অতঃপর প্রেম পর্ব ৪+৫+৬

অতঃপর প্রেম পর্ব ৪+৫+৬
লেখনীতে আয়ানা আরা

আমি বাসায় এসে নিজের রুমে চলে যাই ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখি আম্মু বিছানায় বসে আর তার সাথে কিছু জিনিস রাখা। আমি আম্মুর কাছে যেতেই সে আমাকে বলে,’এই মেহু দেখ তো এই শাড়িটা কেমন।’
আমি ভ্রুকুচকে বলি,’সুন্দর কিন্তু এইসব দিয়ে কি করবা।’
‘মেহেদীর জন্য মেয়ে ঠিক করছি। মেয়েটা অনেক ভালো।’
‘মেহেদী ভাইয়া জানে?’
‘না কিন্তু আমি জানি ওকে বললে ও মানা করবে না।’
‘ওর কোনো পছন্দ আছে নাকি তুমি জিজ্ঞেস করেছো?’
‘ও যেই নিরামিষ ওর আবার কোনো পছন্দ।’
‘তাও….

‘আচ্ছা এইসব বাদ দে আগে বল শাড়িটা কেমন।’
আমি জোরপূর্বক হেসে বলি,’হেহে,সুন্দরই আছে।’
আম্মু শাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে,’হুম। বউমাকে পড়লে বেশ মানাবে।’
আম্মু চলে যাওয়ার পর আমি বিছানায় বসে ফোন হাত নিয়ে এফবিতে ঢুকলাম। এফবি ঘাটাতে ঘাটাতে হঠাৎই নিশার আইডিতে চোখ আটকিয়ে যায়। আমি এতো কিছু না ভেবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়ে ফোনটা রেখে দেই।
বিকালে শপিং এর জন্য বের হই আমি। এক মাত্র ভাইয়ের বিয়ে শপিং না করলে কি ভালো দেখায়।হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই কারো সাথে ধাক্কা লেগে পরে যেতে নেই তখনই দুই জোড়া হাত এসে শক্ত করে আমার কোমড় আকড়ে ধরে। আমি নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। লোকটার দিকে তাকাতেই ঝটকা খাই কারণ এটা আর কেউ না মাননীয় সাদ আনান রোদ স্যার। আমি তাকে দেখে আমতা আমতা বলে বলি,’আ-প-নি?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তিনি নিজের কোট ঝারতে ঝারতে বলেন,’এতো তোতলাচ্ছো কেনো?’
‘কো-থা-য়?’
রোদ স্যার আমার দিকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে চলে যান। আমিও উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা ভেংচি কেটে নিজের মতো শপিং করতে থাকি। শপিং শেষে আমি বাসায় এসে দেখে আম্মু সোফায় বসে কাঁদছে আর সাথে একটা মেয়ে আম্মুকে শান্তনা দিচ্ছে। আমি দ্রুত আম্মুর কাছে যেয়ে বলি,’আম্মু কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেনো?’
মেয়েটার সাথে একটা ছেলেও ছিলো। ছেলেটা আমাকে বলল,’মেহেক ফুপির কিছু হয়নি।’
আমি ছেলেটার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে বলি,’ফুপি?’
ছেলেটা বলে,’তুমি হয়তো কিছু জানো না আমি বলছি।’

ছেলেটা বলতে শুরু করলো,’ফুপি আর ফুপা লাভ ম্যারেজ কিন্তু উনাদের প্রেম কোনো পরিবারই মেনে নেয়নি তাই উনারা পালিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসেন দাদা আর দাদি তাও তাদের মেনে নেয়নি। আমরা অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু দাদা করতে দেন।কাল রাতে দাদা হার্ট এট্যাক করেছেন আর উনি ফুপির সাথে দেখা করতে চান। তাই আমরা এইখানে এসেছি।’
সব শুনে আমি এক প্রকার তব্দা লেগে যাই। আম্মু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি আম্মুকে ভরসা দিয়ে বলি,’চিন্তা করো না আম্মু আমরা এখনি যাবো কিশোরগঞ্জ। মেহেদী ভাইকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি।’

আমার ভরসা পেয়ে আম্মু একটু সাহস পেলো। আমি মেহেদী ভাইকে ফোন দিয়ে সব বলি। সব শুনে সে বলে সে আসছে আব্বুকে নিয়ে। আমি আম্মুর কাছে যেয়ে বলি,’আম্মু ভাইয়া আসছে ততক্ষনে আমি জামা কাপড় গুছাতে থাকি।’
আম্মুকে এতক্ষন ধরে যেই মেয়ে শান্তনা দিচ্ছিলো সে বলে,’মেহেক আমিও হেল্প করি তোমার চলো।’
আমি কিছু না বলে আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,’চলুন।’
আমি আর মেয়েটা আমার রুমে এসে কাপড় গুছাতে থাকি।আমি মেয়েটার উদ্দেশ্যে বলি,’আপনার নাম কি?’
মেয়েটা হেসে বলে,’মাইশা।’
‘ওহ তুমি আম্মুর কি হও?’
‘ভাতিজি।’

ব্যাগ গুছানো শেষে আমরা রুম থেকে বেরিয়ে পরি। দেখি আব্বু আর ভাইয়া এসে পড়েছে। আমরা দুইজন সামনে যাই তাদের। আমি ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ভাইয়া বলে,’ব্যাগ গুছিয়েছিস? এখনি বের হবো আমরা।’
আমি শুধু ‘হুম’ বলি। কিছুক্ষন পর আমরা সবাই বের হলার কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। প্রায় আট ঘন্টা জার্নির পর আমরা কিশোরগঞ্জ পৌছালাম। আমি গাড়ি থেকে বের হই। বাড়িটা দেখে আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভাইয়া গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলে,’কি হয়েছে হা করে আছিস কেনো।’
ভাইয়ার এই কথা বলতে দেরি কিন্তু হা হতে দেরি নেই। আমি শয়তানি হেসে বললাম,’হা করে রেখেছিস কেনো?মশা ঢুকে যাবে তো।’
আমার কথা শুনে ভাইয়া মুখ বন্ধ করে নিলো।

‘এরে মেহু এইটা কি বাড়ি নাকি রাজ প্রাসাদ।’
‘রাজ প্রাসাদ থেকে কম না।’
আম্মু গাড়ি থেকে বেরিয়ে বলে,’এই তোরা এইখানে কেনো দাঁড়িয়ে আছিস?’
আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলি,’আমরা চিনি না তো তাই তোমার অপেক্ষা করছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা চল তাহলে।’

আমরা দুইজন আম্মুর পিছনে চলা শুরু করলাম। আব্বু মাহিম ভাইয়ের সাথে পিছন পিছন আসছে। ভিতরে ঢুকে আমি আর মেহেদী ভাই আরো অবাক হলার কারণ বাহির থেকে এই বাড়ি যতটা বড় তার থেকেও ভিতর থেকে বেশি বড়। আম্মু ভিতরে ঢুকতেই আম্মুর মত হুবুহু কেউ একজন এসে আম্মুকে ঝাপ্টে ধরে। আমি আর মেহেদী ভাই এতে অনেক অবাক হই। পরে জানতে পারি উনি আমাদের আম্মুর জমজ বোন। আম্মুর জমজ বোন আম্মুকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে,’বোন আব্বু আর এই পৃথিবীতে নেই।’
আম্মু কথাটা শুনে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আম্মুকে একটা রুমে শোয়ানো হয়। নানার দাফনের পর আম্মুর জ্ঞান ফিরে। সে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমার জন্য আব্বু চলে গিয়েছে তাই না আম্মু?
নানু তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’না তো।’

আমি আর ভাইয়া বসে বসে উনাদের কথোপকথন দেখছি। কিছুক্ষন পর নানু আমাদের কাছে এসে বলে,’কেমন আছিস তোরা?’
আমি বলি,’আলহামদুল্লিল্লাহ ভালো আছি আপনি কেমন আছেন নানু?’
‘আমিও ভালো আছি তোমার নামটা জানি কি?’
‘মেহেক।’
‘আচ্ছা।’
আসার পর থেকে মামার দেখা মিলে নাই হয়তো উনি আমাদের সামনে আসছেন না। মামি আমাদের কাছেই ছিলো সবসময়।
এই একটা সপ্তাহ আমরা কিশোরগঞ্জেই ছিলাম। আজ আমরা ঢাকা ফিরছি। এই এক সপ্তাহ আম্মুকে আমি,ভাই,আব্বু অনেক কষ্টে সামলিয়েছি। ঢাকা ফিরতে রাত হয়ে যায় আমাদের। বাসায় এসে আমি নিজের রুমে চলে যাই। ওয়াশরুমে যেয়ে সোজা শাওয়ার নিয়ে বের হই। অনেক ধকল গিয়েছে এই দুইদিন তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে যাই।

সকালে ফোনের এলার্মে ঘুম ভাঙে আমার। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে যাই সবার জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে। কোনো রকম খাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে সবাইকে ডাকতে যাই যার যার রুমে। আব্বু আম্মুকে ডাকতে মানা করেছে তাই আর আমিও ডাকিনি। আমি ভাইয়া,আব্বু ব্রেকফাস্ট সেরে নেই। আব্বুকে অফিসের জন্য বিদায় দিয়ে আমি মেডিক্যালের জন্য রেডি হই। আজ মেহেদী ভাইয়া অফিসে যাবে না তাই সে বলেছে আমাকে মেডিক্যালে পৌছে দিবে। আমিও নাকচ করিনি। ভাইয়া আমাকে মেডিক্যালে পৌছে দিয়ে বাসায় চলে যায়। আমি নিজের ক্লাসে যেয়ে সিটে বসি। কিছুক্ষন পর নিশা এসে আমার পাশে বসে বলে,’মেহু তুমি এই কয়েকদিন কোথায় ছিলা?’

আমি বলি,’নানু বাড়ি ছিলাম নানা মারা গিয়েছিলো তাই।’
নিশা বলে ‘ওহ’। আমি কিছু বলি না। কিছুক্ষন পর রোদ স্যার ক্লাসে আসে। সবাই তাকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। তিনি আমার উদ্দেশ্যে বলে,’মেহেক এই কয়েকদিন আসোনি কেনো?’
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিশা বলে,’আসলে রোদ ওর নানা মারা গিয়েছিলো তাই ও ওর নানা বাড়ি ছিলো।’
রোদ স্যার নিশার দিকে বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে বলে,’কল মি স্যার এন্ড আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি মিস নিশা যাকে জিজ্ঞেস করেছি সে উত্তর দিলে খুশি হতাম,সিট ডাউন।’

নিশা মুখ কালো করে বসে পড়লো। আমিও বসলাম ওর সাথে। ব্রেক টাইমে আমি আর নিশা ক্যান্টিনে যাই। আমরা দুইটো চেয়ার টেনে বসে পরি। নিশা নুডুলস অর্ডার দেয় সাথে আমিও। ব্রেকটাইম শেষে আমরা আবার ক্লাসে চলে যাই। ক্লাস শেষে আমরা যে যার মতো চলে যেতে থাকি। আমি রিকশা পাচ্ছিলাম না তাই হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎই আমার সামনে কিছু বাইক এসে থামলো বাইক থেকে শপিং মলের ছেলের সাথে আরো কিছু ছেলে ছিলো। আমি তাদের দেখে ঘাবড়ে যাই। শপিং মলের ছেলেটা আমাকে দেখে শয়তানি হেসে বলে,’ওইদিন চড় দিয়েছিলি তাই না?আজকে সব শোধ তুলবো।’
এই বলে এগিয়ে আসতে থাকে। আমি পিছাতে পিছাতে তাদের বলি,’দেখুন ভাইয়া আমার কাছে আসবেন না তাহলে কিন্তু খ-খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

কে শুনে কার কথা তারা আস্তে আস্তে আমার কাছে এগিয়ে আসছে। আমি পিছাতে পিছাতে কারো সাথে ধাক্কা খাই। আমি ভয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলি। অজানা ব্যক্তিও আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষন পর অজানা ব্যক্তিটা আমাকে বলে,’ওরা চলে গেছে চোখ খোলো।’
পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে আমি চোখ খুলে দেখি এটা আর কেউ না রোদ স্যার। আমি দ্রুত তার কাছ থেকে সরে নিজের ওড়না ঠিক করে নেই। তারপর তার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলি,’স্যা-র আ-প-নি?’
‘হুম আমি।’
‘আপনি এইখানে?’

‘আমি যদি না আসতাম তাহলে কি হতো ভাবতে পারো তুমি?আবার বলো আপনি এইখানে অনেক তো সাহসী সাহসী দেখাও বাহির থেকে ভিতর দিক দিয়ে যে ভিতুর ডিম সেটা কে জানে’
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই রোদ স্যার এসে আমার হাত ধরে বলে,’চুপ আরেকটা কথাও শুনতে চাই না আমি। আমি তোমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবো চলো আমার সাথে।’
আমি তার থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে বলি,’,কথায় কথায় হাত ধরবেন না।’
আমার কথা শুনে উনি তাচ্ছিল্যর হেসে বলেন,’ওহ রিয়েলি!ভুলে যেও না আমাদের বিয়ে হয়েছে সেটা যেইভাবেই হোক না কেনো। আর আইনিগত ভাবে না থাকলেও ইসলামিক ভাবে আমার তোমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে।’
তার কথা শুনে আমি তব্দা লেগে যাই। কি বলবোই বা আমি? সবই তো সত্যি। তিনি আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলেন,’হয়েছে এখন চলো।’

আমি আর কিছু না বলে গাড়ির পিছের সিটে বসতে নিলে রোদ স্যার বলেন,’আমি তোমার ড্রাইভার না ওকে?তাই ফ্রন্ট সিটে বসো।’
আমি আর কিছু না বলে ফ্রন্ট সিটে যেয়ে বসে পড়লাম। তিনিও বসে বললেন,’বাসার এড্রেস বলো।’
‘জ্বী?’
তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন,’বাসার এড্রেস না বললে আমি তোমাকে তোমার বাসায় কিভাবে নিয়ে যাবো?’

আমি তাকে বাসার এড্রেস বললাম। সে আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে চলে গেলেন। আমি বাসায় ঢুকে রুমে চলে গেলাম। রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর আম্মুর রুমে চলে গেলাম। আম্মু ঘুমিয়ে আছে। আম্মুর পাশে বসে, আম্মুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলাম। হাতটা ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। মুখটা ফেকাসে হয়ে গেছে। আমি আম্মুর কপালে একটা চুমু দেই। হঠাৎই আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি আম্মুর পালস চেক করলাম। মন হাহাকার করছে। তোলপাড় চলছে মনে। সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা যখন হারিয়ে ফেলি তখনই এরকমটা হয়। আমি হঠাৎই চিৎকার করে ‘আম্মু’ বলে উঠি। তারমানে আম্মু কি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে?চলে গেছে আমাকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য। আমি কি করবো কিছু বুঝতেছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কখনো ভাবেনি আমি।

একদিকে মাকে হারানোর ভয় হানা দেয় আরেকদিকে বাসায়া আমি আর আম্মু ছাড়া কেউ নেই। মেহেদী ভাইয়া একটু কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে।

সাদা কাফনে মুড়ানো লাশকে জড়িয়ে ধরে লাশটির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। এই লাশটা আর কারো না আম্মুর!!যে কিনা আজ সকাল অব্দি বেঁচে ছিলো!ডক্টর বলেছেন আম্মু ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করেছেন। আমার চোখ ফুলে গেছে। আমি আর মায়ের লাশ দেখতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পরে যেতে নেই তার আগেই রোদ স্যার আমাকে ধরে নেন। কোনো দিক বিবেচনা না করে তিনি আমাকে পাঁজকোল তুলে রুমে নিয়ে যেয়ে শুয়ে দেন। নিশা রোদ স্যারের পিছে পিছে রুমে ঢুকে। রোদ স্যারের উদ্দেশ্যে বলে,’ওর কি হয়েছে?’
‘ও মা হারানোর ধাক্কাটা সামলাতে পারিনি তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে।’
‘ওর উপর এটার ইফেক্ট খুব খারাপ ভাবে পড়েছে।’
‘হুম’
এই বলে তিনি আমার মুখের দিকে তাকান। কয়েক ঘন্টার তফাৎে মুখ ফেকাসে হয়ে গিয়েছে।
ফ্ল্যাশব্যাক-

আমাদের বাসার কাছেই আমার মেডিক্যাল থাকার কারণে আম্মুকে আমি ওইখানে কিছু প্রতিবেশির সাহায্যে নিয়ে যাই। আমি চেঁচাতে চেঁচাতে ডক্টর কে ডাক দেই। তখন ভাগ্যবশত রোদ স্যার কাজের জন্য হস্পিটালে এসেছিলেন আমাকে এইভাবে চিল্লাতে দেখে আমার কাছে এসে বলে,’কি হয়েছে মেহেক চিল্লাচ্ছো কেনো?’
আমি কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলি,’রোদ স্যার আমার আম্মুকে বাঁচান প্লিজ।’
আমার কান্না দেখে রোদ স্যার আতকে উঠেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে বলেন,’কি হয়েছে তোমার আম্মুর?’
রোদ স্যার কয়েকটা নার্সকে ডেকে বলেন আম্মুকে আইসিইউ তে নিয়ে যেতে। আম্মুকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার পর আমি হস্পিটালের ল্যান্ড লাইন দিয়ে আব্বু আর ভাইয়াকে হস্পিটালে আসতে বলি। তারা আসার পর রোদ স্যার গোমড় মুখ নিয়ে বেরিয়ে বলেন,’শি ইজ নো মোর।’

উনার কথা শুনে আমার সারা পৃথিবী থমকে গিয়েছে। থমাকাবেই না কেনো আমার পৃথিবীই তো চলে গেছে আমাকে ছেড়ে সেই দূর আকাশে না ফেরার দেশে। আমি আর কাউকে ‘আম্মু’ ‘ও আম্মু’ বলে ডাকতে পারবো না। ডাকলেও সাড়া দেওয়ার জন্য মানুষটাই তো নেই। আমি উঠে দাঁড়িয়ে রোদ স্যারের কলার চেপে ধরে বলি,’মিথ্যা বলছেন কেনো স্যার আপনি? আপনি ডাক্তার হয়ে মিথ্যা বলছেন?’
কথা গুলো বলতে বলতে আমি কেঁদে দেই। মেহেদী ভাই আর আব্বু চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে তারাও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবশেষে সাদা কাফনের কাপড়ে মুড়ানো আম্মুকে আনা হলো। এইটাই আম্মুর সাথে লাস্ট দেখা আর কখনো দেখা হবে না আমার তার সাথে।
বর্তমান-
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসি আমি। ফজরের আজানের ধ্বনি কানে আসছে। আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারি এটা একটা বাজে স্বপ্ন। আমি পাশে থাকা জগ নিয়ে ঢক ঢক করে সব পানি খেয়ে শেষ করে ফেলি। তারপর ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে নেই।

চারদিকে আবছা আলো। আমি কিচেনে যেয়ে এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে পরিবেশ উপভোগ করছি। ঘড়ির কাটায় সাতটা বাজতেই আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নিলাম সবার জন্য। হঠাৎই মা উঠে এসে বলে,’কিরে মেহু কিচেনে কি করছিস?’
আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,’ব্রেকফাস্ট বানাতে।’
আমার কথা শুনে আম্মু অনেক অবাক হয় সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আম্মু আমার কাছে এসে গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,’আমি কি স্বপ্ন দেখছি?তুই নাস্তা বানাচ্ছিস?’
আমি হেসে বলি,’এটা বাস্তব।’
আম্মু আর কিছু না বলে খাবার গুলো নিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দেয়। আব্বু আর ভাইয়াও এসে ব্রেকফাস্ট করে চলে যায়। আমিও মেডিক্যাল যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে যাই। দেখি আম্মু টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। আমি আম্মুর কাছে যেয়ে বলি,’আম্মু আমি যাই তাহলে’

আম্মু টিভি দেখতে দেখতে বলে,’হুম যা।’
আমিও মেডিক্যালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। মেডিক্যালে পৌছে হাঁটতে হাঁটতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যাই। আমি রাগে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের ব্যক্তিকে বলি,’এই চোখে দেখেন না কানা নাকি?’
সামনের ব্যক্তিটা ভ্রুকুচকে বলে,’সরি খেয়াল করিনি।’
‘খেয়াল করেননি নাকি ইচ্ছা করে ধাক্কা দিয়েছেন।’
‘এক্সকিউজ মি আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন।’
‘কি ভুল ভাবছি হ্যা?’
এই বলে রাগে চলে আসলাম। আমি ক্লাসে ঢুকে দেখলাম ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। রোদ স্যার আমাকে বলে,’তা মিস ওপস সরি মিসেস মেহেক মেডিক্যাল কি আপনার বাসা।’
‘না এটা বাসা কেনো হবে?’
‘তাহলে যখন খুশি আসেন কেনো?’
‘আসলে…

আমার পুরা কথা শেষ না করতে দিয়েই রোদ স্যার আমাকে এক ধমক দিয়ে সিটে বসতে বলেন। আমি মুখ ফুলিয়ে সিটে বসলাম। এইভাবে অপমান না করলেও পারতো। খবিশ ব্যাটা হুহ!!নিশা আমাকে ফিসফিস করে বলে,’আচ্ছা তোমাকে রোদ মিসেস কেনো বলেছে?’
নিশার কথা শুনে আমি চমকে উঠি। আমি আমতা আমতে করে বলি,’ক-কি জা-নি’
আমার কথা শুনে নিশা ভ্রুকুচকে বলে,’আমতা আমতা করছো কেনো?’
আমি কথা ঘুরিয়ে বলি,’ক্লাস করো।’
নিশাও আর কিছু না বলে ক্লাস করে। কয়েকটা ক্লাস শেষে আমি বাসায় চলে আসি। কোত্থেকে আমার কাজিন দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’এই মেহুউউ।’
‘রোথি তুই?’

অতঃপর প্রেম পর্ব ১+২+৩

‘হ্যা আমি কেমন দিলাম সার্প্রাইজ।’
‘সত্যিই আমি অনেক অবাক হয়েছি। তা ফুপিমা আর তোর ওই ইঁচড়েপোকা ভাই এসেছে?’
‘না ভাইয়া আসেনি কিন্তু আম্মু এসেছে। মামির রুমে আছে।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে আমি ফ্রেশ আসছি তারপর একসাথে যাই নিচে।’
‘হুম জলদি যা।’
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে আম্মুর রুমে যাই।আমি ফুপিকে দেখে দৌড়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলি,’কেমন আছো ফুপিমা।’
ফুপিমাও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’অনেক ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
‘আমিও অনেক ভালো আছি।’
ফুপিমা আমাকে ছেড়ে বলল,’শুনলাম মেডিক্যালে চান্স পেয়েছিস?’
‘হ্যা।’

‘আমাকে একটু খবরও দিলি না।’ (মুখ ফুলিয়ে।)
আমি হেসে ফুপিমাকে বললাম,’খুশিতে মনে ছিলো না।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে। আমি তোর জন্য রসমালাই নিয়ে এসেছি।’
আমি খুশিতে লাফ দিয়ে বলি,’সত্যিই ফুপিমা?’
ফুপিমা হেসে বলেন,’হুম।’
‘তুমি বেস্ট ফুপিমা।’
ফুপিমা একটা ভেংচি কেটে বলে,’হইছে এতো মিথ্যা বলতে হবে না আপনার এখন যান খান গিয়ে।’
আমি দাঁত কেলিয়ে চলে গেলাম রসমালাই খেতে। রসমালাই আমি অনেক ফেবারেট….

অতঃপর প্রেম পর্ব ৭+৮+৯