অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১২

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১২
ইরিন নাজ

দেখতে দেখতে পেরিয়েছে একটা সপ্তাহ। আজ আয়ানা, মীরার সম্পূর্ণ পরিবার কে আদ্রিশদের বাড়িতে ইনভাইট করা হয়েছে। এই জন্য আয়ানা, মীরার মন আনন্দে বাকবাকুম করছে। তারা সবাই মিলে আনন্দের সহিত দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে। বাড়ির পুরুষ সদস্যরাও লাঞ্চের আগেই আজ বিরতি নিয়ে চলে আসবে।
রান্নাবান্না প্রায় শেষ। তাই অনু বেগম আয়ানা এবং মীরা কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— “যাও তোমরা গোসল করে নাও। রান্না প্রায় শেষ। বাকিটা আমি আর প্রীতি সামলে নেবো।”
আয়ানা, মীরা অনু বেগমের কথায় সম্মতি জানিয়ে উপরে চলে আসলো। মীরা আয়ানা কে জিজ্ঞাসা করলো,
— “কি পড়বি তুই?”
— “কেনো যা পড়ি সবসময়। থ্রি পিস…”
— “আমি ভাবছি শাড়ি পড়বো। এক কাজ কর তুই ও পড়। তুই তো একেবারেই পড়িস না। মাঝে মাঝে জামাই কে দেখাতেও তো পড়তে পারিস।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ানার গাল টেনে বললো মীরা। তারপর চলে গেলো নিজের রুমে। মীরার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমে চলে আসলো আয়ানা। কাবার্ড খুলে দেখলো এক সাইডে অনেক অনেক শাড়ি। কিন্তু তার পড়া হয় নি একটাও। কিছুক্ষন চিন্তা ভাবনার পর সেখান থেকে মিষ্টি কালারের একটা হালকা, পাতলা শাড়ি নিলো আয়ানা। মেসেজ করে আনিকা কে রুমে আসতে বললো। অতঃপর চলে গেলো শাওয়ার নিতে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে চিরুনি চালাচ্ছে আয়ানা। মাত্রই আনিকা শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে তাকে। সাথে হালকা করে সাজিয়ে ও দিয়েছে। আয়ানা ও বাঁধা দেয় নি। বাড়িতেই তো থাকবে। অন্য কেউ দেখতে পারবে না। ভেজা চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখতে লাগলো আয়ানা।

এমন সময় ব্যস্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করলো আদ্রিশ। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসবে সেই উপলক্ষে লাঞ্চ টাইমসহ বিকাল অব্দি ব্রেক নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু তার ব্যস্ত পা জোড়া থমকে গেলো সামনে দাঁড়ানো শাড়ি পরিহিতা রমণী কে দেখে। আঁখি জোড়া আটকে গেলো সেই রমণীর উপর। ভেজা চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার। আয়নায় সেই স্নিগ্ধ রমণীর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে, নিজেকে দেখতে ভীষণ ব্যস্ত সে। আদ্রিশের আঁখি জোড়াও ব্যস্ত হয়ে উঠলো মেয়েটাকে মন ভরে দেখার জন্য।

ধীর পায়ে আয়ানার দিকে অগ্রসর হলো আদ্রিশ। আয়নায় নিজের পেছনে আদ্রিশ কে দেখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো আয়ানা। চোরা চোখে চাইলো আদ্রিশের দিকে। লোকটার গভীর দৃষ্টি তার উপর ই আটকে আছে। সেই দৃষ্টিতে বিরাজ করছে একরাশ মুগ্ধতা। বেশিক্ষন সেই চোখে চোখ রাখতে পারলো না আয়ানা। দৃষ্টি নামিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

আয়ানার খুব কাছে এসে থামলো আদ্রিশ। মুগ্ধ চোখে আয়নায় তার মিষ্টি বউ কে দেখতে লাগলো মন ভরে। হাত উঠিয়ে আলতো করে আয়ানার পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঘন, কালো কেশ অন্য পাশে সরিয়ে দিলো। পেছন থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলো আয়ানা কে। মাথা নামিয়ে আয়ানার উন্মুক্ত ঘাড়ে চিবুক ঠেকালো। কেঁপে উঠলো আয়ানা।

চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসলো তার। আদ্রিশ আরও কিছু সময় অপলক তাকিয়ে রইলো। ফের ফিসফিসিয়ে বললো,
— “ইউ আর লুকিং সো মাচ বিউটিফুল বউ। আমার চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না যে! ইচ্ছে করছে এভাবেই তোমায় দেখতে থাকি, তোমায় দেখা শেষ না হোক। তোমার ওই কাজল কালো চোখ, গোলাপি অধর আমাকে পাগল করে দিচ্ছে বউ।”

আদ্রিশের এতো টা কাছে আসায়, এভাবে কথা বলায় হৃদয়ে ঝড় উঠেছে আয়ানার। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। আদ্রিশের উষ্ণ অধরের গভীর স্পর্শ উন্মুক্ত কাঁধে পড়ায় থরথর করে কেঁপে উঠলো আয়ানা। গাল জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো মুহূর্তেই। উদরে রাখা আদ্রিশের হাত খামচে ধরলো সে। আয়নায় আয়ানার মুখের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসলো আদ্রিশ। আলতো করে নিজের হাত ছাড়িয়ে কিছু টা দূরে সরলো। পুনরায় আয়ানার কানের কাছে মুখ এনে বললো,
— “চোখ খোলো বউ….”

আদ্রিশ দূরে সরে গেছে বুঝতে পেরে চোখ মেললো আয়ানা। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগলো। এর মাঝেই পকেট থেকে দুটো ছোট ছোট বক্স বের করলো আদ্রিশ। একটা বক্স খুলে আয়ানার সামনে ধরে বললো,
— “দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।”

চমকে তাকালো আয়ানা। বক্সের ভেতরের জিনিসগুলো দেখে আরও চমকালো সে। বক্সের ভেতর ছোট ছোট সবুজ পাথর বসানো একটা পেন্ডেন্ট এবং দুটো কানের টপ। আয়ানা হা করে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। জিনিসগুলো ছোট, ছোট হলেও অনেক সুন্দর, আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। আয়ানা কে কিছু বলতে না দেখে আদ্রিশ নিজেই বললো,

— “কি হলো পছন্দ হয় নি বুঝি?”
— “না, না অনেক পছন্দ হয়েছে। অনেক সুন্দর এগুলো। কিন্তু কি দরকার ছিলো…”
আয়ানার হাত ধরে থামিয়ে দিলো আদ্রিশ। বক্স থেকে পেন্ডেন্ট টা বের করে গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “অবশ্যই দরকার ছিলো। বিয়ের পরে তোমাকে কিছু দেয়া হয় নি। যা দিয়েছে আম্মু দিয়েছে। তাই ভাবলাম কিছু জুয়েলারি কিনি তোমার জন্য। শপে যাওয়ার পর এটা পছন্দ হলো। তাই কিনে ফেললাম।”

এবার অপর বক্স টা খুললো আদ্রিশ। সেটাতে একটা আংটি জ্বলজ্বল করছে। আংটি টা মাঝারি সাইজের। ঠিক মাঝখানে একটা সবুজ পাথর বসানো আর তার চারপাশ ছোট ছোট সাদা পাথর দিয়ে মুড়ানো। আদ্রিশ বক্স থেকে আংটি টা বের করে আয়ানার বা হাতের অনামিকা আঙুলে সেটা পড়িয়ে দিলো। আলতো স্বরে বললো,

— “এগুলো সবসময় পড়ে থাকবে কেমন! ছোট, হালকা দেখেই নিয়েছি যাতে সবসময় পড়ে থাকতে পারো।”
আয়ানা নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকালো। আদ্রিশ আয়ানার কপালে একটা চুমু খেয়ে নিজের কাপড় নিয়ে চললো ফ্রেশ হতে। আর আয়ানা, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো, নিজের মাঝের পরিবর্তনগুলো ধরার চেষ্টা করতে লাগলো।

আদ্রিশদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে আয়ানাদের পরিবারের সবাই। আদ্রিশদের এতো বড় বাড়ি দেখে চোখ জ্বলজ্বল করছে সারার। আয়ানা এতো বড় বাড়ির বউ হয়েছে ভেবে ভেবে ভেতর টা জ্ব’ল’ছে তার। একইভাবে জ্ব’ল’ছেন সাহেরা বানু ও। নিজেকে নিজে গালি দিচ্ছেন উনি। তখন যদি একটু খোঁজ খবর নিতেন তাহলে হয়তো তার মেয়ে এই বাড়ির বউ হতো। সাহেরা বানু কিছুতেই আসতে চাচ্ছিলেন না আদ্রিশদের বাড়িতে। কারণ টা হলো আয়ানার উপর অনেক রাগ উনার। এই রাগের কারণে আগেরবার যখন দাওয়াত করা হয়েছিল তখন ও আসেন নি উনি এবং সারা। কিন্তু আজ সারা ভীষণ জোর করেছে। সে আসবেই আসবে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে উনাকেও রাজী হতে হলো।

মায়ের আসার খবর পেয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসলো আয়ানা। দেখলো মীরা, অনামিকা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আয়ানা এগিয়ে এসে সবাই কে সালাম দিলো। আয়ানা কে দেখে মুখ বাঁকালো সাহেরা বানু এবং সারা। অনামিকা বেগম উজ্জ্বল হেসে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুহূর্ত ব্যয় না করে মা কে ঝাপ্টে ধরলো আয়ানা। বুকের মাঝে লেপ্টে গেলো। অনামিকা বেগম মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শুধালেন,

— “কেমন আছিস মা?”
— “আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি আম্মু।”
মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে উজ্জ্বল হেসে বললো আয়ানা। অনামিকা বেগম আয়ানার উজ্জ্বল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মেয়ের মুখের উজ্জ্বলতাই বলে দিচ্ছে সে অনেক ভালো আছে। দুই মেয়ে কে সুখী দেখে মনের মাঝে শান্তি অনুভব করলেন উনি।

আয়ানাদের কথার মাঝেই নিচে নেমে আসলো আদ্রিশ, আহিল। দু’জন কুশল বিনিময় করে বিভিন্ন কথা বলতে লাগলো। সারা আয়ানার পাশের সোফাতেই বসে ছিলো। হঠাৎ আয়ানার বা হাত চেপে ধরলো সে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। চমকে তাকালো আয়ানা। সাবধানে হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। সারা নিচু স্বরে শুধালো,

— “অনেক দামী মনে হচ্ছে। জামাই দিয়েছে বুঝি?”
আয়ানা বুঝতে পারলো সারা আংটিটার কথা বলছে। আংটি টা অর্থের দিক দিয়ে হিসাব করলে কতোটা দামী জানা নেই আয়ানার কিন্তু তার কাছে এটা মহামূল্যবান কিছু। সে এক পলক আংটি টা দেখে নিচু স্বরে ছোট করে উত্তর করলো,
— “হু।”
আর কোনো কথা হলো না দুজনের। এরপর বেশ কিছুক্ষন সবাই গল্প করলো। অনু বেগম এবার তাড়া দিয়ে বললেন আগে লাঞ্চ করে নিতে সবাই কে তারপর নাহয় গল্প করা যাবে আবার।

লাঞ্চ শেষে সবাই আবারও বসার ঘরে বসে গল্প করতে লাগলো। এক পর্যায়ে ফোনে কল আসলো আদ্রিশের। সে একটু পর আসছে বলে উপরে নিজের রুমে চলে গেলো। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে পুনরায় মায়ের সাথে গল্পে মশগুল হলো আয়ানা। কিছু সময় পর আয়ানার হাতে খোঁ’চা দিলো পাশে বসে থাকা মীরা। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
— “আমাকে একটু হেল্প করবি বোন? শাড়ির কুচি খুলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। একটু ঠিক করবো। তুই ও চল না আমার সাথে…”
— “আচ্ছা, আচ্ছা চলো।”

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১১

আয়ানা, অনামিকা বেগম কে বললো সে আর মীরা একটু উপরে যাবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে তারা। অনামিকা বেগম সম্মতি দিতেই দুই বোন উপরে মীরার রুমে চলে গেলো। আয়ানা মীরার কুচি গুছিয়ে দিলো। সব ঠিকঠাক করে রুম থেকে বের হলো দু’জন। নিচে যাওয়ার জন্য একটু এগোতেই আদ্রিশের মৃদু চিৎকারের শব্দ কানে এসে পৌঁছালো দু’জনের। নিচে যাওয়া বাদ দিয়ে উল্টো পায়ে দ্রুত আয়ানাদের রুমের সামনে আসলো দু’জন। রুমের ভেতরের দৃশ্য দেখে জমে গেলো আয়ানা। হাত মুঠ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আঁখি জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো নিমিষেই।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৩