অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৮

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৮
ইরিন নাজ

ডিনার শেষে হাতে হাতে সবকিছু গুছিয়ে রুমে ফিরলো আয়ানা। আদ্রিশের সামনে যেতে তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। এই জন্য এতো সময় অনেক টা পালিয়ে বেরিয়েছে সে। কিন্তু এখন তো ফিরতেই হতো। আয়ানা রুমে ঢুকতেই আদ্রিশের চোখ আয়ানার উপর পড়লো। আদ্রিশের চোখে চোখ পড়ায় দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো আয়ানা।

আদ্রিশ এগিয়ে আসলো আয়ানার দিকে। আয়ানা কে পাশ কা’টি’য়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর আয়ানার হাত ধরে বিছানায় নিয়ে বসিয়ে দিলো। টেবিলের উপর থেকে একটা বক্স এনে আয়ানার হাতে ধরিয়ে দিলো সে। গোল গোল চোখে একবার আদ্রিশ আর একবার বক্স টা দেখতে লাগলো আয়ানা। সুন্দর করে ৱ্যাপিং পেপারে মোড়ানো হয়েছে বক্সটাকে।
— “কি হলো খোলো…”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আয়ানা কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তাড়া দিলো আদ্রিশ। আয়ানা কৌতূহলের সাথে ধীরে ধীরে উপরের ৱ্যাপিং পেপার টা খুলে ফেললো। অমনি চোখ বড় বড় করে আদ্রিশের দিকে তাকালো সে। কারণ আদ্রিশ তার জন্য স্মার্ট ফোন নিয়ে এসেছে। আয়ানা কে ওভাবে তাকাতে দেখে মিষ্টি হাসলো আদ্রিশ। বলে উঠলো,
— “আমাকে তুমি পরেও দেখতে পারবে, এখানেই আছি। আগে বক্স টা খুলে তো দেখো পছন্দ হয় কিনা…”
লজ্জা পেলো আয়ানা। মাথা নিচু করে বলে উঠলো,

— “এটার কোনো দরকার ছিলো না। আম্মুর ফোন আছে, আপনার আছে…”
আদ্রিশ হাত ধরায় থেমে গেলো আয়ানা। আবারও তাকালো আদ্রিশের দিকে। আদ্রিশ আয়ানার হাত মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে উঠলো,

— দরকার আছে বলেই নিয়ে এসেছি। আরও আগেই এনে দিতাম। কিন্তু পড়াশোনা থেকে তোমার মনোযোগ ন’ষ্ট হতে পারে বলে আনি নি। এখন তো তুমি মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছো। আর ছোট নও তুমি। নিজের ভালো কোনটাতে সেটা নিজেই ভালো বুঝবে। কোনটা করলে ঠিক হবে বা কোনটা করলে ভুল সেটাও তোমাকেই বুঝে নিতে হবে। তোমার বয়স হয়েছে নিজের ভালো, খারাপ বোঝার। আর মজার বিষয় কি জানো?

আমাদের তিন ভাই বোনকেও এই লেভেল টা পাড় করার পর আম্মু ফোন হাতে দিয়েছে। এর আগ অব্দি আমাদের পার্সোনাল কোনো ফোন ছিলো না। যখন ভার্সিটি লেভেলে গেলাম তখন আম্মু আমাদের ফোন হাতে দিয়ে বলেছিলো এখন তোমাদের বুঝ তোমাদের। যা করবে ভেবে চিন্তে করবে।”

মাথা নিচু করে হাসলো আয়ানা। এতদিনে সে একটা জিনিস ভালোই বুঝে গেছে যে এই বাড়ির প্রতিটা সদস্য অনু বেগম কে ভীষণ মান্য করে, শ্রদ্ধা ও সম্মান করে। আর অনু বেগম এমন একজন মানুষ যিনি সবাই কে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন। তাই তো এই বাড়ির সবাই এতোটা ভালো মন মানসিকতার।
আদ্রিশ ফের তাড়া দেয়ায় বক্স খুললো আয়ানা। ব্লু রঙের ফোন টা। ভীষণ পছন্দ হলো আয়ানার।

— “পছন্দ হয়েছে?”
— “হু ভীষণ…”
উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো আয়ানা। আদ্রিশ টেবিলের উপর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আসলো। সেই প্যাকেট থেকে নতুন সিম কার্ড বের করে আয়ানার ফোনে লাগিয়ে দিলো, ফোনে কভার পড়িয়ে ফোনটাকে ওপেন করলো। বলে উঠলো,
— “এখন নাম্বার সেভ করবো। কিভাবে করতে হয় দেখে নাও।”

আদ্রিশ একে একে সবার নাম্বার ফোনে টুকে সেভ করতে লাগলো। মনোযোগ সহকারে সেটা দেখতে লাগলো আয়ানা। সে আসলেই এসব পারে না। শুধু কল করতে পারে, রিসিভ করতে পারে। অনু বেগমের ফোন চালিয়ে শিখেছে।
আদ্রিশ আয়ানার কাছে কার নাম্বার কি নামে সেভ করবে জিজ্ঞাসা করে করে সেভ করছে। সবার নাম্বার সেভ করা শেষে নিজের নাম্বার আয়ানার ফোনে টুকে নিলো। জিজ্ঞাসা করলো,

— “আমার নাম্বার কি নামে সেভ করবো বলো…”
— “ডাক্তার সাহেব।”
ফট করে বলে থতমত খেয়ে গেলো আয়ানা। তালে তালে কি বলে ফেলেছে ভেবে লাজে রক্তিম হলো সে। আদ্রিশ মিটিমিটি হেসে বলে উঠলো,
— “ওহ আচ্ছা, আচ্ছা। বাই দা ওয়ে নাম টা কিন্তু সুন্দর।”

আদ্রিশ কে হাসতে দেখে লজ্জায় আরও নুয়ে পড়লো আয়ানা। গলা ঝাড়লো আদ্রিশ। আর লজ্জা দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই তার বউ টা মারাত্মক রকমের লজ্জাবতী। আদ্রিশ নিজের নাম্বার ‘ডাক্তার সাহেব’ নামে সেভ করে দিলো। তারপর আয়ানা কে একটা ফেসবুক আর একটা হোয়াটস্যাপ একাউন্ট খুলে দিলো। মেডিকেলের ক্লাস শুরু হলে আয়ানার এই দুটো জিনিসের প্রয়োজন পড়বে জানে আদ্রিশ। তাই একাউন্ট খুলে আয়ানা কে সব টা ভালো মতো বুঝিয়ে দিলো সে। সব কাজ শেষে ফোন টা আয়ানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— “এই নাও তোমার ফোন। আপাতত সব কাজ শেষ। কোনো কিছু না বুঝলে আমাকে জিজ্ঞাসা করিও। আর,, আর এখন থেকে কল দিলেই যেনো সাথে সাথে রিসিভ হয়। মনে থাকবে তো?”
মাথা ঝাকালো আয়ানা। আদ্রিশ কিছু টা দূরে গিয়ে নিজের ফোনে আয়ানার নাম্বার সেভ করলো। নাম দিলো ‘মিষ্টি বউ’। নিজের এলোমেলো চুলে হাত ডুবিয়ে হাসলো সে। দিনদিন কেমন পাগলাটে হয়ে যাচ্ছে সে। হয়তো বউয়ের প্রেমে পড়ে ভেবে পুনরায় হাসলো আদ্রিশ।

পাশাপাশি শুয়ে আছে আদ্রিশ আয়ানা। মাঝখানে অন্যান্য দিনের মতো কোল বালিশ। আদ্রিশ আড়চোখে একবার কোল বালিশ আর একবার আয়ানার দিকে তাকালো। কোল বালিশটাকে ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। ইচ্ছে করছে ছুড়ে ফেলে দিতে। আর আয়ানা, সে তো অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে নাকি জেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না। আদ্রিশ হালকা কাশি দিয়ে বলে উঠলো,

— “ঘুমিয়ে পড়েছো?”
— “উহু…”
আদ্রিশের দিকে কাত হয়ে জবাব দিলো আয়ানা। আবছা আলোয় আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। আদ্রিশ বলে উঠলো,
–“পরশু তোমাকে কোচিং এ ডেকেছে। ইন ফ্যাক্ট, সকল মেডিকেলে চান্স প্রাপ্ত স্টুডেন্ট কেই ডাকা হয়েছে। অনুষ্ঠান আছে, তোমাদের সকল কে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট প্রদান করা হবে। আজ আমাকে কল করে জানালো।”

— “তাহলে তো দ্বীপ আর মিথিকেও ডেকেছে?”
— “হুম, অবশ্যই। ওদের সাথে কথা হয় নি?”
— “উহু…”
— “আচ্ছা কাল কল করে কথা বলে নিও আর তোমার নাম্বারটাও ওদের জানিয়ে দিও।”
— “আচ্ছা।”

এরপর কিছু সময় নীরবতায় কে’টে গেলো। খানিক সময় পর টিপিটিপি চোখ খুলে আদ্রিশের দিকে চাইলো আয়ানা। আদ্রিশ চোখের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে। আয়ানার চোখ গেলো আদ্রিশের বুকের দিকে। ভীষণ লোভ লাগছে তার। ইচ্ছে করছে গত রাতের আদ্রিশের বুকে মুখ গুজে ঘুমাতে। কিন্তু এখন এমন কিছু করতে গেলে আদ্রিশ ও তাকে নির্লজ্জ বলবে হয়তো ভেবে ঠোঁট উল্টালো সে। এমনিতেও গতকাল রাত থেকে আজ অব্দি যেই যেই কাহিনী সে করেছে তাতে নিজেকে নিজে একাধিক বার নির্লজ্জ উপাধি দিয়ে ফেলেছে সে। এইসব নানারকম হাবিজাবি চিন্তা ভাবনা করতে করতে এক সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো আয়ানা।

আয়ানা ঘুমিয়ে পড়ার কিছু সময় পর চোখের উপর থেকে হাত সরালো আদ্রিশ। ঘাড় কাত করে আয়ানার দিকে চাইলো। ঘুমিয়ে পড়েছে আয়ানা। গাঢ় নিঃশ্বাস পড়ছে তার। মেয়েটা কে বুকে না নিলে যে আজ আর ঘুম হবে না বুঝে গেছে আদ্রিশ। এক রাতে এমন বা’জে নে’শা কি করে ধরলো ভেবে পেলো না সে। আদ্রিশ ধীরে ধীরে মাঝের কোল বালিশ টা সাইডে সরিয়ে রাখলো।

তারপর আয়ানার দিকে কিছু টা এগিয়ে ধীর হাতে কোমর চেপে ধরে বুকে নিয়ে আসলো। আদ্রিশের শরীরের ওম পেয়ে আরামে আদ্রিশের বুকের সাথে আরও মিশে গেলো ঘুমন্ত আয়ানা। বুকে মুখ গুজে গুটিসুটি হয়ে লেপ্টে রইলো। আয়ানার ঘুম ভা’ঙে নি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আদ্রিশ। মেয়েটার ঘুম বেশ গাঢ়, সহজে ভা’ঙে না খেয়াল করেছে সে। ঘুমন্ত আয়ানার কপালে এবং চুলের ভাঁজে পরপর দুটো চুমু খেলো আদ্রিশ। এখন শান্তি লাগছে তার। এতক্ষনের অ’স্থি’রতা দূর হয়েছে। আয়ানা কে আরেকটু নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো আদ্রিশ। কিছু সময়ের ব্যবধানে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো সে ও।

ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভা’ঙ’লো আয়ানার। চোখ মেলে নিজেকে কারোর শক্ত বাহু বন্ধনে আবদ্ধ পেয়ে চমকালো সে। ঘুম ঘুম ভাব উড়ে গেলো। কোথায় আছে, কিভাবে আছে বুঝতে পেরে দ্রুত মাথা উঁচু করলো। নজরে আসলো আদ্রিশের ঘুমন্ত মুখশ্রী। আয়ানা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো সে আদ্রিশের এতো কাছে কিভাবে আসলো, মাঝখানের কোল বালিশ ই বা কোথায় গেলো! কোথাও সে ঘুমের মাঝে উঠিয়ে ফেলে দেয় নি তো ভেবে চিন্তিত হলো আয়ানা। পরোক্ষনেই নিজের চিন্তা ত্যাগ করলো সে। যেই সরিয়েছে বেশ করেছে। আরামের ঘুম তো হলো!

আয়ানা ফের তাকালো আদ্রিশের দিকে। আবছা আলোয় আদ্রিশ কে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। কি সুন্দর করে ঘুমায় লোক টা ভাবলো আয়ানা। হাত উঠিয়ে আলতো করে আদ্রিশের কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো সে। অমনি চোখ মেললো আদ্রিশ। থতমত খেয়ে দ্রুত হাত নামিয়ে ফেললো আয়ানা। তখন ও দূরের মসজিদে আজান চলছে। আজানের শব্দে হাই তুলে উঠে বসলো আদ্রিশ। এমন ভাব করলো যেনো কিছুই হয় নি।

বিছানা থেকে নেমে অজু করতে চলে গেলো। আদ্রিশ যেতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলো আয়ানা। বুকে হাত রেখে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। লাইট জ্বালিয়ে কোল বালিশ খোঁজ করতে লাগলো। কোল বালিশ নিজের সাইডে পেয়ে এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো সে। তারমানে কি সে সরিয়েছে…. ঘুমের মধ্যে এসব কি করলো ভেবে দু হাতে মুখ চেপে ধরলো আয়ানা।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৭

এখন যদি আদ্রিশ তাকে এ নিয়ে কিছু বলে তাহলে সে কই যাবে? লজ্জায় ম’রে টরে যাবে বোধহয়। কিন্তু আয়ানার ভাবনা মতো কিছুই হলো না। আদ্রিশ অজু করে বেরিয়ে শুভ্র একটা পাঞ্জাবী গায়ে জড়িয়ে নামাজ পড়তে চলে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আয়ানা। এবারের মতো বেঁচে গেছে। তবে এরপর থেকে সাবধানে ঘুমাতে হবে ঠিক করলো সে।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ৯