অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৬

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

নিজের চেনা এলাকায় আসতেই বুঝতে পারলাম আমার পাশে কেউ বসে আছে। শক্তহীন নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে ফিরে চাইলাম। সাথে সাথে চারশত বিশ ডিগ্রি বোল্ডের শখ খেলাম। আমার পাশে অরিশ ভাইয়া বসে আছে।‌ ফুঁপিয়ে উঠলাম এবার। ভেতরের কষ্টগুলো অশ্রুধারা হিসেবে বেরিয়ে এলো।

এই মানুষটা কেন আগে এলো না, কেন আমাকে শান্ত করতে এলো না। তিনি করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু সেঁটে গেলাম রিক্সার অন্য প্রান্তে। অরিশ ভাইয়া একটু সেঁটে গাঁ ঘেঁষে বসলেন। পশ্চাৎ থেকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন আমায়। পুনরায় তাকে ছাড়িয়ে সরে এলাম। তিনি হয়তো আঁচ করতে সক্ষম হলেন। অসহায় চাইনি নিক্ষেপ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হলো পরে অনুভব করতে সক্ষম হলাম, বাইরে থেকে কেউ অনবরত আমার শাড়ির আঁচল টানছেন। আমি হাত দিয়ে আঁচল পেঁচিয়ে ধরলাম। কিন্তু কোনো রুপ উন্নতি হয়নি। ধীরে ধীরে আরো পেঁচিয়ে যেত লাগল শাড়ির আঁচল। একসময় গলা পেঁচিয়ে এলো। তখন বাইরে মাথা এগিয়ে দিতেই দেখতে পেলাম, আমার শাড়ির আঁচল রিক্সার চাকায় পেঁচিয়ে গেছে। চিৎকার করার শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই আমার। একহাতে গলা চেপে অন্যহাতে অরিশ ভাইয়ার দিকে ইঙ্গিত করলাম। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে অবলোকন করলেন আমার নিমিত্তে। ততক্ষণে আমার দম বন্ধ হয়ে এসেছে।

অরিশ ভাইয়ার হাত রাখলেন রিক্সা চালকের কাঁধে, গাড়ি থামিয়ে দিলেন তিনি। অরিশ ভাইয়া এবার নেমে উল্টো ঘুরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। এক টানে শাড়ি ছিঁড়ে ফেললেন। হাফ ছাড়লাম আমি। গলায় অনেকটা জায়গা ছুঁলে গেলে। ক্রমাগত কেশে চলেছি আমি। আঁচল ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে পুরো শরীর কভার করা যাচ্ছে না।
অরিশ ভাইয়া নিজের শরীরের শাল খুলে আমার শরীরে পেঁচিয়ে দিলেন। ছুটে গেলেন অজানায়।

একটু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে পানির বোতল নিয়ে হাজির হলেন। আমার পাশে বসলেন। ছিপি খুলে এক ঢোক পানি মুখে পুড়ে দিলো। ধীরে ধীরে কাশি কমে এলো আমার। অরিশ ভাইয়ার হৃদ মাঝারে মাথা রেখে নিজের অন্তর্ভাগের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস ছাড়লাম।

রুমাল ভিজিয়ে নিলো বোতলের পানিতে। আমার গলায় ছুঁলে যাওয়া স্থানগুলো ভেজা রুমাল দিয়ে ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দিতে লাগলো। ভেজা ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। মৃদু শব্দে বললাম..

– “কেন বার বার আমার সাথেই এমন হয়। আমার বাঁচতে একদম ইচ্ছে করে না। প্লীজ আমাকে মেরে ফেলো ভাইয়া। আমি বেঁচে থেকে সবার ক্ষতি করছি। ভাইয়ার ক্ষতি করবো বলে, সে আমাদের সাথে থাকে না। মামুনিও আমাকে সহ্য করতে পারে না। আমি চাইনা, আমার জন্য তোমার ক্ষতি হোক।”

রুমাল ছেড়ে নিজে হাত অধরের উপরে রেখে থামিয়ে দিলেন আমায়। পানিতে সমেত রুমালের ছোপ ছোপ শব্দে হুম ফিরলো তার। রিক্সার হুঁড টেনে নামিয়ে দিলেন। রিক্সা চালাতে বললেন।মুড়িয়ছ নিলেন আমায় নিজের সাথে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন..
– “কি সব বলছিস পাগলী। তারুণ্য অন্য কারণে তোর থেকে দূরে সরে আছে। চাইলে সে তোকে নিজের সাথে নিজে যেতে পারে কিন্তু তাতে বিপদ তোরই হবে।”

শীতের রাত থমথমে। সন্ধ্যা হতে না হতেই মানুষ – পশু – পাখি নিজ নিজ আশ্রয়ে ফিরে আসে। ঘরে ঘরে আলাে নিভে যায়। কর্মচঞ্চল গ্রাম ও শহর ঘুমে ঢুলতে থাকে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়। শহরের পথে লাঠি ঠুকে ঠুকে চলে পাহারাদার। বিদ্যুৎবাতিগুলাে অসহায়ের মতাে রাস্তার দু – ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামে গ্রামে চৌকিদারদের খবরদারি শােনা যায়। কুকুরগুলাে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে চলে। অনেক দূর থেকে কানে আসে শিয়ালের ‘হুক্কা হুয়া ’ ডাক।

দুই বোন বসে বসে পরীক্ষার পড়াগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। আমার পাশে বসে মহাদয় পরীক্ষার খাতা খুলে দেখছেন। আকর্ষণীয় নজরকাড়া নয়নজোড়া চশমা দ্বারা বন্দী। সেকেন্ডে সেকেন্ডে ললাটে কুঁচকে যেতে দেখা মিলছে। হয়তো শিক্ষার্থীদের প্রতি অসন্তুষ্ট সে। একসময় সব খাতাগুলো দেখা শেষ করলেন। ভাঁজ করে কাবার্ডে রেখে এলেন। চশমা খুলে চেয়ারে গাঁ হেলিয়ে দিলেন। নয়নজোড়া ঘন অন্ধকারে আবৃত তখন। বলেন..

– “কিসব পড়াশোনা করে এরা। আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। এক প্রশ্নের কালেক্ট এন্সার নেই। সবগুলো যেন কুমির রচনা লিখে রেখেছে।”
কদাচিৎ ফাক করে এলো ওষ্ঠ যুগল। আরশি আর আমি একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ নিরব বচ্ছিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বললাম..

– “ভাইয়া কুমির রচনা এলো কোথা‌ থেকে?”
– “এটা কুমির রচনা না। এটা হলো টেকনিক। যেই প্রশ্নই করো, এটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কুমিরের কাছে নিয়ে যাবে।”
টেকনিক টা জানার জন্য ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি সম্মুখীন হলাম। কিন্তু ভাইয়া বলবে না মানে বলবে না। তাই কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে বলতে লাগলেন তিনি।

— “একজন আলসে ছেলে ছিল। থ্রী-তে পড়তো সে। পড়াশোনা তার মোটেও ভালো লাগতো না। প্রতিদিন স্যারের মার খেত। একদিন সে বুদ্ধি করে একটা কুমির রচনা শিখল। স্যার যখন তাকে গরু রচনা বলতে বলল। সে কুমির রচনা বললো।

গরু একটা গৃহপালিত প্রাণী। তার চারটি পা, দুইটা কান, দুইটি চোখ ছিলো। গরু ঘাস খায়। গরু আমাদের দুধ দেয়। একদিন গরু পানি খেতে নদীর কাছে গিয়েছিলো। কুমির টেনে তাকে পানির ভেতরে নিয়ে যায়। কুমির সরীসৃপ প্রাণী। পানিতে বসবাস করে। বড় বড় দাঁত আছে।

এভাবে কুমিরের ব্যাখা দিতে লাগলো। স্যার তখন স্পিসল্যাস হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর স্যার ছেলেটিকে প্লেন রচনা জিজ্ঞাসা করল। ছেলেটি কিছুটা প্লেনের বৈশিষ্ট্য বললো। তারপরে প্লেন ক্রাস করে নদীর পানিতে নিয়ে গেল। নদীতে পড়ার পরে সেখান থেকে আবার কুমিরে মানুষ টেনে নিয়ে গেল। মুল কথা হচ্ছে, যেই রচনাই আসুক না কেন? টেনে কুমিরের কাছে নিয়ে কুমিরের ব্যাখা দিতে হবে।

তেমন হয়েছিস তোরা। সারাবছর পড়বি না, পরীক্ষার সময় কুমির রচনার মতো দিবি। কে বিয়ে করবে তোদের। এক দরজা দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাবি, অন্য দরজা দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।”
আরশি ললাটে জমে থাকা ছোট ছোট কেশ গুচ্ছ পেছনে হেলিয়ে দিয়ে বলল..

– “প্যারা নাই চিল, ঘর জামাই থাকমু। এক দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকবো না, অন্য দরজা দিয়ে ফিরতে হবে না। শুধু শুধু গাড়ি ভাড়া নষ্ট হবে।”

ভাব নিয়ে কথাগুলো বলে ফোনের স্ক্রিনে স্ক্রল করতে লাগলো। অরিশ ভাইয়ার ভ্রু যুগল সরু করলেন কিছুটা। স্কেল ছুঁয়ে মারলেন আঙুলের পাতা বরাবর। ফোঁস করে উঠলো আরশি। চোখ উল্টে মা বলে চিৎকার করলো। অরিশ ভাই ক্ষুব্ধ হলেন কিছুটা। চোখ রাঙালেন। মুহুর্তেই আরশি নিস্প্রাণ হয়ে গেল। আমার সামনের বইটা টেনে নিজের কাছে নিলেন। বইয়ের উপর হাত রেখে গালে স্থাপন করলেন। আরস ভঙ্গিতে বললেন..

– “দুই কাপ চা করে আন। উইথ-আইট সুপার। গাঢ় লিকার দিয়ে। চাইলে নিজের জন্যও আনতে পারিস। গো ফাস্ট..
আরশি ভাইয়া দিকে কিছুটা অসন্তুষ্ট দৃষ্টি অবলোকন করলো। তবে তার জন্য বেশ সুবিধা হলো বোঝা যাচ্ছে। ফোনটা হাতে নিয়ে প্রস্থান করলো আরশি।

আরশি মিলিয়ে যেতেই অপ্রস্তুত কর চাইনি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। অদ্ভুত নেশালো দৃষ্টিতে নিজেকে অগোছালো মনে হতে লাগলো আমার। পড়নে ওরনা নেই। ওরনা গুলো কাবার্ডে রেখে লক করে রেখেছেন তিনি। পড়নের জ্যাকেটটা নিচে নামিয়ে পড়া। চুলগুলো উপরে উঠিয়ে কাঁটা দিয়ে বাঁধা
গলায় ড্রেসিং করা হয়েছে। মাথা নিচু করে জ্যাকেট টা পেঁচিয়ে ধরলাম। অরিশ ভাইয়া এতে অতিশয় উষ্ম হলেন। ইশারায় থামিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক স্বরে বলেন..

– “আজকে বিকালে কোথা থেকে ফিরেছিস তুই। পা ভাঙ্গা। গলা ছিড়া মুরগির মতো।”
ভাষাগুলো হারিয়ে গেল অগোচরে। আমতা আমতা করে বললাম – “এই একটু মন খারাপ ছিলো, তাই বেরিয়েছি।”
– “তাই বলে শাড়ি পড়ে? আমার জানা মতে তুই কখনো শাড়ি পড়িস না।”
সবাই হয়তো কম বেশী মিথ্যার আশ্রয় গ্ৰহণ করতে পারে। কিন্তু আমার দ্বারা হয় না। সাজিয়ে গুছিয়ে সময় নিয়ে বললাম..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৫

– “আমার ভাইয়া থেকেও নেই, একটু ঘুরতে নিয়েও যাবে না। কবে আসবে তাও জানি না। হয়তো তার আগে বিয়ে নামক শিকলে বাঁধা পড়ে যাবো। আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব থাকবে না। তাই মন ভরে..
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। অরিশ ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার মুখপানে। মিথ্যা শব্দগুলোর চেয়ে সত্যি টাই বেশি ছিল। বইয়ের পাতায় মগ্ন হলাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৭