অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৬

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৬
ইফা আমহৃদ

রক্তের ছড়াছড়ি। ভার্সিটির সামনের রাস্তার মোড়ে ভাংচুর চলছে। ঈগল গ্যাং এর লোকেরা মারছে। ভার্সিটির প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখা হয়েছে। যাতে কেউ ভেতরে কিংবা বাইরে যেতে না পারে। সকলের মনে ভয়ের আতংক ছড়িয়ে আছে। তবে আরশির মনে লাড্ডু ফুটছে। নিজের চোখে সবকিছু দর্শন করার প্রবল ইচ্ছে তার। টিভিতে একটু আধটু দেখেছে। সামনাসামনি দেখা হয়নি তাকে। সকলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ভিড় ঠেলে এক দৌড় বেড়িয়ে গেল আরশি। দারোয়ানকে সরিয়ে প্রবেশদ্বার বেড়ে চলে গেল বাইরে। পেছন থেকে প্রফেসরস, দাড়োয়ান, তার বন্ধুরা ডাকল। শুনলো না সে। দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে গেল সেখানে।

পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে ঈগল গ্যাং এর মেইন লিডার অপূর্ব আহসান। তাকে ঘিরে আছে বড় বড় লম্বা লম্বা লোকজন। হয়তো গ্যাং স্টার একেই বলে। সামনেই রক্ত পড়ে আছে। হয়তো একটু আগে মারামারি হয়েছিল। মন খারাপ হয়ে এলো আরশির। আরেকটু আগে এলে ডিসুম ডিসুম মারামারি দেখতে পারত। রিয়েল লাইফের মারামারি। তার ভাবনার মাঝেই অপূর্ব উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। পেছনে সারিবদ্ধ কয়েকটি গাড়ি। প্রথমটার দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সাথে সাথে ভাবনার ছেদ ঘটল আরশি। হাঁটুতে ভর দিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল..
— “এই এই এই মিস্টার গ্যাং স্টার।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পেছনে ফিরল অপূর্ব। চোখ মুখে বিরক্তিকর আভা ছড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকালো সে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। পড়নের ব্লু কার্লার জিন্স। গায়ে লং টপস। পিঠে একটা ব্যাগ। গলার ওরনাটা এলোমেলো হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ফর্সা শরীরে ঘাম গুলো মুক্তার মতো লাগছে তার কাছে। একদম সাজগোজ বিহীন রমনী। পাশের দিকে তাকাতেই ভদ্রলোক বলতে শুরু করল..– “এই মেয়ে জীবনে ভয় ডর নেই তোমার? বাঁচতে চাইলে যাও এখান থেকে।”

এতে আরশির ভেতরে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। সে এগিয়ে এলো কয়েকপা। মোহনীয় চোখে তাকিয়ে রইলো অপূর্বে দিকে। নীল রঙের শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা। যার ফলস্রুতিস্বরূপ বুকের বেশ খানিকটা উন্নুক্ত হয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে ফর্সা লোমহীন বুক। পড়নের জিন্সটায় একটা ভাঁজো নেই। চোখে নীল সান গ্লাস। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে পুরো মুখ ঢাকা। অধর জোড়া গোলাপি রঙের। যেন কোনো লিপ বাম ব্যবহার করেছে। নয়নজোড়া নীলাভ রঙের। কপালের উপরে বাম পাশে ছোট একটা লালচে তিল। লালচে কি-না জানা নেই, তবে রোদে জ্বলজ্বল করছে। অধর যুগল নাড়িয়ে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করলো ..

— “শুভ্র-নীল কুমার।”
— “কী?”
— “হাই, আমি আরশি। আপনার বিগ, বিগ, বিগ পাংখা। না-মানে ফ্যান। আপনি জানেন, আপনার মারামারি আমার এতো পছন্দ হয়। ”
হাত এগিয়ে দিলো অপূর্বের দিকে। অপূর্ব হাত মেলানো না। লজ্জায় পড়লো আরশি। হাত গুটিয়ে নিল সে। আমতা আমতা করে বলল..

— “আমাকে মারপিট শেখাবেন? আমিও আপনার মতো গ্যাং স্টার হতে চাই।”
— মেয়েদের জন্য রাজনীতি নয়, রান্না বান্না তাদের একমাত্র কাজ।
সাথে সাথে দাঁত কেলিয়ে আরশি বলল.. — “আমাকে বানাবেন? আমি রান্না করতে চাই!”
সাথে সাথে জিভ কাটলো আরশি। নিজের মাথায় একটা চপল মেরে বিরবির করে বলল..

— “আরু তুইও না? তুই কেন রাঁধুনী হবি? তুই তো গ্যাং স্টারের বউ হবি। তোদের অফিসে এতো লোক কাজ করবে আর তুই কি-না আরেকজনের বাড়িতে রাঁধুনীর কাজ করবি! ছাগল একটা।
বলছিলাম কি, বিয়ে করবেন আমায়। আমি রান্না শিখে নিবো। তবুও আমাকে রিজেক্ট কইরেন না।”

অধর বাঁকিয়ে হাসলো অপুর্ব। তার সামনে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর পুচকি একটা মেয়ে বড় বড় কথা বলছে। করতালি দিলো সে। সান গ্লাসটা খুলে গার্ডের হাতে দিয়ে এগিয়ে গেল আরশির দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল..
— “পাগলেও নিজের ভালোটা বুঝে। আর তুমি একজন মানুষ হয়ে বুঝতে পারছো না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো? তোমার জায়গায় একটা ছেলে থাকলে তার অবস্থা কি করতাম আমি, সেটা কেউ ধারণাও করতে পারত না।”
— “আরে গ্যাং স্টার, ছেলেরা কেন আপনাকে বিয়ে করতে চাইবে। কিসব বলছেন আপনি?”

তিনি আরশিকে কিছু বলতে নিয়ে থেমে গেলেন। আরশির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি আরশির পিছুপিছুই এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। বিনা বাক্যে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মুখোমুখি দাঁড়ালেন সোজা হয়ে। গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কেন জানো তার চাওনীতে কোনো প্রকার অস্বস্তি খুঁজে পেলাম না। হাত উঠিয়ে আমার গাল স্পর্শ করতে চাইলেন। সাথে সাথে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি। পরক্ষণেই গালে আস্তে আস্তে তিনটা চপল পড়লো। চোখ খুলে তাকালাম এবার। তিনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! বললেন..

— “তোমার বোন হয় নিশ্চয়ই?”
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। তিনি আবার বললেন..
— “ভালো মেয়ে, দেখতেও মাশাআল্লাহ। আমি চাইনা তার ক্ষতি হোক। বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাও!”
চপল মারা গালে হাত রাখলাম আমি। তিনি এবার আমার হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। মুহুর্তেই তার চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। দাঁতের সাথে দাঁতের সংঘর্ষ ঘটালেন। ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগলেন..

— “হাতে কি হয়েছে?”
— “জানি না।”
— “তাহলে কি জানো তুমি?”

বলেই তিনি উল্টো হাঁটা দিলেন। তার ধমকে কেঁপে উঠলাম আমি। হঠাৎ তার রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলাম আমি। সকলে গাড়িতে উঠে একে একে চলে গেল। যাওয়ার আগে অপূর্ব নামক ছেলেটি আমার দিকে এক নজর তাকালো। তবে সেই চাওনির মানে আমার দ্বারা বোঝা সম্ভব হলো না। এগিয়ে গেলাম আরশির দিকে। সে কদাচিৎ হা করে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁধে হাত রাখতেই ফিরে তাকালো। সন্দিহান স্বরে বললাম..

— “আরু কে উনি?”
— “আরে এনাকে চিনিস না। অপূর্ব তার নাম। দেখতে যেমন অপূর্ব, মারামারিতেও অপূর্ব। আমার ক্রাশ, আমার জান, আমার শুভ্র-নীল কুমার।”
মুখ ভেংচি কাটলাম আমি। পাশ দিয়ে চলমান একটা রিক্সার দিকে নজর গেল। আরশিকে টেনে রিক্সায় তুলে ছুটলাম বাড়ির দিকে।

— “অরিশ, তোর সাহস হয় কি করে আমার খুকিকে বেত দিয়ে আঘাত করার। আমি তোর ভরসায় আমার কলিজাকে ওখানে রেখে এসেছি আর তুই তাকে মেরে রক্তাক্ত করেছিস। আমি তোর কাছে এটা আশা করি নি। আমি কালকেই আমার পুচকুকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো।”
— ভাইয়া আমি ভূল করেছি। কিন্তু তুই যেভাবে ভাবছিস তেমন কিছু নয়।
ফোনে ওপাশের ব্যাক্তিটিকে বলল অরিশ। বিনিময়ে আরো বাজখাঁই গলায় বলল..

— “আমাকে তোর অবুঝ মনে হয় অরিশ। তুই ভালো করেই আমার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত। আমি কখনো ভুল কিছু শুনি আর বলিও না।”
কিছুক্ষণ নিঃশব্দ রইলো দুজনের গলা। অতঃপর অরিশ বলতে শুরু করল..
— “তুই জানিস আমি পিচ্চিকে কতোটা ভালোবাসি। ও কারো সাথে কথা বললে, আমি সহ্য করতে পারি না। তাই রাগের বশে..

— রাগ ভালো অরিশ। কিন্তু আমার কলিজার সাথে নয়। তাহলে আমি সেই কাজটা করতে বাধ্য হবো, যেটা আমি কখনো করতে চাইনি। ওর আমার আর আমি ওর সবকিছু।
অরিশ বেশ বুঝতে পারল তরীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। সাথে সাথে তার বুক মুচড়ে উঠলো। আমতা আমতা করে বলল..– “ভাইয়া আমি সব ঠিক করে নিবো। কিন্তু প্লীজ তুই আমার পিচ্চিকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাস না।”

— “এটাই তোর ফাস্ট অ্যান্ড লাস্ট সুযোগ। দুজনের মাঝখানের ব্যবধানটা মিটিয়ে নে। আর খেয়াল রাখিস ওর। আমি পিচ্চির কষ্ট সহ্য করতে পারব না।”
দরজা কাছ থেকে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি। অরিশ ভাইয়ার অস্পষ্ট কষ্ঠস্বর কানে আসতেই ফিরে তাকালাম। পরক্ষণেই তিনি ফোন রেখে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্দেগ নিলাম। কিন্তু সক্ষম হলাম না। তার আগেই একটা শক্তপোক্ত হাত আমার হাত ধরে থামিয়ে দিল। এটা অরিশ ভাইয়া বুঝতে আমার সময় লাগলো না। আচম্চা তিনি আমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলেন। শক্ত করে নিজের সাথে পেঁচিয়ে নিয়ে বললেন..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৫

— “আ’ম স্যরি পিচ্চি। আমি তোকে খুব ব্যাথা দিয়েছি, কষ্ট দিয়েছি‌। তাই বলে আমার উপর রাগ করে আমাকে ছেড়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি নিঃস্ব, নিঃপ্রাণ।”
তার কথার আগা মাথা বুঝতে পারলাম না আমি। কৌতূহলী কন্ঠে বললাম..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৭