অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৫

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৫
ইরিন নাজ

সন্ধ্যায় ঘুম ভা’ঙ’লো আয়ানার। মাথা চে’পে ধরে উঠে বসলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে আদ্রিশ কে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু আদ্রিশের দেখা পাওয়া গেলো না। আয়ানা বুঝতে পারলো সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আদ্রিশ হয়তো চলে গিয়েছে। ঘন্টা দুয়েক আগে নিজের করা পা’গ’লা’মিগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো আয়ানার। সেই সাথে আদ্রিশের কথা ও।

লজ্জায় গাল জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো তার। আদ্রিশ আর তার ঘনিষ্ট মুহূর্তের কথা ভেবে লাজুক হাসলো সে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর গেলো আয়ানার। এতক্ষনে মাগরিবের আজান হয়ে গিয়েছে। আয়ানার খেয়াল হলো তার আসরের নামাজটাও মিস হয়ে গিয়েছে। তাই দ্রুত বিছানা ছাড়লো সে। অজু করে এসে আসরের কাজা নামাজ টা আগে আদায় করলো। তারপর মাগরিবের নামাজ আদায় করলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জায়নামাজ ভাঁজ করে রেখে মাত্রই বিছানায় বসেছে আয়ানা, ওমনি তার ফোন টা বেজে উঠলো। আয়ানা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে ‘ডাক্তার সাহেব’ নাম টা ভেসে আছে। আপনাআপনি অধর কোণে হাসি চলে আসলো তার। দ্রুত ফোন টা রিসিভ করে নম্র কণ্ঠে সালাম দিলো সে। আদ্রিশ সালামের জবাব দিয়ে শুধালো,

— “উঠেছো তবে?”
— “হু…”
— “এখনো মন খা’রা’প?”
— “উহু…”
— “এতো কা’ন্না’কা’টি করেছো, মাথায় ব্য’থা আছে নিশ্চয়ই! হালকা কিছু খেয়ে একটা মাথা ব্য’থা’র ওষুধ খেয়ে নিও। বাকি ট্রিটমেন্ট আমি এসে দিবো নাহয়।”

নিঃশব্দে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো আয়ানা। আদ্রিশের শেষের কথায় লজ্জা ও পেলো। তবে কোনো জবাব দিলো না। আদ্রিশ ব্যস্ত থাকায় কল কে’টে দিলো। ফোন রেখে খানিকটা সময় চুপ করে বসে রইলো আয়ানা। ভাবতে লাগলো আদ্রিশের কথা। নিজেকে ভীষণ লাকি মনে হলো তার। আদ্রিশ তার অনেক যত্ন নেয়। এই তো যাওয়ার আগে তার চুল মুছে দিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো যাতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। আর এখন তার মাথায় য’ন্ত্র’না হচ্ছে ভেবে ফোন করে ওষুধ খেয়ে নিতে বললো। সবার কপালে কি আর এমন জীবন সঙ্গী জোটে! সত্যিই সে লাকি, ভীষণ লাকি।

রাত নয়টা। আদ্রিশ এখনো আসে নি, আহিল ও নেই বাসায়। তাই মীরার রুমে উঁকি দিলো আয়ানা। বসে বসে ফোন টিপছে মীরা। আলতো করে দরজায় টোকা দিলো আয়ানা। মীরা দরজার দিকে তাকিয়ে আয়ানা কে দেখে আলতো হাসলো। বললো,

— “আয়, আয় ভেতরে আয়।”
ভেতরে ঢুকে মীরার পাশে বিছানায় পা তুলে বসলো আয়ানা। শুধালো,
— “মন খা’রা’প তোমার?”
— “একটু একটু। আজ যা হলো তা না হলেও পারতো। সারা এতোটা নিচে নামবে আমি সত্যিই ভাবতে পারি নি। আমার তুলনায় তোর মন তো বেশি খা’রা’প বোধহয়!”

— “ছিলো, এখন নেই।”
মীরা হাসলো। বললো,
— “যাক ভালো তবে। ওই সময় যেই রে’গে গিয়েছিলি তুই!”
এরপর কিছু টা সময় নীরবতায় কা’ট’লো। নীরবতা ভে’ঙে আয়ানা শুধালো,

— “আচ্ছা আপু একটা প্রশ্ন করি?”
— “হুম কর। এভাবে জিজ্ঞাসা করার কি আছে!”
— “আমাকে অনেক ভালোবাসো তুমি তাই না?”
— “হুম, বাসিতো। কোনো সন্দেহ?”
মাথা ঝা’কি’য়ে হাসলো আয়ানা। পুনরায় শুধালো,

— “তাহলে আগে আমার সাথে কথা বলতে না কেনো? কেনো আমার সাথে তেমন একটা মিশতে না?”
আয়ানার প্রশ্নে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো মীরা। সে জানতো একদিন না একদিন এই প্রশ্ন আয়ানা করবেই। মীরা আলতো করে আয়ানার হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। বললো,

— “যখন তুই আমাদের বাড়িতে এসেছিলি তখন আমি তোকে খুব আদর করতাম। মনে আছে তোর?”
— “হু, মনে আছে তো। তুমি আমায় খুব আদর করতে। কিন্তু ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়লো।”
— “ছোটবেলা থেকেই আমার শখ ছিলো আমার একটা ছোট ভাই বা বোন হোক। আমার সেই শখ পূরণ হয়েছিল যেদিন তুই আমার লাইফে এসেছিলি। গুলুমুলু, ছোট্ট একটা পরী। দেখেই আদর, আদর পাচ্ছিলো। কিন্তু সময় যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি হলো। তবে ভালোবাসা টা এক বিন্দু ও কমে নি। তোকে শুরুতে যেমন ভালোবাসতাম, আজও তেমন ভালোবাসি।”

— “তাহলে আমাদের মাঝে দূরত্ব কেনো আসলো আপু? কেনো হঠাৎ করে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেলে তুমি? জানো আমার কতো খা’রা’প লাগতো! ভাবতাম তুমি বুঝি আমাকে আর পছন্দ করো না, ভালোবাসো না। ধীরে ধীরে ভী’তির সৃষ্টি হলো আমার মনে। সেই ভী’তি’র কারণে তোমার কাছেও যেতাম না আমি। দূরে দূরে থাকতাম।”
মীরা কিছুক্ষন থম মে’রে থেকে বললো,

— “আমাদের মাঝে এতো এতো দূরত্ব ফুপির কারণে তৈরি হয়েছিলো বোন। আম্মু মা’রা যাবার পর আমার আর আব্বুর মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি হয়। আম্মু কে বড্ড বেশি ভালোবাসতো আব্বু। নিজের প্রানপ্রিয় স্ত্রী কে অকালে হা’রি’য়ে আব্বু একদম নীরব হয়ে যায়, কেমন যেনো ক’ঠো’র হয়ে যায়। আমাকেও আর আগের মতো ভালোবাসতো না, সময় দিতো না, যত্ন নিতো না। ফুপি তখন আমাদের সাথে থাকতো না।

যেহেতু আব্বু আমার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছিলো না আর ফুপা ও দেশে ছিলো না তাই আব্বু ফুপি কে আমাদের কাছে চলে আসতে বলে। ফুপি, সারা কে নিয়ে চলে আসে আমাদের কাছে। ফুপি আসার পর কয়েক মাস কে’টে যায়। ফুপি ভেবেছিলো ভাইয়ের সাথে থাকলে সে আরামে থাকতে পারবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সবকিছু ফুপি কে সামলাতে হতো। তাই সে নতুন বুদ্ধি আটে। নিজের আরাম, আয়েসের কথা চিন্তা করে আব্বু কে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলে। আব্বু কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না।

কিন্তু ফুপি আব্বু কে বোঝায় আমার মায়ের দরকার। আর মায়ের অভাব সে বা আব্বু কেউ ই পূরণ করতে পারবে না। তবুও আব্বু রাজী হচ্ছিলো না। অনেক ভাবে বোঝানোর পর শেষমেষ আব্বু রাজী হয়। আম্মুর সাথে বিয়ে হয় আব্বুর। কিন্তু আব্বু কখনো আম্মু কে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানতে পারে নি। নিজের স্ত্রীর স্থান টা দিতে পারে নি। ঠিক একইভাবে আম্মু ও কখনো আব্বু কে নিজের স্বামীর স্থানে বসাতে পারে নি।

তবে এটা সত্য, আম্মু আসার পর আমার মায়ের অভাব পূরণ হয়েছে। আম্মু কখনো আমাকে বুঝতে দেয় নি আমি তার পেটের সন্তান না, আমি তার স’ৎ মেয়ে। আল্লাহ আমার কাছ থেকে এক মা কে’ড়ে নিয়ে আমাকে আরেক মা দিয়েছেন। কিন্তু আম্মু আসায় আমার মায়ের অভাব পূরণ হলেও তোর বাবার অভাব টা পূরণ হলো না। উল্টো আম্মু আর তোর মাঝেও দূরত্ব আসলো। তুই একা হয়ে পড়লি। এই সব কিছুই ফুপির কারণে হয়েছে।

আমার জানা নেই ফুপি তোকে আর আম্মু কে এতোটা অ’পছন্দ কেনো করে, এতো ঘৃ’ণা কেনো করে! আব্বু, ফুপি কে প্রচুর বিশ্বাস এবং মান্য করে, একমাত্র বোন বলে কথা। তাই ফুপি যা বলতো আব্বু তাই বিশ্বাস করতো। সেই সুযোগ নিয়ে ফুপি আব্বুর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যে তুই আর আম্মু ফুপি কে আর উনার মেয়ে কে হিং’সা করিস। এটা বুঝিয়েছিল যে তোকে আর আম্মু কে বেশি মাথায় না তুলতে।

বেশি মাথায় তুললে আম্মু নাকি শুধু তোকে আদর করবে, আমার উপর অ’ত্যা’চা’র করবে। কারণ আমি আম্মুর আপন মেয়ে না। এটা আমি কিভাবে জানলাম জানিস? উনি আমাকেও এসব বুঝিয়েছিল যাতে তোর সাথে না মিশি, খা’রা’প ব্যবহার করি, তোকে আম্মুর কাছে ঘেঁ’ষ’তে না দেই। কিন্তু আমি পারি নি। তাই উনি আব্বু কে আবার কি সব বুঝিয়েছিলো যার কারণে আব্বু একদিন আমাকে ডেকে ক’ড়া কণ্ঠে বলে তোর সাথে যেনো এতো না মিশি, দূরে দূরে থাকি।

এরপর থেকে আমি লক্ষ্য করতাম, আমি যখন ই ফুপির কথা অ’মান্য করে তোর সাথে কথা বলতাম, খেলতাম তখন সে তোকে আর আম্মু কে আরও বেশি বি’র’ক্ত করতো, জ্বা’লা’তন করতো। আমাকে তো কিছু করতে পারবে না তাই সব তোর উপর দিয়ে যেতো। এমনিতেও কম জ্বা’লা’তন তো আর করতো না তোকে! যখন ইচ্ছা গায়ে হাত তুলতো। আর আব্বু কে বলতো তুই সারা কে মা’রি’স।

তার উপর আবার আমার কারণে তোকে আরও বেশি জ্বা’লা’তো, মা’র’তো। তোর সাথে খা’রা’প ব্যবহার করা আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব ছিলো না। আর না ফুপির বিরুদ্ধে আব্বুর কাছে কিছু বলতে পারতাম। কারণ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম ফুপি এমন একজন মানুষ যে নিজ স্বার্থের জন্য আমাকেও আব্বুর চোখে খা’রা’প বানিয়ে দিতে পারে। তাই ধীরে ধীরে তোর কাছ থেকে দূরে সরে যাই, কথা বলা বন্ধ করে দেই।

মীরার সম্পূর্ণ কথা শুনে চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো আয়ানার। ভাবলো, সাহেরা বানু, এই একটা মানুষের কারণে তাদের জীবন টা কতো কতো জ’টি’ল’তায় ভ’রে গিয়েছিলো। আর রইলো সারা, সে তো মায়ের দেখানো পথ ই অনুসরণ করেছে। আয়ানা অন্যমনস্ক হয়ে বললো,

— “উনি এমন কেনো করেছে জানো মীরা আপু? কারণ উনি আম্মু কে ভাইয়ের বউ হিসেবে নয়, কাজের লোক হিসেবে ওই ঘরে তুলেছে। উনি আমাদের সাথে ওমন আচরণ করে বুঝিয়ে দিতো যে আমাদের ওই বাড়িতে কোনো মূল্য নেই, মূল্যহীন আমরা। উনিই রাজা, উনার রাজত্ব ই চলবে। উনি এই সবটা করেছে যাতে আম্মু কখনো নিজেকে ওই বাড়ির বউ আর আমি কখনো নিজেকে ওই বাড়ির মেয়ে মনে না করি, কোনোরকম অধিকার না খাটাই। আর হিং’সা, ঘৃ’ণা তো আছেই।”

মীরা বুঝতে পারলো আয়ানা ক’ষ্ট পেয়েছে। তাই সে আয়ানা কে এক পাশ থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
— “থাক বোন অতীতের কথা ভেবে ক’ষ্ট পাস না। উনাদের শা’স্তি উনারা ঠিক পাবে। আর আমরা তো এখন সারাজীবন একত্রে থাকতে পারবো। কেউ তোকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। আদর করতে, ভালোবাসতে বারণ করবে না। এই বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য কতো ভালো! তারা আমাদের অনেক ভালোবাসে, আদর করে। আমরা কতো লাকি বল! এতো ভালো একটা পরিবারে দুই বোন একসাথে এসেছি।”

আয়ানা ও হাসলো। মীরা কে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। ভাবলো, আসলেই মীরা ভুল কিছু বলে নি। অতীতের কথা ভেবে শুধু শুধু ক’ষ্ট পাওয়ার কোনো মানেই হয় না।

রাত ১২ টা। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আয়ানা। চোখে ঘুম নেই তার। আদ্রিশ রুমে বসে মনোযোগ দিয়ে কি সব বই পড়ছে। তাই বেলকনিতে চলে এসেছে সে। দৃষ্টি তার আকাশে বিদ্যমান অর্ধচন্দ্র এবং অগণিত তারার দিকে। কিছুক্ষণ পর পর ফুরফুরে বাতাস এসে গা ছুঁয়ে দিচ্ছে তার। এই তো সন্ধ্যার দিকে ঝুম বৃষ্টি হলো। অথচ এখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার।

কিছু সময় অতিক্রম হবার পর হঠাৎ দুটি হাত পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আয়ানা কে। হঠাৎ স্পর্শে হালকা কেঁ’পে উঠলো আয়ানা। হাত জোড়ার মালিক কে বুঝতে পেরে শান্ত হয়ে গেলো সে। কিন্তু আদ্রিশ এখানেই থামলো না। আয়ানার খোঁপা করা চুল এক টা’নে খুলে ফেললো। কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে ধীর স্বরে শুধালো,

— “ঘুমাবে না?”
— “বিকালে ঘুমিয়েছি, এখন আর ঘুম আসছে না। আপনি ঘুমাবেন না?”
— “কি করে ঘুমাই বলো! একজন ভীষণ বা’জে অভ্যাস করিয়ে দিয়েছে। তাকে জড়িয়ে না ধরলে, বুকে না নিলে ঘুম জিনিস টা চোখে ধরা দিতে চায় না। মন-মস্তিষ্ক শান্ত হয় না।”

আদ্রিশ কি মিন করেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো আয়ানা। হাসির কারণে তার ফুলো ফুলো গাল আরও ফুলে উঠলো। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদ্রিশ। কোনো কিছু না ভেবে আয়ানার ফুলে ওঠা গালে অধর চেপে শব্দ করে একটা চুমু খেলো সে। ঘাড় ফিরিয়ে চোখ বড় বড় তাকালো আয়ানা। হাসলো আদ্রিশ। বললো,

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৪

— তোমার এই ফুলো ফুলো গালের উপর আমার কতদিনের লো’ভ জানো?
আয়ানা জবাব দিতে পারলো না। লাজে রাঙা হয়ে মাথা নিচু করে রইলো। আদ্রিশ মুখ ডু’বা’লো আয়ানার উন্মুক্ত চুলের ভাঁজে।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ১৬