অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৭

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৭
তাশরিন মোহেরা

বিরসমুখে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির হলাম আমি। কিছুক্ষণ আগে মা-ছেলের কথোপকথন আমায় ভীষণ ভাবাচ্ছে। রূপন্তীর দিকে আড়চোখে একবার দেখলাম। কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে সে। যাওয়ার জন্য সেও একদম প্রস্তুত। মুগ্ধ এর মাঝে বলে উঠে,

‘আপনারা একটু দাঁড়ান। আমি ভাইয়াকে ডেকে আসি।’
পরপরই সে মুখরকে ভেতরের রুম হতে ডেকে আনলো। তবে মুখরকে দেখে বোঝার উপায় নেই খানিকক্ষণ আগে সে হাজার দুঃখে জর্জরিত ছিলো। ছেলেটা এতো ভালো অভিনয় কিভাবে পারে? তবে মুখরকে একটু ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম ছেলেটার চোখে এখনো দুঃখ ঝরছে। মানুষ যতই অভিনয় করুক, যতই নিজেকে মিথ্যা হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলুক, নিজের চোখ কখনো মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে পারে না!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুখর রূপন্তীকে বললো,
‘গাড়ি কি চলে এসেছে তোমার জন্য?’
‘হ্যাঁ, এখনই এসে পড়বে। এইতো এসে গেছে!’
রূপন্তী ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো। মুখর বলে,
‘আচ্ছা চলো, তোমাকে এগিয়ে দেই।’
পরক্ষণেই আমার দিকে ফিরে বলে,
‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, মিস.তিথিয়া!’

আমার ইহজগতের কিছুতেই যেন খেয়াল নেই। মাথায় গুঁজে থাকা একগুচ্ছ ভাবনা সবটা এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার। আমি ভাবনায় বুদ হয়ে মাথা দুলালাম শুধু।
মুখর এসে আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমি একবার ক্ষীণ স্বরে বললাম,
‘আমি একা-ই যেতে পারবো, মুখর সাহেব।’
মুখর প্রত্যুত্তরে বলে,

‘কতক্ষণই বা লাগবে? আর এই সন্ধ্যেবেলা আপনাকে একা যেতে দেওয়াটা কি ঠিক হবে, বলুন?’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মন মেজাজ একদমই ঠিক নেই! যতই চিন্তা করি পাশের মানুষটাকে কষ্ট দেবো না ততই যেন তার উপর দায়িত্ব আরো বেশি পরিমাণে ফেলে দেই। ছেলেটা বাবার শোকটাও ঠিক মতোন পালন করতে পারলো না!

সন্ধ্যের আলোতে চারপাশ একটু অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। খোলা রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে আমার। আজ সেদিনের মতো অস্বস্তি কাজ করছে না। হালকা হিমেল হাওয়ায় মন প্রাণ ছুঁয়ে যাচ্ছে ভালোলাগায়।
মুখর পকেটে দু’হাত গুঁজে সামনে এগোচ্ছে। তার দৃষ্টি সামনেই নিবদ্ধ। আর আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ তার দিকেই। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমি নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,

‘মুখর সাহেব, আপনার এই কঠিন ব্যক্তিত্বের পেছনে কোনো দুঃখজনক কাহিনী নেই?’
মুখরকে যেচে দেখলাম সে আমায় তার দুঃখের কাহিনী বলে কিনা! তবে মুখর মুখরই! যত কিছুই হোক, নিজের শক্ত খোলস এতো সহজে সে খুলছে না। সে যথারীতি বললো,
‘আছে! সবার জীবনেই দুঃখজনক কিছু না কিছু আছে।’

চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কথা শুনলাম। কিছু সময় নীরবতা পালন করে মুখর আমায় অবাক করে দিয়ে মুখ খুললো,
‘জানেন, মিস.তিথিয়া? আমার মন খোলা আকাশের মতো স্বচ্ছ নয়, বরং এই মন জালের মতো কঠিন, হযবরল! মাঝে মাঝে নিজের মনকেই আমি যেন বুঝে উঠতে পারি না।’
মুখে একটা মলিন হাসি এঁটে আমাকে দেখলো মুখর। হঠাৎই বুক ভেঙে কান্না এলো আমার। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমার! ছেলেটাকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, মুখর সাহেব।’

কিন্তু এমনটা করার সাধ্যি নেই আমার। জানি না কখনো সাধ্যি হবে কিনা! কেননা আমার ভালোবাসাটা অনিশ্চিত! কাউকে পাবো না ভেবেও তার প্রতি টান অনুভব করাটাই বোধহয় ভালোবাসার প্রকৃত সত্য!
একটা পার্কের কাছাকাছি এসেছি আমরা। কিছুদূর হেঁটে গেলেই আমার বাসা। আমি অনুরোধের সুরে মুখরকে বললাম,
‘আপনি এবার ফিরে যান, মুখর সাহেব। এটুকু পথ আমি নিজেই যেতে পারবো।’

ক্ষীণ সুরে বললো মুখর,
‘খোলা হাওয়ায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। তাছাড়া আপনার বাসার গলি পর্যন্ত না হয় আপনাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম। সমস্যা তো নেই, তাই না?’
ব্যাগটা হালকা তুলে বললাম,
‘তা তো নেই।’

তবে আমি জানতাম না আমার জন্য ভবিষ্যতে এতোবড় একটা সমস্যা অপেক্ষা করছে। হাঁটার মাঝপথে আজ আবারো আব্বাকে চোখে পড়লো আমার। ভ্রুটা কুঁচকে ভালোভাবে দেখলাম। আব্বা আমার দু’হাট মুট করে পেছনের দিকে নিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি উপায় না পেয়ে আবারো মুখরকে টান মেরে বসিয়ে দিলাম। তবে আজ তার হাত নয় বরং তার কলার ধরে টান মেরেছি আমি। কলারের টান খাওয়ায় বেচারা ভীষণ চমকে উঠলো। একটা গাছের কোণায় মুখরকে নিয়ে বসে পড়লাম। মুখটা বিকৃত করে বলে উঠলাম,

‘খোদা, বারবার আমার সাথেই কেন এসব হয়?’
কিছুক্ষণ যেতেই খেয়াল করলাম আমি আর মুখর মুখোমুখি বসে আছি তবে খুব কাছে। আমার মাথা তার বুক ছুঁইছে। মুহুর্তেই লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমার। মুখর বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘মিস.তিথিয়া? আমরা হঠাৎ এভাবে বসে পড়লাম কেন?’
আমি তার ঠোঁটে তর্জনী চেপে বলে উঠলাম,
‘চুপ! কোনো কথা বলবেন না এখন।’

ফিসফিসিয়ে ধমকালাম আমি। মুখর এই ধমকে নিঃশব্দ হয়ে গেল। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পাঠ করছি। আর দোয়া করছি আব্বা যাতে এদিকটায় না আসে! আমায় বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে দেখে মুখর ঠোঁট টিপে হাসছে। আমার খুব রাগ হলো। একে তো আমি জীবন-মরণ অবস্থায় আছি, আর লোকটা হাসছে?
‘কিরে? তিথি মা না?’

এ কথায় দুজনেই শিউরে উঠলাম। গাছের অপর পাশে কিছুদূরেই দাঁড়িয়ে আছেন আব্বা। ভয়ে আঁতকে দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। এদিকটা সামান্য অন্ধকার, কিন্তু আব্বা কিভাবে টের পেল আমাকে? আমি তৎক্ষণাৎ সাতপাঁচ না ভেবে মুখরকে ধাক্কা মেরে চট করে উঠে দাঁড়াই। আব্বা যখন আমায় চিনেই ফেলেছে তাই এখন লুকিয়ে আর লাভ নেই! আব্বার দিকে ফিরে অপ্রস্তুত হাসলাম আমি। আব্বা আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘আরে, তিথি-ই তো! কিরে মা, এখানে কি করছিস?’
আব্বাকে দেখে পুরো হাত-পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। কি করবো, কি বলবো কিছুই বুঝে উঠছি না। আমতা আমতা করে কোনোরকমে বললাম,
‘আব্বা আমার ফোনটা এদিকে পড়ে গিয়েছিলো তাই এটাই নিচ্ছিলাম আরকি! হাহা।’
আব্বাও বুঝতে পারার মতো ভান করে বললো,
‘আচ্ছা, আচ্ছা!’

আমি পেছন ফিরে একবার দেখলাম। কিন্তু অন্ধকারে মুখর সাহেবকে ঠিক বোঝা গেল না। আব্বা সামনের দিকে এগিয়ে বললো,
‘চল তাহলে একসাথে যাই।’
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পেছন ফিরে বারবার দেখছি। মুখর সাহেবকে ধাক্কা মেরে তাকে ছাড়া যেতেও মন সায় দিলো না। পা টা অবশ হয়ে এসেছে আমার। আব্বা আবার আমার দিকে ফিরে বললো,
‘কি হলো চল!’

অগত্যা আব্বার পিছু পিছু চলে গেলাম। লোকটাকে কাল সকালবেলা গিয়েই সরি বলতে হবে! একটা সরিতে কি হবে তার? আচ্ছা, সাথে একটা চকলেটও নিয়ে যাবো প্রয়োজন হলে।
মুখরের কথা ভাবতেই দেখি ফোনে ভাইব্রেট হলো। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে। মেসেজ দেওয়া ব্যক্তিটি মুখর। সে লিখেছে,

‘আব্বার ভয়ে যে এমন এক ধাক্কা দিলেন, ঠোঁটের একপাশ থেকে রক্ত পড়ছে।’
মুখর সাহেব রক্তাক্ত হয়েছে শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম আমি। ধাক্কাটা একটু জোরেই দিয়ে দিয়েছি বোধহয়। হায় হায়! কি হবে এখন?

আমি ঘাবড়ে প্রশ্ন ছুড়লাম,
‘মুখর সাহেব, আপনি বাঁচবেন তো?’
ওপাশ থেকে এবার মেসেজ এলো,
‘জানিনা, তবে আপাতত আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
মেসেজ দেখে আপনাআপনি হেসে দিলাম। লোকটা এই অবস্থায়ও মজা করছে! অপর পাশ থেকে আবারো মেসেজ এলো,
‘আমার এই ক্ষতের জন্য কিন্তু আপনার জরিমানা দিতে হবে!’

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
‘জরিমানা? কিন্তু কেন?’
‘কেন আবার? এই যে বিনা কারণে আমায় আহত করলেন!’
‘তা জরিমানা হিসেবে কি দিতে হবে?’
‘তা তো কাল এলেই জানতে পারবেন।’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৬

ছেলেটা তো আস্ত এক বদমাইশ! এভাবে আমায় অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিলো? জরিমানাটা যে কি তা না জানা অবধি কি আমার আজ রাতে ঘুম হবে?

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ১৮