অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১১

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১১
ইফা আমহৃদ

পিটপিট করে নয়ন যুগল মেলে তাকাতেই সর্বপ্রথম অরিশ ভাইয়ার মুখ দর্শন করলাম। তিনি মৃদু ঝুঁকে আছেন আমার মুখের দিকে। নয়ন যুগল মেলে তাকানোর দ্বি মুহূর্তে পুনরায় গ্ৰথণ করতে হলো। জলকণা চোখের পাতার উপর পড়তেই খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর নয়ন জোড়া মেলে পুনরায় অবলোকন করলে দেখতে পেলাম অরিশ ভাইয়ার আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমকালাম আমি, ভিশন চমকালাম। তিনি তো আমার থেকে বেশ দূরে অবস্থান করছেন। তাহলে কেন চিত্তানুভব হয়েছিল, তিনি আমার সন্নিকটে বসে ক্রন্দন করছিলেন। হয়তো এটাই আমার দৃষ্টিভ্রম। উঠে বসার প্রয়াস করতেই বাঁধ সাধলেন তিনি। এগিয়ে এলেন আমার অভিমুখে। মস্তক নিজের কোলে নিয়ে নিলেন। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন..

— “চড়ুই পাখি উঠতে হবে না তোকে? শান্ত হয়ে একটু রেস্ট নে। নড়াচড়া করলে স্যালাইনের ক্যানেল শিরা হাঁরিয়ে ফেলবে।”
হন্তদন্ত হয়ে দৃষ্টিপাত করলাম পাশে। প্রদর্শন হলো স্যালাইন। এতোক্ষণের এইটুকুই মস্তিষ্ক জানান দিলো না। দৃষ্টি সরিয়ে কেবিনের বাকি অংশ গুলো পরীক্ষা করলাম। না আজও ভাইয়া আসে নি। আয়াস গুলো ভেতরে পেঁচিয়ে পুন্ডুলির ন্যায় হলো। অরিশ ভাইয়ার হয়তো আন্দাজ করতে সক্ষম হলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “মন খারাপ করিস না পিচ্চি। অপূর্ব আসতে পারে নি তাকে কি হয়েছে? তোর জন্য অনেক গিফ্ট পাঠিয়েছে। ঐ দেখ।”
ভাইয়া কখনো আমার আবেদন অপূর্ণ রাখেনি। যখন যেটা অবশ্যক ম্যাজিকের মতো পাঠিয়ে দিতো। কিন্তু ক্লাস ফাইভে উঠার তাকে দেখা হয়নি। আমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে গেছে সে। মাঝে মাঝে শুধু ফোনেই কথপোকথন চলে তার সাথে।

অরিশ ভাইয়া তারুন্য ভাইয়ার কন্টাক্ট নাম্বারে ডায়াল করে, শ্রবণপথে ধরলেন আমার। হাতে নিলাম না ফোন। মুখ ভার করে রইলাম। এবার তিনি স্পিকারে দিয়ে দিলেন। বিপরীত পাশ থেকে ভেসে এলো ভাইয়ার সেই পরিচিত কাতর কন্ঠস্বর..

— “কি হয়েছে খুকি। আমার উপর রাগ করে আছিস? রাগ করিস না পাগলীটা আমার। একদিন ঠিক আমাকে দেখতে পারবি। ”
–” হ্যাঁ একদিন তোমাকে ঠিকই দেখতে পারব, তবে সেই দিনই তোমার সাথে কথা বলবো, তার আগে নয়।”
ললাট তুলনামূলক কুঁচকে অধর বাঁকিয়ে হাসলেন তিনি। তার হাসিতে গাঁ জ্বলে গেল আমার। খপ করে ফোনটা নিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম। আর কখনো তার সাথে কথা বলবো না।

হসপিটালে থেকে ফিরেছি অনেকটা দিন পেরিয়ে গেল। গতিশীল সময় পেরিয়ে গেছে আমাদের। দিদা সুস্থ হয়ে উঠেছে। আমি মোটেও অসুস্থ ছিলাম না, তবে ভাইয়া আমার যত্ন নিয়েছে। এখন আমি আর আরশি আগের মতো একসাথে ঘুমাই। মামনি এটা মেনে নিতে না চাইলে অরিশ ভাইয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছে।

গত দুদিন ধরে আগের থেকে মধুর ব্যবহার করছে মামুনি। কেন জানি, সেই ভালোবাসাটা লোক দেখানো মনে হচ্ছে, অন্তর থেকে নয়। আমি মেনে নিয়েছিলাম সেই ভালোবাসাটা। কিন্তু পারলাম আর কই। আজ সন্ধ্যায় একজন ভদ্র মহিলা তার ছেলেকে সাথে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। মামুনি আপ্পায়নে ব্যস্ত হয়ে গেছে। দিদাও যোগ দিয়েছে সাথে। দিদার ভালো ব্যবহারটা কেন জানি সহ্য হলো না আমার।
আচম্বকাই মামুনি আমার হাতে একটা সুতি শাড়ি ধরিয়ে দিলেন। বারবার পড়তে বললেন। প্রথমে বুঝতে না পারলেন পরে পারলাম।

শাড়িটা পড়ে নিচে নামতেই হাতে ধরিয়ে দিলেন শরবতের গ্লাস। শাড়ির অগোছালো কুচিগুলো ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। আমাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলেন। আমাকে তার পাশে বসিয়ে দিলেন। কিন্তু অলঙ্কারের মতো পরক করে নিলেন আমাকে। ততক্ষণে মামুনি এসে বসেছে আমাদের সামনে সোফায়।

মামুনির দিকে দৃষ্টিপাত করে ইশারায় মুচকি হাসলেন মহিলা। একটা রিং পড়িয়ে দিলেন আমার অনামিকা আঙ্গুলের ভাঁজে। নজর কেটে বললেন..
— “বাহ্। বেশ মানিয়েছে।”
তার বাক্য ধ্বনি শেষ হওয়ার আগে কন্ঠস্বর শোনা গেল দিদার। বললেন..
— “আপনার ছেলের সাথে তরীকে বেশ মানাবে।”
এতোক্ষণে ছেলেটিকে নজরে এলো আমার। সকলের মুখে উচ্চেপড়া হাঁসি। কিন্তু আমার মুখে নেই। শব্দময় ক্রোন্দন করার মতো অবস্থা হয়েছে আমার। ভাষাগুলো হারিয়ে গেল মুহুর্তেই। কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নাড়িয়ে উচ্চারন করলাম..

— “মামুনি কি বলছো তুমি?”
সবাই দৃষ্টি তখন আমার মাঝে বন্দী‌। তাই আমাকে থামিয়ে মামুনি বলতে অনুবদ্ধ করলেন..
— “আসলে ছোটবেলা থেকে আমাদের কাছে বড় হয়েছে তো। তাই বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছে না।”

— “আমিও তোমাকে আমার মেয়ে করে নিবো। তোমার মামুনির অভাব বুঝতে দিবো না। তুমি চিন্তা করো নি মা..
মুখ বন্ধ হয়ে গেল আমার। জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। নয়ন জোড়া ভিজে উঠলো। মামুনি তাকে সালাম করতেন বললেন। চুপচাপ তার মতো সালাম করলাম। তাদের কথার মাঝেই মামুনি রুমে পাঠিয়ে দিলেন আমায়।
দরজা বন্ধ করে শরীর থেকে শাড়িটা এক টানে খুলে ফেললাম। হাঁটুতে মাথা মুড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম এবার। মামুনি কিভাবে পারলেন আমার সাথে এমনটা করতে। অরিশ ভাইয়া তিনি কি জানেন, মামুনি আমার সাথে এমনটা করেছেন। আরশি আটকাতে পারতো, সে-তো বাড়িতে নেই। আজ বন্ধুদের সাথে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। আজ আমি আরেকজনের বাধ্যক্তা হয়ে গেলাম।

নিঝুম রাত্রি। হুতুম পেঁচা ডেকে চলেছে চারদিকে। কাঁদতে কাঁদতে তন্দ্রালগ্ন হয়েছিলাম আমি। মাঝরাতে কারো হিম শীতল স্পর্শ পেয়ে তন্দ্রা ভঙ্গ হলো আমার। অরিশ ভাইয়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে আমার সম্মুখে। তাকে কাছে দেখে মৃদু হাসলাম আমি। সংকোচ নিয়ে তার এলোমেলো কেশগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলাম। আজ কেমন দুজনের মাঝে অদৃশ্য দেয়ালের উপস্থিতি অনুভব করলাম। কোনো এক অপরিচিত প্রহরে তার এই ভুবন ভোলানো চুলগুলো ছোঁয়ার অধিকার আমার থাকবে না। আমার স্পর্শে নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। হাতটা মাথার নিচে নিয়ে নিলেন। অতিশয় কম্পিত হলো আমার সর্বাঙ্গ। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরে হাত ছেড়ে দিলেন। নিজের গালে স্লাইড করলেন। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন..

— “তোর হাতে কি লাগিয়েছিস পিচ্চি? গালে একদম ঢুকে গেছে।”
উল্টিয়ে নিজের হাতটা অবলোকন করলাম। অনামিকা আঙ্গুলের গোড়ায় একটা পাথরের রিং। যেটা আমার খেয়াল করাই হয় নি। হাতটা সরিয়ে নিলাম। অরিশ ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে এবার বেশ বিরাগী হলেন তিনি। উঠে বসলেন। অন্ধকারে আবৃত ঘরে তার মুখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন..

— “কি হলো কথা বলছিস না কেন? দেখি কি লাগিয়েছিস।”
হাতটা টেনে নিলেন ভাইয়া। ফোনের ফ্লাস লাইট জ্বালিয়ে নিলেন। আচম্কা আলোয় কুঁচকে এলো ললাট। হাতের বরাবর ধরলেন তিনি। রিং টা খুলে এপিঠ ওপিঠ করে দেখলেন। কৌতূহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন ছুঁড়ল..
— “পিচ্চি দেখে তো গোল্ড মনে হচ্ছে। তোর কাছে গোল্ড এলো কিকরে?”

মাথা নিচু করে রইলাম আমি। উত্তর নেই আমার কাছে। কি বলবো তাকে, আমার অবাধে রিং পড়িয়ে গেছে। নিজের কাঙ্খিত উত্তর না পেয়ে বেশ রেগে গেলেন তিনি। চেপে ধরলেন আমার নরম কোমল হাত‌। দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত ঘর্ষণ করে বললেন..

— “থাপরিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো..। তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে। ভালোভাবে কথা বললে তোর গায়ে লাগে না। বল..
শেষের শব্দ টা বেশ দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন তিনি। তার কন্ঠে কম্পিত হলো আমার শিরায় শিরা। ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম। আবেশে বাহুডোরে মিশিয়ে নিলেন আমায়। আদুরে গলায় বলল..

— “পিচ্চি; এই পিচ্চি! কাঁদিস না প্লীজ। কিছু জিজ্ঞাসা করার পরে উত্তর না পেলে আমি রেখে যাই। বল কি হয়েছে..
একে একে সব ঘটনা খুলে বললাম ভাইয়াকে। আমার বলা অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছালেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন ড্রয়িং রুমে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চিৎকার করলো লোচনগুলো মুহুর্তের মাঝেরক্তিম হয়ে এলো। তার এই মুখশ্রীর সাথে বেশ অপরিচিত আমি। ধীরে ধীরে নেমে এলো সকলে।

আমার হাতের অনামিকা আঙ্গুল থেকে রিং টা খুলে ছুঁড়ে মারলেন মামুনির পায়ের কাছে। বিনিময়ে দু’পা পিছিয়ে গেলেন তিনি। আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকালেন। মাথা নিচু করে রইলাম।
অরিশ ভাইয়া ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে শান্ত গলায় বলল..
— “তারুণ্যের অনুপুস্থিতিতে আমি তরীর গার্ডিয়ান। ওকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১০

ভাইয়ার বাক্যগুলো অস্পষ্ট হওয়ার আগেই মামুনি এগিয়ে এলেন আমার অভিমুখে। আচম্বিতে পরপর চড় বসিয়ে দিলেন গালে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১২