অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৮

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৮
ইফা আমহৃদ

ভূত! নামটা শুনলেই ভেতরে একটা ভয়ংকর অনুভুতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু বিজ্ঞানে তার কোনো ব্যাখা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বর্তমান এবং অতীতে মানব সমাজের কুসংস্কার হিসেবে বিশ্বাস করে। বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখা না থাকলেও শিক্ষিত হয়েও ভূতকে বিশ্বাস করা আমি। অরিশ ভাইয়ার কাছ থেকে এর যুক্তিসংগত ব্যাখা পাই নি। তার একটাই কথা ভূত ভুতকে দেখে।

আমি ভূত তাই ভূতকে দেখি। তাই ভূতের ব্যাখা দিতে আজ ভূত রুপে ভাইয়ার কক্ষে আবির্ভূত হবো আমি। উজ্জ্বল সাদা রঙের শাড়ি, মোটা এবং এলোমেলো সাজগোজ। দেখতে পাক্কা ভূত। চামড়া গুলো কসমেটিক ব্যবহার করে কুঁচকে নিয়েছি। শাড়ির আঁচলটা মাটি পর্যন্ত মিশে গেছে। আরশিকে ধোঁয়া ওঠার দায়িত্ব দিয়েছি। তবে আজও আমি জানি না, ভূতরা কেন শাড়ি বস্ত্র পরিধান করে। অন্য কোনো রং কি তাদের অপছন্দ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গভীর রাত। চারদিকে অন্ধকার বিরাজমান। ল্যাপটপের আলোয় অরিশ ভাইয়ার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি শান্তমনে ল্যাপটপে কাজ করে চলেছে। পূর্বেই বেলকেনিতে লুকিয়ে ছিলাম আমরা। আরশি ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। ধীরে ধীরে ধোঁয়াশা হয়ে এলো কক্ষ। অরিশ ভাইয়া কেশে উঠলো। হাত দিয়ে নাড়িয়ে চশমার কাঁচ পরিস্কার করলেন। বললেন ..– “রুমের তার সার্কিটে সমস্যা হলো নাকি?”

উঠে দাঁড়ানোর পূর্ব মুহুর্তে অগোছালো চুলগুলো আরো অগোছালো করে টেনে টেনে এগিয়ে গেলাম ভেতরে। ফোকলা দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ দিয়ে টেনে টেনে অস্পষ্ট স্বরে বললাম..– “অরিশ..! তুই নাকি বিশ্বাস করিস না আমি এই পৃথিবীতে আছি। তাই তোকে আমার উপস্থিতি জানান দিতে এসেছি।”
বিনিময়ে দু’পা পিছিয়ে গেল ভাইয়া। চোখ থেকে চশমা খুলে চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় পড়ে নিল। তার দৃষ্টি ভুল নয়। ভ্রু কুঁচকে বলল..– “আবে কে তুই!”

বিরাগী হয়ে উঠলাম আমি। আরশি তো বলল, আমাকে পাক্কা ভূত লাগছে। তাহলে এই ছেলে আমাকে দেখে কেন ভয় পাচ্ছে না। ভুতুড়ে আওয়াজ তৈরি করে বলল..– “আমাকে চিনতে পারছিস না অরিশ, আমি তোর দাদা, তার দাদার, তার দাদার, তার দাদার ফুফাতো বোন।”

ভয় পাওয়ার বদলে স্মিত হাঁসলো অরিশ ভাইয়া।‌ তার মুঠো ফোনটা খুজে নিয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে পরপর কয়েকটা ছবি তুলে নিল। স্ক্রিনে তোলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল..
— “আমি আর দাদুর দাদু, তার দাদু, তার দাদু, তার দাদুর ফুফাতো বোনকে দেখি নি। আমার বিশ্বাস বাবাও দেখে নি। কালকে এই ছবিগুলো দেখাবো।”

ভরকে গেলাম আমি। কি বলে এইসব। ভুতের ছবি তুলে বলছে, সবাইকে দেখাবে। নাক ছিঁচকে বললাম..
— “আমি ভূত!”
— “আপনি বলেছেন, আমি শুনতে পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে। আমি এখন এই ছবি দেখিয়ে সবাইকে বলতে পারব, আপনি আছেন মহিশয়ী।”
— অ্যা..

— অ্যা নয় হ্যা। আচ্ছা আপনার এখানে একা একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না। দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।
বলেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে দিলেন। একটা ভুতের ফ্লীম অন করলেন। তার ছবিটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। ভয়ে আমার দম বন্ধ অবস্থা। ল্যাপটপ-টা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম ভাইয়া বুকে। পারলে ভাইয়ার বক্ষ ছিঁড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। তিনি আমাকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কদাচিৎ হেসে বলল..– “এটা কি হচ্ছে ভূত ভূতকে ভয় পায়।”

তিনি হাত ধরে আমাকে ল্যাপটপের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেদিকে যাওয়ার আগেই ভাইয়ার হাত খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। অতিশয় ভয়ে জ্ঞান হারালাম ?। ভাইয়া দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন আমায়। কোলে তুলে শুইয়ে দিলেন বেডের মাঝ বরাবর। পরপর কয়েকটা ডাক দিল। শুনতে পেলাম তার কন্ঠস্বর কিন্তু জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই আমার। ধীরে ধীরে শোনার ক্ষমতাটুকুও লোপ পেল। মস্তিষ্ক তলিয়ে গেল অতল অন্ধকারের। পুরোপুরি জ্ঞান হারালাম নিজের।

শীতের কুয়াশামাখা ভোরে নিদ্রা ভঙ্গ করতে হয়েছে আমাকে। আর পাঁচটা দিন যেখানে ব্লাঙ্কেটের তলে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে ছিলাম। আজ সেখানে রান্না করে কাটাতে হয়েছে আমাকে। রান্না করে একে একে সাজিয়ে দিয়েছি ড্রাইনিং টেবিলে। কিন্তু সেই খাবার জুটে নি আমার ভাগ্যে। জুটেছে কালকে পান্ত ভাত আর বাসি তরকারি। অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ধাত রয়েছে আমার। কিন্তু পেটের ভেতরের ক্ষুধা পিড়া দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে খেতে লাগলাম সেই খাবার। দু-লোকমা মুখে তোলার আগেই ফেলে দিতে হলো।

সুন্দর করে মেখে না ছিটকে মুখে পড়তেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো অরিশ ভাইয়া। সচরাচর তিনি কিচেনে আসেন না। হঠাৎ আজকে আসার যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পেলাম না। হাতে থাকা প্লেটটা নিজের পেছনে লুকিয়ে মলিন হাসলাম। তিনি আমার দিকে শান্ত চাওনি দিয়ে বললেন..

— “সেই কখন থেকে আমি তোকে খুঁজে যাচ্ছি, কোথায় ছিলি তুই?
কি খাচ্ছিস এভাবে, মুখে লেগে আছে আর আমাকে দেখে কি লুকালি?”
সাথে সাথে মুখের অপর্যাপ্ত খাবারগুলো মুছে নিলাম। আমতা আমতা করে বললাম..
— “কই, কিছু খাচ্ছি না তো!”

তিনি এগিয়ে এলেন আমার দিকে! ভ্রু কুঁচকে বললেন..– “আমি এখনো দেখতে পারছি, তুই খাচ্ছিস। আবার বলছিস, খাচ্ছিস না। তাহলে হাত পেছনে কেন তোর?
বাক্য উচ্চারণ করার আগেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। পেছন থেকে খাবারের প্লেট টা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। সরু চোখে তাকিয়ে বললেন..– “এইসব কি খাচ্ছিস তুই?”

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই প্লেটটা ছুঁড়ে মারলেন বেসিনের মাঝে। বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম আমি। হাত ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলেন। সবার সামনে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন..– “এইসব কি হচ্ছে মা? কি বলেছো তুমি ওকে? কেন ও পান্তা ভাত খাচ্ছে?”
অতিশয় ক্ষোভে তার শরীর কাঁপছে। তার এই রাগের সাথে পূর্ব পরিচিত নয় আমি। মামনি সামনে এসে বললেন..
— “কেন ও এইসব খাচ্ছে, আমি কিভাবে বলবো।”

— “মা আমি তোমার ছেলে হই। তোমার চেয়ে আমি তোমাকে সবচেয়ে ভালো চিনি। তরী কখনো তোমার অবাধ্য হয়নি। তাই তুমি না বললে এইসব ও কখনোই খাবে না!”
— হ্যাঁ! আমি ওকে এইসব থেকে বলেছি! এই বাড়িতে থেকে শুধু শুধু খাবার নষ্ট করছে আর আমাদের পেছনে ছুরি মারার চেষ্টা করছে। তাই এই বাড়িতে থাকতে হলে, কাজ করে খেতে হবে।

সবাই যেন বাক রুদ্ধ হয়ে গেল। সবাই অবাক চোখে মামুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মামুনির কথা হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাদের কথোপকথন চললো বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু মামুনিকে শান্ত করতেন পারলেন না। এবার পূর্বের তুলনায় বেশ রেগে উঠলেন তিনি। বলল..– “তরী খাওয়া নিয়ে যদি এতোই সমস্যা হয়। তাহলে আমার খাবারটা তরী খাবে।”

মামুনিকে কোনো কথা বলতে দিয়ে একে একে টেবিল ত্যাগ করলো সকলে। মামুনি ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখনই হয়তো আমাকে বকে দিবেন। কিন্তু তেমন কিছু করলেন না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..
— “শান্তি হয়েছে তোর? এবার সব খাবারগুলো গেল।”
বলেই হনহন করে চলে গেল সে। পেছনে পেছনে ছুটলো দিদা। হয়তো আবার কোনো বিপদ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

বিকেল চারটা পেরিয়ে গেছে আরো আগে। মেলা আরো জমজমাট হয়ে উঠেছে। ভিড় ভাট্টা হয়ে উঠেছে চারপাশ‌। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষজন। মিনিট বিশেক হয়েছে আমরা মেলায় এসেছি। আরশি বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটানোর চেষ্টা করছে। ভয় ভয় করছে তার। অনেকবার বেলুন ফুটানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তখন অরিশের জন্য সক্ষম হয়নি। তাই আজকে অরিশকে না জানিয়ে এসেছে। অপূর্ব নামক ছেলেটার সব টাকা শেষ করবে।

এক চোখ বন্ধ করে বন্দুক তাক করলো বেলুন দিকে। ছুঁড়ে মারলো প্লাস্টিকের বুলেট। বেলুন‌ তো ফুটলোই না উল্টো অন্যকারো মাথায় আঘাত করলো। সাথে সাথে ঘুরে গেল সে। আরশি ভাগ. বলে দৌড় দিতে চাইলে পেছনে থেকে ডেকে উঠলো কেউ। ধমকের সুরে বললেন..
— “এই বিচ্ছু মেয়ে, কি করলে এটা?”

আরশি ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকাতেই চমকে গেল। উবে গেল ভয়। এগিয়ে গেল কয়েক কদম। অপূর্বের গাল ধরে টেনে নিয়ে এলো কাছে। উষ্ণ গরম ফুঁ দিলো চক্ষু দর্পনে। অনুসূচনা মাখা কন্ঠে বলল..– “বেশি ব্যাথা লেগেছে জানেমান? এখনই সেরে যাবে।”
অপূর্ব নিভু নিভু নয়নে অবলোকন করলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৭

— “এভাবে কেউ বন্দুক চালায়। বন্দুক চালাতে হয় এইভাবে।”
সময় না নিয়ে আরশির হাত সমেত বন্দুট নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। একদম মাঝখানের লাল রঙের বেলুন বরাবর করে ছুঁড়ে মারলো। সাথে সাথে গিয়ে লাগল কাঙ্খিত জায়গায়।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৯