অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৭

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৭
ইফা আমহৃদ

— “ভাইয়া কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? কোথায়ও যাচ্ছি না আমি। প্লীজ শান্ত হও। আমি আছি, তোমার খুব কাছাকাছি।”

অরিশ ভাইয়া মাথা তুলে আমার দিকে অবলোকন করলেন। নিজেকে সুশীল করার পরিবর্তে ভারসাম্য হীন আচরণ শুরু করে দিয়েছে। নিজের সাথে আরো ঘন করে পেঁচিয়ে নিলো আমায়। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসার উপক্রম হলো এবার। নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা অরিশ ভাইয়ার পিঠে রেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললাম..– “ভাইয়া প্লীজ ছাড়ো আমায়। অস্বস্তি লাগছে!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আচম্বিতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন আমার। নিজের নিয়ন্ত্রণ করে ললাট কুঁচকে বলল..
— “আমি তোকে ছুঁলে তোর অস্বস্তি হয়। আর যখন তোর বন্ধু তোকে বাজে ভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করে তখন। তখন অস্বস্তি হয় না বুঝি। তোর বন্ধু তোকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে, তুই কিছু বলিস নি। তাই রাগের বসে তোকে ওভাবে মেরেছি।”
বেশ চমকে দৃষ্টিপাত করলাম তার দিকে। থমকিয়ে বললাম..

— “কিসব বলছো তুমি? ও আমার বন্ধু হয়।”
— “কালকেই তোর সব বন্ধুদের সাথে ব্রেকআপ করে আসবি। আমি আরশিকেও বলে দিবো। মেয়ে ছাড়া কোনো ছেলের সাথে কথাও বলবি না। বুঝতে পারছিস।
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। ভাইয়ার তার হাত আমার মাথায় রেখে অধর প্রসারিত করে মুচকি হাসলেন। মাতাল করা দৃঢ় সেই হাঁসি। বললেন..

— “পিচ্চি তুই কেন এতো অবুঝ বল তো? কেন বুঝতে পারিস না, তোকে অন্যকারো সংস্পর্শে দেখলে ভেতরটা পুড়ে যায়।”
আগা মাথা না ভেবেই ফট করে বলে ফেললাম..
— “ভালোবাসো আমায়, ভাইয়া?”

মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেল ততক্ষণাৎ। তিনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে। চপল মারলেন মস্তিষ্কের অগ্ৰভাগে। ত্রুব্ধ লোচনে তাকিয়ে বললেন..
— “এইসব আজবুড়ি কথা বার্তা বাদ দিয়ে পড়তে বস। আমি একটু পর পড়াতে আসছি। যা..
শেষ উক্তিটা কঠোর স্বরে উচ্চারণ করলেন তিনি। আমি এক ছুটে রুম প্রস্থান করলাম। এই ছেলেটা কখনো সহজ সরল এবং সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারে না।

— “ঋনী, আজকে থেকে বাড়ির সকল রান্না তুই করবি! আমি পাশের বাড়ির তমাকে বলেছি আসতে, সে এসে তোকে রান্না শিখিয়ে যাবে কিছুদিন।”
প্রাতঃকালে মামুনি এমন কথায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম আমি। যিনি কখনো আমাকে কিচেনে ঢুকতে দেয় নি, তিনি বলছেন রান্না করতে। ব্যাপারটা অদ্ভুত তাই না। আমি আমতা আমতা করে বললাম..

— “মামুনি রান্না করলে ভার্সিটিতে যাবো কখন? পড়াশোনাই বা করব কখন?”
তিনি আমার কথনগুলো শ্রবণপথে নিলেন না। কিছুটা পাল্টা স্বরে বলতে শুরু করলেন..– “বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশোনা করবি। তাছাড়া পড়াশোনা করে কি হবে, সেই তো অন্যর কপাল পোড়াবি।”

তীরে ন্যায় বক্ষে এসে লাগলো কথাটা। নয়নে সীমাবদ্ধ রইলো অম্বু ধারা। বিশ্বাস হচ্ছে না মামুনি আমাকে এইসব বলছেন। নত কন্ঠে বললাম, আমার কোনো সমস্যা হবে না।
আমাদের কথার মাঝেই এসে উপস্থিত হলেন দিদা। ফোড়ন কেটে বলল..

— “সমস্যা হলেও তোকে এই কাজ করতে হবে। জন্মের সময় তো নিজের মাকে খেলি, বাবার ব্যবসা লাটে তুলে দিলি। ভাইটাকে..! অন্তত তোর মতো অপয়া অলক্ষী দিয়ে ঘরের কাজ করাই যেতে পারে।”

ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল হৃদয়টা। দৃষ্টি সরিয়ে মামুনির দিকে অবলোকন করলাম। অন্তত তিনি কি বলবেন। কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে কিছু বললেন না। হয়তো আমারই আশা করাটা অন্যায় দিলো। দিদা থামতেই মামুনি মুখ খুললেন..– “ঋনী আজকের পর থেকে তুই অরিশের ঘরে যাওয়া তো দূরের কথা, কথাও যাতে বলতে না দেখি! প্রয়োজনে কাল থেকে নতুন একাডেমিতে ভর্তি করে দিবো। কিন্তু অরিশের কাছে নয়।”

চলে গেলেন তারা। স্তব্ধ হয়ে তাদের গমন পথের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলাম। কোনো বাক্য অবশিষ্ট নেই আমার কাছে। আমি যখন এই পৃথিবীতে সবে এসেছি। সদ্য জন্ম নেওয়া একটা ফুটফুটে মেয়ে। আমার আসাতে কেউ খুশি হয়নি। বরং একরাশ অন্ধকার নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছিলাম। জন্মের সময় আমার মা চলে গেলেন। বাবা আগলে নিয়েছিলেন আমায়। আমার নামে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কিছু বছরের মাথায় ব্যবসায় লোকসান হয়।

বাবা আমার আর ভাইয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আবার দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ভালোই চলছিলো কিছুদিন। কিছুটা বড় হয়ে উঠলাম আমি। নিজের মা বলতে তাকেই চিনতাম। ধীরে ধীরে আমার সৎ ভাইয়ের আগমন ঘটে। পাল্টে যেতে থাকে তার ব্যবহার। সেদিন ছিল মায়ের ৯ম মৃত্যু বার্ষিকী আর আমার ৯ম জন্মদিন। মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে বেশ কয়েকটি মসজিদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল।

বাবা আর ভাইয়া বাইরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্কুল থেকে ফিরে রুমে গিয়ে দেখতে পেলাম, আমার সৎ মা আলমারি থেকে মায়ের জন্য রাখা টাকা চুরি করছে। তবুও চুপ করে ছিলাম। বাড়িতে ফিরলেন বাবা। টাকার কথা জিজ্ঞাসা করলে অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, তিনি কিছু জানেন না। বাড়িতে আমি আর ভাইয়া ছিলাম। বাবা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সব সামলালেন। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি মিথ্যা বললেন। তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। বাবা বাড়িতে ফিরলেন। সৎ মা বাবাকে বললেন, আমরা মায়ের জন্য রাখা টাকা চুরি করেছি।

সৎ মায়ের প্ররোচনায় সেদিন মারলেন আমাকে আর ভাইয়াকে। মুচকি হেসেছিলেন তিনি। সেদিন দাড়োয়ান চাচা মামাকে ফোন করে জানিয়েছেন সবটা। সাথে সাথে মামা গিয়ে আমাদের সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ধীরে ধীরে কাঁটতে লাগল সময়। ভাইয়া নিজের পড়াশোনা শুরু করলেন। কিছুদিন পরে চলে গেলেন দূরে‌। একসময় হার্ট সার্জন হয়ে গেলেন। কিন্তু ফিরলেন না। ফোন করলে কথা হয়, আমার প্রয়োজনীয় কিছু পাঠিয়ে দেয়, তবে দেখা হয়নি। জানি না কখনো দেখা হবে কি-না। তবে সেদিনের পর থেকে ভাইয়ার সাথে দেখা যায় নি।

ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। আমি আর আরশি পাশাপাশি বসে বই পড়ছি শান্তমনে। এখনো মামনির কথাটা বাড়ির কাউকে জানাই নি। বই পড়ছি বললে ভুল হবে। শুধুমাত্র বইয়ের পাতা নড়াচড়া করছি।
কোনো এক ছেলে ভুল করে আরশির বিকাশ একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন আর আরশি এই নিয়ে ১৫ বার একই কথা বলেছে। আমি গালে হাতে দিয়ে শুনে চলেছি। কানের অবস্থা শৌচনীয়। আরশির কথার ব্যাঘাত ঘটলো ফোনের রিংটোন বাজাতে। আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে ফোন রিসিভ করলো সে। অর্থাৎ অপরিচিত সেই ছেলেটি ফোন করেছে।

— “আসসালামু আলাইকুম অরমাতুল্লাহি অবারাকাতু আপু। আপনার বিকাশ একাউন্টে ভুল বশত পাঁচ হাজার টাকা চলে গেছে। যদি সেটা ফেরত দিতেন?”
আরশি ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া দিয়ে আমার দিকে তাকালো। শ্রবণেন্দ্রিয় থেকে ফোন সরিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। বিরবির করে বলল..

–” বইন, এর গলাটা পরিচিত লাগছে‌। আগের পোলা এটা না। স্পিকারে দিচ্ছে, দেখ তো চিনোস কি-না?”
স্পিকারে দিল আরশি। আমিও গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম কন্ঠস্বর।
— “ওয়া আলাইকুমুস সালাম অরমাতুল্লাহি অবারাকাতু। ভাইয়া ভলুবশত হোক, আর যাই হোক। টাকা যেহুতু আমার বিকাশে এসেছে তাই ফিরত যাচ্ছে না। ইটস্ ফাইনাল।”
এতোক্ষণ অপরপাশের লোকটার স্বাভাবিক কন্ঠস্বর শোনা গেলেও এবার গেল না। ত্রুব্ধ হলো সে। কটমট আওয়াজ করে বলল..

— “হ্যালো মিস্, আপনি জানেন না আপনি কার সাথে কথায় বলছেন? আমি গ্যাং স্টার অপূর্ব আহসান বলছি। আমার এক টাকা আত্মসাৎ করার ক্ষমতা কারো নেই, সেখানে এতো গুলো টাকা।”
মুহুর্তেই আরশি মুখে হাঁসির দেখে মিললো। আসন দিয়ে দু’পা ভাঁজ করে বসলো। বালিশে শরীর হেলিয়ে দিয়ে বলল..
— “আমি তো তোমার নিজের জানেমান। আমি কেন আত্মসাৎ করব। ভালোবাসার টানে টাকা আমার কাছে চলে এসেছে।”

— “কিসব আবোল তাবোল বকছেন আপনি? দেখুন,ভালোয় ভালোয় বলছি টাকা ফেরত দিন। নাহলে..
অপর পাশের মানুষটির কথা কেড়ে নিয়ে আরশি..
— “নাহলে কি জানেমান। তুলে নিয়ে বিয়ে করে নিবে‌। আমি একপায়ে রাজি! ধ্যাত, আপনাকে তো আমার পরিচয় দেওয়া হলো না। আমি আরশি।”

বলেই ,হাসিতে ফেটে পড়লো আরশি। দুবার উচ্চারণ করলো অপূর্ব, আর-শি, আর-শি। পরক্ষণেই শব্দময় উচ্চারণ করলো..– “আরশি নাকি আর-সি। কোন আরসি বলুন তো? কোকা কোলা না-কি মোজো?”
সাথে সাথে রাগে ফেটে পড়লো আরশি। কপাট রাগ দেখিয়ে বলল.. — “আমার নাম আরশি। কান খুলে শুনে রাখুন, আর-শি। কালকে দুপুরে ভার্সিটির মোড়ে যে দেখা হলো। ভুলে গেছেন?”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৬

পরের কথাটা বেশ মিষ্টি সুরে বলল আরশি। ওপাশের লোকটা এবার নড়েচড়ে উঠলো। স্মিত হেসে বলল..
— “তুমি!
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তুমি ছাড়া কেউ এভাবে কথা বলে না। টাকাটা বরং তোমার কাছেই রেখে দাও। বাই,,
কেটে দিল ফোন। মন খারাপ হয়ে গেল আরশির। কেন কল কেটে দিল। তাতে কি কন্টাক্ট নম্বর তো আছে, সারাদিন ফোন করে বিরক্ত করা যাবে। ভেবেই রহস্যময়ী হাসলো আরশি।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৮