অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১০

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১০
ইফা আমহৃদ

চারপাশে তখন গভীর রাত বিরাজমান। এখনো জ্ঞান ফেরেনি দিদার। প্রাইভেট হাসপাতালে আনা হয়েছে তাকে। আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন সেখানে। ডাক্তারদের দেখা নেই। তবে নার্স পোড়া হাত ব্যান্ডজ করে দিয়েছে। ডাক্তারের অভাবে ইলেকট্রিক শক না দেওয়া যায়নি তাকে। বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে জানতে পারলাম হসপিটালে একজন দক্ষ ডাক্তার রয়েছে। তিনি মাত্র একদিন অর্থাৎ সোমবার চেম্বারে বসে। মূলত হসপিটাল টা তার নামে। সার্জন বিষয় দক্ষ হলেও, মোটামুটি সকল বিষয়ে তিনি পারদর্শী। কারণটা সকলের অজানা।

বর্তমানে ছুটছি সেই ডাক্তারের চেম্বারে। বাইরে তার এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটি কি আদোও পৌঁছাতে দিবে ভেতরে। অন্য উপায় অবলম্বন করলাম আমরা। কথার তালে বুলিয়ে রাখলাম এসিস্ট্যান্ট নাম স্বল্প বয়সী ছেলেটিকে। এই ফাঁকে ভেতরে প্রবেশ করলো আরশি। ভেতরে প্রবেশ করেই দরজা বন্ধ করে দিলো। মৃদু শব্দে ফিরে চাইলো সকলে। কুঁচকে এলো আরশি ভ্রু যুগল। তার সাথে প্রচুর বিরক্ত সে, অবাকও। আগে পেছনে কিছু না ভেবেই ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরুন পেশেন্টরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হওয়ার কারণ, ডাক্তারের আসনে আর কেউ নয় গ্যাং স্টার অপূর্ব নামক ছেলেটি বসে আছে। আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “তাহলে এই কথাই রইলো মিঃ আহম্মেদ। এবার আসুন।”
তারা গহিন নয়নে আরশির দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। মাথা নিচু করে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল আরশি। অপূর্ব এগিয়ে এলো আরশির দিকে। দুহাত বুকে গুজে বলল..– “কি চাই এখানে?”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আরশি। ভরকে গেল অপূর্ব। সরু চোখে তাকিয়ে বলল..
— “কি হয়েছে আরু? কাঁদছো কেন?”

বিনিময়ে অপূর্বের সাথে লেপ্টে গেল সে। কান্নার শব্দ ক্রমশ বেড়ে গেল। অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। প্রথমবার কোনো রমনী সংস্পর্শ। নিজেকে সামলাতে অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কোমর জড়িয়ে টেবিলের উপর বসিয়ে দিল তাকে। কাতর কন্ঠে বলল..
“আরু, কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে.

— “দি-দা, ভিলেন সাহেব, দি-দা।”
— “কি হয়েছে দিদার?”
— “চলুন, দেখবেন।”
আরশি কান্নারত অবস্থায় অপূর্বের হাত ধরে বেরিয়ে এলো। এগিয়ে গেল দিদার কেবিনের দিকে। পেছন থেকে নজর কাটলাম আমি। ধীরে ধীরে যাতে ওদের ভেতরের সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাক, পূর্ণতা পাক তাদের ভালোবাসা।

অন্ধকার নির্জন রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান। সেই অন্ধকারের মাঝে হেঁটে চলেছি আমি। ঠান্ডা হওয়া শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমার। তার সাথে যোগ হয়েছে ভয়। হাতে মেডিসিনের প্যাকেট‌। আমার একহাত জড়িয়ে ধরে আছে আরশি। আমার চেয়ে বেশি ভয়ে কুপোকাত সে। অন্ধকারের আবরন পেরিয়ে দেখা গেল আলোর শিখা। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। হসপিটালের রাস্তা ভুলে গেছি আমরা। সামনেই কয়েকটা ছেলেদের দেখা গেল। তারা আড্ডায় মেতেছে। ঠিক করলাম তাদের কাছে হসপিটালের এড্রেস জিজ্ঞাসা করব।

তাদের‌ কাছে পৌঁছে ঠিকানা জানতে চাইলে কিছু বললেন না তারা। বিনিময়ে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন। হাইফেন করে বলল..
— “মামা আজকে তো যব্বর মাল পাইছি। দুইটারে দিয়ে আমাদের আটজনের হয়ে যাবে। লাল জামা পড়াটা কিন্তু আমার।”

নিজের দিকে তাকাতেই আতংকে উঠলাম আমি। এরা কি বলছে, বুঝতে সক্ষম হলাম। সাহায্য চাইতে এসে এখন কি বিপদে পড়বো। একহাতে আরশি হাত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলাম। অতিশয় পায়ের শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলো না, তারাও আমাদের পিছু পিছু আসছে।

পায়ে ব্যাথা করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে শরীরটা, তবুও তারা পিছু পিছু ছুটছে তারা। একসময় শক্তি ক্ষয় হয়ে লুটিয়ে পড়লাম রাস্তার মাঝে। আরশি পেছনে ফিরে চাইলো। আমার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে একপ্রকার জোর করে আরশিকে পাঠিয়ে দিলাম। আরশি অদূরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। যাই হোক নিজের জন্য অন্যকারো ক্ষতি করতে পারি না। তখনও ক্রমাগত আমার দিকে এগিয়ে আসছে তারা।

মৃদু ঝুঁকে আমার ওরনা টান দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে লোচন যুগল খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। পরক্ষণেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম। কাঁপা কাঁপা আঁখি যুগল মেলে তাকাতেই দেখতে পারলাম লুটিয়ে পড়ে আছে সেই ছেলেটি। ভুতুড়ে ঢোক গিলে পেছনে তাকাতেই আমার ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। তৃপ্তিকর হাঁসির রেখা ফুটে উঠলো মুখে। অরিশ ভাইয়া আর অপূর্ব ভাইয়া হিংস্র মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার এই রুপে ভেতরটা কম্পিত হলো আমার। অরিশ ভাইয়া আমাকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। ওরনাটা ভালো ভাবে শরীরে পেঁচিয়ে দিলো। বুকে জড়িয়ে নিল আমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল..–

“কিছু হয়নি ডিঙি-রানী।”
তার শান্তনা শোনার মতো জ্ঞানশক্তি অবশিষ্ট নেই আমার মাঝে। শরীরটা ক্রমাগত হালকাহয়ে আসছে।
শোনার মতো মস্তিষ্ক সচল রইলো না আমার। ভাইয়ার বুকে মাথা ঠেকিয়ে জ্ঞান হারালাম সেখানে। কি হলো জানা নেই আমার।

পরক্ষণেই মুখের আকৃতি পরিবর্তন করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল..– “সাহস কি হয়, আমার জানে হাত দেওয়ার। ওর গায়ে হাত দেওয়ার আগে তোর হাত মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলবো আমি।”
অরিশ ভাইয়া আর কিছু উচ্চারণ করার আগে তার কাঁধে হাত রাখলেন। ইশরার কিছু একটা বুঝাতেই থেমে গেলেন তিনি। এগিয়ে গেল অপূর্ব ভাইয়া। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল..

— ঈগল গ্যাং এর গ্যাং স্টার অপূর্ব আহসান কে চিনিস?”
— “ঐ সালারে, কে না চিনে!”

সাথে সাথে ঠাস ঠাস শব্দে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে মুখের সামনে ধরলেন। সবাই একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো কিছুক্ষণ। একজন তো ইতিমধ্যে বলেই ফেলেছে, এটাই অপূর্ব আহসান। আমি তারে টিভিতে দেখছি। ভাই এর মনে দয়া মায়া নাই। বাঁচতে চাইলে ভাগ..! না, না। ক্ষমা চা, নাইলে পাতালে থাকলেও তোরে খুঁজে বের করবে।

সাথে সাথে পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো সকলে। অপূর্ব চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিল। পা ঝাড়া দিয়ে পেছনে এসে দাঁড়ালো কয়েকপা। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল..
— “তোরা আমার বোনেদের শরীরে হাত দেওয়ার দুর্সাহস দেখিয়েছিস। ইচ্ছে করতে নিজের হাতে মাটিতে পুঁতে ফেলতে কিন্তু পারছি না..
তোদের পরে দেখে নিচ্ছি, ফোট ..

শেষের শব্দ টা গলা ফাটিয়ে বললেই এক ছুটে দৌড়ে পালালো সকলে। একে একে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সকলে। হাই তুলে এগিয়ে গেল আরশির দিকে। ইতিমধ্যে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। মাথা নিচু করে একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে চোখের অশ্রুটুকু মুছিয়ে দিল। সাথে সাথে অপূর্বকে জড়িয়ে ধরলো আরশি। মনের মাঝে শিতল আবরন ছড়িয়ে গেল অপূর্বের। অন্তরে জানান দিলো, দ্বিতীয় স্পর্শ। ধরলো না অপূর্ব। কৌতূহলী কন্ঠে বলল..

— “তুমি কি কথায় কথায় নাকে কান্না করা আর জড়িয়ে ধরার ডিগ্রি অর্জন করেছো?
চোখ মুখ কদাচিৎ ছোট করে অরিশের সাথে পা মেলালো আরশি।

— “এখন কি আমি বলে দিবো, কিভাবে ওদের খুঁজে বের করবি ইডিট। তোর সাত পুরুষের ভাগ্য ভালো, আমি তোদের সামনে নেই। যদি থাকতাম..
আমি জানি না, কিভাবে ওদের খুঁজে বের করবি! কিন্তু আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে ওদেরকে আমার সামনে চাইই চাই।”
রাগে গজগজ করতে করতে হাতের মুঠো ফোনটা ছুঁড়ে ফেললো। টুং টাং ধ্বনিতে করে তার পায়ের কাছে খুলে পড়লো ফোনটা বাকি অংশ গুলো। তার রাগের কাছে ভয় পেয়ে গেল সকলে। এটা দূর্বলতা। লম্বা হুড পড়া একজন লোক এসে তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বলল..

— “স্যার জহুরা এপার্টমেন্টের মালিক টেক্স দিতে ঝামেলা করছেন? কি করব.
রক্তচক্ষু দিয়ে লোকটির দিকে তাকাতেই পিছিয়ে গেলেন তিনি। মাথা নত করে সকলে তাকালেন। উঁচু গলায় লোকটি বলল..
— কেন? কেন রেখেছি আপনাদের একটু বলবেন আমাকে? সামান্য একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না। আবার কয়েকটা ছেলের খবর আমাকে দিতে পারছেন না।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৯

সবাই মাথা নত করে রইলো। পরক্ষনেই প্রবেশ করলো আরেকজন লোক। বললেন..
— “স্যার আপনার খুকির জ্ঞান ফিরেছে। এই মাত্র খবর পেলাম। দেখবেন না আপনি?
হম উচ্চারণ করে লোকটি কিছুক্ষণ দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করলেন। ভেতরের কষ্টগুলো দূর করার চেষ্টা আরকি। অতঃপর একটা কাগজ আর কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলেন। তার খুকির পছন্দসই সবকিছু সেই কাগজে লিস্ট করে নিলেন। অনলাইনে সেই সব জিনিস অর্ডার করে তার কাঙ্খিত জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। তাকে এখন আবার বেরুতে হবে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১১