অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৪

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

হাড় কম্পন হিম শীতল রজনী। এশার আযানের মাধুর্য ধ্বনিতে সালাতের আহ্বান জানানো হয়েছে বেশ কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। সালাত আদায় সেরে পড়ার টেবিলে বসে আছি আমি আর আরশি। মহাশয়ের আসার খবর নেই। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। বিগত দিনগুলোতে পড়াশোনা শেষ তবে রিভিশন নামক চার অক্ষরের একটা শব্দ রয়েছে।

পরীক্ষার ফলাফল তার গ্ৰহনযোগ্য না হলে জনাব একটু শান্তি দিবে না। কলম কামরাতে কামরাতে যখন ভাইয়ার ভাবনায় বিভোর ছিলাম, তদানীং প্রবেশ করলেন তিনি। আমার মন মস্তিস্ক নিখোঁজ অজানায়। মস্তিষ্কে মারলেন চপল। বিনিময়ে কলমের খোঁচা খেলাম অধরে। ফোঁস করে উঠলাম সাথে সাথে। হাত রাখলাম ব্যাথার্ত স্থানে। গালে হাত রেখে তৃষ্ট নয়নে চেয়ে রইলাম। আরো একটা চপল মারলেন বাহুতে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– “কালকে পরীক্ষা আর তুই জামাইয়ের ভাবনায় বিভোর কেন? পরীক্ষায় ফেল করলে রাস্তার ঝারুদাড়, স্যরি ঝারুদাড়ী বানাবো তোকে।”
ভেংচি কাটলাম আমি। মনোনিবেশ দিলাম বইয়ের অন্তিম পাতায়। ভাইয়া তার লোচনের চশমা খুলে রাখলেন টেবিলের উর্ধ্বে। দুহাতে হ্রস্ব কেশসমূহ যদৃষ্টভাবে অগোছালো করে নিল। পা জোড়া পা দানির উর্ধ্বে দুলিয়ে চলেছেন। সুক্ষ্ম বৃদ্ধি কৌতূহল ধরা দিলো মস্তিষ্কে।

অতিবাহিত হলো স্বল্পকাল। বহির্ভাগ থেকে ঈষৎদন্ধকারে প্রকৃতির অপরিস্ফুট ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কর্ণগোচর হচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের মাঝে কোনো রুপ প্রভাব পড়ছে না।
নিজের ঠান্ডা শীতল দু’পা স্থাপন করলাম তার পায়ের পাতার উপরিভাগে। কম্পিত হয়ে উঠলেন তিনি। অশান্ত নেত্রে তাকালেন আমার নিমিত্তে। রহস্যময় হাসি দিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলাম। আমার নিকটে আরশি আরশি অবস্থান, নাহলে আজ আমার রক্ষে ছিলো না।

কিয়ৎক্ষণ পর বইটা এগিয়ে দিলাম ভাইয়ার অভিমুখে। বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। এই ফাঁকে গালে হাত দিয়ে বোঝার অভিনয় ধরে, তার পায়ে স্লাইড করতে লাগলাম। পড়নো থামিয়ে ভ্রু নাচালেন খানিকটা। আমি ফাজলামির স্বরে বললাম..

– “ভাইয়া তুমিও কি পারো না। কালকে যদি এটা আসে তাহলে কি দিবো?”
বলেই তদানীং অধর উল্টে ফেললাম আমি। অরিশ ভাইয়া বোঝাতে মন দিলেন। আমি পুনরায় আমার কাজ সমারম্ভ করে দিলাম। পূর্বের ন্যায় এবারও পড়ার গতির কমিয়ে দিলেন তিনি। একসময় পুরোপুরি গতিহীন করে বিরতি দিলেন।অকস্মাৎ ওরনা ধরে টান দিলেন।

কোটার থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। আরশি দুহাত চোখে দিয়ে রইলো। ভাইয়া এমন কিছু করবে বোধগম্য হয়নি আমার। নয়ন যুগল অম্বুতে পূর্ণ হয়ে এসেছে। নিচু করে নিলাম চোখজোড়া। পায়ে শীতল স্পর্শ পেয়ে নয়ন যুগল মেলে তাকালাম। অরিশ ভাইয়া তার হাতজোড়া দিয়ে আমার পা দুটো টেবিলের পা দানির সাথে বেঁধে দিলেন। উঠে সোজা হয়ে বসলেন। কাঁটার দিয়ে স্বত্নে গোছালো কোমড় জড়িয়ে যাওয়া কেশসমূহ থেকে কাঁটা সরিয়ে দিলেন। চুলগুলো সামনে এনে মেলে দিলেন। রহস্যময়ী হাসি হেসে বলে..

– মুখ ঘুরিয়ে রাখার মতো কিছু হয়নি, পিচ্চি।
আরশি করুনতা মাখানো খাঁ খাঁ চোখজোড়া দিয়ে চেয়ে আছে। হয়তো উপলব্ধি করার বৃথা প্রচেষ্টা চালাচে, কি হয়েছিলো কিন্তু অরিশ ভাইয়ার কাউকে কিছু বুঝতে দিলো না।

খাঁ খাঁ রৌদ্দুর মাখানো মধ্যাহ্ন। একটা পঁয়তাল্লিশ। হিমঋতু বিধায় শীত উপলব্ধি হচ্ছে না। ভিড় ভাট্টার মাঝেও ঠান্ডা ঠান্ডা আদ্রর্তা বিরাজমান। গায়ে শীত নিয়ন্ত্রণ হালকা শাল মুড়ানো। মাত্র পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছি আমি। প্রশ্ন দেখতে দেখতে বাইরে এসেছি। আমার পায়ের গতির সাথে আরশির পায়ের গতি সম গতিশীল রেখে হেঁটে চলেছি। তার নয়ন যুগল চাতক পাখির ন্যায় এদিকে ওদিক সন্ধান করে চলেছে। কাউকে ভিশন করে খুঁজছে। আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে দ্রুত বেগে ছুটল সে। পশ্চাৎ থেকে কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু তার হেলেদুলে পাওয়া গেল না।

প্রবেশদ্বারের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। জনশূন্য হয়ে উঠেছে ভার্সিটির অন্তর্ভাগ। এদিক ওদিক অবলোকন করছি। অরিশ ভাইয়া দাঁড়াতে বলেছেন আমায়। বেশ কিয়ৎক্ষণ পর বাইক সমেত ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। আমার সামনে থামালেন। উঠে বসলাম বাইকে। হেলমেটটা পড়িয়ে দিলেন মাথায়। ভাইয়ার বাইকে উঠলেই পর্বপ্রথম কাজ, হেলমেটটা পড়িয়ে দেওয়া। আমাকে নিয়ে কখনো কোনো রুপ ঝুঁকিপূর্ণ থাকতে ইচ্ছুক নয় তিনি।

বাইক চলতে আরম্ভ করলেন বিপরীতমুখী অর্থাৎ বাড়ির বিপরীত রাস্তায়। এসে থামালেন নির্জন শুনশান স্থানে। পার্কের অন্তর্ভাগ জনশূন্য নিরিবিলি। মধ্যাহ্নের কারণে কোনো জনমানবের চিহ্ন টুকু নেই। ঝোপঝাড় পেরিয়ে চলে এলাম অন্য একটা প্রান্তে। ঝিলের চারিপাশ জুড়ে সবুজ গাছের সমারোহ দেখা যাচ্ছে। ছোট ছোট কলাগাছের ভেলা বেঁধে রাখা হয়েছে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এতোক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বললেন..

– “আমার পিচ্চি তরী, আজকে কৃত্রিম তরীতে উঠবে।”
না বোধক মাথা নাড়ালাম সায় দিলাম আমি। যদি একবার নিচে পড়ে যাই। পানি খেয়ে ঢোল হয়ে যাবো। এমনিতেই সাঁতার জানা নেই।
দুহাত দু-কাঁধে রাখলেন ভাইয়া। আশ্বাসে জড়ানো কন্ঠে বলে..

– “ডিঙিরানী, আমি থাকতে কিসের ভয় তোমার। কিছু হতে দেবো। বিশ্বাস করো না আমায়?”
বিশ্বাসের শব্দ গহীন শোনালো শ্রবণপথে। ফট করে প্রত্যুত্তর দিলাম আমি..
– “করি, তোমাকে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি।”
– “তাহলে ভয় কিসের, পিচ্চি?”
– “নেই কোনো ভয় নেই?”

কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে মেলে দিলেন ভাইয়া। তার হাতের করতলের উপর নিজের হাত ঠেকালাম। মুঠোয় ধরে শক্ত করে নিলেন। অপর হাতে ভেলা ইশারা করলেন।
নৌকায় পা ফেলতেই দুলতে শুরু করলো। এক দৌড়ে ভাইয়ার পেছনে এসে দাঁড়ালাম আমি। সন্দিহান স্বরে বলে..

– “কি হয়েছে পিচ্চি?”
– “দ-দুলছে, যদি পড়ে যাই!” (ঠোঁট উল্টে আমি)
– “এই মাত্রই তো বললি, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই?”
এবার কোমড়ে হাত দিয়ে বলল..

– “পড়ে গেলে তুমি যে আমার তুলবে, সেই বিশ্বাস আছে। কিন্তু আমার গুষ্টির দফা করা করবে, তার কোনো বিশ্বাস নেই? বলবে, “চোখ কি মাথায় তুলে রাখিস, ডাফার। হাঁটিস কোনদিকে তাকিয়ে?”
মনে করো কি? আমি বুঝি না।”
-“আজ তো তোকে..

বলে দৌড় লাগালো। তাকে দেখে আমিও ছুটলাম। আর যাই হোক ছেলেদের সাথে দৌড়িয়ে পারা সম্ভব নায় আরো একবার প্রমানিত হলো সেই চিরন্তন সত্য। পশ্চাৎ থেকে এক গুচ্ছ কেশ টেনে ধরলেন। পেঁচিয়ে নিলেন আঙুলের ডগায়। অটোমেটিক চরণ জোড়ায় বিরতি টানল আমার। মুখ ফুলিয়ে পেছনে ফিরলাল। এই ছেলেটা যখন তখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, বিশ্বাস নেই।

তেমন কিছু করলেন না তিনি। চুল ছেড়ে পাজাকোলে তুলে নিলেন আমায়। এগিয়ে গেলেন ছোট ছোট পা ফেলে দ্রুত গুছিয়ে ভেলার উঠলেন। উঠে বসিয়ে দিলেন কিনারায়। সম্পূর্ণ সময় চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ভাইয়ার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলাম। যেটা ছিল ম্যাজিকের এক অনুভূতির সাক্ষী। প্রথমবার কাছে আসা নয়, তবে প্রথমবার প্রকৃতির সাথে ভাইয়ার কাছে মিশে যাওয়া।

নববর্ষ নামটা শুনলেই অন্তরে আনন্দিত আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এই আনন্দিত আমেজ উপভোগ করতে ঘুড়তে বেরিয়েছে ভাই-বোন জুটি।
নিদ্রায় চক্ষু পাতা লেগে লেগে আসছে। রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। মামার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দরজায় দু আঙুলের সাহায্যে টোকা দিলাম।

কোনো কথন শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত এলো না। গভীর রাত্রি অবধি জেগে থাকার বদভ্যাস মামুনির নেই। সে নিদ্রাচ্ছন্ন। মামা প্রতিদিন রাত জেগে ম্যাগাজিন পড়ে। কাপ নিয়ে বেলকেনিতে গেলাম সোজাসুজি। বেলকেনিটা সাধারণ বেলকেনির মতো না। বিশাল বড় জায়গা জুড়ে। বড় একটা টি টেবিল। টেবিলের উপর খবরের কাগজ, কিছু বই, ম্যাগাজিন রাখা। এখানে প্রকৃতির ছোঁয়া আছে। দুইটা ক্যাকটাস গাছের চারা আছে। খোলা ঠান্ডা হাওয়া প্রবেশ করছে গ্ৰিল টপকে।

মামা চায়ের কাপে চুমুক বসালেন। আপাতত ড্রিম আলো জ্বলছে শুধু বেলকেনির অংশ জুড়ে। তার আলোর রেখা অন্তর্ভাগে প্রবেশে বাধা পাচ্ছে। বাইরের মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে। স্মিত হেসে পাশে বসতে বললেন আমায়। তার পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। মাথায় হাত রাখলেন মামা। হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন..
– “মন খারাপ তোর তরিন? মামার উপর রেগে আছিস? স্যরিরে পাগলী। এই বয়সে তোর মামুনির সাথে ঝগড়া করতে চাই না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারি নি।”

সময় নিয়ে ঘনঘন পলক ফেলে সায় দিলাম আমি। আমাকে অরিশ ভাইয়ার থেকে বহুদূরে সরানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। হৃদমাঝারে কেমন খাঁ খাঁ করছে। মামা ভাগ্নির কথার মাঝে প্রবেশ করলেন মামি। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন..
– “তুই আবার এখানে এসে বসে আছিস? তোকে না বলেছি, বাসন কাসন ধুয়ে দিতে। যা বের হ..
– “অনিতা চুপ করবে তুমি? মেয়েটার সাথে এমন করছো কেন তুমি?”
– “যা করেছি বেশ করেছি। বামন হয়ে আমার ছেলের দিকে হাত দেওয়ার দূর্সাহস দেখিয়েছে। ওকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৩

আমার অরি সোনাও হয়তো ওর আসল রুপ চিনে ফেলেছে। তাই শুধু আরুকে নিয়ে ঘুড়তে গেছে‌। তুই তো আপদ,
ক্লান্ত নয়ন জোড়া দিয়ে মামুনিরে দিকে চেয়ে রইলাম। ভাষা হারিয়ে গেছে অজানায়। অন্ধকারের মাঝে আমার কাতর মুখটা তাদের দৃষ্টিগোচর হলো বলে মনে হলো না। ইতিমধ্যে মামার চা প্রায় শেষের দিকে। চায়ের নিম্নাংশে তলানিতে জমে থাকা চা টুকু খেয়ে ফাঁকা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। ফাঁকা কাপ হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে প্রস্থান করলাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৫