আমি। ঠোঁট যুগল নাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললাম..

— “আ-আমি আ-আসলে..
— “জাস্ট শাট আপ এন্ড আউট মাই ক্লাস। মাঠের মাঝখানে একপা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। নাউ আউট..
ক্লাসে অবস্থিত সকলে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পর্যন্ত কাউকে এতোটা হাইপার হতে দেখে নি তারা। দেখবেই বা কি করে, অনার্স তৃতীয় বর্ষের একজন তরুনীকে পড়া না শেখার কারণে এভাবে মারতে পারে। ধারণা ছিল না। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নত মাথা বেরিয়ে গেলাম বাইরে।

জুনিয়র, সিনিয়র সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেউ কেউ বিদ্রুপ করছে। সবটা মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে‌। প্রতিক্রয়া করার উপায় নেই। মাথা ভন ভন করে ঘুরছে। প্রচন্ড রোদে ঘেমে একাকার হয়ে গেছি। শরীরটা প্রচন্ড জ্বলছে। বুঝতে পারলাম, এলার্জি শুরু হতে চলেছে। সামান্য গরমে থাকলেই এলার্জি জনিত সমস্যা দেখা যায়। দৃষ্টি গেল আমার থেকে কিছুটা দূরে। ঘন্টা পরার কারণে অরিশ ভাইয়া বেরিয়ে গেছে ক্লাসরুম থেকে। তবে তার ফেসটা স্পষ্ট নয় আমার কাছে। ঝাঁপসা লাগছে অনেকটা। শুধু তার পড়নের জামা দিয়ে চিনতে পারছি। কয়েকবার চোখ পরিষ্কার করে তাকালাম কোনো লাভ হলো না।

তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এলো আমার বন্ধুমহল। আমার কাছে এসে পানির বোতল এগিয়ে দিল। বোতলটা নেওয়া মতো শক্তিটুকু অবকাশ নেই। আমাকে এমন অবস্থায় দেখে আরশি বলল..
— “ঋনী, পানিটা খেয়ে ছায়ায় চল।”
বিনিময়ে টেনে টেনে বললাম..– “আরু, আমাকে একটু ধরবি। আমি আর শরীরের ভার বইতে পারছি না।”
তট জলদি আমাকে ধরলো সে। শরীরটা ধীরে ধীরে নেতিয়ে গেল। ভারটুকু ছেড়ে দিলাম তার উপরে। আরশি আমার এমন অবস্থা দেখে গালে হাত রাখল আমার। মৃদু মৃদু চপল দিয়ে বলল..

— ঋনী। কি হয়েছে তোর। এমন করছিস কেন?”
— “আমার পুরো শরীর জ্বলছে। সহ্য করতে পারছি না।”
দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগে আমার হাত পায়ের দিকে তাকালো আরশি। খানিকটা চমকে উঠতে দেখা গেল। শক্তহীন নিস্তেজ হাতটা আমার স্বল্প উপরে উঠিয়ে বলল..
— “ঋনি, তোর শরীর লাল হয়ে ফুলে ফুলে গেছে কেন? এলার্জি উঠেছে নাকি!”
কোনো প্রকার সায় দিলাম না আমি।‌ পরক্ষণেই প্রশ্ন ছুঁড়ল আবার..– “তোর গালে হাতে রক্ত কেন?”
সেই উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। নেতিয়ে পড়লাম আরশির বাহুডোরে। তবে জ্ঞান শক্তি পুরো হারালো না।

সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে অনেকটা। বিকেলের হালকা রৌদ্র মাখা হাওয়া প্রবেশ করছে রুমের ভেতরে। হালকা হালকা দুলছে ঘরের পর্দাগুলো। বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভাঙল আমার। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করলাম। মাথার উপরে সিলিং ফ্যান‌ চলছে। শরীরটা ভাড় হয়ে আছে। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। বাড়িতে ফেরার পর ডাক্তার এসেছিলো। আমার বাম বাহুতে ইনজেকশন দিয়েছে। হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। সাথে সাথে হাতটা চলে গেল বাহুতে। তারপরে সম্পূর্ণ হুশ উবে গেছিলো। ধীরে ধীরে নেমে পড়লাম নিচে। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

আধ ঘন্টা পর বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। মাথার টাওয়াল খুলে মেলে দিলাম বেলকেনিতে। বেলকেনিটা পশ্চিম দিকে হওয়াতে বিকেলের পশ্চিমা রবি দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তদানীং পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরায় ভরকে গেলাম আমি। পেছনে আরশি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দিকে তাকিয়ে বললাম..
— “আরু ছাড়, কি করছিস?”

ছাড়ল আরশি তবে দাঁড়াতে দিলো না। টেনে রুমের ভেতরে নিয়ে গেল। বসিয়ে দিল বেডের উপরে। স্যুপের বাটিটা হাতে তুলে নিল। এক চামচ নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিল আমার। বিপরীতে হাঁ করে রইলাম কিছুক্ষণ। গলার দিকে স্যুপ নামতেই সরু চোখে তাকিয়ে বললাম..
— “আরু, এসব নিয়ে যা-তো এখান থেকে। আমি খাবো না।”
বলেই মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। গাল চেপে মুখটা আরশির দিকে এনে আরো এক চামচ গলিয়ে দিল ভেতরে। বলল..

— “সন্ধ্যা হতে চললো। সারাদিন কিছু খাসনি। এখন না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি। এখন আমার কথা শুনছিস না তারুণ্য ভাইয়া এলে ঠিক শুনবি।”
আমার চোখ চড়কগাছ। স্যুপগুলো গলা থেকে নিচে নামতে ব্যর্থ হলো। ফেলে দিলাম মেঝেতে। কৌতূহলী কন্ঠে বললাম..– “তুই ভাইয়াকে ফোন করেছিলি?”

— “হ্যাঁ করেছি। কিন্তু ভাইয়া রিসিভ করেনি। হয়তো ব্যস্ত ছিলো। চিন্তা করিস না, কলব্যাক করলেই সবটা বলে দিবো।”
ব্যান্ডেজ করা হাত বাড়িয়ে স্যুপের বাটিটা টেবিলের উপর রেখে দিলাম। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম..
— “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ভাইয়া জানলে এখান থেকে আমাকে নিয়ে চলে যাবে। মামনি কতোটা কষ্ট পাবে, ভাবতে পারছিস। তাছাড়া তুই ..

ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ গভীর ভাবে ভাবল আরশি। বিঘ্ন সৃষ্টি হলো ফোন আসাতে। বেডের উপর আমার ফোনটা বেজে চলেছে। হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম। ভাইয়া ফোন করছে। রিসিভ করতে ভয় করছে। ছোটবেলায় থেকেই আমার কন্ঠস্বর শুনে বলে দিতে পারে আমার মনের অবস্থা। রিসিভ করে ফোনটা এগিয়ে দিলাম আরশির দিকে। সে রিসিভ করে কানের কাছে নিল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো ক্লান্তময় কন্ঠস্বর..

— “হ্যালো, বনু। কেমন আছিস!”
নত সুরে উত্তর দিলো আরশি.. — “আমি আরশি বলছি!”
— “ও তুই! তোকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলাম। কিন্তু রিসিভ করিস নি। শরীরটা ভালো ছিলো না। তাই একটু ঘুমিয়ে ছিলাম। উঠে দেখি তুই ফোন করেছিস।”
— “কি হয়েছে তোমার?” (আকুতি ভরা কন্ঠস্বর)
— “তেমন কিছু না। ইদানিং ঘুম কম হওয়ায় কারণে মাথা ধরে থাকে।”
নিরবতায় কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। দুজন দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পারছে। দুজনের নিরবতা কাটিয়ে মুখ খুললো আরশি..
— “তোমাকে সবাই খুব মিস্ করছে, কবে আসবে?”
— “খুব শীঘ্রই! তোর কিছু লাগবে?”
বিরবির করে উচ্চারণ করলো,, “তোমাকে”। সেই শব্দ ফোনের ওপাশের মানুষটির কাছে পৌঁছালো কি-না জানা নেই। কিন্তু তেমন কিছু লক্ষ্য করা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ পর ফোন রেখে দিলো আরশি। আমি শান্তমনে স্যুপ খাচ্ছি। এতোক্ষণে অর্ধবাটি ফাঁকা করে ফেলেছি। ফোনটা বেডের উপর রাখতে দেখে বললাম..

— “কালকে আমার সাথে পীরের কাছে একবার যাস তো? এই অরিশকে এমন তাবিজ করব, যে সারাদিন তরী তরী করবে। তার সাথে হিন্দী ফ্লীমের সিন ঢালব। কিন্তু ভাইয়ার সাথে একটাও কথা বললো না। উম্।”
আরশি একটু ঝুঁকে গেল আমার দিকে। ফিসফিসিয়ে বলল.. — “এইসবে কাজ হবে তো ঋনী। তাহলে আমিও একটা তারুণ্যের জন্য নিয়ে আসব। দেখতে চাই, ঐ সালায় কতোদিন আমাকে রিজেক্ট করে!”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩

— “ঐটা তোর সালা নয়, জামাই হবে। ভাইকে ভাইয়া থেকে সাইয়া করতে চাস, সালা না। তাই কথা বার্তা সাবধানে বলিস্..
আরশি ঠোঁট উল্টে বলল.. — “সলি”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৫