অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৫

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৫
ইফা আমহৃদ

রাত্রি গভীরতম। হাতের ফাঁকা চায়ের কাপ। ফিরে এসেছি মামার ঘরে থেকে। মামাও শুয়ে পড়ছে। অরিশ ভাইয়া আর আরশি আজকে বাড়িতে ফিরতে রাত দুইটা ছাড়িয়ে যাবে। আমাকে অপেক্ষা না করে ঘুমাতে বলেছে। তিনি এসে ফোন করবে।

আরশি নাকি তার সাথেই আছে। দুই ভাই বোন একসাথে ফিরবে। নিজের ভাইয়ের কথা মস্তিষ্কে এলেই নয়ন যুগল ভিজে উঠলো আমার। আচ্ছা ভাইয়া আমার সাথে থাকলে কি, খুব অজস্র লোকসান হয়ে যেত। আমাদের ছোট একটা পরিবার হতো। সবাই একসাথে সেখানে থাকতাম। কিন্তু! সব আমার নিয়তির পরিহাস। হয়তো বাবা মা, ভাইয়ের ভালোবাসা আমার জন্য নয়। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গড়িয়ে পড়ার পূর্বে জলকণা মুছে ফাঁকা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলাম। বেসিনের এঁটো থালা বাসন গুলো ধুয়ে নিলাম। যথার্থ স্থানে সাজিয়ে রাখলাম। অতিশয় ঠান্ডায় রীতিমত হাত পা, সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার। চুলোয় উষ্ণময় ছোঁয়ায় শরীর ছেকে নিলাম। সমস্ত বাড়ির আলো নিভিয়ে পা জোড়া গতিশীল করে ছুটলাম রুমের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার পূর্বে শ্রবণ হলো অস্ফুট কন্ঠস্বর। দিদা টিভি দেখা শেষ করে চলে গেছে, এদিকে টিভি এখনো চলছে। পুনরায় নেমে গেলাম নিচে। রিমোট হাতে নিয়ে বন্ধ করতে চাইলে চ্যালেন ঘুরে গেল। টিভিতে রাত ১২টার সংবাদ চলছে।

– “হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই শুনেছেন। আজকে সন্ধ্যা সাতটায় বিচের পাশে ৯টা তরুন ছেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের অবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। কোনো অপঘ্যাতে মাফিয়ার হাতে মৃত্যু হয়েছে তাদের। মুখমন্ডল থেঁতলে দিয়েছে। শরীর থেকে হাত, পা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। চেনার উপায় নেই। ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। চলুন আরো একবার দেখে আসি..

পরপর কয়েকটা চ্যানেল চেঞ্জ করলাম। সব চ্যানেলে একই নিউজ। ফুটেজে সন্ধ্যা সাতটা বিশ উল্লেখ করা রয়েছে।
রীতিমত মতো ঘাম ছুটছে আমার শরীর থেকে। তীব্রতর ভীতিকর পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারলাম চারদিক। চারিদিকে ঘুটঘুটে আলোকহীন আঁধার। টিভির অস্পষ্ট ঔজ্জ্বল্যে যতোটুকু দেখা যাচ্ছে। তাদের চিনতে আমার দৃষ্টি ভ্রম হয়নি। এগুলো তো সেই ছেলেরা।

পড়নে সেই দিনের জামা কাপড় গুলো, তবে বিচ্ছিরি, নোংরা এবং রক্তে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তাদের মুখশ্রী আমি দেখি নি কিন্তু সেই রাতের দৃশ্য গুলো স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে আজীবন। বেশ কিয়ৎক্ষণ তাদের নিখোঁজ হওয়ার বিজ্ঞাপন রাস্তা ঘাটে, টিভিতে দেখানো হয়েছিল।
মাথাটা ভারি হয়ে আসছে। লাশগুলো দেখে শরীরটা ক্রমশ শিতল রুপ ধারণ করছে। দ্রুত হাত দিয়ে টিভি বন্ধ করে নিলাম। সাথে সাথে অন্ধকারে ছেয়ে গেল সবকিছু। দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়লাম নিচে।

প্রত্যুর্ষের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে দিক দিগন্তে। কুয়াশা বিহীন ঝকঝকে নীলাভ অন্তরিক্ষ। আমি শান্তমনে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছিলাম। এখনো বাড়িতে ফিরে নি অরিশ ভাইয়া আর আরশি। মামা অফিসে চলে গেছে। দিদা টিভি দেখতে দেখতে পান চিবুচ্ছে। আমি সবে সবজি তরকারি বসিয়েছি চুলোয়। এমন সময় টোকা পড়লো দরজায়। ব্যাঘাত ঘটল আমার কাজের। এক দৌড়ে ছুটলাম দরজা খুলতে। আমার বিশ্বাস অরিশ ভাইয়া এসেছে। দরজা খুলতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম আমি। আমাদের ভার্সিটির প্রোফেসর এসেছে। নিঃশব্দে সরে দাঁড়ালাম। উল্টো ঘুরে ওরনা টেনে শরীর পেঁচিয়ে নিলাম। সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললাম। মুচকি হেঁসে বললেন..

– “শুভ নববর্ষ তরিন!”
– সালামের উত্তর দেওয়া ওয়াজিব।
ইংরেজি নববর্ষ তাই ইংরেজিতে বলাই বেটার। তাছাড়া কালকে এক তারিখ ছিল আজ নয়।
– “সে যাই হোক! তোমার জন্য আমার জীবনে প্রতিটি দিনই সুন্দর দিন।”

বোধগম্য হলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম তার নিমিত্তে। তিনি আমাকে এমন অবস্থায় দেখে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ধ্যান ফিরতেই ছুটলাম তার পিছুপিছু। টেবিলের উপরে প্যাকেট রাখলেন। চেয়ারে আয়েস করে বসলেন। প্যাকেটের অন্তর্ভাগে মিষ্টি করছে, আমি সিউর। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম..
– “স্যার, ভাইয়া বাড়িতে নেই। আপনি বরং ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করে আইসেন। এবার আসুন..
ভ্রু কুঁচকালেন নিভ্রান স্যার। হাত ধরে টান দিলেন আমার। বললেন..

– “আমি আমার হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি, তার ভাইয়ের সাথে নয়। তাড়াতাড়ি মামি শাশুড়িকে ডাকো?”
ভ্যাবাচাকা খেলাম আমি। মামি শাশুড়ি মানে কি? মামুনি আবার জানিয়ে আরশির বিয়ে ঠিক করেনি তো? তাহলে মামি শাশুড়ি কেন বলবে? তাহলে কি মামুনি আমার সাথে? সেটা কি করে হয়। মামুনি সেই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমার ভাবনার মাঝেই মামুনি চুলে এলেন!

– “ঋনী, রান্না রেখে কোথায় গিয়েছিস তুই..
শব্দ গুলো শেষ করলেন না। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে কি রিয়েকশন দিবো, হয়তো ধ্যান হারিয়ে ফেলেছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন..
– “বাবা ভালো আছো তুমি?” নিভ্রান স্যার কে কিছু বলতে না দিয়ে আমাকে বললেন..
– “ঋনী, যা জামাইয়ের জন্য খাবার..! তুই এইসব কি করেছিস মুখের। (তাকে উদ্দেশ্য করে) আসলে ও রান্না করতে খুব ভালবাসে তাই।”

– “ওতো কিছু আমি জানি না, আমার বউ রান্না ঘরে যাবে না ব্যাস..
নিজের আঁচল দিয়ে আমার ললাটে লেগে থাকা কালিগুলো মুছে দিলেন। প্রথমে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সবটা বোধগম্য হতেই বক্ষ চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।

একপ্রকার জোর করে মামুনি আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন শাড়ি পড়তে। গাঢ় সবুজ রঙের একটা শাড়ি ধরিয়ে দিলেন হাতে। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলাম। আমার কোনো ভাবাবেগ না পেয়ে নিজের হাতে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। চোখে হালকা কাজল, লিপস্টিক। নিয়ে বসালো আমার স্যারের পাশে। এতোক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তিনিই আমার হবু বর। সেদিন যেই ছেলেটা আমাকে দেখতে এসেছিলো সে নিভ্রান স্যারের ভাই সাথে মধ্য বয়স্ক মহিলা ছিলেন তার মা।
আমি এক ধ্যানে চাতক পাখির নিমিত্তে তাকিয়ে রইলাম দরজার নিমিত্তে। এই বুঝি এলো ভাইয়া, কিন্তু আমাকে নিরাশ করে দিয়ে এলেন না। একসময় আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে।

রৌদ্র ঝিকিমিকি করা শান্ত বিকেল। ঠান্ডা শীতল হাওয়া। যেই হাওয়া নদীর গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে তার উল্টো দিকে। পাখিরা গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির ডেকে চলেছে।
পাশাপাশি হাঁটছি আমি। আমার সামান্য একটু দূরত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে নিভ্রান। হাঁটছে সামনের দিকে। কিন্তু দৃষ্টি আমার মাঝে বন্দী। আমাকে এমন ভাবে কেউ চেয়ে রইলেন বরাবরই বিরক্ত হই আমি। ইচ্ছে করে তার চোখ গুলো তুলে ফেলি। কিন্তু আপাতত তা সম্ভব নয়। শাড়ির লম্বা আঁচল টেনে শরীর ঢেকে নিয়েছি। নির্জন ব্রীজের উপর এসে থামলেন তিনি। বসলেন রেলিং এর উপরে। আমাকেও ইশারা করলেন বসতে। কিন্তু বসলাম না, অরিশ ভাইয়ার অনুপস্থিতে কখন রেলিং এ বসার স্পর্ধা নেই আমার।

আচম্চাই হাত ধরলেন তিনি। রেলিং এর কাছে এনে উপরে উঠানোর প্রচেষ্টা করলেন। একদিকে শাড়ি অন্যদিকে এই বিরক্তকর মানুষ। দুটিতেই হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। উপায় নেই, বাধ্য হয়ে রেলিং এ উঠলাম আমি। আনুমানিক ৭-৮ ইঞ্চি প্রশস্ত রেলিং। একহাত ধরে নিচে নিচে হাঁটলেন তিনি। তবে হাত ছাড়লেন না আমার। ধীরে পা ফেলে আমিও হাঁটলাম। একটা সময় এসে বুঝতে পারলাম, প্রচন্ড ভ্রীতি এসে জড়োসড়ো করে তুলেছে আমায়। করুনতা মাখানো চোখে তার নিমিত্তে তাকিয়ে বললাম..

– “আমার প্রচন্ড ভয় করছে। প্লীজ, আমাকে নামান।”
আমার হাত ছেড়ে দুহাত বুকে গুঁজলেন তিনি। অদ্ভুত স্বরে বললেন..
– “মাত্র এইটুকু পথ হেঁটে এমন হাঁসফাঁস করছো কেন? যখন অরিশের সাথে উঠ তখন তো দিব্বি একটা ব্রিজের রেলিং পেরিয়ে ফেলতে।”
তারমানে অরিশ ভাইয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী করে আমাকে রেলিং এ তুলেছে।
প্রচন্ড ভয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললাম..

– “অরিশ ভাইয়ার থাকলে আমার ভয় করে না।”
— “ইউ মিন, আই ক্যান নট বি ট্রাস্টেড”
বলেই হাত ধরে টান দিয়েন। নিজেকে সামলানোর আগেই পড়লাম রেলিং এর ভেতরে। পা ঠিক ভাবে মাটি স্পর্শ না করাতে আঘাত পেলাম। মনে হলো ভেঙ্গে গেছে। দুহাতে পা চেপে চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। উঠার চেষ্টা করলে উঠতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম পা মচকে গেছে। না চাইতেও হাতটা এগিয়ে দিলাম নিভ্রানের নিকট। ধরলেন না তিনি। আমার দিকে একটু ঝুঁকে বললেন..

– “স্যরি বলো!”
– “কেন?”
– “আমার সামনে আমি ছাড়া আর কারো প্রশংসা করবে না তুমি। সেই প্রমিজ করবে তুমি। সাথে অরিশের সুনাম করার জন্য স্যরি বলবে।
ভ্রু কুঁচকালাম আমি। লম্বা একটা হাই তুলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম..- “শুধু পা মচকালে কেন? মেরে ফেললেও আপনাকে স্যরি বলবো না।”

ওকে ফাইন বলে ছুটল সে। তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেল। ধীরে ধীরে গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেল। হাওয়া মিলিয়ে গেলেন। যদি আমি রাজি হই, তাহলে ফোন করতে বলেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করলো গগনের বুকে। নির্জন জায়গায় একা আমি একটা মেয়ে। হাঁটতেও পারছি না। ভেতরের চাপা কান্নাগুলো ছেড়ে দিলাম। কেন বারবার আমার সাথে এমন হয়। উঠে দাঁড়ালাম। রেলিং ধরে ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। হয়তো আমার কষ্ট প্রকৃতি উপলব্ধি করতে পারল। কিছুদূর যেতেই একটা ফাঁকা রিক্সা পেলাম। বিনা বাক্যেয় উঠে বসলাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৪

________ “অবহেলার এই শহরে,
ব্যর্থ আমি শীর্ষ প্রহরে”
-ইফা?

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৬