অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৯

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৯
ইফা আমহৃদ

বিকেল গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে অনেকটা। এখনও ক্রমাগত ঝগড়া করে চলেছে আরশি আর অপূর্ব নামক ছেলেটি। তাদের ঝগড়ায় অতিষ্ঠে সকলে। অপূর্বের ভয়ে কিছু বলার জোর নেই তাদের। আমি ভ্রু কুঁচকে শুধু তাদের কান্ড দেখে চলেছি। তাদের ঝগড়া যখন বেড়ে চলেছে তখন অপূর্ব নামক ছেলেটির দৃষ্টি নজরে পড়লাম আমি। থেমে গেল তাদের কথপোকথন। তিনি চপল পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। গহীন নয়নে চেয়ে রইলেন আমার মুখদর্পনে। কৌতূহলী কন্ঠে বললেন..

— “তরী, কি হয়েছে তোমার? তোমার মুখে স্পষ্ট ভাঁজ পড়েছে, তুমি কি কিছু খাওনি।”
নিজের ব্যাক্তিগত তথ্য অন্যকারো সাথে শেয়ার না করা উত্তম। মৃদু কন্ঠে বললাম..– “খেয়েছি!”
সাথে সাথে যেখানে এসে উপস্থিত হলো আরশি। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল..– “মিথ্যা কেন বলছিস ঋনি? মা যে তোকে খেতে দেয়নি সেটা কেন বলছিস না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপূর্ব নামক মানুষটির ভাবাবেগ কেমন হলো জানা নেই আমার। আমি রুদ্ধ দৃষ্টিতে আরশির দিকে অবলোকন করলাম। দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু শব্দে বললাম..
— “তোর কি কোনো জন্মে বুদ্ধি হবে না। বাড়ির কথা বাইরে কেন বলছিস?”
বোঝার বদলে উল্টো সুরে বলে উঠলো..

— “বাইরে লোক কোথায়? ও তো আমার জানেমান। শোনো জানেমান; মা আগে অনেক ভালো ছিলো। হঠাৎ করে কেমন জানি হয়ে গেল। তরীকে দিয়ে বাড়ির সকল কাজ করায়। ভালো খাবার খেতে দেয়না। তাই আজকে সকালে ভাইয়ার সাথে প্রচুর ঝগড়া হয়েছে। কতোকিছু খেতে বলেছি, কিন্তু খায় নি।”

শেষের শব্দ গুলো মুখ ভার করে বলল আরশি। মুহুর্তেই অপূর্বের চোখ মুখের অবস্থা শোচনীয় হতে দেখা গেল। আরশির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই হাত চেপে ধরলেন আমার। এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন আমায়। আমাদের পিছু পিছু আরশি এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো। অপূর্বের চোখের দিকে না তাকিয়ে বলল..
— ক-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?
— তোমার যেতে হলে উঠো, নাহলে বাড়িতে যাও। গো..

বাক্য উচ্চারণ করলো না আরশি। গাড়িতে আমার পাশের জায়গাটা বিনা বাঁধায় দখল করে নিল। পেছনে পেছনে এলো কয়েকজন গার্ড। হঠাৎ অপূর্বের এমন অবস্থা দেখে কাঁপতে কাঁপতে বলল..
— স্যার আমরা যেখানে যাচ্ছিলাম..
হাতের উল্টো পিঠ দেখিয়ে থামিয়ে দিল অপূর্ব।
“আমি এখন বাড়িতে যাবো। ইটস্ ফাইনাল। চলো..
তিনি বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।

খাবার টেবিলে বসে আছি আমরা তিনজনে। একে একে ইলিশ মাছের খাবারে টেবিল সেজে উঠেছে‌। অপূর্ব নামক ছেলেটি, বাড়িতে পৌঁছে তিনি সকলকে আধঘন্টা সময় দিয়েছে ইলিশ মাছ রান্না করতে। সর্বপ্রকার রান্না হয়েছে। ইলিশ মাছ বরাবরই আমার প্রিয় খাবার, তিনি জানলেন কিভাবে সেটাই বুঝতে পারলাম না।

সার্ভেন্ট রা সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে দিলেন। ইতোহস্ত বোধ নিয়ে দুই লোকমা মুখে দিতেই নিজের দিকে ডাকলেন তিনি। অপূর্বের পাশের চেয়ারটা টেনে দিলেন। বসলাম সেখানে। খাবার মেখে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। চেনা নেই জানা নেই, আছে অদৃশ্য আত্মার টান। সেই অদৃশ্য টানে এতোটা আদোও কেউ করে। আচ্ছা এই ছেলেটার জায়গায় যদি আমার নিজের ভাইয়া থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই এমনটা করতো।
মাথা নিচু করে বললাম..– “আমি খেয়ে নিতে পারব ভাইয়া।”

তিনি আমার কথা কর্নপাত করলেন না। হাতটা আরেকটু এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। স্মিত হেসে বলল..
— “কথা না বলে মুখ খোল খুকি। সবসময় তো নিজের হাতে খাস, আজকে নাহয় আমি খাইয়ে দিলাম।”
খুকি। কি করছিস খুকি, শুনছিস খুকি, কাঁদছিস খুকি। মন খারাপ খুকি। এই শব্দ গুলো আমাকে অতিশয় পরিচিত একজন কাছের মানুষের কথা স্বরণ করিয়ে দিলো। অস্ফুট স্বরে বললাম..– “খুকি।”

কদাচিৎ ফাক করে গেল ওষ্ঠজোড়া। সেই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিলো খাবারের লোকমা। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার ব্যস্ত ভাবনার ছেদ ঘটল আরশি কথায়। মুখ ফুলিয়ে বলল..
— “এদিকে একটা অবুঝ শিশু বসে আছে। ”
অপূর্ব সময় নিলো না, মৃদু হেসে খাবারের লোকমা এগিয়ে দিলো আরশির দিকে। আরশি মুচকি এসে চেয়ার টেনে এগিয়ে এলো অপূর্বের দিকে।

সময়টা শীতকাল। চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। মাটিগুলো বরফের চাকার মতো হিম শীতল হাওয়া আছে। মেঝেতে সামান্য পাতলা নকশিকাঁথা বিছিয়ে তার উপর শুয়ে আছি। রান্নাঘরের জানালা বেঁধ করে ঠান্ডা হাওয়া ভেতরে প্রবেশ করছে। রীতিমত কাঁপাকাঁপি করছি আমি। ঝড়সড় হয়ে গুটিয়ে আছি ঠান্ডায়। এখন এটাই আমার থাকার জায়গা। মামুনির কড়া নির্দেশ।

কারো চরণ ধ্বনি কানে এলো আমার। নড়েচড়ে উঠলাম আমি। ভয়ে কম্পনের মাত্রা আগের তুলনায় কয়েকশত গুন বেড়ে গেল। তদানীং কোনো উষ্ণ ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়েছে আমায়। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অস্পষ্ট স্বরে বললাম..– “ক-কে?”

— তরীরানী, এই নৌকারানী। কার সাহস আছে, আমি ছাড়া অন্য কেউ তোকে স্পর্শ করবে।
ভয় নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। পেছন ফিরে অরিশ ভাইয়ার শরীরের সাথে এক প্রকার লেপ্টে গেলাম। তার উষ্ণ দেহের তাপে নিজের শীতলতা কমানোর চেষ্টা করলাম। আমার কান্ড দেখে বললেন..

,– বেশী শীত করছে?
কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিলাম না..– “না।”
দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগেই নিজের উপরে তুলে নিলেন আমার। দৃঢ় বাঁধনে বেষ্টিত করে নিয়ে বলল..
— “আমার কাছে মিথ্যা বলতে হবে না। ঘুমিয়ে পর।”
চোখের পাতা বড্ড ক্লান্ত তাই দ্রুত নয়ন গ্ৰথন করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালাম।

নিদ্রা ভঙ্গ হতেই পর্বপ্রথম অরিশ ভাইয়ার মুখটা দর্শন করলাম। আমাকে পূর্বের ন্যায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। ঠান্ডায় নাক টাকছেন। তার বুকে অবস্থান করে নিজেকে কেমন জানি পূর্ণ পূর্ণ অনুভব করছি। তার মাথায় এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। গভীর দহনে অধর ছুয়ে দিলাম কেশ বিহীন ললাটে। আচ্ছা মানুষটা এতো কিউট কেন? কেন এতো যত্ন নেয় আমার। এই মানুষটিকে সেই ছোট বেলা থেকে ভালোবেসে আসছি। কখনো বলা হয়ে উঠেনি তাকে।

নড়ে চড়ে উঠলেন তিনি। কেশে উঠলেন একবার। হালকা হয়ে এলো বাহু বন্ধন। ডেক্সি বের করে চুলোয় দুই কাপ সমপরিমাণ পানি দিয়ে দিলাম। আদা আর প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দিলাম। পানি গরম হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে নামাজ আদায় করে এলাম। পরিমাণ মতো চা পাতা আর চিনি দিয়ে দিলাম।

এককাপে চা ঢেলে আস্তে আস্তে অরিশ ভাইয়াকে ডাক দিলাম। উঠে বসলেন তিনি। হাতে ধরিয়ে দিলাম চায়ের কাপ। ভ্রু কুঁচকালো সে। চুমুক দিলো চায়ের কাপে। অবশিষ্ট অংশ টুকু খেয়ে কাপ এগিয়ে দিলেন। হাঁটু ভাঁজ করে বলল..
— “অসাধারণ হয়েছে। এখন থেকে রোজ সকালে কফি নয়, এককাপ আদা চা করে দিবি। মনে থাকবে..
মৃদু হেঁসে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রদান করলাম আমি। সকালের ব্রেকফাস্টের তোরজোর শুরু করে দিলাম। আজ সোমবার। ভার্সিটিতে যেতে হবে। রান্নায় দেরী হলে ভার্সিটিতে যাওয়ার হবে না। রান্নার কাজে হাত লাগাতেই অরিশ ভাইয়া উঠে পড়লেন। ব্যবহৃত বালিশ কাঁথা গুলো ভাঁজ করে রাখলেন। আমার কাজে সাহায্য করলেন তিনি। আমার প্রতি তার দায়িত্ববোধ দেখে শুধু মুচকি হাঁসলাম।

মৃগী রোগ নামক শুনলেই ভেতরের টনক নড়ে উঠে। ভয়ংকরের চেয়ে ভয়ংকর যাকে বলা হয়। এই রোগটা যখন তখন যেখানে সেখানে উঠতে পারে। রোগটি অবস্থান করা সময়টুকু জ্ঞানহীন, প্রাণহীন মানুষ। এমনকি মানুষকে চির নিদ্রায় তলিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এই রোগটি দানা বেঁধে রয়েছে দিদার শরীরে। বিগত দিনগুলোতে হঠাৎ দিদার শরীরে উপদ্রম হলে তাকে নিয়ে হাহাকার পড়ে যেত। আজ তার ব্যাতিক্রম কিছু হলো না। দিনটা ভালোই ছিল।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৮

মামুনি মাজারে গিয়েছিল। শান্তমনে ভার্সিটি থেকে ফিরেছিলাম বাড়িতে। বাড়িতে প্রবেশ করতেই ধোঁয়ায় কাশি হওয়ার উপক্রম। আমি আর আরশি একপ্রকার ছুটে গেলাম রান্নাঘরের দিকে। দিদার একহাত চুলার জ্বলন্ত আগুনের শিখায় রয়েছে। দিদা কিচেনের তাকের উপর মাথা ঠেকিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। দিদাকে এমন অবস্থায় দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমরা। পরিনত হলাম জীবন্ত দানবে। ভেতরের টনক নড়লো এবার। ছুটে গেলাম চুলোর কাছে। চুলো নিভিয়ে দিয়ে বালতি ভর্তি হিম শীতল পানি নিয়ে হাজির হলাম। দিদার হাতটা পানিতে চুবিয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ। চোখ মুখে পানি ছেটালাম, ফিরলো না তার জ্ঞান। উপায়হীন হয়ে অরিশ ভাইয়ার নাম্বারে ডায়াল করলাম। প্রথমবারে রিসিভ না হলেও‌ পরে হলো।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১০