অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৭

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৭
ইফা আমহৃদ

ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আরশি। ছাদের পাশ ঘেঁষে বড় একটা আমগাছ। এক পা আমগাছে রেখে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে। গাছে তেমন পাতা নেই বললেই চলে। শীতের আগে ঝরে গেছে। বসন্তে আবার নতুন পাতা গজাবে। ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। কাঁচা আমে কচি কচি পাতা গুলো ঢাকা পড়ে যাবে। মস্তিষ্কে এই ভাবণাগুলো জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি জিভে জলকণা চলে আসে। তবে আজ শীতের উত্তাপ আয়ত্বে করতে অসময়ে ছাদে আসা। সেদিনের পর থেকে অপূর্ব নামক মানুষটির সাথে দেখা হয় নি।

ছোট রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে বড় বড় কয়েকটা গাড়ি অতিক্রম করলো। ধুলো গুলো ছড়িয়ে পড়লো, ধোঁয়াশা হলো রাস্তাঘাট। যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, আরশি সেই দিকটায় দাঁড়ালো। আরশি মাত্র তিনটা গাড়ি গুনতে পারলো। চতুর্থ টা গোনার আগেই কাঁচ ভেদ করে দৃষ্টি গেল অতিপরিচিত একটা মুখের দিকে। সাদা শার্টের একদম সাদামাটা লাগছে অপূর্বকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরশি ছুটল পিছুপিছু। ওরনাটা কোনো রকম শরীরে পেঁচিয়ে ছুটল গতিশীল গাড়ির পেছনে পেছনে। গাড়ি এসে থাকল বড় একটা বৃদ্ধশ্রমের সামনে। তেরো বছর হয়েছে এই বৃদ্ধশ্রম তৈরি করা হয়েছে। আশ্রমটা আজ সেজে উঠেছে সাদা রঙে। ভেতরে মানুষের গমগম আওয়াজ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে লোকজন নামতে শুরু করলো। কিন্তু কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো না। বৃদ্ধাশ্রমের চারপাশ ঘিরে রইলো। শুধুমাত্র অপূর্ব একাই ভেতরে গেল, পেছনে পেছনে তার এসিস্ট্যান্ট ঢুকল।

অপূর্বের এসিস্ট্যান্ট বিভাসের হাতে সাদা গোলাপ ফুলের প্যাকেট। একটা একটা বৃদ্ধাদের দিচ্ছে। সবাই নিচ্ছে আর অপূর্বের মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করছে। আড়াল থেকে এইসব দেখে স্মিত হাঁসলো আরশি। ছেলেটার পাথর মনের পেছনে তুলোর ন্যায় মন বিরাজ করছে।

অপূর্বের হাতের গোলাপ পাওয়ার ইচ্ছে জাগল তার অবুঝ মনের। বেরিয়ে লাইনে দাঁড়ালো বৃদ্ধাদের মাঝখানে। হাত বাড়িয়ে দিল। অপূর্ব গোলাপ দিতে গিয়ে এক নজর মসৃণ হাতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। অন্তত একবার তীব্র ভাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা জাগল। ফুলটা হাতের মুঠোয় রেখে নিচ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাতের মালিকের দিকে নিক্ষেপ করলেন। আশেপাশে তাকিয়ে পূনরায় হাতের দিকে তাকালো। নয়নজোড়া ফুলবিহীন হাত দিয়ে পরিস্কার করে নিল। অসন্তুষ্ট স্বরে বলে,

– “তুমি! তুমি এখানে কি করছো?”
– “এভাবে ফুলটা ফিরিয়ে দিতে নেই জানেমান। তাছাড়া তুমি যেখানে আমিও সেখানে। তাড়াতাড়ি ফুল দাও।”
নিঃশব্দে ফুলটা আরশির হাতে দিয়ে সামনের দিকে তাকালো। গা ছাড়া ভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সকলে সাদা শাড়ি পড়েছে। এর মাঝে উপস্থিত হলো বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান বয়স্ক মহিলা। তিনি এগিয়ে আসতেই অপূর্ব মৃদু ঝুঁকে পা স্পর্শ করতে চাইলো। কিন্তু সক্ষম হলো না, থামিয়ে দিলেন তিনি। বক্ষ মাঝারে টেনে নিয়ে মাথায় অধর ছুয়ে দিলেন। আরশিও সময় নিলো না। মাথায় কাপড় টেনে প্রধান মহিলা মিসেস্ শুভাসিকে সালাম করলেন। আরশিকে নজর কেটে বললেন..

– “বাহ্, মাশাআল্লাহ। কে তুমি, মা?”
– “আমি আরশি।” অতঃপর লজ্জার্থ দৃষ্টিতে অপূর্বের দিকে তাকালো। আর কিছু বলতে হলো না। মুচকি হাসলেন তিনি। আরশির হাত ধরে নিয়ে গেলেন। আশেপাশের সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।

ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকারের গুচ্ছ এসে আকাশকে নিজের দখলে করে নিয়েছে। আশ্রমের পেছনের দিকটায় জঙ্গলের মতো অন্ধকারে আবৃত। মিলাদ মাহফিল সম্পন্ন করে আরশি এসে দাঁড়ালো সেখানে। তার কানে ভেসে এলো অগোছালো কান্না মাখা স্বর। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল সে। তার থেকে কদম দশেক দূরে মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। শক্তি সঞ্চয় করে কুচিগুচ্ছ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। ফোনের স্ক্রিনে একটা হাসৌজ্জ্বল তরুন রমনীর মুখশ্রীর দেখা যাচ্ছে। রমনীটা একটা সুদর্শন পুরুষের বাহু চেপে আছে। দুজনের মুখে তৃপ্তিকর হাঁসি।

আরশি চমকালো। পায়ের নিচের মাটি ফাঁক হয়ে যাওয়ার যোগার হলো। ছেলেটি আর কেউ নয় গ্যাং স্টার অপূর্ব। আরশির চোখ জোড়া পূর্ণ হয়ে এলো জলকণায়। ফোন ছিনিয়ে নিল। পরক্ষণেই করতলের বিকট আঘাত গালে পড়লো। আরশি ছলছল চোখে চেয়ে রইল। অপূর্বের চোখ ফোলা ফোলা, পাপড়ির উপরে বিন্দু বিন্দু অম্বু ধারা জমে রয়েছে। গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

-“বিভাস, বিভাস। এই মেয়েটা এখানে কি করছে। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যাও। গো ফাস্ট..
বিভাস নামক ছেলেটা আসল। অপূর্বের সামনে মাথা নত করে আরশিকে সম্মানের যেতে বলে। আরশি শ্রবণ গোচর করে না। এতে অতিশয় অসন্তোষ প্রকাশ করে অপূর্ব। আরশিকে মারার জন্য এগিয়ে যায়। উপায় না পেয়ে হাত জোর করে বিভাস। আরশি করুন চোখে অবলোকন করে। জুতোর আওয়াজ তৈরি করে প্রস্থান করলো। পেছন থেকে ডেকে উঠল অপূর্ব। না ফিরে উল্টো ঘুরেই বলে,

-” বিভাস, মেয়েটাকে বাড়িতে পৌঁছে দাও।”
হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে আরশির পিছু পিছু গেল বিভাস। আরশি বিভাসের কথা শুনতে ইচ্ছুক নয়। বড় বড় পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করছে। বিভাস আহত হলো। বুঝতে সক্ষম হলো, অপূর্বের বিহেবিয়ারে কষ্ট পেয়েছে, অভিমান করেছে। গলা ছেড়ে বলতে শুরু করে,

-” আসলে স্যার এই দিনে কারো সাথে তেমন কথা বলে না, প্রচন্ড কাঁদে। আপনিই ভেবে দেখুন, একজন সফল সার্জন, গ্যাং স্টার কখন কাঁদে!”
আরশির পায়ের গতি থেমে গেল। বিভাস এসে আরশির সম্মুখে দাঁড়ালো। অসহায় কাতর চোখ দুটি ঘনঘন পলক ফেলে বলে, -“মানে!”

-” গ্যাং স্টারের জীবনেও অনেক কষ্ট থাকে, তারাও সাধারণ ভাবে বাঁচতে চায় ম্যাম। কিন্তু পরিস্থিতি দেয় না!”
বিভাস গাড়ি আনতে পা বাড়ায়। করলি বাধ সাধে। পায়ের গতির ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটার তালে তালে সে শুনতে চায়।
-” স্যার ছোটবেলায় তার মা মারা যায়, বাবা থেকেও নেই। বোনকে কিছু ব্যক্তিগত কারণে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। নিজের ভালোবাসার মানুষটি এইদিনে চলে গেছেন তার মায়ের কাছে।”

-“কিভাবে মারা গেলেন তিনি!” কোথাও একটা কেঁপে উঠছে আরশির।
-” তিনি ব্যক্তিগত কিছু কারো সাথে শেয়ার করা পছন্দ করে না। আমি তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট তাই এইটুকুই জানি। তবে তিনি এদেশি নয়, ইউকে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন, তখন পরিচিত হয়। আমি চাই, স্যার স্বাভাবিক হোক। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। কোনোরকম সাহায্য লাগবে, বলবেন।”

ঠান্ডায় ঘন ঘন কাঁশতে ব্যস্ত আরশি। শরীরে তার মোটা শাল, মাফলার, কানটুপি, মুজা, গ্লাভস। তবুও শীত কমছে না। থরথর করে কেঁপে চলেছে ক্রমাগত। গরম পানিতে বেশ কয়েকবার উষ্ণতা নিয়েছে। চা কফি খেতে খেতে জিভের ডগা কালচে হয়ে গেছে। হঠাৎ এমন ঠান্ডার কারণ কাউকে বলেনি সে। তার সন্নিকটে আসন দিয়ে বসে আছি আমি। আরশির হাতে অরিশ ভাইয়ার ল্যাপটপ। এখন তার একমাত্র লক্ষ্য টাইটানিক মুভি দেখা‌। সেই লক্ষ্যে স্থির রেখে মুভি দেখতে বসলো আরশি। কিয়ৎক্ষণ আগে ভাইয়ার রুমে আমাকে দিয়ে আনিয়েছে সে।

টাইটানিক মুভি বের করে অন করলো আরশি। ক্রমাগত সেকেন্ড পার করে চলেছে। কিছু একটা মনে দিয়ে খুঁজছে সে। আমি আরশির কাজে চরম বিরক্ত। বিরক্তি নিয়ে বললাম..
– ‘আরু, টাইটানিক মুভি দেখবি বলে ল্যাপটপ নিয়ে এলাম। এমন ভাবে মুভির মাঝখানে কিছু খুঁজছিল মনে হচ্ছে কোনো গুপ্তধন লুকিয়ে আছে।”
আমার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দিয়ে দেখতে মনোনিবেশ করলো সে। কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ টা বেডের উপর রাখলো। গালে হাতে দিয়ে দেখতে দেখতে বলে..

– “লুক, হেব্বি জিনিস। এই সিনটা টিভিতে কেটে আপলোড করে। তাই দেখি নি।”
সাথে সাথে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ল্যাপটপের দিকে দিতেই কুঁচকে এলো আমার চোখ। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। দুহাতে চোখ চেপে ধরে বললাম..
— কিসসস্! আরশি, প্লীজ স্টোপ দিস। ওয়াট আর ইউ লুকিং এট? স্টোপ আপ, ইফ এনিঅন কামস্।
– “চিন্তা করিস না, কেউ আসবে না। প্যারা নাই চিল, সি..

এখনো আমি অন্য দিকে তাকিয়ে আছি। আরশি মন দিয়ে দেখছে। ভাগ্য হয়তো তার সহায় ছিল না। তদানীং প্রবেশ ঘটল অরিশ ভাইয়ার। আরশি দেখায় এতোটা মগ্ন ছিল যে, ভাইয়াকে দেখে নি। দ্রুত স্টোপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে ফিচেল হাসলাম। আরশি বলে,

— ঋনি, দে তো? সিনটা শেষ হয়ে যাবে..
আমি দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু শব্দে বললাম..
– “অনুগ্ৰহ করিয়া আপনার নয়ন জোড়া দিয়ে সামনে দর্শন করেন। নাহলে একটু পরে নতুন সিন শুরু হবে।
সামনে অরিশ ভাইয়াকে দেখে চুপসে গেল আরশি। আমতা আমতা করে বলল..
– “ভ-ভ-ভাইয়া। ত-তুই এখানে কি করছিস?”

সন্দিহান চোখে দুজনের দিকে আলোকপাত করলো সে। অপ্রস্তুত স্বরে বলেন..
– “ল্যাপটপ নিতে এসেছি। এতে তোতলানো‌ কি আছে?”
ভুতুড়ে ঢোক গিলে বললাম..
– “ভাইয়া তুমি যাও, আমি ল্যাপটপ নিয়ে আসছি! ”

নো..! বলে এক প্রকার আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন ল্যাপটপ। আচম্বিতে এমন হওয়াতে শক্ত করে ধরতে পারি নি ল্যাপটপ। আরো একবার করুন সুরে ল্যাপটপ চাইলাম, তিনি নো বললেন। এর পরের পরিস্থিতি অনুভব করে দৌড় লাগালো আরশি। এবার হয়তো ভাইয়ার সন্দেহ জোরালো হলো। ল্যাপটপ খুলে দেখলেন। লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম আমি। পড়নে আমার নীল রঙের জিন্স, লাল টি শার্ট। টি শার্টের উপরে নীল রঙের জ্যাকেট। চুলগুলো দুই পাশে বেনুনী করা। উপরে কানটুপি। পায়ে কাপড়ের জুতা। দেখতে বাচ্চাদের মতো লাগছে। ল্যাপটপ টা আমার দিকে মুখ করে বলল..

-“ছিঃ তরী। কি এইসব? এখন এইসব দেখা শুরু করেছিস। ডোন্ট এক্সপেক্ট।”
– “ভাইয়া বিশ্বাস করো, আমি..
চুপ বলে কিছু একটা করলেন তিনি। টেনে বেডের উপর বসিয়ে দিলেন। নিজের সাথে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে বললেন, দেখতে। ঘৃন্নায় চোখ মুখ ইতিমধ্যে কুঁচকে এসেছে আমার। উঠতে চাইলেই বেনুনী ধরে টান দিলেন। আবার বসে পড়লাম পূর্বের জায়গায়। ভ্রু নাচিয়ে বললেন..

– “এবার দেখছিস না কেন? আগে শুধু কিস্ ছিলো, এখন বাকিসব আছে?”
এবার আমার অবস্থা শোচনীয়। মুখ কুঁচকে বললাম.. -“ভাইয়া বিশ্বাস করো, আমি এইসব দেখি নি। প্লীজ আমাকে ছেড়ে দাও।

– “পুরোটা না দেখে কোথাও যাওয়া চলছে না।”
এবার মুখ কুঁচকে কেঁদে উঠলাম আমি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম..
-“ভাইয়া প্লীজ আমাকে যেতে দাও। আমি আর কখনো এমন করবো না।”
অরিশ ভাইয়া হাত ছেড়ে কাঁধে হাত রাখলেন। আশ্বাসের কন্ঠে বলল,.

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৬

– “দেখতে হবে না। তুই কাঁদিস না।’
বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মুচকি হেসে ভাইয়ার বুকে মাঝে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে গেলাম। বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৮