অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৫

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৫
ইফা আমহৃদ

রাত গভীর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। গভীর ঘুমে ব্যস্ত সকলে। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমিও ঘুমাচ্ছি। ডাক্তারের দেওয়া মেডিসিনের সাথে ঘুমের ওষুধও ছিলো।

মাঝরাতে আমার রুমে প্রবেশ করলো কেউ। খোলা দরজা আরেকটু ভিড়িয়ে দিলো সে। দরজার আওয়াজ এইটু কানে এলো আমার। পরক্ষণেই তার পায়ের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো সে। বসলো আমার পাশে। আমার শক্তিহীন নিস্তেজ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ভেতরের ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু চোখ খুলতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে হাতটা ধরে ছিল। একসময় ব্যান্ডেজ করা হাতটায় ফোঁটা ফোঁটা পানিতে ভিজে উঠলো। অস্তির হয়ে উঠলাম আমি। বরাবরের মতো এবারও চোখ খুলতে ব্যর্থ হলাম আমি। কিছুটা ঝুঁকলো আমার দিকে। তার শরীরের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আমার চোখ মুখে আঁচড়ে পড়ছে। ভয়ে শরীরের গরম তাপমাত্রা উধাও হয়ে ঠান্ডা হতে লাগল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গভীর ভাবে আমার ললাটে অধর ছুয়ে দিল অপর পাশের মানুষটি। এবার চোখের পাতার উপরে গড়িয়ে পড়ল অম্বু ধারা। কিছুটা কেঁপে উঠলাম আমি। পিঠের নিচে হাত রেখে কিছুটা শূন্যতায় ভাসিয়ে নিল আমায়। জড়িয়ে নিল তার বাহুডোর। কৌতূহল থেকে গেল আমার। এই মানুষটি আমার অপরিচিত নয়। আমার কাছে এবং আমার পরিচিত একজন মানুষ। অসহায় কাতর কন্ঠে বলছে..

— “এই তরী-রানী ব্যাথা করছে বেশি। কষ্ট হচ্ছে। আমার উপরে রাগ করেছ?”
গলায় সর্বশক্তি দিয়ে কেউ হাত দিয়ে চেপে রেখেছে। কিছুতেই আওয়াজ বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে বিরবির করে মৃদু শব্দে বললাম..– “ক-কে আ -আপনি?”
কথাগুলো হয়তো তার কর্ণপথে গিয়েছে। ধীরে ধীরে বেডের উপর পূর্বের জায়গায় শুইয়ে দিলো আমায়। ফেলে রাখা ব্লাঙ্কেট টা তুলে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিল। আবার একবার অধর ছুয়ে দিল আমার ললাটে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল..
— “তুমি ধীরে ধীরে জেগে যাচ্ছো? এখন আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। আজ আসি।”

তার হাতের মুঠোয় থাকা আমার হাত ছেড়ে দিলেন তিনি। শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে গেলেন। সাথে সাথে উঠে বসলাম আমি। অবলোকন করলাম দরজার দিকে। দরজা বিড়িয়ে রাখা। মৃদু আলো আঁচড়ে পড়ছে দরজার ফাঁক দিয়ে। ক্ষান্ত হলাম না আমি। এক লাফে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। সব আমার মনের ভুল। বারবার মনে হলো কেউ একজন ছিল। কিন্তু কেউ নেই।

পায়ে তোড়া, হাতের বালা, থাকে যদি সিটি গোল্ডের চেইন, দিয়ে যাবেন…
তাতে সমান সমান তোমরা বাদাম পাবেন। হুউউউউউ,,
বাদাম বাদাম দাদা কাঁচা বাদাম। আমার কাছে নাইতো বুবু ভাজা বাদাম।
আমরা কাছে পাবে শুধু কাঁচা… বাদাম

মনের আনন্দে কাঁচা বাদাম গান গাইছি। গানের তালে তালে হাত নাড়াচ্ছি, পা দুলিয়ে চলেছি। তদানীং মধ্য বয়স্ক লোকের ডাকে ধ্যান ভাঙল। তবে সেই কন্ঠস্বর অস্পষ্ট আমার কাছে। চোখ খুলে তাকালাম আমি। সাথে একশত আশি ডিগ্রী শক খেলাম। আমাকে ভীড় করে আশেপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে নিলাম। চোখ খুলতেই হামলে পড়লেন তারা। একজন বললেন..

— “খালা আমাকে এক কেজি বাদাম দিন-তো?”
আরো একবার প্রচন্ড শক খেলাম আমি। আমি বাদামের গান গাইছি বলে বাদাম নিতে চলে এলো। আবার খালাও ডাকছে। মুহুর্তেই মনে প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা আমি কি দেখতে খালাদের মতো। ফ্রেন্ডরা আমাকে ভালোবেসে কিউটি বলে ডাকে। যাক মেনে নিলাম আমি খালাদের মতো। কিন্তু এটা ভার্সিটি, বাদাম বিক্রি করার জায়গা নয়। সেখানেও চলে এসেছে। আমাকে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিলো আরেকজন। একটা আস্ত নোট বের করে এগিয়ে দিলো আমার দিকে। বললেন..

— “ভালো ভালো দেখে তিন কেজি বাদাম দাও তো বাবু!”
একবার বাবু তো আরেকবার খালা। হচ্ছেটা কি, বুঝতে পারলাম না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম..
— “আমাকে দেখে আপনার বাদাম বিক্রেতা মনে হচ্ছে। দেখতে পারছেন না আমার কাঁধে ব্যাগ রয়েছে। না-কি সেটা চোখে পড়ছে না।”

— “তুমি তো বাদামের ডালাও নিয়ে বসেছো? তাহলে বুঝবো কিভাবে, তুমি বাদাম ওয়ালী নাকি ভার্সিটির শিক্ষার্থী।”
লোকটা আমার সামনে রক্ষিত বাদামের ডালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন। সাথে সাথে দৃষ্টি গেল সেদিকে। ঘনঘন পলক ফেলে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এখানে বাদামের ডালা এলো কিভাবে? অনেক কষ্টে তাদের এখান থেকে বিদেয় করলাম। অতঃপর সবার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলাম। নাক ফুলিয়ে বললাম..
— এখানে বাদামের ডালা এলো কোথা থেকে? তোরা আবার ফাজলামো শুরু করে দিয়েছিস?

নিলয় এগিয়ে এলো আমার দিকে। সাথে সাথে সরু চোখে তাকাতেই পিছিয়ে গেল কয়েকপা। আমতা আমতা করে বলল.. — “বিশ্বাস কর, দোস্ত এখানে কিভাবে এলো বুঝতে পারছি না। তবে তোর গান গাওয়ার ফাঁকে একটা পিচ্চি ছেলে এসেছিলো। তারপরে ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেছে।”
এদের কথার মাঝেই আমার দৃষ্টি গেল দুতলায় অরিশ ভাইয়ার কক্ষের দিকে। তিনি তার হাত ভাঁজ করে রেলিং এ রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখের কোণে মিষ্টি বাঁকা হাঁসি। আবার সিউর হলাম, এটা এই মানুষটির কাজ। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম..

— “এই বিলাতি ইঁদুরের বাচ্চাকে যদি আমি শিক্ষা না দিয়েছি, তাহলে আমার নাম বাদাম ওয়ালা নয়..
আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সকলে। যখন বুঝতে পারলাম ভুল বলে ফেলেছি‌। তখন নাক ঘসতে ঘসতে বললাম.. — তরিন নয়!”

— “বইন, বিলাতি ইঁদুরের বাচ্চা অরিশ ভাইয়া না, আগামী প্রজন্মে চোর পেটের ভেতরে বেড়ে উঠবে।”
পুনরায় আড্ডায় মেতে উঠলাম আমরা। আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন দত্বরী আঙ্কেল। ব্যাঘাত ঘটলো আমাদের আড্ডা-মহলে। অরিশ ভাইয়া তাকে পাঠিয়েছে। আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছে। প্রথমে যেতে রাজি হইনি, পরে ওদের জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে গেলাম।

একমনে কিছু একটা লেখে চলেছেন তিনি। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দরজার কাছে। দরজা খোলা তবুও হাত বাড়িয়ে নক করলাম। এর আগেও অনেকবার ভাইয়ার কক্ষে এসেছিলাম। কখনো নক করা হয়নি। তিনি চোখ তুলে অবলোকন করলো আমার দিকে। অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। পুনরায় তাঁর দিয়ে দৃষ্টিপাত করে দেখতে পেলাম তিনি নিজের মনে কাজ করে চলেছে। তাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলল..– “মে আই কামিং স্যার..
— “হম।”

মৃদু শব্দে বললেও কান পর্যন্ত পৌঁছালো আমার। হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বললাম..– “স্যার ডেকেছিলেন আমায়?”
এবার উঠে দাঁড়ালো সে। এগিয়ে এলো আমার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল..– “আমি না ডাকলে তুমি কি এখানে আসতে?”
আচ্ছা এই ছেলেটা কি কখনো ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। না-কি জন্মের পরে মামুনি মধু দেওয়ার বদলে তিত করল্লা রস খাইয়ে দিলো। নাক ফুলিয়ে বললাম..

— “তা কেন ডেকে ছিলেন? যদি দয়া করে বলিতেন স্যার?”
একটা টিফিন ক্যারিয়ার বের করলেন তিনি। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ফিনিশ ইট!” আমি মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম। ফিনিশ ইট বললেই খেতে হবে। খাবো না। আরেক কদম এগিয়ে এলেন আমার দিকে। ব্যান্ডেজ করা হাতটা মুঠোয় চেপে ধরলেন। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলাম আমি। দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নয়ন যুগল থেকে। আমার কষ্টে বোধহয় তার কিছু যায় আসে না। আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। রক্তের ধারায় ভিজে উঠলো আমার মোটা ব্যান্ডেজ। তবুও ছাড়ল না তিনি। ব্যাথাটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছালে চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। এতেও কাজ হলো না। আমিও চোখ মুখ খিঁচে সহ্য করার চেষ্টা চালালাম কিছুক্ষণ।

ছেড়ে দিলেন আমার হাত। পিছিয়ে গেলাম কয়েকপা। নিজের হাত গিয়ে ঠেকেছে অন্য হাতের ব্যান্ডেজের উপর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম..
— “আপনি কখনো কারো সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারেন না। কেন বারবার আমাকে আঘাত করতে আসেন?”
— “এখনো খারাপ ব্যবহারের কিছুই করি নি। এবার করবো।”

বলেই কিছু একটা ছুঁড়ে মারলেন আমার শরীরের উপর। চিৎকার করে আরো দু’পা পিছিয়ে গেলাম আমি। তেলাপোকা দেখে রীতিমত আমার প্রান যায় যায় অবস্থা। এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম তার টেবিলের উপর। টেবিলের উপর ক্রমাগত দৌড় ঝাঁপ করে চলেছি। জিনিস পত্র গুলো নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে আর আমি ভয়ে ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছি। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে। ইনোসেন্স ফেইস করে বললাম..
— “আমি খাবো, প-প্লীজ তেলাপোকা টা সরিয়ে দিন।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪

তিনি এবার তেলাপোকা-টা সরিয়ে নিলেন। নিজে চেয়ারে গিয়ে বসলো। সাথে সাথে ভাব দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু মাঝ পথেই তিনি তেলাপোকা বলে চিৎকার দিলো।‌ ভয়ে এক লাফে তার কোলে গিয়ে বসে পড়লাম। দুহাতে জড়িয়ে ধরে একদম শিটে গেলাম তার বুকের সাথে। তবুও তার সাথে কথা বলবো না, হমম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৬