অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৩

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৩
ইফা আমহৃদ

পিটপিট করে বেষ্টিত নয়ন যুগল মেলে অবলোকন করলো আরশি। এখনো ঘোর পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়নি তার। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হতেই হতভম্ব হয়ে উঠলো। অপূর্ব বসে আছে আর সন্নিকটে। মৃদু ঝুঁকে আছে তার মুখশ্রীর অভিমুখে। শঙ্কায় হৃৎকম্প বেড়ে গেল। পিছিয়ে যেতেই নিলেই আঘাতপ্রাপ্ত হলো মস্তিস্ক। একহাতে মাথার অগ্রভাগে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে রেখে বেডের শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকলো। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বলল..

— “আপনি? আপনি কি করছেন আমার সাথে? বারবার কেন এগিয়ে আসছেন? পিছিয়ে যান..
অপূর্ব মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করলো আরশির। এলোমেলো অগোছালো কেশগুলো বেশ পিড়া দিচ্ছে তাকে। বেগ সংযত করতে ব্যর্থ করছে। ভ্রু নাচিয়ে বলল..– “কি করার বাকি আছে, যে করব?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাথে সাথে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আরশি। তার ওরনা নেই দেহে। বেডের দুই প্রান্তে নজর দিয়ে ওরনা টেনে নিল শরীরে। ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। অপূর্ব বাঁকা হাসলো। হাঁটুতে ভরশক্তি দিয়ে এগিয়ে এলো আরশির সমীপে। আরশির দেহ থেকে ওরনা সরিয়ে নিল। সাথে সাথে ওষ্ঠজোড়া উল্টে দিলো সে। জামা খামচে ধরল। কম্পিত অধর জোড়া নাড়িয়ে বলল..

— “প্লীজ। ছেড়ে দিল আমায়।”
বিনিময়ে মাথাটা এগিয়ে নিয়ে এলো অপূর্ব। আরশির শরীরে পেঁচিয়ে দিলো ওরনাটা। নিজের শার্ট-টা পড়ে নিল। নেমে এলো নিচে। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজা অতিক্রম করে ফিরে চাইলো। দরজার উপরে হাত স্থাপন করে বলল..

— “এভাবে চিতল মাছের মতো চিপকিয়ে আছো কেন? তুমি ভুলবশত আমার শার্ট নিজের ওরনা মনে করে শরীরে পেচিয়েছিলে। তাই তোমারটা তোমার দিয়ে এলাম আর আমার টা আমি নিয়ে এলাম।
আচ্ছা তোমার মাথায় কি সবসময় এইসব ঘুরে সারাদিন। তাহলে মনে রেখো, তোমার মতো বাচ্চা একটা মেয়ের প্রতি আমার কোনো ইন্টেশন নেই। এই অপূর্ব আহসানের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েরা পাগল। আর সেটা কি-না বাচ্চা মেয়ের সাথে..

বাই দা ওয়ে, তোমার ভাইকে ফোন করেছিলাম। একবার এসে দেখে গেছে।”
পুনরায় ওয়াশরুমে পদাচরন করে বিকট ধ্বনিতে দ্বার অবরোধ করে দিলো সে। অপূর্বের কথণ শ্রবণ হতেই লোচন থেকে নিঃসরণহওয়ার উপক্রম আরশির। ওয়াশরুমের বিকট শব্দে নিজের মাথায় চপল মারল। আরশি, তোর দ্বারা কিছু হবে না। গ্যাং স্টারের বউ হবে, গ্যাং স্টারের মতো ধূর্ত হবে। আর তুই কি-না ভিতু। কাম-অন আরশি।

সূর্যের প্রত্তাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সূর্য তখন উপরে অবস্থান করছ। মধ্যাহ্নের কারণে সরাসরি রশ্মি পড়ছে। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক অবলোকন করলাম আমি। কোথাও অরিশ ভাইয়ার প্রতিবিম্বও পারছি না। ধ্যাত, অরিশ ভাইয়া না থাকলে তার প্রতিবিম্ব আসবে কোথা থেকে। তদানীং নয়ন যুগল আবৃত হলো কর্মচারী চাচার সমীপে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ছুটলাম তার দিকে। তার কাছে জানতে পারলাম, অন্য ডিপার্টমেন্টে ক্লাস চলছে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে দিলাম। ফুরিয়ে এসেছে সময়। ভাইয়া এলো বলে।

শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে কক্ষ ত্যাগ করলেন তিনি। চোখের চশমা-টা খুলে মুছে নিলেন ফাঁকে। চশমা ছাড়া তার অপরুপ সুন্দর বিড়াল চোখ দুটো ভেসে উঠলো আমার সদর্পনে। এই চোখ দুটোর জন্যই হয়তো হাজারো মেয়ের ক্রাশ। ক্যাম্পাসের মাঝখানে কদাচিৎ হাস হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, এটা হয়তো দৃষ্টিতে এলো তার। আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। চেয়ে রইলেন তৃষ্ণার্ত নয়নে। ভাইয়া হিম শীতলতা মেশানো হাতটা ছুঁয়ে দিলেন আমার গালে। আরো একবার শিহরিত হলো আমার সর্বাঙ্গ। কম্পিত হলো শিরায় শিরা। কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নাড়িয়ে বললাম..

— “ক-কি করছো ভাইয়া? সবাই দেখছে।”
নামিয়ে নিলেন হিম শীতল হাত। এগিয়ে গেলেন নিজের রুমের দিকে। আমাকে যেতে বললেন। চুপচাপ তার পিছু নিলাম। কেবিনে নিজের নির্দিষ্ট চেয়ার টা দখলে নিলেন তিনি। ইশারায় সামনের চেয়ারে বসে বললেন। নত মাথায় গিয়ে বসলাম চেয়ারে। ব্যাগের চেইন খুলে খাবারের টিফিন ক্যারিয়ার বের করলাম। সুন্দর করে সাজিয়ে নিলাম। ফিল্টার থেকে গ্লাস ভর্তি করে রাখলাম। নত স্বরে বললাম..

— “আমি জানি, মামুনির উপর রাগ করে কিছু খাইনি তুমি। এমন করো না, মায়েরা যা করে সন্তানের ভালোর জন্যই করে। হয়তো সেখানে তোমার ভালো লুকিয়ে ছিল।”
অধর জোড়া নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলেন তিনি, বললেন না। উঠে দাঁড়ালেন। কাবার্ড থেকে একটা মলম বের করে গালে লাগিয়ে দিলেন আমার। কেশের অগ্ৰভাগে হাত রেখে অধর ছুয়ে দিলেন গালে। নিজের ললাটের সাথে আমার ললাট মিশিয়ে বললেন..

— “চাই না, আমার ভালো। যেই ভালোতে আমার ছোট পিচ্চি টার কষ্ট হবে, কাঁদবে, আঘাত পাবে।”
এখনো দুজনের ললাট একত্রিত হয়ে আছে। ঘন কেশের মাঝে তার হাতটা বিরাজমান। আবেশে নয়ন যুগল বন্ধ। না মেলেই বললাম..

— “আমি আঘাত পাই না, কষ্ট পাই না, কাঁদি না। কারণ কাঁদতে নেই আমার!”
আমাকে ছেড়ে দিলেন তিনি। পুনরায় বসে পড়লেন নিজের আসনে। টিস্যু পেপার দিয়ে ঘামগুলো মুছে নিয়ে বললেন..
— “যেই কাজটার জন্য এসেছিস, আপাতত সেটায় কর..! তোর মতো পিচ্চিকে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বুঝবি তো নয়ই আবার প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করে দিবি। ফাউল পোলাপাইন। দে, খাবার দে..

ফোঁস করে দম বন্ধ নিঃশ্বাস ছাড়লাম আমি‌। কথায় কথায় অপমান করছে আমায়। খাবারের প্লেট এগিয়ে দিলাম। বিনিময়ে দুহাত বুকে গুজে নিলো সে। ওষ্ঠ যুগল কদাচিৎ ফাঁক করে বলল..
— “তাড়াতাড়ি খাইয়ে দে, ক্লাসে যেতে হবে।”
— “আমি?”
— “তা-নয় কে? তোর ভূত? তুই তো এখনো মরিস নি, তোর ভূত আসবে কোথা থেকে!”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি। রাগে গিজগিজ করছে আমার সর্বাঙ্গ। এই ছেলেটা ভালোভাবে কথায় বলতে জানে না, মানে জানে না। মুখ ফুলিয়ে খাবার মেখে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। মুখে তুললেন না। ফিরিয়ে দিলেন আমার মুখে। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন.. — “আমার লিটেল পিচ্চি-টা আমাকে ছাড়া কিছু খায়নি! তাই তাতে না খাইয়ে দিয়ে, আমি খাই কি করে? ”

আমি নিঃশব্দে চেয়ে রইলাম তার মুখশ্রীর দিকে। তিনি বড্ড বেশি অদ্ভুত। কিভাবে আন্দাজ করতে পারলেন আমি খাইনি? আচ্ছা তার বংশে কি কেউ জ্যোতিষী ছিলেন। ভাইয়া কি তার ভার বহন করছে? ভাবতে ভাবতে একসময় প্রশ্ন ছুঁড়লাম।

— “ভাইয়া; তোমাদের বংশে কেউ জ্যোতিষী ছিলো?”
মুহুর্তেই ভাইয়ার বচন গুলো পাল্টে গেল। তেজ নিয়ে বলল..
— “নিয়মিত বেলা করে, সকালে দুপুরে রাতে; তিন বেলা তোকে চড়ানো উচিত ডাফার। ভালোভাবে কথা বললে মাথায় উঠে যায়।”

সেন্টার টেবিলের উপর মৃদু শব্দে খাবার রাখতেই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল আরশি। অপূর্ব তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। পড়নে তার ছাই রাঙা ট্রাউজার এবং টি শার্ট। ভেজা কেশসমূহ থেকে চুইসে চুইসে জলকণা ঝড়ে পড়ছে। একদম সাদা সহজ সাধারণ মানুষের মতো দেখতে, তবে কোথাও একটা নেশালো ভাব যতনে লুকিয়ে আছে। আরশি হা করে তাকিয়ে রইলো সেই দিকে। ক্রাশ খেল কয়েকদফা। এভাবে তাকিয়ে থাকার জন্য অস্বস্তি বোধ হচ্ছে অপূর্বের। চোখের সামনে তুরি বাজালো, কিন্তু গহীন ভাবনায় বিভোর আরশির ভাবনার ছেদ ঘটল না। সে গভীর ধ্যানে অপূর্বকে দেখছে। অপূর্ব আরশির গালের নিচের হাতটা সরিয়ে দিল। সাথে সাথে থুতনি গিয়ে ঠেকলো হাঁটুর সাথে। মুখ গম্ভীর করে রইলো সে। অপূর্ব একগাল হাসলো। খাবার-টা আরশির সামনে রেখে বলল..

— “আই নো, আমি দেখতে হ্যান্ডসাম। নাহলে কি এতোগুলো মেয়ের ক্রাশ হতাম। অন্যদের করা বাদ দেই, আমি তো তোমারও ক্রাশ। ক্রাশকে দেখলে মন ভরে, পেট নয়। তাই পেট ভরার জন্য খেতে হবে। নাও স্টার্ট.!”
লজ্জার্থ রক্তিম আভার দেখা মিললো আরশি কাছে। রক্তিম আভা ছড়িয়ে গেল তার মুখশ্রী জুড়ে। ছেলেটার অধর জোড়া লাগামহীন, যদি একটু লাগাম দিয়ে সুন্দর করে মনের ভাব প্রকাশ করতো, তাহলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?
পোশাক পাল্টে আরশির কোনো হেলেদুলে না দেখে বলল..

— “হাই ফানি, এমন চিতল মাছের মতো চিপকিয়ে আছো কেন? খাবার খেয়ে বিদেয় হয়।”
— “আমাকে দেখে আপনার চিতল মাছ মনে হয়? আপনি জানেন, দিনে কতো গুলো লাভ লেটার পাই, কতো গুলো প্রপোজ পাই..
— আর তুমি তাদের মন ভাঙছো? তুমি তাদের মন ভেঙেছ আর আমি তোমার। ইকুয়াল, ইকুয়াল।
তুমি শুধু চিতল মাছ না পাবদা মাছ।
অতিশয় ক্ষোভে আরশির আচরণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১২

— “দেখুন ভালো হচ্ছে না! আমার নাম আরশি।”
— “আরশি নয়, আয়না, ভাঙা চিরুনি তোমার সাথে ভালো মিলে। মেইড ফর ইচ আদার।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৪