অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১২

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১২
ইফা আমহৃদ

শুনশান নিরিবিলি পথঘাট। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান।‌ শুনশান নিরিবিলি পথ অতিক্রম করে হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে আরশি। সময় রাত দুইটা পনেরো মিনিট। এই গভীর রাতে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছে। নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই তার জন্য অনুচিন্তন করছে। একসময় ঘুটঘুটে অন্ধকার অতিক্রম করে মৃদু আলোর দেখা মিললো।

আরো কিছুটা পথ অতিক্রম করার পরে দেখা মিললো অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটির। তবে আরশির হৃদমাঝারে বিরাজমান শঙ্কা নিমিষেই হ্রাস পেল। অপূর্ব বসে আছে গাড়ির দরজা খুলে। একপার উপরে অন্যপা মাটি সংলগ্ন করেছে। দাঁতের ভাঁজে টুথপিক। বাম হাতে ব্যান্ডের সিলভার কালারস ওয়াচ। গোছালো কেশসমূহ পেছনে হেলিয়ে দেওয়া। আঙুলের ভাঁজে কালো সানগ্লাস ঘুড়াচ্ছে। অন্ধকারে মুখশ্রী পরিস্ফুট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আরশির পরিচিত মানবটিকে চিনতে সময় লাগলো না। স্মিত হাঁসলো আরশি। কাঁধে রক্ষিত ব্যাগটা বাম হাতে চেপে ধরে ছুটতে লাগালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপূর্বের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো আরশি। হাঁটুর উপর ভর করে হাঁপালো সে। অপূর্ব ভ্রু কুঁচকালো। চোখজোড়া পরিস্কার করে পুনরায় দৃষ্টি স্থির করলো। না তার দৃষ্টিভ্রম নয়। বিরাগী হতে দেখা গেল তাকে। মুখশ্রী সরিয়ে নিলো অদূরে। সবসময় এই রমনী তাকে বিরক্ত করে। গার্ডরা অপূর্বের ভঙ্গিমা বুঝতে পেরে আরশির দিকে এগিয়ে গেল। আরশির পথ আটকে দাড়িয়ে বলল..

— “এই মেয়ে কি চাই এখানে? যাও বলছি এখান থেকে।”
বিনিময়ে মুখ ভেঙালো আরশি। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অপূর্বের পাশে বসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল..
— “কেমন লোক পোষো তুমি জানেমান? কথায় কথায় এগিয়ে আসে মেয়েদের দিকে। বেহায়া নির্লজ্জ ছেলেরা।”
সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে হতাহত চোখে আরশির মুখপানে চেয়ে রইল। আরশি ভাব নিয়ে অপূর্বের হাত জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মাথা রাখল। ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল..

— “ছাড়ো আমায়, এমন করছ কেন? এতো রাতে, রাস্তায় কি করো তুমি? সেদিন তো ভয়ে মরো মরো অবস্থা হয়েছিলো। শিক্ষা হয়নি।”
— “আমার আবার ভয় কিসের? জানেমন আছে না। সেদিন যদি ওরা জানতো, আমি গ্যা স্টার অপূর্ব আহসানের জান,তাহলে দশবার কান ধরে উঠবস করতো।”

অপূর্বের হাত থেকে সানগ্লাস-টা নিয়ে নিজের কাজল টানা নয়নজোড়া ঢেকে নিল আরশি। আরো লেপ্টে গেল অপূর্বের বাহুতে। অপূর্ব কিছু করতে পারলো না। অবশেষে হাত ছাড়িয়ে নেমে দাঁড়ালো সে। সানগ্লাস টা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ঘুড়াতে ঘুড়াতে নিজের চোখে পড়ে নিলো। শার্টের কলার টেনে ঠিক করে আরশি হাত ধরে টেনে সরিয়ে দিল।

ফটাফট গাড়িতে উঠে বসলো অপূর্ব। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার আগে তার গার্ডরা সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো। গাড়ি চলেছে শুরু করলো। গাড়ি যতোই সামনের দিকে এগুচ্ছে আরশির মনের কোণে ততই ভার হয়ে আসছে। একসময় শূন্যতায় অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটা। ক্রমাগত ভীতি বাড়তে শুরু করলো তার। ব্যাগটা শক্ত করে খামচে ধরে সামনের দিকে পা চালালো সে। কিভাবে পারল অপুর্ব তাকে একা এই মাঝরাতে, মাঝ রাস্তায় ফেলে যেতে। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে।

কিছুদূর পৌঁছাতেই একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামলো তার সামনে। দুইজন ছেলে নামলো গাড়ির ভেতরে থেকে। আরশির মাথা থেকে পা পর্যবেক্ষণ করে বলল..
— “এই সেই মেয়েটা না, যার জন্য রতন আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের ধরে নিয়ে গেছে। একে দিয়েই ওদের ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।”

একপ্রকার তেজশক্তি দিয়ে আরশিকে গাড়িতে তোলার প্রচেষ্টা চালালো তারা। অনেক দস্তা দস্তির পরে সক্ষম হলো। কিন্তু ততক্ষণে বেশ সময় বিলম্ব হয়ে গেছে। কালো রঙের গাড়িটা এসে গতিহীন হলো তাদের সামনে। এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল আরশি মুখশ্রী জুড়ে। আরশি তাদের ছাড়িয়ে অপূর্বের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাত ধরে আটকে দিল। অপূর্ব নেমে এলো গাড়ি থেকে। পুর্বের ন্যায় পা দুলিয়ে বসে রইল গাড়ির মাঝে। টুথপিক নিয়ে খেলা করতে লাগলো।
অপর পক্ষের গ্যাং স্টার ছুড়ি ঠেকালো আরশির গলায়। নেমে এলো তাকে নিয়ে। অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলল..

— “তুই আমাদের গ্ৰুপের সবাইকে ছেড়ে দে, নাহলে তোর আদরের বোন কে
কথা শেষ করার আগে ঘাড় বাঁকালো অপূর্ব। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল..
— “দে, দে! মেরে দে। কেউ হয় না আমার। এই অপূর্ব পিছুটান নিয়ে ঘোরাফেরা পছন্দ করে না।”

আরশির হাত পা কম্পিত হতে লাগলো ক্রমাগত। অপূর্ব কি বলছে এইসব, তার মৃত্যুকে কিছু যায় আসে না। একটুও কি সম্মান প্রাপ্ত নয়। এতোটাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য। ফিচেল হাসলো সে। “গ্যাং স্টারদের দয়া মায়া নেই, কিন্তু তারা সম্মান করতে জানে না!” এটা জানতো না সে। ঠোঁট চেপে ঘন পাপড়িযুক্ত নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। আর হয়তো দেখা হবে না প্রিয় জনদের সাথে। তার চিত্ত ধারনার মাঝেই ঘটে গেল অঘটন।

অপূর্ব স্থির রইলো না। জুতোর ফাঁক থেকে ছুরি বের করে ছুঁড়ে মারলো ছেলেটার গলা বরাবর। আঘাত হানলো গলার মাঝ বরাবর। শিরা কেটে রক্ত বেরুতে লাগলো। ছেলেটা শক্তহীন হয়ে পড়ে গেল রাস্তার মাঝে। কাঁটা মুরগির মতো ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। আরশি অতিশয় শঙ্কায় গুটিয়ে গেল। এমন দৃশ্য দেখে ভেতরটা দুমরে মুচড়ে উঠলো তার। দুহাতে মুখশ্রী আড়াল করে চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। আর যাই হোক, একজন মানুষের মৃত্যুর দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়।

“,রক্ত, রক্ত। প্লীজ এইসব সরাও। আমি সহ্য করতে পারছি না। প্লীজ।” ধীরে ধীরে নিস্প্রান হয়ে পড়লো আরশি। দেহটা শিতল হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মস্তিষ্ক অচল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো সে। নেমে এলো রাজ্যের অন্ধকার। হারিয়ে গেল অজানায়।
অপূর্ব ছুটে গেল আরশির সমীপে। পরে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। হাতের মৃদু শব্দে চপল মেরে ডাকল..

— “আরশি, এই আরশি! শুনতে পারছো আমার কথা! এই মেয়ে। কিছু হয়নি তোমার। ধ্যাত কোন ঝামেলায় পড়লাম আমি।”
আরশি চেয়ে দৃষ্টিপাত করলো না। চিন্তায় ললাটে রুদ্র ভাজ পড়লো অপূর্বের। আশেপাশে দৃষ্টি দিতেই বুঝতে পারলো, সকলে তাদের দেখে মুচকি মুচকি শব্দ হীন হাঁসছে। ভ্রু কুঁচকালো অপূর্ব, বলল..– “ওয়াট?”
— “স্যার মেয়েটা গ্যাং স্টারের বউ হতে এসে রক্ত দেখেই জ্ঞান হারিয়েছে। মেয়েটার সাহস আছে বলতে হবে, আবার ভয়ও পায়।”

অপূর্ব গলা ঝেড়ে দিলো এক ধমক। পুনরায় শুনশান হয়ে এলো পথঘাট। মৃদু ঝুঁকে পাজাকোলে তুলে নিলো আরশিকে। গাড়ির ভেতরে উঠে প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিল। হাই তুলে কাঁচ খুলে বলল..
— “এদের-কে জায়গা মতো পাঠিয়ে দে।”
মুঠোফোন বের করে ডায়াল করলো। রিসিভ হওয়ার আগেই গাড়ির চাকা গতিশীল হয়ে উঠলো। শোনা গেল না তাদের কথপোকথন।

ঠাস ঠাস চড় বসিয়ে দিলেন আমার গালে। গালে হাত দিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম নিচের। সাথে সাথে গর্জে উঠলেন ভাইয়া। আমার হাত টেনে পেছনে নিয়ে এলেন। মুড়িয়ে নিলেন নিজের সাথে। চেঁচিয়ে বললেন..
— “মা তুমি আবার শুরু করেছো, তোমার পাগলামি? তোমার কাছে আমি আর তরীকে রাখব না। তুমি যখন তখন ওর ক্ষতি করে দিতেও পিছু পা হবে না।”

গভীর ভাবে কিছুটা ভাবনা আয়ত্ত করলেন মামুনি। অরিশ ভাইয়াকে বললেন..– “ঠিক আছে, আমি ওর বিয়ে দিবো না। তোর যা ইচ্ছা তাই কর।”
অরিশ ভাইয়া প্রত্যুত্তর দিতে চেয়েও পারলেন না। তার আগেই রিংটোন বেজে উঠল তার ফোনে। ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। অতঃপর কাউকে কিছু না বলে এক প্রকার ঝড়ের গতিতে চলে গেলেন।‌
ভয় ভীতি ক্রমশ বাড়তে লাগলো আমার। মাথা নিচু করে রইলাম। মামুনি এসে মুখোমুখি দাঁড়ালেন আমার। আঙুল দিয়ে মুখটা স্বল্প উঁচ্চতায় নিয়ে বললেন..

— “অরিশকে আমার বিরুদ্ধে না লাগানো অবধি তোর শান্তি নেই, তাই না তরী। নিজের মায়ের সংসার-টা শেষ করে এখন আমার সাজানো গোছানো সংসার টাকে নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছিস।‌
আমাদের কথা বার্তা এখানেই শেষ। অরিশ জানবে তোর আর বিয়ে হবে না। কিন্তু আমরা জানবো, তোর বিয়ে হবে। রিং-টা আমার কাছেই না-হয় রইলো।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১১

রিংটা তুলে নিজের কুড়ে আঙুলে স্থাপন করলেন তিনি। প্রস্থান করলো কক্ষ। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে এলো। নিভে গেল আলো। অন্ধকারের মাঝে একা হয়ে পড়লাম আমি। কি করা উচিত আমার। আচ্ছা ভাইয়াকে যদি বলি, আমি তার সাথে থাকতে চাই। নিবে না আমায়। ভাবতে ভাবতেই দুহাতে মুখশ্রী আড়াল করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। এখন থেকে নিজেকে সবার থেকে আলাদা একজন হিসেবে তৈরি করে তুলতে হবে। একদম আলাদা একজন মানুষ।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৩